Tuesday, September 15, 2015

অষ্টম বেতন কাঠামো ও শিক্ষকদের অবস্থান

অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল
চলমান আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বেতন-ভাতা ও মর্যাদা ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থা তথা উচ্চশিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, সরকারের ভিশন পূরণে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ জাতির অবস্থান সুদৃঢ় করা। এই আন্দোলনকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমি বিস্মিত যে শিক্ষকরা সরকারি সিদ্ধান্ত জানার আগেই আন্দোলনে নেমে যান।' অথচ বাস্তবতা হচ্ছে_ ১৮ জুন ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবিত অষ্টম বেতন কাঠামোতে মর্যাদা ও বেতন-ভাতার অবনমনের আশঙ্কা জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তখন শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক বলে মত প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে নীতিনির্ধারণী মহলে অনেকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান ও প্রতীক কর্মসূচির মাধ্যমে এই বৈষম্যের বিষয়টি তাদের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করেন ফেডারেশন নেতৃবৃন্দ। এমতাবস্থায় শিক্ষকদের আশঙ্কাকে সঠিক প্রমাণপূর্বক তাদের মর্যাদা এবং আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিকে গুরুত্ব না দিয়ে অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো যখন অনুমোদন করা হয়, তখন আমরা বিস্মিত হই। বস্তুত বাজেট পাসের আগে আমরা কোনো মহল থেকে আলোচনার প্রস্তাব পাইনি।
বেতন কমিশন সরকার অনুমোদিত একটি প্রতিনিধিত্বশীল কমিশন। ১৮ সদস্যবিশিষ্ট অষ্টম বেতন কমিশন ১৩ জন অস্থায়ী ও ৫ জন স্থায়ী সদস্য নিয়ে গঠিত, যেখানে শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন ৪ জন। তাদের মাধ্যমে জেনেছি যে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে খণ্ডকালীন 'শিক্ষক' সদস্যদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। কমিশন কর্তৃক প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের পর পুনর্মূল্যায়নের নামে ৫ সদস্যবিশিষ্ট সচিব কমিটি স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে অন্যদের অবমূল্যায়নের কাজটি নিশ্চিত করেছেন। তাই বলা যায়, এই বেতন কাঠামো সচিবদের তৈরি, যেখানে অন্যদের মতামত ও আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। মূলত দুটি সুপার গ্রেডসহ গ্রেড হলো ২২টি, যা অর্থমন্ত্রী প্রায়শ এড়িয়ে যান। 
২২ ধাপবিশিষ্ট এই বেতন কাঠামোতে চতুরতার সঙ্গে শিক্ষকদের ৪ ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যারা সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক আছেন তারা গ্রেড-১-এ সচিবদের সমতুল্য বেতন পাবেন ঠিকই; কিন্তু যারা সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক নন কিংবা নতুনভাবে অধ্যাপক হবেন তাদের পক্ষে গ্রেড-১-এ যাওয়ার আর সুযোগ থাকবে না, যা সপ্তম বেতন কাঠামোতে ছিল। সিলেকশন গ্রেড অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে অধ্যাপকদের গ্রেড-১-এ যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলো। অর্থমন্ত্রী বলেন, অধ্যাপকরা আগের মতো সচিবদের সঙ্গে অবস্থান করছেন, সেই গ্রেডের মাসিক বেতন ৭৮ হাজার টাকা। কিন্তু এটা কি জানাবেন যে, যারা ভবিষ্যতে অধ্যাপক হবেন তারা কীভাবে গ্রেড-১-এর বেতন পাবেন? 
তিনি বলেছেন, 'শিক্ষকদের পদোন্নতির করাপট প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।' বাস্তবতা হলো, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে নূ্যনতম ১০ বছর চাকরি করতে হয়; এই মেয়াদে স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা হতে হবে নূ্যনতম ৭টি এবং সর্বমোট ১৫টি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় কার্যকাল নূ্যনতম ২৫ বছর। পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে উলি্লখিত শর্তপূরণসাপেক্ষে ১২ বছর সক্রিয় কার্যকালের পর অধ্যাপক পদের জন্য দরখাস্ত করা যায়। সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকতার চাকরির বয়স হতে হবে নূ্যনতম ২০ বছর। অধ্যাপক হিসেবে ৫ বছর, সর্বশেষ বেতন স্কেলে এক বছর স্থিতাবস্থায় থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট অধ্যাপকের ২৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেই কেবল এই পদ পাওয়ার যোগ্য হন। মূলত ৬০ বছরের কাছাকাছি বয়সে সব শর্তপূরণসাপেক্ষে একজন অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেডে উন্নীত হন, যা সচিবদের অবসর গ্রহণের বয়সের প্রায় সমান। সুতরাং 'যেভাবে পদোন্নতি পান তা বেশ অস্বচ্ছ'_ মন্ত্রীর এমন বক্তব্য সঠিক নয়। উল্লেখ্য, জনপ্রশাসনে প্রয়োজনের তুলনায় বা অনুমোদিত পদের চেয়ে সুপার নিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদ্ধতির মাধ্যমে অধিকসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন অধিদপ্তর ও সংস্থায় প্রেষণে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে উপসচিবের ৮৩০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১,২৯৪ জন, যুগ্ম সচিবের ৩৫০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৯১৭ জন, অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত ১২০টি পদের বিপরীতে আছেন ৪২৯ জন এবং সচিবের ৬০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে আছেন ৭২ জন। এভাবে শুধু প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে প্রশাসনের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অথচ মন্ত্রী এ বিষয়ে নিশ্চুপ।
মন্ত্রী বলেছেন, 'সচরাচর যে পিরামিড ক্যারিয়ার সার্ভিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তা তেমন নয়; এখানে নিম্ন শ্রেণীর পদের তুলনায় উচ্চ শ্রেণীর পদ খুব বেশি।' বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমোশন হয় উচ্চতর ডিগ্রি ও গবেষণাকর্মের ভিত্তিতে; বয়সের ভিত্তিতে নয়। এখানে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের ক্রমধারায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে প্রভাষক থেকে শুরু করে অধ্যাপক পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ নেই। সচিবালয়ে পদোন্নতির জন্য নিম্নপদস্থ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ পর্যন্ত যেভাবে ফাইল চালাচালি হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সুযোগ নেই। একটি মন্ত্রণালয়ে একজন সচিব থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগে একাধিক অধ্যাপক থাকতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে সচিবালয় বানানো যাবে না। এখানে বসিংয়ের স্থান নেই, সিনিয়র ও জুনিয়র স্কলারের স্থান এটি। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানসৃষ্টি ও বিতরণের পাদপীঠ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের মতো পিরামিড হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মন্ত্রীর ব্যাখ্যানুযায়ী শিক্ষকদের স্তরবিন্যাসে পিরামিড আকৃতি রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় যত পুরাতন, অধ্যাপকের সংখ্যাও তত বেশি। বাংলাদেশে নতুন ও পুরাতন এবং ভারতের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরে মন্ত্রীর বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে মোট শিক্ষক ৬৫ জন; অধ্যাপক একজন, সহকারী অধ্যাপক ৮ জন এবং অন্যরা প্রভাষক। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ১৫২ জন; অধ্যাপক দু'জন, সহযোগী অধ্যাপক ১২ জন, সহকারী অধ্যাপক ৭৪ জন, প্রভাষক ৬৪ জন। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ১১২ জন; অধ্যাপক একজন, সহযোগী অধ্যাপক ৯ জন, সহকারী অধ্যাপক ৪৪ জন, প্রভাষক ৫৮ জন। এ হলো নতুন গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র_ যেখানে পিরামিড আকৃতি রয়েছে। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন ১২টি বিভাগে শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন, ছাত্র ৮৭৭ জন, যা উলি্লখিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ১৯৭০ জন; অধ্যাপক ৬৮৯ জন, মোট শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপকের হার ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশের পুরাতন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও প্রায় অনুরূপ। ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের তুলনায় অধ্যাপক ৪৭ শতাংশ। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের হার ৪৮ শতাংশ। ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের হার ৪৮ শতাংশ। উলি্লখিত তথ্যাবলির আলোকে দেখা যায়, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপকদের সংখ্যা মোট শিক্ষকের প্রায় ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় বাংলাদেশে অধ্যাপকের হার অনেক কম। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পিরামিড আকৃতি নেই। তাহলে মাননীয় মন্ত্রী কি বলবেন যে, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুপার করাপট প্র্যাকটিস করছে? 
আমরা জেনেছি, বেতনবৈষম্য নিরসনের জন্য যে কমিটি রয়েছে তার প্রধান মাননীয় অর্থমন্ত্রী। আমরা বলতে চাই, ইতিমধ্যেই যিনি শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন এবং শিক্ষকদের ব্যাপারে অসম্মানজনক বক্তব্য রেখে নিজেকে বিতর্কিত করেছেন, তার নেতৃত্বাধীন কোনো কমিটি শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আলাপ-আলোচনার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবসহ বাস্তব ও গঠনমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করুন_ যেখানে শিক্ষকরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। আমাদের উদ্দেশ্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। এ লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে একটি কমিশন গঠনেরও দাবি জানাচ্ছি। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে শিক্ষকদের মর্যাদা, বেতনভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পুনঃমূল্যায়নের দাবিও আমরা ব্যক্ত করছি। মূলত উচ্চশিক্ষাকে অবহেলা করে বা শিক্ষাব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে কোনো জাতি তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে উন্নীত হতে পারে না। তাই আমরা দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে অবিলম্বে শিক্ষকদের উত্থাপিত সব দাবি-দাওয়া পূরণের জোর দাবি জানাই। এ ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। 
অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল
মহাসচিব, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
Published in: http://www.samakal.net/2015/09/15/162188

0 comments:

Post a Comment