Saturday, October 3, 2015

মন্ত্রিসভা কমিটি কি অনুধাবন করবে?

মেজবাহ উল আজম সওদাগর
যে কোনো বিপ্লব বা আন্দোলনের পেছনে আন্দোলনকারীদের বঞ্চনার অনুভূতিই কাজ করে বেশি। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলও বিপ্লবের একই কারণ দেখিয়েছেন। ফলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। কূটনীতি, আলোচনা বা মধ্যস্থতার কৌশল ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু বঞ্চনার অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করার যে কোনো চেষ্টা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন ও দাবির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাস, যাকে বুঝতে হলে এদেশের আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনমান এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের একটি তুলনামূলক চিত্র দেখানো প্রয়োজন। মন্ত্রিসভা কমিটিকে এ তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বঞ্চনার অনুভূতিকে অনুধাবন করতে হবে এবং তবেই আলোচনা সফল হবে বলে মনে করি।
বেতন ও পদমর্যাদা সংক্রান্ত বৈষম্য নিয়ে এদেশের আমলাতন্ত্র কীভাবে সরকারকে ভুল বোঝায়, তা প্রমাণের জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯ আগস্ট দৈনিক কালের কণ্ঠ লিখেছে, প্রশাসন ক্যাডার বাদে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সমন্বয় কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল নিয়ে ভুল ভাঙল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। তিনি বলেন, আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে আমার ধারণা সঠিক ছিল না। তাই আমাকে এটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এ থেকে পরিষ্কার, সরকারকে কীভাবে ভুল বোঝানো হয়। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে থাকার সুবিধা নিয়ে নিজেরাই নিজেদের সুবিধাগুলো বারবার নিতে নিতে আর অন্যদের বঞ্চিত করতে করতে ব্যাপক আন্তঃক্যাডার বৈষম্য তৈরি করেছেন। অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্টধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারি সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত করতে করতে এই কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব চরমে উঠে গেছে। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে থেকে নিজেই নিজের সুবিধা নেয়া আর অন্যদের বঞ্চিত করা কত বড় করাপ্ট প্র্যাকটিস, তা বিবেচনায় নিতে হবে মন্ত্রিসভা কমিটিকে।
১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নির্ধারণের জন্য ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স-১৯৮৬ নামক একটি আইন করা হয়। সেখানে একজন অধ্যাপকের মর্যাদা কত নিচে নামানো হয়েছে! ২৩ নম্বরে। সামান্য যুগ্ম সচিবেরও নিচে। আর সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে ১৮ নম্বরে, একজন অতিরিক্ত সচিবের সমান। সিলেকশন গ্রেড উঠিয়ে দিলে একজন সিনিয়র অধ্যাপকেরও মর্যাদা গিয়ে দাঁড়াল যুগ্ম সচিবেরও নিচে। আমলাদের বিশ্ববিদ্যালয়বিদ্বেষী মানসিকতার দ্বারা সৃষ্ট দেশের সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্টধারীদের কী কারণে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পেছনের চেয়ারে বসার এ আইনি ব্যবস্থা হয়েছে তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা এখনও কেউ দেননি। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিকে লোপ্রোফাইল জবে পরিণত করার একটি চক্রান্ত। আর বেতন গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিচে নামানোর কাজটি এই সুদূরপ্রসারী চক্রান্তেরই অংশ বলে এখন প্রমাণিত। এবার নতুন কিছু করা হয়নি, ষোলোকলা পূর্ণ করা হয়েছে মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও প্রমোশন নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। আমিও তুলি এবং প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিকে লোপ্রোফাইল জবে পরিণত করার অপচেষ্টা কেন? আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির অভিযোগ তো আরও প্রবল, এমনকি ভয়ংকর। বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে প্রথম বানানোয় প্রধান ভূমিকা পালনকারী আমলাদের স্বার্থ এতটা উপরে কেন, তা এক প্রশ্ন বটে। দুদকের তথ্য অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডার এখন দুর্নীতির শীর্ষে (কালের কণ্ঠ ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)। বাংলাদেশ সরকারের ১৭ অতিরিক্ত সচিব ও ৩৭ যুগ্ম সচিবের শিক্ষাজীবনে একাধিক তৃতীয় বিভাগসহ টেনেটুনে পাস করার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৮৪ ব্যাচের একজন যুগ্ম সচিব তৃতীয় বিভাগ পেয়ে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। উপসচিব থাকাকালে ২০০৬ সালে তিনি প্রাইম ইউনিভার্সিটির অবৈধ একটি শাখা থেকে এলএলবি ও পরে এমবিএর সার্টিফিকেট জোগাড় করে পদোন্নতি বাগিয়েছেন। দুজন যুগ্ম সচিব অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাধিক ডিগ্রি নিয়েছেন বলে জানা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী পদে চাকরির জন্য পৃথিবীর কোথাও এক্সট্রাঅর্ডিনারি মেধাবীরা ভিড় জমান না (দৈনিক শিক্ষাডটকম, ২৭ জুলাই ২০১৫)। কিছুদিন আগে শিক্ষা ক্যাডারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে প্রশাসন ক্যাডারের একজন জুনিয়র কর্মকর্তার পা ধরে মাফ চাওয়াতে বাধ্য করানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তাকে উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তি এখনও দেয়া হয়নি। পরীক্ষার সময় সরকারি কলেজে গিয়ে শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ওপর প্রশাসন ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তাদের ওপর খবরদারি করার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এছাড়া প্রায় সব ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের কাছে অপমানিত হচ্ছেন। শিক্ষা ক্যাডারটিকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এখন বিসিএসে পছন্দ তালিকার সর্বনিুে থাকে শিক্ষা। শিক্ষাকে কেন এভাবে টার্গেট করে শেষ করা হচ্ছে তার জবাব খুঁজতে হবে এখনই।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা কেন প্রাথমিক শিক্ষার ডিজি বা সচিব হবেন? এখানে কেন শিক্ষা ক্যাডার নয়? কেন শিক্ষা ক্যাডার শিক্ষা সচিব হতে পারেন না? একইভাবে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা কেন স্বাস্থ্য সচিব হবেন না? পোস্টাল ক্যাডার কেন তার মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে পারেন না? পুলিশ কেন সচিব হতে পারেন না? সব সচিবের পদ কেন প্রশাসন ক্যাডারের দখলে? সচিবের স্ত্রী-সন্তানরা রাষ্ট্র পরিচালনায় কী অবদান রাখেন যে তাদের পরিবারকেও বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতে হবে? বড় বড় করাপ্ট প্র্যাকটিসের কারণ অনুসন্ধান না করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিগ্রেডেড করা হচ্ছে। আমলাদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর খবরদারিত্ব করার, তারই প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয় নীতিতে। বিশ্ববিদ্যালয় আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়- তা আমলারা বোঝেন বলে মনে হচ্ছে না। এছাড়া আলী ইমাম মজুমদারের বক্তব্য অনুযায়ী আমলারা যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী অধ্যাপকরা তা কীভাবে মানবেন, একটি বড় প্রশ্ন। একজন সচিব বা যুগ্ম সচিবের সরকারি কোয়ার্টার থেকে সচিবালয়ে অফিস করতে প্রাডো, মিতসুবিশি পাজেরো দরকার। তাদের স্ত্রীদেরও দরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চেয়ারম্যান, ডিনদের এগুলো দরকার নেই- এ সুবিধাবাদী বক্তব্য সরকারের মাথায় ঢুকিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়বিদ্বেষী আমলারা। আমলাদের যেমন বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রয়োজন, এর চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের। কিন্তু বিদেশে পড়াশোনার জন্য প্রতি বছর আমলাদের সম্ভবত প্রায় একশ জনকে ৩০ লাখ করে টাকা দেয়া হয় এবং দেখা যায় এজন্য কোনো বছরই যোগ্য প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। তারা কষ্ট করে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে স্কলারশিপ ম্যানেজ করে বিদেশে যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে এ বৈষম্য আরও প্রকট। যদিও এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রধান কাজগুলোর একটি; কিন্তু এজন্য তারা কোনো সরকারি বরাদ্দ পান না। অন্যদিকে একজন যুগ্ম সচিব থেকে সচিব প্রতিবছর কতবার বিদেশে যান সম্মেলনের নাম করে তা যাচাই করে, তার ইয়ত্তা নেই। এ ক্ষেত্রে সম্মেলনে অংশ নিতে যে পেপার প্রেজেন্ট করার প্রয়োজন তা লেখার বা তার একটি অ্যাবস্ট্রাক্ট লেখার দক্ষতা এদের আছে কি-না, তা কেবিনেট সচিবের বক্তব্যকে ভিত্তি ধরেই খুঁজে দেখার সময় এসেছে। এগুলো নিয়ে কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়বিদ্বেষী আমলাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদাহানি করে একে লোপ্রোফাইল জবে পরিণত করা হচ্ছে।
এখন নতুন নিয়ম করা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়া কেউ অফিসিয়াল পাসপোর্ট পাবেন না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও পাবেন না। এর অর্থ কী? যারা বিদেশ সফর করেন তারাই জানেন অফিসিয়াল পাসপোর্টের সুবিধা কী। এ সুবিধাটি কেন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা পাবেন না, এমনকি বিমানবন্দরে কেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ভিআইপি লাউঞ্জও ব্যবহার করতে পারবেন না, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা কেউ দেন না। একদিকে শিক্ষকদের নিয়ে নীতিকথার ফুলঝুরি আর অন্যদিকে অপমান করার সব আইনি ব্যবস্থা?
মন্ত্রিসভা কমিটির আলোচনা তখনই সফলতার মুখ দেখবে যখন এ বঞ্চনার ইতিহাস অনুধাবন করে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে। এ বঞ্চনার নেপথ্য অনুধাবনের মধ্যেই এদেশের সাম্প্রতিক শিক্ষা খাতের সংকট উত্তরণের মূলসূত্র নিহিত। আমরা আশাবাদী যে মন্ত্রিসভা কমিটি সে পথেই হাঁটবে।
মেজবাহ উল আজম সওদাগর : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
samezbah@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment