Kamrul Hassan
বাংলাদেশের যে ঘরে অন্তত একটি শিশু বা ২৫ বছরের কম বয়সের সন্তান আছে সেই ঘরের বাবা মায়েরা সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে আমার ধারণা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় দিনানিপাত করেন। আমাদের সব বাবা-মা মন করেন ভালো চাকুরী আর ভালো থাকা দুটোই নির্ভর করে ভালো শিক্ষা প্রাপ্তির উপর। আমাদের সংবিধানেও বলা আছে শিক্ষা মৌলিক অধিকার অর্থাত অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মত শিক্ষাও মৌলিক অধিকার। সত্যি বলতে কি গুরুত্বের দিক থেকে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ন কারণ অন্য চারটির অবস্থানের নির্ণায়ক হলো শিক্ষা। অথচ শিক্ষাই এখন এই দেশে সবচেয়ে অবহেলিত যার ফলে শিক্ষার সাথে সংস্লিষ্ঠ সকল ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অরাজকতা। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে অন্যান্য যেই বাম ধারার সংগঠন ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার কাছাকাছি আছে তারা সর্বদাই শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে দেখার ঘোর বিরোধী। কি আশ্চর্য্য আজ তারাই শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করছে। এটাকেই বলে double standard বা দ্বৈতনীতি।
প্রথমত রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ববোধ থেকেই সরকার জনগনের কাছ থেকে কর আরোপের মাধ্যম টাকা নিয়ে সেই টাকার একটি অংশ শিক্ষা খাতে অর্থাত স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করে সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে চলার ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমাদের সরকারের আর্থিক সক্ষমতার দিকে তাকিয়ে জনগণ এটা প্রায় মেনে নিয়েছে সরকার একার পক্ষে এই বিশাল জনগোষ্ঠির জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগান দিতে পারবে না। ফলে প্রাইভেট স্কুল, কলেজ এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি। এই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরী হতে দিয়ে আমাদের সরকারগুলো তাদেরকে নিয়মের মধ্যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এটা শুধু এই সরকার না বরং পূর্ববর্তী সরকারগুলোর দায় বেশি যেহেতু শুরুতে নিয়ন্ত্রণ সহজ ছিল কিন্তু করেনি বা করতে পারেনি। এখন এই দেশে নানাধারার শিক্ষা কার্য্যক্রম চলছে। এখন প্রশ্ন হলো প্রাইভেট হয়েছে বলে সেটাকে কি সরকার কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখবে এবং একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে যে ভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর নেয় সেইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও কর নিবে? এটা একটা নীতির প্রশ্ন। এখন এই কর নেওয়া মানেই হলো শিক্ষাকে আর মৌলিক অধিকার এবং এটা provide করা যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল সেটা অস্বিকার করার নামান্তর। সরকার ইতিমধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে কর্পোরেট কর ( প্রত্যক্ষ কর) এবং VAT (পরোক্ষ কর) আরোপ করে আদায় শুরু করেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সরকার কর্পোরেট কর আদায় করছিল আর আবার থেকে VAT আদায় শুরু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আমরা দখেছি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বা দোকানে কিছু কিনতে গেলে ভ্যাট দিতে হয়। অর্থাত পরোক্ষ কর ভোক্তাকেই দিতে হয়। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চার্টার অনুসারে এগুলোর সরাসরি মালিক নেই, চলে ট্রাস্টি বোর্ড-এর মাধ্যমে। যাদের চার্টারে বলা আছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত মুনাফা কোন ব্যক্তি তার ঘরে নিতে পারবে না বরং এটা থেকে অর্জিত মুনাফা ফিড ব্যাক করে অর্থাত বিশ্ববিদ্যালয়েই পুনঃবিনিয়োগ করতে হবে এবং কেবল তখনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আস্তে আস্তে একটা মান সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের রুপান্তরিত হবে।
কিন্তু আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে বিরাট অরাজগতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভ থেকে মালিক পক্ষ নানারকম ফন্দিফিকির করে মুনাফার একটা বিরাট অংশ নিয়ে নিচ্ছে। মুনাফা আরেকটি অংশ কর্পোরেট ট্যাক্স-এর নামে নিচ্ছে সরকার। তার উপর আবার ভ্যাট। এখন কথা হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার এবং মালিকরা যে মুনাফা নিচ্ছে এটা আসে কোথা থেকে? মালিকের মুনাফা, সরকারের ট্যাক্স (প্রতক্ষ বা পরোক্ষ) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনাফা সব আসে ছাত্রের কাছ থেকে। চার্টার অনুযায়ী মালিকরা যদি কোন মুনাফা না নিত, সংবিধান অনুযায়ী সরকার যদি কোন ট্যাক্স না নিত তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফী অনেক অনেক কম হতে পারত এবং মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা আরো স্বচ্ছন্দে করতে পারত। বেশি না কমলেও অতিরিক্ত মুনাফাও যদি নিত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত উন্নতি করতে পারত।
তাই ছাত্ররা যে অনদ্লন করছে তা ন্যায্য। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করছে না কারণ তারা ছোট। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের একটা ভালো দিক লক্ষ্য করছি তারা এখন পর্যন্ত কোন ধংসাত্বক কাজে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু এই আন্দোলন বেশি দীর্ঘায়িত হলে এরকম নাও থাকতে পারে। তাছাড়া অনেকেই এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টাও থাকতে পারে। শুনতে পাচ্ছি সরকার নাকি ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক থেকে এবং এই ঋনের শর্ত পূরণের অংশ হিসাবেই এইসব ভ্যাট বা বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করছে। এটা খুবই দুঃখজনক। বিশ্ব ব্যাংক কখনো চাইবে না তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করুক তাই দাবাইয়া রাখতে যা যা করার দরকার তারা তাই করে। কিন্তু উন্নতি করার জন্য আমাদের যা করার দরকার আমরা তার উল্টোটা করছি।
কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment