মো. আবু সালেহ সেকেন্দার
অষ্টম জাতীয় পে স্কেল মন্ত্রিপরিষদে পাস হওয়ার পর প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের মতো কঠোর কর্মসূচিও তাঁরা দিয়েছেন; যদিও অষ্টম পে স্কেলে প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন বেতন কাঠামোয় 'শুভংকরের ফাঁকি' থাকায় গভীরভাবে পর্যালোচনার পর শিক্ষকতায় নিয়োজিত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকরা সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
সপ্তম পে স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল থাকায় শিক্ষকরা পদোন্নতি না পেলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর গ্রেড পরিবর্তন করে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন। অষ্টম পে স্কেলে সেই প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে। এখন পদোন্নতি ছাড়া কোনোভাবেই শিক্ষকদের গ্রেডের পরিবর্তন হবে না। ফলে আর্থিকভাবেও তাঁরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পদোন্নতির সুবিধা থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা লাভবান হবেন, এমনটি সত্য নয়। কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া জটিল ও নির্দিষ্টসংখ্যক পদে পদোন্নতি হওয়ার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা যে পদে নিযুক্ত হন, সেই পদেই অবসরে যান। সপ্তম পে স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল থাকায় পদোন্নতি না পেলেও নির্দিষ্ট সময় পর তাঁরা গ্রেড পরিবর্তনের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন। কিন্তু অষ্টম পে স্কেল বাস্তবায়িত হলে সেই পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ শিক্ষকদের মতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংকট টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সরকার যদি শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনঃপ্রবর্তন করে, তবে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংকটের সমাধান হবে না। কারণ সপ্তম পে স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবস্থান ছিল মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শতাংশ অধ্যাপক মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরের বেতন স্তর গ্রেড-১ পর্যন্ত যেতে পারতেন। কিন্তু অষ্টম পে স্কেলে গ্রেড-১-এর ওপরে সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করায় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কখনোই সেই পদে যাওয়া সম্ভব হবে না। আর যদি সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের সিদ্ধান্তে সরকার শেষ পর্যন্ত অনড় থাকে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গ্রেড-৩ পর্যন্ত যেতে পারবেন। সপ্তম পে স্কেলে তাঁদের অবস্থান ছিল মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরে। আর এখন তাঁদের অবস্থান হবে : মন্ত্রিপরিষদসচিব, সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিবের পরে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নয়, অন্য যেকোনো পেশাজীবীদের পক্ষে এমন অবনমন মেনে নেওয়া কঠিন।
তাই শুধু টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রবর্তন করে বর্তমান সংকটের সমাধান হবে না। স্বতন্ত্র পে স্কেল প্রবর্তন না করলে মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবস্থান সুনিশ্চিত করতে সরকারকে নতুনভাবে ভাবতে হবে; যদিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সরকার সিনিয়র সচিবের মতো সিনিয়র অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করার কথা ভাবছে। তবে সিনিয়র অধ্যাপক পদ সৃষ্টি বর্তমান সংকটকে আরো জটিল করে তুলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে কারা সিনিয়র অধ্যাপক হবেন সেটি নিয়ে আরেক বিতর্কের সৃষ্টি হবে। অস্থির হবে শিক্ষাঙ্গন। তাই বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের একটি ভালো উপায় হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা। আর এই স্বতন্ত্র পে স্কেল প্রবর্তনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও জাতীয় শিক্ষানীতির অঙ্গীকার থাকায় তা বাস্তবায়ন কঠিন নয়। বর্তমান শিক্ষকদের আন্দোলন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে হলেও সরকার চাইলে এ আন্দোলনকে তার অনুকূলে ব্যবহার করতে পারে। এ আন্দোলনের ফলে সরকার দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেল দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে আসছে, তা পূরণের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরকারকে এখন এই আন্দোলনের দোহাই দিয়ে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোবিরোধী গোষ্ঠীর খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
দুই.
স্বতন্ত্র পে স্কেল শিক্ষকদের নতুন কোনো দাবি নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেলের স্বপ্ন দেখিয়েছে। তারাই নানা সময়ে নানাভাবে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে স্কেল প্রবর্তন করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। সর্বশেষ মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যখন সাক্ষাৎ করেছিলেন তখনো বলা হয়েছিল, 'স্বতন্ত্র পে স্কেল অচিরেই বাস্তবায়ন করা হবে।' 'সংকটমোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সালে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই' শীর্ষক প্রবন্ধেও 'শিক্ষা' উপশিরোনামেও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে স্কেলের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। প্রবন্ধটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, '২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।' ('ভিশন ২০২১', ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা : ২০০৯, পৃ. ৫১) ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ইশতেহারেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল প্রদান ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। (পৃ. ৩৪) ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে, 'আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।' (পৃ. ৫৮) এসব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর 'অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার' আহ্বানও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেল বাস্তবায়নের বিষয়ে আশান্বিত করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও আজও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে স্কেল বাস্তবায়ন করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং উল্টো অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতনের অবনমন ঘটেছে।
তিন.
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের সংকট টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডকেন্দ্রিক হওয়ায় স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মতো তাঁরা খুব বেশি সোচ্চার নন। তবে তাঁরাও চান শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হোক। অবশ্যই বাংলাদেশকে যদি সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তবে শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। আর এই বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান দিক প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের উচ্চ বেতন নিশ্চিত করা। আর তা তখনই সম্ভব হবে যখন শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা যাবে। বিষয়টি অন্যরা না বুঝলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ভালোভাবে জানেন। তাঁরা কেবল নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি করছেন। দেশের সব শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব ছিল প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তথা সব স্তরের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবি তোলা।
তবে এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মূল ভূমিকায় থেকে প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পে স্কেল বাস্তবায়নের দাবি সরকারের কাছে উত্থাপন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি 'জাতীয় কমিটি' গঠন করা যেতে পারে। শান্তিপূর্ণভাবে ওই সমন্বয় কমিটি যদি সরকারের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরতে পারে, তবে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা করা সরকারের জন্যও কঠিন হবে না।
শিক্ষক হিসেবে আমাদের নতুন কোনো দাবি নেই। সরকার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমরা তার বাস্তবায়ন চাই। জাতীয় শিক্ষানীতি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন অধিকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমান শিক্ষকবান্ধব সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন বলে আমরা আশা করি। আর ওই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নই বর্তমান সংকটের সমাধান করবে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের ফলে যে সংকট তৈরি হয়েছে, প্রতিশ্রুত স্বতন্ত্র পে স্কেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে।
সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@gmail.com
Published in: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2015/10/02/274406
আরো পড়ুনঃ
"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
শিক্ষকদের জন্য আলাদা স্কেল হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রী-2013
শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামোর পরিকল্পনা রয়েছে: শিক্ষামন্ত্রী-2014
শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো শিক্ষানীতিতেই আছে-2015
শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো বিবেচনাধীন , প্রধানমন্ত্রী 2011
শিক্ষকদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজে মন্তব্য-2015
তথ্যবহুল লেখাটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, মো. আবু সালেহ সেকেন্দার স্যার।
ReplyDelete