Saturday, October 10, 2015

উচ্চ শিক্ষা ভাবনা: প্রাসঙ্গিক কথা

মো: জিল্লুর রহমান

পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির পর থেকেই তার মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে, সমাজকে বা রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করে। শিক্ষার প্রকার, পদ্ধতি বা এর সংগা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও শিক্ষা ছাড়া যে কোনো দেশ বা জাতি পৃথিবীতে মাথা তুলে দাড়াতে পারে না সে ব্যপারে কোনো বিতর্ক নেই।
এক্ষেত্রে মহাকবি জন মিল্টনের শিক্ষার সংগাকেই পরিপূর্ণ বলা যায়। শিক্ষার প্রয়োগিক দিক সামনে রেখে তিনি বলেছেন - "I call a complete and generous education that which fits a man to perform justly, skillfully and magnanimously all the offices both private and public, of peace and war". তিনি আরো বলেন: " Education is the continuous process through which mental physical and moral training is provided top new generation, who also acquire their culture and ideals through it". উল্লিখিত সংগার আলোকে পৃথিবীতে উন্নত বা স্বল্পোন্নত জাতিসমূহ তারা তাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি বা আদর্শকে সামনে রেখে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে থাকেন এবং এর আলোকে নিজেদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাধীনতা পরবর্তী বা পূর্ববর্তী সময়ে আজ পর্যন্ত আমরা সময়োচিত বা কার্যকর শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হই নাই, যার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ নিজেদেরকে একজন সত্যিকার আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন বা ধারণ করে সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক বা রাজনৈতিক নানা সমস্যার সৃষ্টি তথাকথিত উচচ শিক্ষিত শ্রেণীর। অথচ শিক্ষার মৌলিক দাবিই হলো শিক্ষিত মানুষই হলো সমাজ বা দেশের পরিচালক, তাদের কাছেই দেশ বা জাতি নিরাপদ। আমরা আমাদের সমাজে এর ঠিক বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করে থাকি। বিষয়টির কারণ স্পষ্ট করতে হলে আমাদের উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নের বিবর্তন পর্যালোচনা ও এর সুক্ষ বিশ্লেষন একান্ত জরুরী। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতি অনেক আগ থেকেই চলমান। ব্রিটিশ আমলে শুধুমাত্র সুবিধা ভোগীরাই সীমিতভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতে এবং যা তাদের প্রান্তিক বিশাল জনগোষ্ঠি থেকে অনেক বেশী বিছিন্ন করে রাখত। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানসমূহ দেশের নগরকেন্দ্রিক গড়ে তুলে সমাজের মধ্যে একটি প্রছন্ন বিভাজন তৈরির মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষাকে ব্যবহার করা হতো। উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির সেই ব্রিটিশ আমল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত একটি স্পষ্ট ঐতিহাসিক ধারণা এবং এর একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করি।

প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তার বা শিক্ষা সম্প্রসারণের বিষয়ে খুব একটা মনোযোগী ছিল না। ১৮১৩ সালে তারা তাদের চুক্তি নবায়নের পর প্রথম ভারতবর্ষের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য ১লাখ রুপি বরাদ্দ দেয়। ১৯২৩ সালে গণশিক্ষা বিষয়ে কলকাতাতে একটি কমিটি গঠন করে এরপরই খ্রিস্টান মিশনারীদের তত্ত্বাবধানে তারা অনেকগুলো নতুন নতুন স্কুল ও ভারতীয় ভাষায় অনেকগুলো বই ছাপানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং এর সাথে সাথে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনও শুরু করে। পরবর্তীতে লর্ড হার্ডিঞ্জ রেজুলেশনের (অক্টোবর ১০, ১৮৪৪) মাধ্যমে সকল সরকারী নিয়োগে ইংরেজি জ্ঞানের অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়টি প্রচলন করা হয়। ১৯৫৪ সালের চার্লস উডের শিক্ষানীতির মাধ্যমে প্রত্যেক প্রদেশে আলাদা শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার এক নতুন যুগের দ্বার উম্মোচন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই ধারণা থেকেই গৃহিত হয় সরকারের ভবিষ্যৎ শিক্ষানীতি। প্রাথমিকভাবে এই