Sunday, October 4, 2015

আমলারা প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন - শিক্ষকদের অভিযোগ

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে 'মর্মাহত' বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক নেতা। আমলারা প্রধানমন্ত্রীকে তাঁদের ব্যাপারে ভুল বুঝিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। একই সঙ্গে সচিবদের ব্যাপারেও পাল্টা অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা। ৬৫ বছর চাকরির পরও একজন শিক্ষক নেতার কী সম্পদ থাকে আর ৫৯ বছর চাকরি করার পরও একজন আমলার কী সম্পদ থাকে, তা যাচাই করে দেখতে বলেছেন তাঁরা।

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে গতকাল রবিবার গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'তাঁদের (শিক্ষকদের) চাকরির বয়স ৬৫ বছর আর সরকারি চাকরিজীবীদের বয়স ৫৯ বছর। এগুলো তো বিবেচনায় নিতে হবে। আজকে যেটা (স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো) নিয়ে আলোচনা করছে, সেটা নিয়ে আমারই তো প্রস্তাব ছিল। পিএসসির একটা আলাদা ইউনিট করে আমরা চাচ্ছিলাম...কিন্তু ওনারা আন্দোলন করছেন। তার মানে যে বেতন বাড়িয়েছি, নিশ্চয় তাঁরা বর্ধিত বেতন গ্রহণ করবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত সমাধান না হয়।'
শিক্ষকদের উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, 'ওনারা (শিক্ষকরা) সচিবদের সঙ্গে তুলনা করছেন। আচ্ছা সচিবরা কী কী সুবিধা পাচ্ছেন আর ওনারা কী কী ভোগ করছেন তার একটা তুলনামূলক চিত্র লেখেন না। কোনো সচিব কিন্তু অন্য কোথাও চাকরি করতে পারেন না। সেটা জানেন ভালো করে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা পারেন। কোন ইউনিভার্সিটির কত শিক্ষক কোন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেন সে হিসাব কিন্তু আমার কাছে আছে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'কথা নাই বার্তা নাই ওনারা (শিক্ষকরা) ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন। কেন পড়াশোনা বন্ধ করবেন? শিক্ষকরা আন্দোলন করতে যাবেন কিসের জন্য? আর যদি করতে হয়, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করার রাইট তো তাঁদের নাই। আর আমরা যেটা নিজেরাই চিন্তাভাবনা করছি, এটা নিয়ে তাঁদের আন্দোলন করার দরকার ছিল না। আন্দোলন যখন করছেন, করতে থাকুন। এখানে আমার হস্তক্ষেপের কিছু নাই। তাঁরা আন্দোলন করছেন। বিষয়টি অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী দেখবেন। কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, কমিটি দেখবে। কিন্তু আমি ওনাদের অনুরোধ করব, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না।'
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সহসভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক খবির উদ্দিন গতরাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা মর্মাহত। আসলে আমলারাই প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন। আমরা আমাদের সম্মান আর অস্তিত্বের প্রশ্নে আন্দোলন করছি। আসলে শিক্ষকদের সঙ্গে আমলাদের কখনো তুলনা হয় না। আমলাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অনেক দেশেই শিক্ষকদের চাকরির কোনো বয়সসীমা নেই।'
ফেডারেশনের এই সহসভাপতি বলেন, 'আমলারা শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি কনসালট্যান্সি করেন। বছরে অনেকেই আট-দশবার বিদেশে যান। এমনকি তাঁরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নেন। আমি যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিই, সেখানে একজন সচিবও ক্লাস নেন। আমরা গত মে মাস থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমলাদের কারণে এখনো সেই সুযোগ পাইনি। আমাদের কথাটাই এখনো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারিনি। আগামী মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক আছে এবং ফেডারেশনের সভা আছে। সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেলে কঠোর কর্মসূচিতে না গিয়ে উপায় নেই।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কিন্তু তাঁর কথাগুলো ঠিকমতো স্টাডি করে বলা না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন ঢাকার কিছু শিক্ষক। তা-ও সব বিষয়ের না। আর সেটা সর্বসাকল্যে ৩-৪ শতাংশের বেশি হবে না। আমরা ৬৫ বছর চাকরি করেও দরিদ্র থাকি। আর আমলারা ৫৯ বছর চাকরি করে আমাদের চেয়ে ধনী হন। আমরা কিভাবে জীবন যাপন করি আর আমলার কিভাবে জীবন যাপন করেন, এরও একটা স্টাডি হওয়া উচিত। তাহলেই প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে।'
ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী হয়তো রাগের বশে এসব কথা বলেছেন। আমরা এখনো তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) ওপরই ভরসা করছি। নতুন বেতন স্কেলে আমাদের পদের অবনমন বিষয়ে আন্দোলনে এখনো অনড় অবস্থানে আছি। আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীই আমাদের দেখবেন।'
এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে আগামীকাল মঙ্গলবার আবারও বসবেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিকেল ৩টায় ওই সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। গতকাল সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে এক বৈঠকের শুরুতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, 'বেতন স্কেল নিয়ে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে মঙ্গলবার বৈঠক রয়েছে।'
ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বৈঠকের বিষয়ে বলেন, 'আমরা মূলত আমাদের দাবিগুলো পুনর্ব্যক্ত করব। ঈদের আগেই আমরা সুনির্দিষ্ট আশ্বাস চেয়েছিলাম; কিন্তু তা এখনো পাইনি। আমরা চাই সরকারকে সহযোগিতা করতে। একসঙ্গে যদি ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সরকারের ওপরই চাপ পড়বে। সেশনজট বাড়বে। ভর্তি পরীক্ষা বিঘ্নিত হবে, যা আমরা চাই না। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা এবং ওই দিনের ফেডারেশনের সভায়ই পরবর্তী কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।'
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ঘোষণা এবং যত দিন তা না হয় তত দিন পদের অবনমনের অভিযোগে অষ্টম বেতন স্কেল পুনর্নির্ধারণের দাবিতে চার মাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচিও পালন করেছেন তাঁরা। তবে এ বিষয়ে 'বেতনবৈষম্য দূরীকরণসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি' গঠিত হলেও তাদের সভা এখনো হয়নি। জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ কমিটির সভাপতি। তিনি দেশের বাইরে আছেন। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে তিনি দেশে ফিরবেন। এর পরই এ কমিটির সভা হতে পারে।
Published in: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/10/05/275572

0 comments:

Post a Comment