কাবেরী গায়েন
[লেখাটি একটানে লিখে পাঠিয়েছিলাম পত্রিকায়, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে সাথেই, সেই দিনই। কিন্তু লেখাটি ছাপেনি পত্রিকাটি। আমিও আর জিজ্ঞেস করিনি। আমার ফেসবুক বন্ধ রেখেছিলাম তাই ফেসবুকেও নোট দেইনি। এরই মধ্যে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় লেখাটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ ফের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে অবাক হইনি কিন্তু ফেসবুকে অন্তত নোটটি দিতে ইচ্ছে করলো। পুরনো লেখা। হয়তো প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কিংবা হারিয়েছে কী? যাই হোক, ধারাবাহিকতা রাখার জন্য হলেও নোটে রাখছি।]
এই তাহলে থলের বেড়াল! মাননীয় অর্থমন্ত্রী অবশেষে ঝেড়ে কাশলেন। একটি দেশের অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, ‘আমলাতন্ত্রকে আমরা যেভাবে ম্যানেজ (পরিচালনা) করি, বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফদেরও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করব’ (প্রথম আলো, ৮ সেপ্টেম্বর)। এই কথার ভেতর থেকে তিনি ঘোষণা করলেন, এদেশের আমলাতন্ত্রকে তাঁরা ম্যানেজ করেন। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্টাফ’দের ম্যানেজ করতে চান। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্টাফ’দের এখনো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁরা করতে পারেননি।
আমলাতন্ত্রকে ম্যানেজ নিশ্চয়ই করেন তাঁরা। কীভাবে ম্যানেজ করেন? বেতন-ভাতা-সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে। এই ম্যানেজ করার দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয় সচিবের উপরে আরো দু’টি পদ বাড়িয়ে। আমাদের সচিবরা নিশ্চয়ই কোন বড় কাজ করেছেন, যে কারণে প্রজাতন্ত্রের প্রচলিত বেতন-কাঠামোর উপরে আরো দুই-ধাপ বাড়ানো হয়েছে। সেই বড় কাজটি সম্পর্কে আমাদের জানা নেই। ‘জ্ঞানের অভাবে’ আন্দোলনরত শিক্ষকরা আসলে সে’কথাটাই জানতে চাইছেন। আশা করি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী অথবা সচিব কমিটি অথবা ফরাসউদ্দিন কমিশন অথবা মন্ত্রীপরিষদ থেকে কেউ না কেউ দায়িত্ব নিয়ে আমাদের এ’বিষয়ে আলোকিত করবেন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বিজ্ঞ মন্ত্রীমহোদয় নিজেই কাজটি করেন।
মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্টাফ’দের নিয়ন্ত্রণের অভিলাষ বিষয়ে আলোচনায় যাবার আগে তাঁর বক্তব্যের তথ্যগত ভ্রান্তির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘দেখা গেছে, নিচে ১০ জন প্রভাষক, কিন্তু ওপরে এক হাজার অধ্যাপক।’ এই তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? বরং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন, এবং সপ্তম বেতন-কাঠামো পর্যন্ত সিলেকশন গ্রেডে যেসব অধ্যাপকেরা সচিবদের সমান বেতন সুবিধা পেতেন, তাদের সংখ্যা ১ হাজার ২৫০ জন। তিনি ১০জন প্রভাষকের উপরে এক হাজার অধ্যাপকের হিসেবটা কোন সূত্র থেকে পেয়েছেন, জানালে আমাদের অজ্ঞানতা কাটতো। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদোন্নতি ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করার পরে। তারমধ্যে রয়েছে- চাকরিতে কতবছর আছেন, উচ্চতর গবেষণা ডিগ্রি এবং স্বীকৃত গবেষণা জার্ণালে প্রকাশিত প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রবন্ধ। সরকারী হিসেব অনুযায়ী বছর পার করার উপরে নয়। তাই শিক্ষকতায় যোগ দেবার অনেক বছর পার করেও অনেকের অধ্যাপক হতে দেরি হয় উচ্চতর গবেষণামূলক ডিগ্রি এবং পর্যাপ্ত প্রকাশনা না থাকার কারণে, অথচ তাঁর বিভাগেরই তরুণ সহকর্মী এই আবশ্যকীয় শর্তগুলো পূরণের মধ্য দিয়ে দ্রুত পদোন্নতি পেতে পারেন। পদোন্নতি এখানে কে কোন ব্যাচে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তার উপরে নির্ভর করে না। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগে কতোজন অধ্যাপক হবেন তার কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
এবার আসা যাক, মন্ত্রীমহোদয়ের মূল বক্তব্যে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্টাফ’দের নিয়ন্ত্রণ করার অভিলাষ জানিয়েছেন। বিনীতভাবে বলতেই হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কারো ‘স্টাফ’ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘স্টাফ’ ঠাউরে থাকলে তিনি একটু ভুলই করছেন বোধ হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ সম্পর্কে সম্ভবত একটু কম খোঁজখবর রাখেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের বিবেক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে ছাড়া আর কারো কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। কাজেই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার অভিলাষটি আসলে পূরণ হবার নয়। অবশ্য নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছাটি পোষণ করে এসেছেন সকল শাসক। কেনো জানিনা, শাসকরা বুঝি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভয়ই পান। শিক্ষকদের একাংশকে কিছু সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী চালানোর ব্যবস্থা করতে পারলেও, সব শিক্ষককে যে পারেন না, সেটা সব শাসকই বোঝেন। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার যন্ত্রণাটি সম্ভবত প্রবল। ছাত্ররাজনীতির ক্ষমতাসীন রাজনীতির দলীয় ছাত্রসংগঠনকে কব্জা করে রাখা গেলেও ’৬৯, ’৮৩-র ছাত্র-অভ্যূত্থান, কিংবা ২০০৭ সালের আগস্ট-বিদ্রোহের মতো ঘটনা যখন ঘটে, তখন তাঁদের আনুক’ল্যের ক্ষমতাসীন শিক্ষক-ছাত্ররাজনীতির মানুষেরা চুপ থাকলেও সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তাপটি তাঁদের বুঝতেই হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণের সাধটি বের হয়েই যায়। তিনি অবশ্য সেনাশাসক লেফটান্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের মন্ত্রীসভাতেও ছিলেন। বিশ্বদ্যিালয়ের স্বাধীন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এরশাদ আমলকে সুস্থির থাকতে দেয়নি। সেই স্মৃতি কারোরই ভোলার কথা নয়। এরশাদ শাসনামলের মন্ত্রী হিসেবে তাঁরও মনে থাকবারই কথা।
তিনি ফের বলেছেন, ‘ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের করাপ্ট প্র্যাকটিস নিযন্ত্রণে আনা দরকার।’ কী মুশকিল! এতোবার নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন তিনি! বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘করাপ্ট প্র্যাকটিস’ নেই বলছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার রাজনীতিতে ঝামেলা আছে। আমি আমার গত লেখাতেই সে’বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি। তবে তিনি যে ‘করাপ্ট প্র্যাকটিস’-এর কথা বলেছেন, সেটি ঠিক নয়। পদোন্নতি এখানে একটি কাঠামো মেনেই হয়। ‘করাপ্ট প্র্যাকটিস’ যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা রাজনীতির সাথে জড়িত, ক্ষমতাসীন দলের বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার রাজনৈতিক ইচ্ছার সাথে জড়িত । সাধারণ পেশাগত পদোন্নতির সাথে সেইভাবে জড়িত নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি যতোটা চোখে পড়ে, আমলাতন্ত্রের ভেতরকার রাজনীতিটা জনপরিসরে সেভাবে আসে না। গণমাধ্যমও বেশ নীরব এবিষয়ে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সচিবালয়ে কতো কতো কর্মকর্তাকে যে ওএসডি করা হয় এবং সেই কর্মকর্তারাই যে ফের ভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এলে সকল সুযোগ-সুবিধার অধিকারি হয়ে প্রবল ক্ষমতাধর হন, এই একটিমাত্র ঘটনাই প্রকাশ করে যে প্রজাতন্ত্রের সরকারী কর্মকর্তাদের ভেতরে কীভাবে রাজনীতিকরণ চলে।
একটি দেশের মেধাবী জনগোষ্ঠীকে এইভাবে অপমান করার অধিকার কারো থাকতে পারে না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যেমন স্থানীয় স্কুল কমিটিকেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি না পেলে বেতন কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার হুমকি দেন, দুঃখের সাথে বলতেই হচ্ছে, মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়ের এই হুমকি তারচেয়ে পৃথক কিছু নয়।
আমি বাংলাদেশের জনগণের টাকায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক। আমি নীল-সাদা-গোলাপী কোন দলেরর সদস্য নই। শিক্ষকতা ভিন্ন আমার কোন পরিচয় নেই, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কোন নির্বাচনে কোনদিন প্রতিযোগিতা করিনি। কোন বাড়তি সুযোগ-সুবিধা কোনদিন নেইনি। আমার দায় এবং জবাবদিহিতা শুধুই আমার শিক্ষার্থীদের কাছে এবং যে জনগণের টাকায় পড়েছি এবং বেতন পাই- সেই সাধারণ মানুষের কাছে। আমি জানি, আমার মতো সাধারণ শিক্ষকদের বড় দুর্দিন যাচ্ছে। রাষ্ট্র একদিকে আমাদের বেতন-কাঠামোতে অসম্মান করেছে, ক্ষমতাবান রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার রীতিকে কলুষিত করে শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন প্রকট করেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সরকারদলীয় ক্যাডারদের দিয়ে স্বাধীন শিক্ষকদের পেটানো হচ্ছে। আমাদের সত্যিই কোন নিরাপত্তা নেই। তবুও, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসাবে আমি নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত মনে করি। সেই জায়গা থেকে বলছি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনি ভুল বলছেন। আপনি আমাদের সম্মানে আঘাত করছেন- বেতন-কাঠামোতে তো বটেই, বাক্যে এবং অনধিকার চর্চ্চায়।
আমাদের মন্ত্রীমহোদয়রা ভুলে যান, তাঁরা এই সরকারের আমলে ক্ষমতায় আছেন, ক্ষমতাকাঠামো পাল্টে গেলে তাঁদের এই ক্ষমতা থাকবে না। আমরা সাধারণ শিক্ষকরা থাকবো। আমাদের হাতেই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা বের হবেন, দেশের হাল ধরবেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনগণের ভোটে নির্বাচিত মন্ত্রী নন, তিনি জনপ্রতিনিধিও নন। তবুও তাঁর বিরুদ্ধে অসম্মানজনক কোন শব্দ-বাক্য প্রয়োগের কোন ইচ্ছা নেই। একটি দেশের মেধাবী পেশাজীবিদের অসম্মানিত করে একটি রাষ্ট্র আসলে কতোটুকু ভুক্তভোগী হবে, নিজেকে জ্ঞানী হিসাবে দাবি করলেও সেই ধারণা তাঁর নেই বলেই মনে হচ্ছে। সবচেয়ে মেধাবি শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় ধরে রাখা আর সম্ভব হবে না। সেই ক্ষতি যে কতোটুকু ক্ষতি, আজ বোঝা না গেলেও অচিরেই বোঝা যাবে বলে মনে করি। সেই ক্ষতি ঘটবার আগেই দাবি করি, এই বেতনকাঠোমোর বৈষম্যই কেবল দূর করা নয় বরং একটু খোলাচোখে এমনকি পাশের দেশ ভারত বা শ্রীলংকাতেও শিক্ষকদের কোন মর্যাদায় বেতন দেয়া হয় এবং কীভাবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ করা হয়, সেই দিকে নজর দেবার জন্য। শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো প্রনয়ণের জোরালো দাবির পাশাপাশি, শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানাই। অনুরোধ জানাই, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করার অশুভ অভিলাষ ত্যাগের।
৮সেপ্টেম্বর, ২০১৫
ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
আরো পড়ুনঃ
শিক্ষকদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজে মন্তব্যআমলাতন্ত্রের আমলনামা ও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
0 comments:
Post a Comment