তিনিটি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কলেজ ও ইনস্টিটিউট এর অধিভূক্তি, পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ, সনদ পদান এবং নানা আয়োজনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন ইন্ডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতিও উন্নত হয় ১৯১৭ সালে স্যার মাইকেল স্যাডলার এর নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে। যদিও কমিশনের কর্মকান্ড পরিচালিত হতো শুধুমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক তথাপিও এর প্রস্তবনাসমূহ পুরো ভারতবর্ষের উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কমিশন তিন বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স চালু, বিজ্ঞান শিক্ষা চালুকরণ, টিউটোরিয়াল পদ্ধতি ও গবেষণা কাজের উপর গুরুত্ব প্রদান করে সুপরিশমালা পেশ করেন। ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে এসে প্রায় ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতবর্ষে উচ্চ শিক্ষা আরো বিস্তৃত হয় এবং এর অব্যবহতি পরেই ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ভারতবর্ষের বাংলাদেশ অংশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও বিস্তারের দ্বার উম্মোচিত হয়। শিক্ষাবিস্তার ও ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনের আসল উদ্দেশ্য ছিল মূলত ব্রিটিশ কৃষ্টি ও কালচার সুকৌশলে বিশাল জনগোষ্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করানো এবং সাথে সাথে রাজা ও প্রজার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে কাজে লাগানো। তাদের গৃহিত সকল পদ-পদবীসমূহ শিক্ষা বিস্তারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে সুকৌশলে তারা উপমহাদেশের জনগোষ্ঠিকে ব্রিটিশ দাসে পরিণত করে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রয়ারী সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য লর্ড ম্যাকেলের শিক্ষা বিবরণীতে যাতে একই বছরের ৭ মার্চ তদানিন্তন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিক সম্মতি দেন এবং লেখেন - "the great object of the British Government ought to be the promotion of European literature and science among the natives of India." এক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় একটি উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে আরো পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে সরাসরি লর্ড ম্যাকেলের নিজের উক্তি থেকে, তিনি বলেন - "We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern, --a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect." তিনি তার কাজ শেষে উল্লাস করে বলেছিলেন -"it will be the proudest day in English history. " দু:খজনক হলেও সত্য আমরা তাদের প্রদত্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি আদর্শ দাসে পরিনত হয়েছি। তথাপিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ক্রমে অধিভূক্তি করণ এবং অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের আলোকে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে শুরু করে। পরবর্তীতে এই অঞ্চলে ১৯৫৩ সালে রাজশাহী ও ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

ষাটের দশকের শুরুতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) অংশে দুটি প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দুটি যথাক্রমে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। উল্লেখ্য আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়কেই বুয়েটে রূপান্তরিত করা হয়। মূলত পাকিস্তান আমলে সাধারণ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় যা মানগতভাবে নয় বরং অনুভূমিক বিস্তৃতিই বেশি লাভ করে। ১৯৫৯ সালে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় যা পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ শিক্ষার উপর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা পেশ করে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষা পদ্ধতি অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেকটা দুর্বল ছিল। আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন মোট ৬৪টি সুপারিশমালা পেশ করেন। ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে আর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। যার নাম দেয়া হয় - স্টুডেন্টস প্রবলেমস অ্যান্ড ওয়েল ফেয়ার। এই কমিশন পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির উপর কিছু বিশেষ নির্দেশমালা পেশ করেন। কমিশন সরকারী কলেজ, প্রাইভেট কলেজ, ছাত্রছাত্রীর চাহিদার উপর বেশ কিছু বিশেষ সুপারিশমালা পেশ করেন। পরবর্তীতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনমলে ১৯৬৯ সালে নুর খান কমিশন গঠন করা হয় পূর্ববর্তী কমিশনের সুপারিশ আগ্রাহ্য করে। নুর খান কমিশন শিক্ষা আইনসহ বেশ কিছু সুপারিশমালা পেশ করেন। সুপারিশমালার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষা পদ্ধতির কিছু নতুন প্রস্তাবনা পেশ করেন। এছাড়াও অধিভূক্ত কলেজ সমূহের অধিকতর বিস্তৃতির মাধ্যমে নিয়মিত ও অনিয়ামিত ছাত্র ছাত্রীদের সুবিধা প্রদানের সুপারিশও এর আওতাভূক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তান আমলে কোনো শিক্ষা কমিশনেরই সুপারিশমালা বাস্তবায়নতো দুরে থাকে বরং নানাভাবে নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে যা মূলত উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতিসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার গতিপথকেই রুদ্ধ করেছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনা পদক্ষেপ শিক্ষার পরিবেশ ও মান উন্নয়নে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকাও রেখেছে।

১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অনিবার্য অভ্যূদয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক এক নতুন ও সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে সবাই আশা করেছিল প্রতিশ্রুতিশীল সম্ভাবনাময়ী এই রাষ্ট্রের অন্যান্য দিকের সাথে সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে এক নতুন মাত্রার সূচনা হবে এবং সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৭২ সালে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের গঠিত হয় ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশন। কমিশন শিক্ষা ক্ষেত্রের নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করণ এবং প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সাথে বাস্তব জীবনের সম্পর্কহীনতা চিহ্নিত করণের মাধ্যমে ব্রিটিশ কর্তৃক পরবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনসহ বেশ কিছু সুপারিশমালা পেশ করে। ১৯৭৯ সালে নতুন করে জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, এই পরিষদ দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে নানা অসামাঞ্জস্যতা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করেন যার মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কহীনতা পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ব্যতিরেকে কলেজ স্থাপন, শিক্ষক সংকট, গবেষণা কাজে সম্পৃক্ত না থাকা ইত্যাদি। উক্ত কমিটির নানা ফাইন্ডিংস ও সুপারিশমালার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে নতুনভাবে ১৯৯৭ সালে গঠন করা হয় জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটি, যার নেতৃত্ব ছিলেন প্রফেসর শামসুল হুদা। এই কমিটি কোটা পদ্ধতির পরিবর্তে মেধা ভিত্তিক শিক্ষা, চার বছর মেয়াদী অনার্স ও ১ বছর মেয়াদী মাষ্টার্স কোর্সসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা উন্নয়ন শীর্ষক সুপারিশমালা পেশ করেন। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে ২০০২ সালে প্রফেসর এম এ বারীর নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। বারী কমিশন কলেজ ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্রিক গুরমুত্ব প্রদানসহ বেশ কয়েকটি সুপাশিমালা পেশ করেন। অশ্চর্যজনকভাবে এর এক বছর পরেই ২০০৩ সালে প্রফেসর মো: মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে নতুন কশিমন গঠন করা হয়। কমিশন প্রত্যন্ত অঞ্চলে নতুন নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠা, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, প্রাইভেট সেক্টরে উচ্চ শিক্ষা বিস্তার এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশমালা পেশ করেন। সর্বশেষ ২০০৯ সালে