মুসতাক আহমদ
শিক্ষকরা আর সরকারি অনার্স-মাস্টার্স এবং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে পারবেন না। অষ্টম পে-স্কেলে নির্দেশিত গ্রেড বিন্যাসের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসতে যাচ্ছেন। এছাড়া শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হাত থেকে চলে যাচ্ছে। মূলত এসব বন্ধে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। তারা বৈষ্যম্য নিরসনে পাঁচ স্তরের পদ এবং নয় স্তরের বেতন কাঠামো দাবি করছেন।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব আইকে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার যুগান্তরকে বলেন, অষ্টম পে-স্কেলে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ ধাপ ‘অধ্যাপক’ পদ ৪র্থ গ্রেডে নামিয়ে আনা হয়েছে। অথচ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের পদ তৃতীয় গ্রেডের। গ্রেড পার্থক্যের কারণে একজন অধ্যাপক, অধ্যক্ষ পদে যেতে পারবেন না। শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত। এসব পদেও শিক্ষকদের যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় চতুর্থ গ্রেডের অধ্যাপকের পক্ষে তৃতীয় বা তদূর্ধ্ব পদে যাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা প্রশাসনে সর্বোচ্চ উপ-পরিচালক হতে পারবেন শিক্ষকরা। তিনি আরও বলেন, এসব সমস্যা সমাধানেই আমরা সরকারকে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। সেই সঙ্গে তিন দফা দাবিও জানিয়েছি। প্রস্তাবের মধ্যে আছে, পাঁচ স্তরের পদবিন্যাস করতে হবে। সর্বোচ্চ ধাপ হবে সিনিয়র অধ্যাপক। আর বেতন কাঠামো করতে হবে নয় স্তরের। অনুমোদিত অষ্টম পে-স্কেলে সৃষ্ট বৈষম্য ও ক্ষতি নিরসনে এই ‘রিমেডির’ (সমাধান) বিকল্প নেই।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগামীতে কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে শিক্ষকরা থাকতে পারছেন না’ এ ধরনের সমস্যার কথা তারা আমাকে জানিয়েছেন। আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝে নিয়েছি। এগুলো নিয়ে কমিটির সদস্যরা বসব। আসলে শিক্ষা পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি এসব সমস্যা নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবেও কথা বলতাম। এখন কমিটিতে থাকার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে বলার সুযোগ পাব। সেখানে এসব তুলে ধরব। আশা করছি, সমস্যা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, ‘আসলে কারও সঙ্গে তুলনা করে নয়, মর্যাদা-ইজ্জত-সম্মান আর বেতনভাতার দিক থেকে আমরা শিক্ষকদের উচ্চকিত করতে চাই। সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও এ বিষয়ে সহানুভূতি রয়েছে।’
জানা গেছে, বর্তমানে কলেজ শিক্ষকদের চার স্তরের পদবিন্যাস রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক। সপ্তম পে-স্কেলে তারা আট স্তরে বেতন পেতেন। সম্প্রতি শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক এক নম্বর গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। সেই হিসাবে ৯টি গ্রেডেই যাওয়ার সুযোগ ছিল শিক্ষকদের। তবে অষ্টম পে-স্কেলে বেতন কাঠামো ৬টি স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে। অধ্যাপক পদ চতুর্থ গ্রেডে স্থির করায় তাদের মহাপরিচালক তো দূরের কথা, মাউশির পরিচালক, বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এমনকি কলেজের অধ্যক্ষ পদে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।
এ প্রসঙ্গে আইকে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার বলেন, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তম পে-স্কেলে অধ্যাপকদের প্রারম্ভিক গ্রেড ছিল ৪র্থ। ৫০ ভাগ সিলেকশন গ্রেড পেয়ে ৩য় গ্রেডে উন্নীত হতেন। সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকরাই বিভিন্ন অনার্স-মাস্টার্স ও ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ হতেন। এরাই ২য় গ্রেডের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন। দুটি মহাপরিচালকের পদ সম্প্রতি এক নম্বর গ্রেড করা হয়েছে। সেখানেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বসার সুযোগ ছিল। কিন্তু অষ্টম পে-স্কেলে শিক্ষকদের চতুর্থের পর অন্য কোনো গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।
শিক্ষা ক্যাডারে বর্তমানে মোট সদস্য ১৫ হাজারের বেশি। এদের দাবি সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল করা হোক। অন্যথায় পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তারা যে ক্ষতির শিকার হবেন তা কখনও পূরণ হবে না। গত কয়েকদিন এই ক্যাডারের ব্যাচভিত্তিক বিভিন্ন ফোরামের নেতাদের সঙ্গে যুগান্তরের আলোচনা হয়। ক্ষতির শিকার বিভিন্ন ব্যাচের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ২৪তম বিসিএসের শিক্ষক। এই ব্যাচের ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ‘আমরা ২২৪৬ জন বিগত ১০ বছর ধরে প্রভাষক পদে আছি। মাত্র ১২ ঘণ্টার জন্য সিলেকশন গ্রেড বঞ্চিত হয়েছি। কবে নাগাদ পদোন্নতি পাব, তার নিশ্চয়তা নেই। সিলেকশন গ্রেডও বাতিল হয়েছে। সরকার এটা বাতিল করায় এখন আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি।’ ১৬তম ব্যাচের কর্মকর্তা ঢাকা বোর্ডের কলেজ উপ-পরিদর্শক মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। তিনি এখনও সহকারী অধ্যাপক। এভাবে বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। বঞ্চিত এসব কর্মকর্তারা বলছেন, যদি সরকার সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল না করে, তাহলে আমাদের দাবি থাকবে, পদবিন্যাস ও বেতন কাঠামো আরও তিনটি বাড়ানো হোক। এক্ষেত্রে ৮ স্তরের পদ চাইব। সেগুলো হচ্ছে- অধ্যাপক, সিনিয়র অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সিনিয়র সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষক, সিনিয়র প্রভাষক। এভাবে করা হলে দুটি উপায় হবে। একটি হচ্ছে, শিক্ষা ক্যাডারের উপরের পদগুলো আর অপদখলের আশংকা থাকবে না। অপরটি হচ্ছে, পদোন্নতি বঞ্চনা দূর হবে।
এ বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের দাবি সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করা হোক। তা না হলে সরকার যদি বিকল্প প্রস্তাব চায়, তবে আমরা সমিতির সাধারণ সদস্যদের আবেগ ধারণ করে ৮ স্তরের পদবিন্যাস দাবি করব। তিনি বলেন, এখানেই বিষয়টি শেষ নয়। পরিকল্পনা কমিশনে বর্তমানে একজন অধ্যাপক ডেপুটেশনে কর্মরত আছেন। অধ্যাপকদের ৪র্থ গ্রেডে আটকে দেয়ায় এক নম্বর গ্রেডের এই পদে আর কখনোই শিক্ষকরা যেতে পারবেন না।
গত ৭ অক্টোবর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তারা ৩ পৃষ্ঠার প্রস্তাব ও দাবিসংবলিত স্মারকলিপি দেন। তাতে তারা ২৯ ক্যাডারের একটি হিসেবে অন্য ক্যাডারে মতো গাড়ি কেনা বাবদ ৩০ লাখ টাকা বিনা সুদে ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসে ৪৫ হাজার টাকা ভাতাও দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নাসরীন বেগম বলেন, এই একটি ভাতার কারণে শিক্ষকরা অন্য কর্মকর্তাদের থেকে মাসে কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন। অথচ সব কর্মকর্তাই পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) একই যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছি। আমরা সব ধরনের বৈষম্যের নিরসন চাই।
Published in: http://www.jugantor.com/first-page/2015/10/13/336197
0 comments:
Post a Comment