সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবিতে আন্দোলন করছেন। সরকারের তরফ থেকে বহুবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সব পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীও নানা সময়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। উপাচার্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সর্বশেষ আলাপেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়টি উঠে এসেছিল। ‘শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল অচিরেই বাস্তবায়ন হবে’ এমন সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অতিসম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত জাতীয় বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার কয়েক ধাপ অবনমন ঘটায় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যদিও শিক্ষকরা আশা করছেন, সরকার তার নীতির পরিবর্তন করে পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
বিদ্যমান বেতন কাঠামোয় বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪ হাজার ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ বেতন ৮ হাজার ডলারেরও বেশি।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বি না হলেও শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পার্থক্য এভারেস্ট সমান। ভারতে একজন প্রভাষক প্রতি মাসে ৬০ হাজার রুপি এবং একজন অধ্যাপক ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেলেও এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন একশতবার গালমন্দ করি সেই পাকিস্তানও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে ২ লাখ ৩ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান।
বিগত সপ্তম পে-স্কেলে শিক্ষকদের বেতন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষকদের চেয়ে অনেক কম হলেও কিছুটা হলেও মর্যাদাপূর্ণ ছিল। কারণ তখন শিক্ষকরা শেষ বয়সে হলেও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এক ধাপ পরে সচিবের সম-মানের বেতন পেতেন। কিন্তু ৮ম পে স্কেলের বেতন পেতে শুরু করলে শিক্ষকদের আর ওই ধাপে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা কখনও আর সচিবদের সমান বেতন পাবেন না। আগে তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় ধাপে বেতন পেলেও এখন তারা ৫ম ধাপে বেতন পাবেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বহুবার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, ‘২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে’ (ভিশন ২০২১, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ২০০৯)।
আওয়ামী লীগ প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ইশতেহারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল প্রদান ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের বিষয়টির উল্লেখ ছিল।
এই সব প্রতিশ্রুতির সাথে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর ‘অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার’ আহ্বান শিক্ষকদের আশান্বিত করেছিল, অচিরেই হয়ত তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও এখনও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেল বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয় নি বরং তাদের অবস্থান আরও নামিয়ে দেয়া হলো। এ বিষয়ে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে যে আন্দোলন চলছে তাতে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতি স্তরের শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পে স্কেল প্রণয়নের জন্য নতুন একটি বেতন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল: ‘সকল স্তরের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধার জন্য যথাযথ ব্যবস্থার সুপারিশ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতিনিধিত্ব সংবলিত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জোর দাবি জানাচ্ছি।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Published in: http://shampratikdeshkal.com/weekly/free-speech/2015/10/03
আরো পড়ুনঃ
শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক
0 comments:
Post a Comment