Thursday, July 30, 2015

শিক্ষকের বেতন কত হবে?


মোটা দাগে এটা প্রায় সবাই মানে যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। এটা এত কম যে, ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা এমন যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তাদের বেতন অনেকটা হাস্যকর। অনেকেই reluctantly এটাও চায় যে শিক্ষকদের বেতন বাড়ুক, অভাবের তাড়নায় তাদের বিড়ম্বনায় না পড়তে হোক এবং এটা তারা অনেকটা আন্তরিকভাবেই কামনা করে। সবকিছু মানার পর আবার কিছু "যদি-কিন্তু" যোগ করে বলবে চাকুরীর দরখাস্ত করার সময় জানতেন না আপনার বেতন? হ, জানতাম এবং এখনো জানি। যখন চাকুরীর জন্য দরখাস্ত করি তখন বয়স কম ছিল, তখন অবিবাহিত ছিলাম, কোন প্রকার পিছুটান ছিল না এমন কি আমার উপর কেউ নির্ভরশীল ছিল না। ছাত্রবস্থায় শিক্ষকদের দেখেছি মহানায়কের মত। আর যেখানে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় পার করেছি, যেখানে আমার জ্ঞান বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি সেখানে একদিন শিক্ষক হয়ে সারা জীবন ওই ক্যাম্পাসে থাকতে পারার এক বাসনাতো আছেই। এছাড়া এক্সপোজার কম ছিল বলে এক্সপেকটেশন বা চাওয়া-পাওয়াও কম ছিল। একটু বুঝিয়ে বলি। আমি যখন খুব ছোট ক্লাসে ছিলাম তখন মোমবাতি বা হ্যারিকেনের আলোতে পড়াশুনা করেছি। হাত পাখায় বাতাস করে গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর বৈদ্যতিক বাল্বের নিচে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পরি। এরপর প্রতি ছুটিতে বাড়িতে গেলে সাথে করে ব্যাগ ভরে বই নিয়েছি বাড়িতে পড়ব বলে কিন্তু হ্যারিকেনের আলোতে পড়াশুনা আর করতে পারিনি। হাত পাখায় আর চলত না। ঘরে হ্যারিকেনের আলো জালালে কেমন জানি অন্ধকার অন্ধকার লাগত। তারপর বিদেশ যাই উচ্চ শিক্ষার জন্য। ওখানে গিয়ে আরেক দফা পরিবর্তন ঘটে। এবারের পরিবর্তনটা ছিল বড়সর পরিবর্তন। অনেকটা উন্নত জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাই। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুতে। জীবন যাত্রার মানের অভ্যাস অনেকটা entropy-র মত একমুখী reversible না।তাই চাকুরীর জন্য দরখাস্ত করার সময় "আমি" আর এখনকার আমি এক না। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর সুবাদে সবারই কম বেশি এরকম পরিবর্তন ঘটে। আর চাকুরিটাই এরকম সর্বদা শিখতে হয়। আমরা কেউ স্ট্যাটিক না। মানুষ তথা সরকারকে এটা বুঝতে হবে। এখন পরিবর্তন হয়েছে বলে শুধু টাকা এবং প্রাচুর্য্যই সব? এটা সব না। আমাকে কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যদি দ্বিগুন, তিনগুন, চারগুন বেতনও দেয় তারপরও আমি এখানেই থাকব ওখানে যাব না। কারণ ওগুলোকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করি না। যাক ওটা ভিন্ন ইসু। তাই বেতনটা এমন হওয়া উচিত যেন আমার শিক্ষা, এক্সপোজার, জ্ঞান এগুলোর সাথে commensurable হয়।

অনেককেই আবার বলতে শুনি এই স্বল্প বেতন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাবার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক? এসব ক্ষেত্র বোঝার জন্য আমাদের দুটো এক্সট্রিম case চিন্তা করতে হবে। প্রথম case, আমাদের বেতন যদি খুব খুবই কম হয় তখন কি ঘটতে পারে।দ্বিতীয় case, যদি বেতন খুব খুবই বেশি হয় তখন কি ঘটতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের আর যাই হোক শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন যেন না দেখে তার ব্যাবস্থা করবে। তখন শুধু তারাই চাকুরী করবে যারা কোথাও কোন চাকুরী না পাবে যেমন এখন আমাদের প্রাইমারি স্কুলে ঘটে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রত্যেক বাবা মাই তখন স্বপ্ন দেখবে: আহা আমার ছেলে বা মেয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারত। শিক্ষকদের বেতন দিন দিন কমেছে অর্থাত ৪০ থেকে ৫০ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তার বেতন দিয়ে যতটুকু স্বর্ন কিনতে পারতেন এখন তা পারেন না। অন্য দিকে আমরা দিন দিনদিন বর্জুয়া জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষকদের বেতন বাড়ছে না। তার ফলাফল স্বরূপ ক্লাসের সেরা ছাত্ররা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। অর্থাত এখন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করছে তাদের অধিকাংশই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র না। সবচেয়ে ভালোরা বিদেশ চলে যাচ্ছে আর দেশে ফিরে আসছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়াতে হলে বেতনের দিকেতো লক্ষ্য রাখতেই হবে। কেউ কেউতো exceptional বা ব্যাতিক্রমী থাকবেই। ব্যাতিক্রম সব কিছুতেই থাকে।

কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment