Thursday, October 8, 2015

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

মো. মশিউর রহমান

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালে যখন ভালো রেজাল্ট করছিলাম তখনই মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা বাসা বেঁধেছিল যদি শিক্ষক হতে পারি তাহলে শ্রদ্ধেয় স্যারদের মতোই জাতি গঠনে সামনে থেকে ভূমিকা পালন করার একটি সুযোগ পাব। ব্যাচেলর ও মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম হওয়ায় সেই স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষাটা আরও তীব্রতর হয়ে উঠল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগ লোক প্রশাসন বিভাগের শ্রদ্ধেয় সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দীন স্যারের সঙ্গে একদিন দেখা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তোমার ক্যারিয়ার প্ল্যান কি? আমি স্যারকে বিনয়ের সহিত বলেছিলাম স্যার যদি একাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ পাই তাহলে সেদিকেই মনোনিবেশ করব।

স্যার শুনে যে জবাবটি দিলেন সেটি হলো এমন, তুমি ভালো রেজাল্ট করেছ, যাও সিভিল সার্ভিসে চেষ্টা কর, শিক্ষকতায় এখন আর আগের মেধা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েরা সিভিল সার্ভিসে ঢুকে আমাদের সামনে দিয়ে সরকারি গাড়িতে ধুলা উড়িয়ে চলে যায়, আর আমরা ছাত্রজীবনের প্রথম সারির ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর ওই গাড়ির ধুলোগুলো আমাদের পরিহিত কাপড়গুলো নষ্ট করে দিয়ে চলে যায়।

স্যারের কথা শুনে একদিকে একটু দুঃখবোধও কাজ করছিল অন্যদিকে মনের মধ্যে এও কাজ করছিল আমরা প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা যদি এই পেশায় না আসি তাহলে ওই কোটটাই পরা সিভিল সার্ভেন্টসদের তৈরি করবেন কারা? অবশেষে জাতি গঠনের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যোগ দিলাম আমার স্বপ্নের পেশা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়।

আমার বাবা আজও মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি আমার এই পেশাটি। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর চেয়ারম্যান থাকাকালে সরাসরি দেখেছেন মাঠ প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনিও হয়তো বা তার ছেলেকে ওই রকম একটি জায়গায় মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার শিক্ষকতার প্রতি প্রবল আগ্রহ, আন্তরিকতা ও কঠোর মনোভাবের কারণে আব্বু আর তেমন পেরে ওঠেননি।

আমার এ নিয়ে মোটেও আফসোস নেই, কোনো দিনও বিন্দু পরিমাণ আফসোসও হবে না। এই পেশায় এসেছি নিজেকে জানতে, পড়তে, অপরকে জানাতে, সর্বোপরি দেশের ও জাতির কল্যাণে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে। এখানে আসিনি কাড়ি কাড়ি টাকা কামাতে বা আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার দাপট দেখাতে। একটাই চাওয়া ছিল যাতে নিজের পেশায় আত্মসম্মান ও বিবেকবোধ নিয়ে চলতে পারি।

যারা জানেন খোঁজ নিয়ে দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার সীমাবদ্ধ আয় (বেতন) দিয়ে কতটা হিসাবনিকাশ করে দৈনন্দিন দিনগুলো পার করেন। তারপরও শিক্ষকদের এ নিয়ে প্রবল কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু এমন কী হলো সরকারের যে, অষ্টম পে স্কেলে হঠাৎ করে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষকদের স্কেল ও পদমর্যাদার অবনমন করতে হলো? অথচ মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে স্কেল দেওয়া।

দেশে সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ আলাদা স্কেল পেতে পারলে শিক্ষকদের আলাদা স্কেলের দাবি করাটাও কী অন্যায়? শিক্ষকদের আলাদা স্কেলের অন্যতম একটা যুক্তি হলো, এখানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা। বর্তমান স্কেলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন এই পেশা থেকে। কেননা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনেক বেতনে মেধাবীদের আকৃষ্ট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল আছে। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে আমাদের চেয়ে চার-পাঁচ গুন বেশি বেতন পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

এরই প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবি দাওয়া দিয়ে আসছিলেন। এর জবাবে কী পেলাম আমরা? মাননীয় অর্থমন্ত্রী বললেন, শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান না, বাড়িতে গিয়ে পড়ান। সর্বশেষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বললেন তা সত্যিই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনকও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নাকি সচিবদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি ভালো করে খোঁজ নেন কত শতাংশ শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। যাদের সুযোগ আছে তারা নেন। কেন নেন? শিক্ষকদেরও পরিবার আছে, তাদেরও খেতে হয়। তাদের ছেলেমেয়েদেরও একটা ভালো স্কুলে পড়াতে মন চায়। প্রচলিত স্কেলে প্রাপ্য স্বল্প বেতন দিয়ে যখন তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে যান তখনই তারা বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন ক্লাস নিয়ে বিকল্প কিছু আয় করার চেষ্টা করেন। তারা তো আর চুরি করছেন না বরং সেখানেও জ্ঞান বিতরণ করছেন। তারা তো বাংলাদেশকে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতে সহায়তা করেননি।

প্রত্যেকটি পেশারই কিছু স্বতন্ত্রতা আছে। প্রত্যেকটি পেশার নিয়োগের শর্ত ভিন্ন রকম। ধরুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে গেলে কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে শিক্ষাজীবনে চারটি প্রথম শ্রেণি থাকতে হয়। অন্যদিকে আমলা হতে গেলে এসবের বাধ্যবাধকতা নেই, পাস থাকলেই চলে। তথাপি শিক্ষক নিয়োগে যে ব্যতিক্রমগুলোও হয় তাও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নগ্ন হস্তক্ষেপেই হয়। এখানে তো শিক্ষকদের একতরফা দায়ী করার সুযোগ নেই।

দুটি পেশাই চরিত্রগত ও প্রকৃতিগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা। এগুলোর মাঝে আসলে তুলনা হয় না। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ৪ অক্টোবর সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, শিক্ষকদের নাকি একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছেন, কমিয়ে দেওয়া উচিত। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে আরও বলেছেন, একজন শিক্ষক সচিবদের থেকে যে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পান সেগুলো পত্রিকার মাধ্যমে তাদের তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। আমার মোটেও ইচ্ছে নেই সচিবদের সঙ্গে শিক্ষকদের তুলনায় যাওয়ার। তবে যৌক্তিক কারণেই জনমনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য কয়েকটি দিক উল্লেখ করা প্রয়োজন।

একজন সচিব সার্বক্ষণিক পাজেরো, প্রাডোর মতো কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল গাড়ি পান এবং এ গাড়িগুলো সচিব ছাড়াও তার স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের লোকজনকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বর্তমানে যুগ্ম সচিব ও তার ওপরের কর্মকর্তারা গাড়ি ক্রয়ের জন্য ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারি কোষাগার থেকে ঋণ নিতে পারেন। এর পাশাপাশি ওই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও গাড়ি চালকের খরচ বাবদ প্রতি মাসে ৪৫ হাজার টাকা করে পান। আর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শ্রেষ্ঠ মেধাবী শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার সচিব তৈরির কারিগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে চলেন পাবলিক বাসে অথবা রিকশায়। তা ছাড়া সরকারি আবাসিক প্রকল্পসমূহে প্লট, ফ্ল্যাট ও গৃহ ঋণের প্রায় অনেকটাই তো আমলারই ভোগ করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এগুলো থেকেও বঞ্চিত হন। এমনকি ক্যাডারভুক্ত সরকারি কর্মকর্তারা অফিশিয়াল (নীল) পাসপোর্ট পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এ সুবিধাও পান না। উল্লেখ্য অফিশিয়াল পাসপোর্টের অধিকারী ব্যক্তিদের সার্কভুক্ত দেশসহ ৩২টি দেশে যাওয়ার জন্য কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো দেশি বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করা এবং সে জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে বিতরণ করা। কিন্তু পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তুলনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর আর আমলাদের ৫৯ বছর। দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমাই নেই। তারা যত দিন সক্রিয় ও সক্ষম থাকেন তত দিন শিক্ষা ও গবেষণা কার্য চালিয়ে যান। একজন শিক্ষক মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত শিক্ষক থাকেন। কেননা, একজন শিক্ষক যত সিনিয়র হন ততই তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আরও শাণিত হয়। যেটি আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা খাতকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এ ছাড়া যে কোনো দেশে সরকারি চাকরিজীবীদের বয়স নির্ধারিত হয় সে দেশের মানুষের গড় আয়ুর ভিত্তিতে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭০ বছর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সসীমার কথা না ভেবে সব সরকারি চাকরিজীবীদের বয়সসীমা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয় এখনো মান্ধাতার আদলে। বিসিএস পরীক্ষার মেধাক্রম অনুসারে তবে বিভাগীয় পরীক্ষা পাস করা সাপেক্ষে। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পদোন্নতির গুঞ্জনও পত্রিকায় দেখতে পাই। তাদের পদোন্নতির জন্য দেশে কিংবা বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রধান শর্ত হলো গবেষণা, প্রকাশনা ও উচ্চতর ডিগ্রি। অথচ উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন না থাকলেও ক্যাডারদের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে উচ্চশিক্ষা খাতে বিরাট অঙ্কের টাকা বরাদ্দ থাকে। কোনো কর্মকর্তা বিদেশে ভর্তি নিতে পারলেই সে তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আসা উচ্চশিক্ষার অধিকাংশ স্কলারশিপ এখন আমলারই ভোগ করে থাকেন সুকৌশলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এসব সুবিধা থেকে এখন প্রায় বঞ্চিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন শিক্ষকেরা নিজেদের চেষ্টায় স্কলারশিপ অর্জন করেন।

এত কিছুর পরও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তো এগুলো চাইনি আপনার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা চেয়েছি আমাদের পদের কেন অবনমন করা হলো সেটার প্রতিকার। আমরা চেয়েছি জাতি গঠনের এই পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে গেলে স্বতন্ত্র পে স্কেলের বিকল্প নেই। কেননা বৃক্ষ যদি উর্বর কিংবা শক্তিশালী না হয় তাহলে ভালো ফলন কীভাবে আশা করবেন? আপনি বলেছেন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বন্ধ করে শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন কেন? আমার জানামতে শিক্ষকদের আন্দোলনে ক্লাস পরীক্ষা খুব কম সময়েই বন্ধ থাকে। কিন্তু আপনাদের সব রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন মাসের পর মাস বন্ধ থাকে, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধ থাকে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে লাশ পড়ে তখন যদি আপনি একইভাবে কনসার্ন থাকতেন তাহলে আজকের আপনার এই প্রশ্ন নিয়ে কারও প্রশ্ন থাকত না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ৯১ ভাগ বেতন বাড়িয়েছেন। এ তথ্যের মধ্যেও কিছুটা বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ আছে। এটি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। আগের স্কেলে যেখানে একজন অধ্যাপক ২৯ হাজার টাকা স্কেল দিয়ে শুরু করে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের সুবিধা নিয়ে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা (গ্রেড-১) স্কেলে বেতন পেতেন যেটি সচিবরাও পেতেন। কিন্তু সম্প্রতি সরকার সচিবদের ওপরে সিনিয়র সচিব নামে পদ সৃষ্টি করে তাদের জন্য গ্রেড ১-এর ওপরে বিশেষ স্কেল প্রবর্তন করেছেন (৮২০০০ টাকা স্কেল)। স্বাভাবিকভাবে সিনিয়র অধ্যাপকগণও ওই বিশেষ স্কেল প্রাপ্য হওয়ার দাবি তুলতে পারেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকেরা যারা সচিবদের সমান স্কেলে গ্রেড ১-এ বেতন পেতেন তাদের বিশেষ স্কেল তো পরের কথা সেই সিলেকশন গ্রেডটিই তুলে দিয়ে অধ্যাপকদের গ্রেড ৩-এ (নির্ধারিত ৫৬ হাজার টাকা) নামিয়ে দেওয়া হলো অষ্টম পে স্কেলে। এর ফলে কোনো অধ্যাপকের আর গ্রেড ১-এর বেতন সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকল না। সে ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৫০ ভাগেরও কম এবং পদের তিন ধাপ অবনমন করা হয়েছে।

আর পে স্কেলে যতটুকুই বেতন বাড়ানো হয়েছে সেটা কী শুধু শিক্ষকদের জন্য বাড়ানো হয়েছে? এটা তো প্রতি চার-পাঁচ বছর পরপর মুদ্রাস্ফীতিজনিত কারণে নিয়মিত বেতন বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া মাত্র। তাই বলে কী দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষকদের পূর্বেকার পদের অবনমন করা কতটা যৌক্তিক? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলেছেন শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান না বাড়িতে গিয়ে পড়াবেন বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়ান এটা জীবনে এই প্রথম শুনেছি। উনি মনে হয় কলেজের চিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে করে ফেলেছেন।

যা হোক শিক্ষকেরা পদমর্যাদা চাইতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে যে নানামুখী তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন সেটা মোটেই কাম্য ছিল না। আজকের চারিদিকের নানামুখী এই বিভ্রান্তিকর অভিযোগে শিক্ষকেরা একবার অভিযুক্ত হয়ে গেলে এটি ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় সূচিত হয়ে থাকবে। মেধাবীরা আর এই পথে পা বাড়াবে না। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আর কোনো মেধাবী সন্তান দেশে আসবেন না। পরাজিত হবে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, পরাজিত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

এখনো সময় আছে, কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বাস্তবতা উপলব্ধি করুন, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করুন, শিক্ষকদের পদমর্যাদা সংরক্ষণ করুন। মনে রাখা ভালো জাতির সকল ক্রান্তিকালে বিশেষ করে ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭১, ১৯৯০ ও সর্বশেষ ১/১১ তে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আজকের শিক্ষক সমাজ পরাজিত হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরাজিত হবে। 

(লেখক সহকারী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না)

0 comments:

Post a Comment