Wednesday, October 7, 2015

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা দুই ভাগ - ফেডারেশন-সমিতি মুখোমুখি, ফেডারেশন থেকে জগন্নাথকে বহিষ্কার

শরীফুল আলম সুমন

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার বৈঠকের পর আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা। এর মধ্যে দাবির পক্ষে ঘোষণা না এলে ১ নভেম্বর থেকে লাগাতার কর্মবিরতির হুমকিও দিয়ে রেখেছিল ফেডারেশন। কিন্তু এক দিন যেতে না যেতেই ফেডারেশনের বাইরে গিয়ে আলাদাভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ও ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না। শিগগিরই তারাও কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে। এতে ফেডারেশন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিগুলো মুখোমুখি অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অথচ চলতি মাসের পুরোটাজুড়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা। ফলে সেই পরীক্ষাও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, ফেডারেশন তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকরা ফেডারেশনের এই নমনীয়তা মেনে নিতে চান না। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতাদের ওপরই চাপ বাড়ছে। ফলে ফেডারেশনের বাইরে গিয়েও কর্মসূচির চিন্তাভাবনা করছেন শিক্ষকরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ফেডারেশনের গত মঙ্গলবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরা। ফলে গতকাল বুধবার জরুরি সভা আহ্বান করে শিক্ষক সমিতি। এতে প্রায় আড়াই শ শিক্ষক অংশ নেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় সব ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষকদের অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আগামী শুক্রবারই 'বি' ইউনিটের পরীক্ষার মাধ্যমেই শুরু হওয়ার কথা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভর্তি পরীক্ষা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রত্যেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাও নিজস্ব। তাই আমাদের সাধারণ শিক্ষকরা যদি চান তাহলে আমাদের কর্মসূচি ঘোষণার অধিকার রয়েছে। ফলে সব শিক্ষকের সম্মতিক্রমেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিক্ষকরা পরীক্ষা নেবেন না, তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই ঠিক করবে তারা কী করবে?'

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখনো আগামী শুক্রবারে অনুষ্ঠিতব্য ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করে নাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কাল (আজ বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টায় একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করা হয়েছে।'

জানতে চাইলে ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি আমাদের না জানিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এটা ফেডারেশনের নিয়মনীতিবহির্ভূত। তাই ফেডারেশন তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'

গতকাল রাতে ফেডারেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জানানো যাচ্ছে যে ফেডারেশনের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে ফেডারেশন থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হলো। আজ (গতকাল) থেকেই এটি কার্যকর হবে।

জানা যায়, ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্তের পর ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন সাধারণ শিক্ষকরা। একই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে এভাবে বহিষ্কার কারোই কাম্য নয় বলে জানান শিক্ষকরা।

নাম প্রকাশ না করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নেতা বলেন, 'ফেডারেশনের কয়েকজন নেতা তাঁদের নিজেদের মতো কর্মসূচি দিতে চান। সাধারণ শিক্ষকদের মতামতের মূল্য তাঁরা ঠিকমতো দেন না। অথচ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি নিয়েই এই ফেডারেশন। আসলে ফেডারেশনের কয়েকজন নেতা এমনভাবে চলতে চান, যাতে সরকারের সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্ক নষ্ট না হয়।'

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক দুলাল নন্দী চন্দ্র গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরাও পৃথক কর্মসূচির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছি। শিক্ষকদের পদমর্যাদার যেভাবে অবনমন করা হয়েছে সেটা অশনিসংকেত। আসলে শিক্ষাকেই অবনমন করতে একটা গোষ্ঠী এজেন্ডা নিয়ে নেমেছে। তবে এখনো প্রধানমন্ত্রী আমাদের শেষ ভরসা। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমাদেরও বিকল্প চিন্তা করতে হবে। ১১ অক্টোবর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। এরপর সাধারণ সভা আহ্বান করে কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক খসরুল আলম কুদ্দুছী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যে সাধারণ শিক্ষকদের মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছি। সরকারের এই আচরণে আমরা খুবই মর্মাহত। ফেডারেশনের বাইরে কর্মসূচি দেব কি না তা সাধারণ শিক্ষকদের ওপরই নির্ভর করবে। জগন্নাথের শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণেই তাঁরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমি তাঁদের এই সিদ্ধান্তকে স্যালুট করি।'

ফেডারেশনের সহসভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা গতকাল বলেন, 'শিক্ষকদের আন্দোলন অবশ্যই লিগ্যাল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাই তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কিছুটা হলেও এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।'

ফেডারেশনের অন্য সহসভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক খবির উদ্দিন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসলে আগামী ১ নভেম্বর থেকে ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে লাগাতার কর্মবিরতিতে যাওয়ার যে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে এর চেয়ে বড় কর্মসূচি তো হতে পারে না। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি হয়তো তাদের সাধারণ শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে পারেনি। কিন্তু আমরা পেরেছি। তাই ফেডারেশনের বাইরে কিছু করছি না।'

গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষক নেতারা পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। এগুলো হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের জন্য বেতন কমিশন; স্বতন্ত্র বেতন স্কেল বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ঘোষিত অষ্টম বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণ, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে (পদমর্যাদা ক্রম) শিক্ষকদের প্রত্যাশিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী পদমর্যাদা নিশ্চিতকরণ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও নিশ্চিতকরণ।

ঢাবির সাদা দলের বিবৃতি : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ এবং তাঁদের চলমান আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিএনপি সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন সাদা দল। সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আমিনুর রহমান মজুমদার ও অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, 'অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গ্রেড অবনমন এবং তাঁদের মর্যাদাহানির প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন এবং শিক্ষকদের সম্পর্কে গত ৪ অক্টোবর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা বিস্মিত, লজ্জিত ও হতাশ। তাঁর এ অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যে গোটা শিক্ষক সমাজ অপমানিত ও মর্মাহত হয়েছে।'


Published in: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-age/2015/10/08/276775

0 comments:

Post a Comment