Thursday, October 15, 2015

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার খোলনলচের বদল চাই

মির্জা তাসলিমা, নাসরিন খন্দকার, বখতিয়ার আহমেদ, মানস চৌধুরী, কাজী মারুফুল ইসলাম, সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরীন, সাঈদ ফেরদৌস, আইনুন নাহার, সেলিম রেজা নিউটন, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, মেহের নিগার, মাহমুদুল সুমন, সাদাফ নূর, আ-আল মামুন, ফাহমিদুল হক
----------
দীর্ঘদিন থেকে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুণ্ন হয়ে আছি। একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচর্যার ক্ষেত্রে রয়েছে রাষ্ট্রের অমনোযোগিতা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারের দলীয়করণ ও অযাচিত হস্তক্ষেপ। তবে এর মধ্যে ঘৃতাহূতি হলো যখন শিক্ষকদের স্পষ্ট নাখোশী অবস্থান ও চলমান আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীপরিষদ বৈঠকে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোই হুবহু অনুমোদিত হয়ে গেল। সরকার অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সান্ত্বনা দিতে একটি কমিটির ঘোষণা করেছে। তা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে ঢালাও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করলেন, শিক্ষকদের ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে সে বক্তব্য প্রত্যাহারও করলেন। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন একইরকম বিদ্বেষমূলক ভাষায়, শিক্ষকদের হাস্যস্পদ-তাচ্ছিল্য করে, এবং শাসিয়ে বক্তব্য দিয়ে!তাঁর দেশের প্রজন্ম গড়ার কারিগরদের প্রতি এরকম মনোভাবের প্রকাশ, যেকোনো অর্থেই নিন্দনীয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল শিক্ষক, শিক্ষার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করছেন না, এরপরও সরকারপ্রধানের কাছ থেকে এরকম মন্তব্য অনভিপ্রেত। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার স্বার্থে ও দেশের মঙ্গলের জন্য আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি শিক্ষকদের দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার উদ্বুদ্ধকরণের দায়িত্ব নিতে পারতেন। এই পেশা-গোষ্ঠীকে তীর্যক বাণে জর্জরিত করে, সমাজের সকলের কাছে হেয় করে, তাঁদের কল্পিত কৃতকর্মের (তাঁদের কিছু সংখ্যক সে কাজ করলেও)জন্য শাসিয়ে আর যাই হোক শিক্ষার কোনো মঙ্গল হবে না, শিক্ষকের মঙ্গলের সম্ভাবনা তো নয়ই।

রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকরা এটা জানেন না, এরকম ভেবে নেওয়া হবে নাদানপনা। বরং আমরা দেখতে পাই যে গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংকোচনের নীতিগত যে আয়োজন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় আজকের সব ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাধাহীন, মৌলিক জ্ঞান চর্চার জায়গা হওয়ার কথা। যা কিছু বিদ্যমান তা কিছুতে সম্মতি দেওয়া, পুনর্বার জারি রাখার দায়বদ্ধতা বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের তথা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নেই। বরং বিদ্যমানের দুর্বলতা নিরন্তর উদ্ঘাটন করা, চ্যালেঞ্জ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই কারণেই এইখানে চর্চিত জ্ঞান নতুন ও মৌলিক, কেবল পূর্বের ধারাবাহিকতা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে দলীয়করণ করা, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চশিক্ষা কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে তাগাদা দেয়া (যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে সাযুজ্যহীন, বরং ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ), সার্বিক শিক্ষায় ব্যয় হ্রাস করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়ন বলতে কেবল শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনের খরচ দেওয়ার ধারণা ইত্যাদিসহ গবেষণা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশে অনেক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর থেকে দেশের অধিকাংশ সরকারপ্রধান বিশ্ববিদ্যলয়ের সারবস্তু, স্বাধীন চিন্তা ও মৌলিক জ্ঞানকে ভয় পেয়ে আসছে, চ্যালেঞ্জড হওয়াকে এড়াতে চেয়েছে। দৃশ্যমান যে, এদেশের রাজনীতিবিদরা এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন নি। ফলে বিশ্ববিদ্যায়ের স্বাধীন চিন্তাপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে দলীয় অনুগত বাহিনী তৈরি করতে তাঁরা অধিক মনোযোগী ছিলেন। তারই ফল হিসেবে হয়তো রাষ্ট্রের তল্পিবাহক কিছুসংখ্যক ‘জ্বি হুজুর’ শিক্ষক, সর্বোচ্চ নির্বাহীর বক্তব্যে নিহিত থাকা শিক্ষকদের প্রতি স্পষ্ট তাচ্ছিল্য ও শাসানোর সুরকে অন্য কারও ষড়যন্ত্র হিসেবে বুঝতে চান! তবে পাঠক আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন ও মৌলিক চিন্তার সামর্থ্যকে জলাঞ্জলি দিতে রাজি নন। তাঁরা সমাজ ও মানুষের জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞানচর্চার উৎকর্ষকে চূড়ায় নিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁদের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টির সকল আয়োজন আজ সম্পন্ন।

বেশি কিছু নয়, কেবল কয়েকটি নীতিগত সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছ, শিক্ষকের বেতন ভাতা ও গবেষণার জন্য এমন অর্থ বরাদ্দ করা যাতে তাকে নিত্য চাল-ডাল-নুনের হিসেব কষতে না হয়, এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য তাঁরা সম্পূর্ণ নিবেদিত হতে পারেন। দ্বিতীয়টি হলো, দেশের রাজনীতিবিদরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিল্লায়ই ছেড়ে দিতে পারতেন! একটি কাজ করলেই তার কতক পূর্ণ হয় – যদি উপাচার্য নিয়োগে রাষ্ট্রের, রাজনৈতিক দলের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকে। এরপর আসে শিক্ষক নিয়োগে অলিখিত হস্তক্ষেপের চর্চা বন্ধ করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেই নিজের ব্যবস্থার অভ্যন্তরে শিক্ষকদের সুকর্মের পুরস্কার ও দুষ্কর্মের তিরস্কারের রীতি জারি করবে, সেটা দেশের জনগণ তথা রাজনীতিবিদদের দাবি হতেই পারে।

এইসব নীতিগত পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খোলনলচে বদলে ফেলতে কেবল পরবর্তী দশকই যথেষ্ট। কিন্তু নীতিগত পরিবর্তনের জন্য প্রথমত প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সর্বোপরি সদিচ্ছার। এরপরেও আরও কিছু কাজ রাষ্ট্রের রয়ে যাবে। সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর স্বার্থে, তার শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, লাইব্রেরি, জাদুঘর ইত্যাদির আধুনিকায়ন করতে হবে, সেইজন্যে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। এরপরের কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। তার মধ্যে অন্যতম হল, শিক্ষাদান আধুনিকায়ন করতে দেশ, সমাজ অনুযায়ী গবেষণার ভিত্তিতে চাহিদা ও লক্ষ নির্ধারণ। শিক্ষাদান শিক্ষার্থীমুখি করতে, পাঠদান পদ্ধতির উৎকর্ষের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রয়োজনে তার জন্য কাঠামো নির্মাণ আবশ্যকীয়। শিক্ষকদের বাস্তবধর্মী কর্মঘণ্টা অনুমান করা প্রয়োজন এবং শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষা-সহকারীর ধারণা সবক্ষেত্রে চালু করা একান্ত জরুরি। তবেই শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে, ভবিষ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তাতে লাভ বই ক্ষতি হবে না। তবে বলা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আগের ধাপে শিক্ষার সব পর্যায়ে পেডাগজিক্যাল ও কাঠামোগত পরিবর্তন না আনলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। ফলে রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য আগে প্রয়োজন ফাঁপা বুলি নয়, বরং শিক্ষার অগ্রাধিকারে সত্যিকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা এবং বেতন বৈষম্য সংক্রান্ত চলমান আন্দোলনকে বিবেচনায় রেখে আমরা কয়েকটি সুস্পষ্ট দাবি করছি: এক. অষ্টম বেতন কাঠামোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেশাগত যে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তা দূর করতে হবে; দুই. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। জিডিপির অন্তত ৪% শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সবক্ষেত্রে এই বরাদ্দের সুষ্ঠু বণ্টন করতে হবে। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের পৃথক বেতনকাঠামো তারই আওতায় চলে আসবে। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। শিক্ষায় বিনিয়োগ ছাড়া কোনো দেশই নিম্ন কিংবা মধ্য পর্যায় থেকে উন্নত পর্যায়ে যেতে পারে নি। 

----------
লেখকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য। লেখাটি আংশিক পরিবর্তনসহ সমকাল (১৬ অক্টোবর, ২০১৫) প্রকাশ করেছে।

Published in: a. https://goo.gl/e68lml , b. http://www.samakal.net/2015/10/16/167781 (উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা)

0 comments:

Post a Comment