প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে নতুন কশিমন গঠন করেন। ২০১০ সালে কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত সুপাশিমালা জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। যদিও কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশামালা দেশব্যাপী নানামহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেই। সুপাশিমালায় উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক বিবেচনার উপর জোর দেয়া হয়। ৪ বছর ব্যাপী অনার্স সম্পন্নকারীদের টিসিং (Teaching) ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকুরী প্রদানের সুযোগ সৃষ্টির বিষযটি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ১৯৭০-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সময়কালকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বন্ধ্যাযুগ বলা যেতে পারে। এই সময়ে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে খুব কম অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। ১৯৮৫-১৯৯২সাল পর্যন্ত ৫টি পাবলিক বিশববিদ্যালয় যথাক্রমে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৫), কুষ্টিয়ায় শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯০), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯১), উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২) ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময়েই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ৩৪ (১৯৯২) পাশ হয়। পরবর্তীতে এই আইনের আওতায় অদ্যাবধী প্রায় ৮০টির মত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯৬ -২০০১ সময়ে আরো প্রায় ৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১-২০০৬ সময়ে ড. বারী ও প্রফেসর মিয়া কমিশনের সুপারিশমালার আলোকে আরো বেশ কয়েকটি জেনারেল ও প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালাভ করে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক অনুভূমিক বিস্তৃতি লাভ করলেও গুণগত মান নিশ্চিত করার বিষয়টি বরাবরের মত এখনো বিস্তর আলোচনার দাবী রাখে একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা অবকাঠামোগতভাবে দৃশ্যমান উন্নতি করলেও গুনগতভাবে এর মান ক্রমশ নিম্মমূখী একথা এখন সর্বত্রই আলোচিত একটি বিষয়। গুনগত মান নিশ্চিত করার বিষয়টি আড়াল করে শুধুমাত্র প্রচারের উপলক্ষে অধিকমাত্রায় সনদ বিতরনের যে আয়োজন তা নিসন্দেহে জাতীর জন্য এক অন্ধকারময় ভবিষ্যতেরই ইংগিত বহন করে। আমাদের জন্য সব থেকে দুর্ভাগ্যের বিষয হলো স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছরেও আমরা একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও এর সফল বাস্তবায়নে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়েছি। যেখানে একটি জাতি তার আদর্শ, কৃষ্টি ও দেশপ্রেম সবকিছুই অর্জন করে তার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে, সেখানে বারবার শিক্ষাকমিশন গঠন করেও এর প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতা সামগ্রিকভাবে জাতি হিসাবে আমাদের অনেকটাই পশ্চাদপদ করে রেখেছে। বিগত সময়ের নানাভাবে বিতর্কিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সনদ বিতরনের উদগ্র নেতিবাচক প্রতিযোগিতা উচ্চশিক্ষা গ্রহনে বঞ্চিত বিশাল সংখ্যা তৈরির মাধ্যমে আগামী দিনে দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধিতে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে একথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ভর্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান আসন সংখ্যার বিপরীতে যে বিশাল অস্বাভাবিক সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর ভীড় যা রীতিমত ভীতিকর। এক্ষেত্রে এখানে উপস্থাপিত পরিসংখ্যানগত তথ্য বিষয়টিকে অরো পরিস্কার করবে। বিগত ২০১৩ ও ২০১৪ সালে প্রকাশিত পরীক্ষার ফলাফলে ছাত্র-ছাত্রীর পাশ রেকর্ড গড়েছে যা অতিত নিকটে দেখা যায়নি। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লীড নিউজ করা হয়। অধিকাংশের শিরোনাম ছিলো ’নজিরবিহীন ফল’। এ হার এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ডও ভঙ্গ করেছে। এই রেকর্ড গড়ার মধ্যে জাতি আশান্বিত হবে এটাই স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু এই রেকর্ড সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর পাশ নিয়ে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ সহ অনেকেই নানা সমালোচনা করে এর ভবিষ্যত নেতিবাচক বিশ্লেষন তুলে ধরেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা ও ব্যঙ্গাত্বক মন্তব্য তো আছেই। এই রেকর্ড পাশের ভবিষ্যত ভয়াবহ চিত্র কি হতে পারে তা একটি পরিসংখ্যানগত তথ্য বিষয়টিকে অরো পরিস্কার করবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সূত্র মতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী যেখানে বাংলাদেশে ৩৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন সংখ্যা ৪৩১০৮টি এবং ২২ টি সরকারী মেডিকেল, ৯ টি ডেন্টাল, একটি সরকারী টেক্সটাইল ও একটি সরকারী মেরিন একাডেমিতে আসন সংখ্যা ৪২৯৮ টি অর্থ্যাৎ সর্বমোট আসন সংখ্যা ৪৭৪০৬ টি। সেখানে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে এইচএসসিতে GPA 5 (A+) প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা যথাক্রমে ৭০ হাজার ৬০২ জন ও ৪২ হাজার ৮ শত ৯৪ জন। অর্থ্যাৎ গত ২০১৪-১৫ ভর্তি বছরে যদি ধরেও নেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় (মেডিকেল, প্রোকৌশল ও কৃষি সহ) শুধুমাত্র GPA 5 (A+) প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীরাই ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, তারপরেও বিগত (২০১৩-১৪) ভর্তি বছরে ভর্তির পর সুযোগ বঞ্চিত ৩৫-৪০ হাজারসহ এবারের সংখ্যা হিসেব করলে বিদ্যমান আসন সংখ্যার বিপরীতে প্রায় ২৫-৩০ হাজার GPA 5 (A+) প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তির সুযোগ বঞ্চিত হবে। খুবই উদ্বেগের বিষয় হলো প্রতি বছর একটা বড় সংখ্যক GPA 5 (A+) প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তির সুযোগই পাচ্ছে না অথচ এর বাইরেও লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এই প্রতিযোগিতায় সম্পৃক্ত। সামগ্রিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এবারের ভর্তি বছরে (২০১৫-১৬) মোট পাশকৃত (৭৩৮৮৭২) ছাত্র-ছাত্রীর মাত্র ৬% পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (৪৭৪০৬), ৬০% জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (৪,৪৪,২০০ যার মধ্যে ২ লাখ ৪ হাজার ২ শত অনার্স লেভেলে এবং ২ লাখ ৪০ হাজার পাশ কোর্সে ) সামর্থবান পরিবার থেকে ১৫% বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে (১১২০০০) ভর্তির সুযোগ পাবে যা মোট পাশকৃত ছাত্র-ছাত্রীর প্রায় ৮১%। অবশিষ্ট প্রায় ১৯%, (যা এই বছরের ভর্তি হতে না পারা সংখ্যা) ভর্তির সুযোগ হারিয়ে আগামী বছরের অপেক্ষায় থাকবে। এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভর্তি সুযোগ একবার দেওয়ায় অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে এর চাপ পড়বে এবং সেখানে একটা বড় অংশ ঝরে পড়বে। এর সাথে অতি সম্প্রতি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাস বিষয়টিকে আরো জটিল পর্যায়ে রুপ নিয়েছে। মেডিকেলের মত অতি টেকনিক্যাল শিক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাস শুধু লজ্জাজনকই নয় বরং এর ভবিষ্যৎ যে কত বিপর্যয়কর হতে পারে তা অনুধাবনের সামর্থ্য বা সদিচ্ছা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আছে বলে মনে হয় না। সামগ্রীক বিবেচনায় যে ছাত্রটি তার সর্বশেষ দুটি পরীক্ষার উভয়টিতে অথবা একটিতে GPA 5 বা এর কাছাকাছি নম্বর পেয়েও কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলো না তার অবস্থান এই সমাজে কোথায় হবে তা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন আমাদের নীতিনির্ধারকগন? বাজারে চাহিদার বিপরীতে যদি যে কোন উৎপাদন দ্বিগুন বা তিনগুন হয় তাহলে সেই উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কমে যাবে অথবা বিক্রি করতে না পেরে অবহেলা বা অযতনে তা নষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। অতি সহজ সমীকরণ কেন আমাদের তথাকথিত উর্বর মস্তিস্কসমূহ ধরতে পারলো না তা সত্যিই দঃখজনক। একথা এখন অহরহ শোনা যায় যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় শিক্ষা বোর্ড থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নকারীদের এই মর্মে বার্তা দেয়া হয় যেন সর্বক্ষেত্রে উদার মানষিকতা নিয়ে