অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
অষ্টম পে-কমিশনই দেশের শেষ পে-কমিশন। এরপর থেকে প্রতি বছর জুলাই মাসে একটা নির্দিষ্ট শতকরা হারে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে। নতুন পে-কমিশন গঠন করা লাগবে না, যতটুকু জানি এমন একটি সুপারিশই মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত হয়েছে সচিব কমিটি কর্তৃক পরিমার্জিত ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন অষ্টম পে-কমিশনের রিপোর্ট। প্রত্যেকবার পে-কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে গেলেই কিছু ঝামেলা হয়, এবারও হচ্ছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা অবনমিত করা, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড রহিত করা, বিভিন্ন ক্যাডারকে বঞ্চিত করে কারও কারও জন্য সুপার গ্রেড প্রবর্তন, ক্যাডারভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি ইত্যাদি। অভিযোগ ও বঞ্চনা নিরসনের জন্য একটি কেবিনেট কমিটিও গঠন করা হয়েছে। প্রত্যাশা মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত এই কেবিনেট কমিটি আলোচনার মাধ্যমে অসন্তোষ দূরীকরণে সমর্থ হবে এবং পে-কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে বিদ্যমান জটিলতার আপাতত সমাধান হবে। যদিও সর্বস্তরের শিক্ষকের জন্য একটি আকর্ষণীয় বেতন কাঠামোর আন্দোলন অব্যাহত থাকবে, যা চলে আসছে প্রায় দুই-তিন দশক ধরে। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর যে সমস্যাটা থেকে যাবে সেটা একটা 'সাইকো-পলিটিক্যাল' সমস্যা। মনে রাখতে হবে অর্থনীতি কেবলই অর্থনীতি ছিল না আরও কয়েক শতক আগেও। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত অ্যাডাম স্মিথের 'ওয়েলথ অব নেশন' বা আরও বহু আগের কৈটল্যের 'অর্থসাশ্রয়'কে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। বর্তমান অর্থনীতির পুরোটাই পলিটিক্যাল ইকোনমি। প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে যেমন রাজনীতি থাকে তেমনি সিদ্ধান্তের প্রভাবও রাজনীতি বিযুক্ত হবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত আটটি পে-কমিশন হয়েছে। সবগুলোর পেছনেই ছিল রাজনৈতিক অঙ্গীকার। জীবনযাত্রার ব্যয় যখন বেড়ে যায়, ভিন্ন অর্থে নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবী ছাড়া অন্যদের আয় যখন বেড়ে যায় (যেমন- যাত্রীসাধারণের জন্য রিকশা ভাড়া বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে রিকশাওয়ালার আয় বেড়ে যাওয়া) তখনই সরকার বাধ্য হয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে পে-কমিশন গঠন করে এবং রিপোর্টের ভিত্তিতে বেতন বৃদ্ধি করে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতেও বেতন বৃদ্ধি হয়, যদিও বেসরকারি খাতের বেতন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময়ই সরকারি খাতের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা ও মনোবল ধরে রাখার জন্য এর বিকল্প কিছু নেই। হার্জবার্গের 'টু ফ্যাক্টরস্ থিউরি' মনে রেখেই বলছি, বেতন বৃদ্ধি প্রণোদনার ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর উপাদান না হলেও অন্যান্য প্রণোদনার ভিত্তি তৈরি করে বেতন।
দেশে যখন নির্বাচন আসে সবাই নতুন কিছু প্রত্যাশা করে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সার্বিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার মানুষ শুনতে চায়। আমরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলি স্থূল অর্থে কেবল নির্বাচনকেই বুঝে থাকি। যদিও গণতন্ত্র আর নির্বাচন সমার্থক নয়। নির্বাচনের স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী কাজে তাদেরকেই ব্যবহার করে। নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল প্রয়োজনীয় জনবলের এক-শতাংশেরও কম। নির্বাচনের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে কর্মচারীদের ঐকান্তিক সহযোগিতা, তাদের নিরপেক্ষতা এবং দায়িত্ববোধের ওপর। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের জন্য বিভিন্ন অঙ্গীকার করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলের পক্ষে ভোটদানের জন্য আহ্বান জানায়। কোনো রাজনৈতিক দল বা নির্বাচন কমিশন যদি চায় সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উৎসবের আমেজ নিয়ে নিরপেক্ষ ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করুক (যেটা তাদের শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতাও বটে), সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও দেশের সার্বিক উন্নয়নের অঙ্গীকারের মধ্যেই সরকারি কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে কীভাবে লাভবান হবেন তা বলতে হবে। সেই অঙ্গীকারের ওপরই নির্বাচনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য কাজে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অনেকাংশে নির্ভর করবে। আইনি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের উদ্বুদ্ধ করা অনেকাংশেই সম্ভব হবে না।
স্বাভাবিক অবস্থায় ২০১৯ সালে আমাদের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের মেনোফেস্টোতে যদি রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষণা দেয় যে, ২০২০ সালে আমাদের নবম পে-কমিশন হবে, তবেই সরকারি কর্মচারীদের নির্বাচনের মতো ঝামেলাযুক্ত কাজে সক্রিয় ও উদ্বুদ্ধ করা যাবে। সে পথ অষ্টম পে-কমিশন রিপোর্টে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি উচ্চপর্যায়ের আমলাদের জন্য ভালো (যারা ফিল্ড লেবেলে নির্বাচনের কাজ করে না), কারণ প্রতিটি পে-কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের ঝামেলাগুলো তাদের পোহাতে হবে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। নির্বাচনী অঙ্গীকারে সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রাপ্তির কোনো বিষয় থাকবে না অথচ একটি সফল, ত্রুটিমুক্ত এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব দায়িত্ব তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করবে এমনটি আশা করা একেবারেই বাস্তবতা-বিবর্জিত একটি ধারণা। পাঁচ বছর অন্তর অন্তর পে-কমিশন এটা নিছক 'ইকোনমি'র বিষয় না, এটা 'পলিটিক্যাল-ইকোনমি'র বিষয়। পে-কমিশন না করে বছর বছর বেতন বাড়ানোর ধারণাটি অর্থনীতি ও হিসাব বিজ্ঞানসম্মত হলেও এটি রাজনীতি-বিবর্জিত। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। অষ্টম পে-কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত বছর বছর বেতন বৃদ্ধি প্রক্রিয়াটি গ্রহণ করলে এর বাস্তবায়ন সহজ হবে এবং হিসাব বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সঠিকভাবেই কাজটি সম্পন্ন হবে। তবে কাজটি সঠিক কাজ কিনা ভেবে দেখতে হবে রাজনীতিবিদদের। পিটার ড্রাকার যেমনটি বলেছিলেন 'সঠিক কাজটি করা' 'সঠিকভাবে কাজটি করার' চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে ভালো হয় সঠিক কাজটি যদি সঠিকভাবে করা যায়।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Published in:http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/10/04/109784
0 comments:
Post a Comment