গোলাম মোর্তোজা
লেখার মূল বিষয়ে প্রবেশ করার আগে স্পষ্ট করে বলে রাখি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছেন তা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করি। প্রাইমারি-মাধ্যমিক-কলেজ শিক্ষকদের দাবি-আন্দোলনও যৌক্তিক এবং সমর্থন করি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলনে যাওয়ার আগে থেকেই তাদের ওপর ঘটতে যাওয়া অবিচারের প্রতিবাদ করেছি। টকশোতে শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছি। তাদের প্রতি অন্যায় অবিচারের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছি। শিক্ষকদের পক্ষে জোরালো ভাষায় কথা বলেছি। যদিও শিক্ষকদের নিজেদের ভাষা অধিকাংশ সময় জোরালো ছিল না। আন্দোলনের সময় যত গড়িয়েছে তত তা স্পষ্ট হয়েছে। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে তীব্র ভাষায় কথা বললেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া-অসহায়ত্ব এবং আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের লেখা।
১. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা হলেও পদমর্যাদা তিন ধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের এই পদমর্যাদার অবনতি কে ঘটালেন? শিক্ষকরা একবার বলেন, সাবেক আমলা ফরাসউদ্দিন করেছেন এ কাজ। আবার বললেন, বর্তমান আমলা এবং অর্থমন্ত্রী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যে এ কাজ করেছেন। তাদের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর নজরে না দিয়েই এমন কিছু করা হয়েছে। রাষ্ট্র এবং প্রশাসন পরিচালনা সম্পর্কে যাদের সামান্য ধারণা আছে, তারাও এমন মন্তব্য করতে পারেন না। এ বিষয়ে শিক্ষকদের ধারণা নেই এমন কিছু লিখলে তা প্রলাপ মনে
হবে। কিন্তু শিক্ষকরা এ কথা বলছেন।
২. শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন স্বতন্ত্র বেতন স্কেল এবং পদমর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে শিক্ষকদের তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন।
শিক্ষকরা নিজেদের সচিবদের সঙ্গে তুলনা করছেন- প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট করে এ কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে শিক্ষকরা মর্মাহত হয়েছেন, অনেকে ঘুমাতে পারছেন না, কান্নাকাটি করছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দিচ্ছেন না। আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের অভিভাবক, এখনও তারা প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখছেন...। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছায়নি... তাই তিনি এমন কথা বলেছেন ইত্যাদি।
৩. আপনাদের দাবি যদি যৌক্তিক হয়, তবে ইনিয়ে-বিনিয়ে এভাবে এর-ওর ওপর দায় চাপাচ্ছেন কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্য জায়গায় চাকরি করেন। কারা চাকরি করেন, সেই তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যত্র চাকরি করেন। বাস্তবে এই তথ্যটির সামান্য অংশ সঠিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কম সংখ্যক শিক্ষক অন্যত্র আরেকটি চাকরি করেন। হিসাব করলে দেখা যাবে ঢাকায় এ হার ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ এবং ঢাকার বাইরে ১-৩ শতাংশ। দু’একজন শিক্ষক এ তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জোরালোভাবে এটা বলছেন না।
৪. একজন সাবেক শিক্ষক নেতাকে দেখলাম টকশোতে এসে কান্নাকাটি করার দশা। মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। মনে হচ্ছে তারা তাদের ন্যায্য দাবি বা অধিকার চাইছেন না, করুণা চাইছেন!
৫. আগে রাজনীতিবিদরা শিক্ষকদের কাছে আসতেন। এখন শিক্ষকরা রাজনীতিবিদদের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। পদ-পদবির জন্য তদবির করেন। ফলে রাজনীতিবিদরা শিক্ষকদের শ্রদ্ধা বা সম্মান করেন না। দলীয় রাজনীতির প্রয়োজনে কখনও কখনও করুণা করেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ সুযোগ সুবিধার লোভে দলের কাছে, নেতার কাছে এভাবে সমর্পণ করেছেন যে, যৌক্তিক দাবি কখনও তারা বলতে পারেন না।
এসব শিক্ষকরা অধিকার বা দাবি বলতে নিজেদেরটাই বোঝেন। ছাত্র বা অন্য শিক্ষকদের কোনও বিষয় তারা বোঝেন না। বুঝলে দলের প্রতি আনুগত্য থাকবে না, এমন মানসিকতা ধারণ করেন।
৬. শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করল ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য পাওয়া গেল না। ভ্যাটবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনেও দেখা গেল না এসব শিক্ষকদের। সারা দেশের দশ পনেরটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সরাসরি পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সেখানে কোনও ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর কামান দিয়ে গরম পানি মারা হয়েছে, পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করেছে, পুলিশ পিটিয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষকরা নির্বিকার থেকেছেন।
৭. প্রাইমারি, এসএসসি, এইচএসসি ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। সর্বশেষ মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। পুরুষ পুলিশ ছাত্রীদের গায়ে হাত দিয়ে নির্যাতন করছে। রাইফেলের বাট দিয়ে ছাত্রদের ঘাড়ে আঘাত করছে, মাথায় মারছে বুটের লাথি- নিজেদের দাবিতে আন্দোলরত শিক্ষকদের তা স্পর্শ করছে না। কোনও কোনও শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদের এই আন্দোলনের কোনও যৌক্তিকতা দেখছেন না। ঠিক যেমন দেখছেন না সরকার।
৮. গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন ভিসি এবং আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনেককে দেখা গেছে সরকারের যাবতীয় অন্যায়-অনিয়ম-অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমর্থন করে গেছেন। ভিসি-শিক্ষকরা ছাত্রলীগের শিক্ষক পেটানো, ছাত্র পেটানো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ না করে মিনমিন করেছেন টকশোতে এসে। ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলেছেন তা প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমর্থন যুগিয়েছেন। একজন ভিসিকে কেন সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নিতে হয়? শিক্ষক নেতৃবৃন্দ কেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন না?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঘটা যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি লোক-দেখানো মানববন্ধন করতেও দশ দিন সময় লাগে। পাঁচ-সাতজন শিক্ষক মিলে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন, তার মধ্যে দুজন আবার থাকেন যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক। নাম ব্যবহার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির।
অথচ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সমাজের কত রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতির জন্য দিক-নির্দেশনামূলক ভূমিকা রেখেছে এই শিক্ষক সমিতি! দলীয় লেজুড়বৃত্তি সব কিছুকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
৯. শিক্ষকদের তোষামোদের রাজনীতি কোন পর্যায়ে নেমেছে যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ খরচ করে পত্রিকার শেষের পাতায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। প্রধানমন্ত্রী পদক পেয়েছেন, শিক্ষকরা তাকে অভিনন্দন নিশ্চয়ই জানাবেন। সেটা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে? কোন নীতিমালায় পড়ে এটা?
আসলে দলীয় ভিসি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে। একজন শিক্ষকের সম্মান-আত্মসম্মানের কোনও কিছুই তার বিবেচনায় নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নোবেল না দেওয়ায়, নোবেল কমিটির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একজন শিক্ষক! তোষামোদি কাকে বলে!
১০. শিক্ষকদের পদমর্যাদা কমিয়ে অসম্মান করা হলো। তার প্রতিবাদে তারা আন্দোলন করছেন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এর কোনও প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের শিক্ষকদের এত বড় অসম্মানে ছাত্র-ছাত্রীরা নিরব। কোনও ছাত্র সংগঠনও শিক্ষকদের সঙ্গে নেই।
ভিসি, শিক্ষক নেতৃবৃন্দ, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনকে নানাভাবে ব্যবহার করেন। ছাত্রনেতারাও শিক্ষকদের ব্যবহার করেন। কেউ কাউকে শ্রদ্ধা-স্নেহ করেন না। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের পক্ষে অন্য ছাত্র সংগঠনের বিপক্ষে কাজ করেন এসব শিক্ষকেরা। ফলে অন্য ছাত্র সংগঠনও শিক্ষকদের পক্ষে অবস্থান নেয় না, কেউ কেউ নিতে পারে না।
১১. এই লেখায় কোনওভাবেই সব শিক্ষকদের কথা বলছি না। সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব শিক্ষক ও শিক্ষক নেতারা- এসব অভিযোগ মূলত তাদের বিরুদ্ধে। তাদের দায় নিতে হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র শিক্ষক সমাজকে।
জানি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি নীতি-নৈতিকতার প্রতি শতভাগ সচেতন থেকে শিক্ষকতা করছেন, এমন শিক্ষকের সংখ্যা অনেক। ব্যক্তিগতভাবে তাদের কেউ কেউ কথা বলছেন, লিখছেন বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। কিন্তু তারা নেতৃবৃন্দের অনৈতিকতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না বা অবস্থান নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না, দায় নিচ্ছেন। ফলে কিছু সংখ্যক শিক্ষকদের জন্যে সব শিক্ষকদের ইমেজে ধস নেমেছে। সরকার সেই সুযোগটিই নিচ্ছে।
এমন কৌশল বা আচরণ থেকে সরকারকে বিরত রাখার জন্যে যে দৃঢ়তা শিক্ষক-শিক্ষক নেতৃবৃন্দের থাকা দরকার, তার সামান্যও তাদের মধ্যে নেই। ফলে তারা এখন কাগজেকলমে মান-সম্মান হারাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী, ছাত্রসংগঠন, অভিভাবকদের কাছে তারা তা হারিয়েছেন আরও আগে।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
Published in: http://banglatribune.com/tribune/single/111789
আমলাতন্ত্রের আমলনামা ও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন
"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
আরো পড়ুনঃ
শিক্ষকদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজে মন্তব্যআমলাতন্ত্রের আমলনামা ও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন
"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
0 comments:
Post a Comment