খাতা মূল্যায়ন করার জন্য, সহসা যেন কেউ অকৃতকার্য না হয়। এ যেন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থারই ছায়া। এক সময় সবাই রাশিয়ায় যেত এই জন্য যে সেখানে গেলেই একটা সনদ অবশ্যই মিলবে। এখনো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যাদের ডিগ্রি রাশিয়া থেকে তাদেরকে রাশান ডিগ্রিধারী (সস্তা) বলে বাঁকা চোখে দেখা হয়। মোদ্দা কথা হলো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ যেমন প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে আবার যার যার স্বীয় যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়নও তার আধিকারের মধ্যেই পড়ে। যেনতেন ভাবে পার পাইয়ে দেয়ার মানসিকতা একটি ব্যাক্তি, সমাজ ও দেশের জন্য বেকারত্বের বোঝা বাড়িয়ে অত্যন্ত ভয়াবহ বিপর্য়য় ডেকে আনতে পারে। এই ভয়াবহ চিত্র শুধুমাত্র নীতি নির্ধারক নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের ঘাপটি মেরে থাকা কিছু মানুষের জনগন বা দেশের স্বার্থ ও ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে একেবারেই হীন আদর্শ, সংকীর্ণ মানসিকতা, সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার অসুস্থ চর্চারই বাস্তব বহি:প্রকাশ।

জাতি হিসেবে স্বাবলম্বী হতে হলে সেই জাতির শিক্ষিত সমাজ কখনো সংখ্যার বিবেচনায় মূল্যায়িত হতে পারে না বরং গুনগত মানের বিবেচনায় মূল্যায়িত হয়। তথাপিও কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে সমস্ত ভাগ্যবান সম্ভাবনাময় যুবক একবুক আশা ও গর্ব নিয়ে কলেজ বা বিশ্ববদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রাখছে তারাই কি সুন্দর স্বাভাবিক ও নির্মল শিক্ষার পরিবেশ আদৌ পাচ্ছে , না আমাদের উচ্চ শিক্ষাঙ্গন অসুস্থ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে সেটাই এখন মৌলিক প্রশ্ন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় হাতে গোনা দু’একটি ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুন, ধর্ষণ, চাদাবাজি, টেণ্ডারবাজি থেকে শুরু করে সকল অপকর্মের নিরাপদ অভায়রণ্যে পরিণত হয়েছে এবং যার খেসারত দিতে হচ্ছে এদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের। ৪ বছরের অনার্স শেষ হতে কখনো প্রায় ৬-৭ বছর লেগে যাচ্ছে। মূলতঃ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক এবং ননএকাডেমিক চিত্র এতটাই নাজুক পর্যায়ে গেছে তা বর্ণনা করা সত্যি কঠিন। বেসরকারী অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সনদ বিক্রির অভিযোগ ইউজিসি শত চেষ্টা করেও তা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নিরব দুবৃত্তায়ন। অনেকেই মহান পেশা হিসেবে শিক্ষকতায় এসেও মান সম্মান নিয়ে চলতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে হীন দলীয় বিবেচনা বা নোংরা রাজনৈতিক বৃত্তাবলয়ে শিক্ষকদের মান মর্যাদা রক্ষা করা দুরে কথা নিজেদের ন্যূনতম সুস্থ মানষিকতা নিয়ে অবস্থান করাও দূস্কর। যেখানে শিক্ষকদের জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরনের চর্চায় সদা নিয়োজিত থাকার কথা, সেখানে অনিয়ন্ত্রিত ছাত্ররাজনীতির বেপরোয়া রুপ এবং মেধার পরিবর্তে অতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু শিক্ষকদের অতি দলীয় মানষিকতা উচ্চশিক্ষার অঙ্গনকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে উগ্র দলীয় বিবেচনায় এর মূল কারন বলে মনে করা হয়। একটি জাতির ভবিষ্যত দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক তৈরির স্থান যদি এভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তবে এ জাতির ভবিষ্যত কোথায়? অন্তত মৌলিক কিছু যায়গা রাজনৈতিক চর্চার বাইরে রাখা দরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় আর যায় হোক না কেন শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কিছু মৌলিক বিষয় না আনার মধ্যে আমাদের ভবিষ্যত কল্যান নিহিত। এইসব বিবেচনায় সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এছাড়াও কম বেতন এবং অতি রাজনৈতিক চর্চার কারনে এখন মেধাবী অনেকেই এই মহান পেশায় আসতে বিমূখ। যেখানে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে আমাদের তুলনায় প্রায় আড়াইগুন বেতনসহ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো সেখানে এই অবস্থায় ক্লাসের সবথেকে