দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাস খানেক ধরে নিজেদের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে অধ্যাপক। সেই অধ্যাপক এত দিন প্রশাসন ক্যাডারের যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার ছিলেন, আর সিলেকশন গ্রেড পেলে জীবনের শেষ পর্যায়ে অনেকে সচিবের পদমর্যাদা পেতেন। স্বাভাবিকভাবেই সবাই সিলেকশন গ্রেড পেতেন না, যাঁরা সেই শর্ত পূরণ করতেন, তাঁরাই সেটা পেতেন। এবার অষ্টম পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল উঠিয়ে দেওয়ায় তাঁদের যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার ওপরে ওঠা সম্ভব হবে না। এটি কেবল শিক্ষকদের জন্য নয়, জাতির জন্যও লজ্জাজনক।
শিক্ষকেরা সে কারণেই বলেছেন, অন্য ক্যাডারের সঙ্গে তুলনা করার প্রয়োজন নেই, তাঁদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল দেওয়া হোক। প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আমরা এমন অবস্থায় কেন নিপতিত হলাম। অভিযোগের আঙুল উঠেছে আমলাদের দিকে। তাঁরা সবাইকে নিচে রাখতে চান। সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের পদমর্যাদা নিয়ে যতটা ভাবিত, জনগণের সেবা নিয়ে তার এক ভাগও চিন্তিত নয়। তাঁরা নিজেদের জনগণের সেবক মনে করেন না। অথচ জনগণের করের টাকায় তাঁদের বেতন দেওয়া হয়।
প্রশাসনের হাতে শিক্ষকেরা নানাভাবে অপদস্থ হন। জেলা শহরগুলোতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অধীনস্ত কর্মচারী জ্ঞান করেন। পাবলিক পরীক্ষার সময় দেখা যায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে গটগট করে ঢুকে যান, তাঁর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। তাঁর সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলেন। অথচ পদমর্যাদায় ম্যাজিস্ট্রেট বা এডিসির চেয়ে অধ্যক্ষের অবস্থান ওপরে। আর বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কথা আর না-ই বললাম।
একটি রাষ্ট্রকে উন্নত হতে হলে তাকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দুনিয়ার সব উন্নত দেশেই সে দৃষ্টান্ত দেখা যায়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা জিডিপির ২ শতাংশ, আর বাজেটের ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরে সেটা ছিল ২ দশমিক ১৬ শতাংশ। ইউনেসকোর সুপারিশ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। আর যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার বেশির ভাগই চলে যায় বেতন-ভাতায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা নেই বললেই চলে। কিন্তু এসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। অন্যান্য দেশ যখন শিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করতে নিয়ত সিলেবাস নিয়ে গবেষণা করছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছে, তখন আমাদের শিক্ষকেরা মর্যাদা ও বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন। অর্থাৎ আমরা এখনো শিক্ষকদের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা কমিউনিকেটিভ ইংরেজি চালু করব, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করব, আর শিক্ষকদের তিমিরে রেখে দেব, তাদের ছাপোষা মনে করব, সেটা হতে পারে না।
আমাদের দেশ ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বিপুল। কিন্তু এই বিপুল জনসংখ্যাকে জনশক্তিকে রূপান্তরিত করতে হলে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছাতে হবে। কিন্তু এখনো দেশের ৩৯ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। আমাদের শ্রমিকদের বেশির ভাগই অদক্ষ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশকে নিরক্ষরতার জন্য বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ও সামাজিক মূল্য দিতে হচ্ছে। এভাবে কোনো দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করতে পারে না। তাই শিক্ষার উন্নয়নে এবং শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। আমরা শিক্ষার উন্নয়ন চাইব কিন্তু শিক্ষকদের মর্যাদা দেব না, সেটি হতে পারে না। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, এখন সেখান থেকে আরও ওপরে যেতে হলে শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/646876
0 comments:
Post a Comment