কুন্তলা চৌধুরী
সারা পৃথিবীতে নীতি, আদর্শ ও সম্মানের মূর্ত প্রতীক হিসেবে শিক্ষকদেরই ধরা হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী এই সমাজে অর্থ ও সম্মান দুই জায়গাতেই অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো দিয়ে শিক্ষকদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে ।
বারবার একটি কথা শিক্ষকরা পরিষ্কার করেই বলেছেন, তাঁদের লড়াই হারানো সম্মান ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায়। যেহেতু অর্থের মানদণ্ডই আজ শিক্ষকদের গ্রেড নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সম্মান নির্ধারণ করে দিচ্ছে; আর সে ক্ষমতার দৌড়ে শিক্ষকরা নিতান্ত নিরীহ জীব বলে পিষে মেরে ফেললেও তাঁরা টুঁ শব্দটিও করবে না, এমনটিই ভেবে বসে আছেন আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা। ঠিক এ সময়ে শিক্ষকদের এ কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট তাঁদের যে অবাক করে দিয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাই রুখে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষকরা।শিক্ষকদের বেতন কম, তাই তাঁদের জীবনযাপনের ধরনও সে রকম। তবে সব দুঃখই চলে যায় যখন শিক্ষকরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াতে ক্লাসে ঢোকেন। তাঁদেরও চোখে-মুখের ভাষা জানান দেয়, তাঁদেরও অনেকের স্বপ্ন আদর্শ শিক্ষক হওয়া। আমার আদর্শ শিক্ষকরা আমার স্বপ্নের কারিগর ছিলেন। কিন্তু সেই আদর্শ শিক্ষকদের মর্যাদা কি আমরা দিতে পারছি? যে দেশের মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে।’
বাহ, কী সুন্দর মন্তব্য! আমার খুব কষ্ট হয়েছিল, মাননীয় অর্থমন্ত্রীর শিক্ষকের জন্য আর ভয় পাচ্ছিলাম পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কী শিখবে তারা, যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চ মহলের একজন ব্যক্তির এ রকম অদ্ভুত বক্তব্যে আমরা মর্মাহত সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষকসমাজ। তিনি নাকি বুঝতেই পারেননি, কোথায় আমাদের অবমাননা করা হয়েছে। তাহলে বলতেই হয়, এটা তাঁর নিতান্তই অজ্ঞতা বা বুঝেও না বোঝার প্রবণতা। কারণ, তাঁর বিবৃতিতে অপমানিত হয়েছে গোটা শিক্ষকসমাজ। আমাদের যেখানে প্রতিটি ধাপে মানসম্মত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ তৈরি করে প্রমোশন পেতে হয়, এমনকি চাকরি স্থায়ী করতে হয়, তিনি সে প্রমোশনের দিকেও আঙুল তুলেছেন। তিনি এত মেধাবী একজন মানুষ, বিশ্বের সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান লাভ করে কীভাবে জ্ঞানগুরুদের এতবড় অপমান করলেন, সেটা কোনোভাবেই বুঝতে পারি না ।
তিনি কি তবে আশা করেছিলেন যে, নিরীহ জীব ভেবে শিক্ষকদের পিষে মেরে ফেললেও তাঁরা ‘উহ’ শব্দটি করবেন না! তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, তাঁর জ্ঞানের উৎস কোথায়?
স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, এতটা অবলা শিক্ষকরা নন। প্রয়োজনে তাঁরা গর্জে উঠতে জানেন। আমাদের বাংলাদেশের জন্মের পেছনেও এই শিক্ষক-সমাজের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন সময়ে কলম ধরে, যুদ্ধ করে শিক্ষকরাই আশা জাগিয়েছেন নতুন করে বাঁচার। হিংসাপরায়ণ নন শিক্ষকরা, তাঁদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই আমলাদের সঙ্গে, তাঁরা হয়তো সঙ্গে দশটা আর্দালি নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চান, সেটা তাঁদের ব্যাপার। আর শিক্ষকরা জ্ঞান বিলিয়ে ভালোবাসা ও সম্মানটুকু পেতে চান। ব্যস এতটুকুই। তবে শিক্ষকদের সম্মানচ্যুত করে কোনো বিজয়ের হাসি তাঁরা হাসতে চান? কোথা থেকে জ্ঞান নিয়ে হয়েছেন তাঁরা আমলা? সব কি তাঁরা ভুলে গেছেন? তাই সময় এসেছে সে সত্য মনে করিয়ে দেওয়ার। শিক্ষকরা চান স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো।
বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চার দফা দাবির কোনোটিই গ্রহণ করা হয়নি, এমনকি দাবি পূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। শিক্ষক-সমাজের দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা সব জায়গাতেই তাঁরা সর্বোচ্চ মর্যাদা পাচ্ছেন। তবে আমরা কেন পিছিয়ে? আমাদের কেন শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এত কম? জাতির মেরুদণ্ড শক্ত না হলে যে জাতি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না, সে সত্যও তো অজানা নয়। তবে এ পরিহাস কেন?
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এ মানহানিকর বিবৃতিতে শিক্ষক-সমাজ কর্মবিরতি, বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পর প্রেস ব্রিফিং করে মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তব্য তুলে নেওয়া ও দুঃখ প্রকাশ করায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি যে তিনি অন্তত তাঁর ভুল স্বীকার করেছেন। তবে এর আগেও তিনি এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে অনেককেই কমবেশি কষ্ট দিয়েছেন। কথা তো তীরের মতো, একবার বলে ফেললে ফেরত নেওয়া যায় না; সেটা গায়ে বিঁধেই যায়। তাই মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথা বলার ক্ষেত্রে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৩ সেপ্টেম্বর পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি গ্রহণ করে ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর সব কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এবং এর মধ্যে সরকারপক্ষ থেকে শিক্ষকদের সঙ্গে বসার আহ্বান না পেলে আবারো ১৭ তারিখে কর্মবিরতি গ্রহণ করা হবে। সামনেই ঈদের বন্ধে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর আগেই সরকার উদ্যোগ নেবে বলে আশা করছি।
শিক্ষকের মূল আনন্দ কলমে, জ্ঞান বিতরণে, বই-খাতায়, মননে; আন্দোলনে নয়, কর্মবিরতিতে নয়। তাই আশা করি, শিক্ষাবান্ধব এ সরকার শিক্ষকদের দিকে মুখ তুলে চাইবে। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি মেনে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মর্যাদা পুনঃঅধিষ্ঠিত করবেন।
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
Published in: http://goo.gl/67zroZ
0 comments:
Post a Comment