মেধাবী ছাত্রটি কেন আসবে শিক্ষকতায় এই প্রশ্নটি অবান্তর নয়। আবার মেধাবী হওয়ার পরও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় মেধাকে প্রকাশ্যে পাশ কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীকে দলীয় বিবেচনায় নিযোগ দেয়াও এই পেশায় অনীহার অন্যতম কারন যা গত কয়েক বছর ধরে প্রকট আকার ধারন করেছে। বিষযটির ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে ক্লাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার পরও শুধু তার কোন এক আত্নীয় বিপরীত ধারার রাজনীতি করার অভিযোগে তার যত ভাল রেজাল্টই থাকুক না কেন নির্বাচন বোর্ডে প্রকাশ্য ঘোষনার মাধ্যমেই তাকে বঞ্চিত করা হয়। তার আত্নীয় বিপরীত ধারার রাজনীতি করাই নাকি তার বড় অযোগ্যতা। এক্ষেত্রে পছন্দের দলীয় প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য কখনো স্বায়ত্বশাসনের নামে আবার কখনো রাজনৈতিক অজুহাত দেখিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে যেভাবে ইচ্ছা আইন পরিবর্তন করা হয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার পরিবর্তে মুল্যায়ন করা হয় দলীয় পরিচয় অথবা বাবা মা আত্বীয় স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় অথবা লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময় আর এই সমস্ত অপকর্মে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদের শাষক শ্রেণীরই কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক পর্যায়ের দূর্নীতিবাজ নেতারা। দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে উপাচার্য হতে শুরু করে দলীয় শিক্ষক কর্মকর্তা সবাই মরিয়া হয়ে কখনো ইচ্ছায় আবার কখনো অনিচ্ছা স্বত্বেও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এর মূল কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে সকল নিয়োগ প্রছন্নভাবে আবার কখনো কখনো সরাসরি নিয়ন্ত্রন করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এসব চিত্র দেখে শত শত সত্যিকার গবেষক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বহু গুনী শিক্ষক অসহায় দর্শক হয়ে নিরবে নিভৃতে কেদে চলেছেন। এই সমস্ত শত নেতিবাচক ঘটনার পরও আশাবাদী হওয়ার অনেকগুলো কারণও আছে। এদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো ফলাফল করার পরও যারা নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে গেছে তাদের বড় একটি অংশ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে কোন প্রকার রাষ্ট্রিয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়াই। অথচ আমাদের দূর্ভাগ্য আমরা শুধুমাত্র অতি সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার উর্দ্ধে উঠে সেই সমস্ত মেধাবীদের দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছি। এটা খুবই স্বাভাবিক যেখানে মেধার মূল্যায়ন নেই সেখানে মেধাবী জন্ম নেয় না, আর এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে সেদিন বেশী দুরে নয় যেদিন এই সোনার দেশটিই মেধাহীন লুটেরাদের হাতে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আর এই সমস্ত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে আগামী দিনের মেধাবী নেতৃত্ব তেরির কারখানা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দল মত নির্বিশেষে একটা জাতীয় ঐক্যমত, যেখানে মেধাহীন পেশী শক্তি নির্ভর ছাত্র রাজনীতিকে না বলে মেধা ও আদর্শিক বলয়ে ছাত্র সমাজের মৌলিক সমস্যা সমাধানে আবর্তিত হবে ছাত্ররাজনীতি। শিক্ষকসমাজ সংকীর্ণ দলীয় চিন্তা ও চর্চার উর্দ্ধেই থাকবে না বরং উচ্চ শিক্ষার পবিত্র এ অঙ্গণ থাকবে সমস্ত রাজনৈতিক চর্চার ও প্রভাবের বাইরে এবং যেখানে সবাই ব্যস্ত থাকবে শুধু জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরনে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে শিক্ষকদের কাংখিত মর্যাদা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা। সর্বোপরী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে জাতীর সকল সমস্যা সমাধানের শেষ আশ্রয়স্থল, যা একটি দেশের সমন্বিত ও সামগ্রীক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক , পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
zillu1977@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment