Tuesday, September 11, 2012

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

মো. আক্তারুজ্জামান

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুগবাণীর ‘‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, ‘‘ আমরা চাই আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিতে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে-শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসেবে ‘ডাংপিটে’ ছেলে বরং অনেক ভাল। কারণ পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না; আর যাহার ‘জান’ নাই, সে মোর্দা দিয়ে কোন কাজই হয় নাই আর হইবেও না। এই দুই শক্তিকে – প্রাণশক্তি আর কর্মশক্তিকে একত্রীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।’’ (নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, সম্পা. আবদুল কাদির, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬, পৃ. ৮৪৪)। নি:সন্দেহে, যে-শিক্ষার জীবনীশক্তি নেই তা মানবিকও নয়। আশাব্যঞ্জক এই যে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ -এ মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত বক্তব্য, মন্তব্য ও সুপারিশ বহুলমাত্রায় পরিলক্ষিত।

প্রাক্-ব্রিটিশ সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠান ও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ঘোষিত শিক্ষানীতি হলো বাংলা তথা ভারতের প্রথম সরকারি শিক্ষানীতি। এর মাধ্যমে নীতিগতভাবে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর বহুল আলোচিত অ্যাডাম রিপোর্ট (১৮৩৫-১৮৩৮) -এর উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি (১৯৪৭) পর্যন্ত অন্তত আটটি কমিশন, কমিটি ও সংস্কার প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে হান্টার কমিশন রিপোর্ট (১৮৮২) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত নাথান কমিটি (১৯১১) রিপোর্ট খুবই পরিচিত। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৮-১৯৭১) বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি রিপোর্ট প্রণীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার (আতাউর রহমান খান) কমিশন ১৯৫৭, জাতীয় শিক্ষা কমিশন (এস এম শরিফ কমিশন) রিপোর্ট ১৯৫৯, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট ১৯৬৬ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘শিক্ষা নীতি’ নামেও দু’টো প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছিল- এয়ার মার্শাল এম. নূর খান নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন শিক্ষানীতি ১৯৬৯ ও শামসুল হক কমিটি প্রণীত শিক্ষানীতি ১৯৭০। উল্লেখ্য, ঘোষিত সব কয়টি প্রতিবেদন/নীতি প্রবল আন্দোলনের মুখ থুবড়ে পড়ে, নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুড়ে। বর্তমান মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ (এমপি)সহ বরণ্য শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতক নেতৃবৃন্দের অনেকে এসব আন্দোলন সংগ্রামে শরিক ছিলেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন বিশেষ করে ১৭ সেপ্টেম্বরের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এক্ষেত্রে বড় দৃষ্টান্ত।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ -এর পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশে আরো ছয়টি কমিশন/কমিটি রিপোর্ট ঘোষিত হয়েছিল। এগুলো হলো : বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন (ড. কুদরত-ই-খুদা) রিপোর্ট ১৯৭৪, অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি (কাজী জাফর-আবদুল বাতেন প্রণীত) ১৯৭৯, মজিদখান কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৩, মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ ও জাতীয় শিক্ষা কমিশন (মনিরুজ্জামান মিয়া) প্রতিবেদন ২০০৩। জাতির দীর্ঘদিনের আন্দোলন, সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেমনি সাংবিধানের চার মূলনীতির উদ্ভব ঘটেছিল তেমনি স্বধীনতাউত্তর বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও জাতীয় উন্নয়নের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রণীত সুপারিশেও জাতির প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক স্বৈরাচারী সরকারসমূহ তা বাস্তবায়ন না করে, সকলেই বিতর্কিত, খন্ডিত কিছু প্রতিবেদন, সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে শিক্ষাঙ্গন ও সুশীল সমাজের বৈধতা পাওয়ার এক ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে। স্পষ্টত: বাংলাদেশে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ হয়েছে দু’টো । দু’টোই হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ তথা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে – ২০০০ ও ২০১০ -এ।

জাতীয় শিক্ষানীতির কয়েকটি মৌলিক বেশিষ্ট্য থাকে : এর শিক্ষা-দর্শন থাকবে, এতে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে; জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা প্রণীত ও গৃহীত হবে। জাতির পূর্ব অভিজ্ঞতাসমূহ এখানে ব্যবহৃত হবে, উপেক্ষিত হবে না। এসকল মানদন্ডে ৬ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে গঠিত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী (চেয়ারম্যান) ও ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ (কো-চেয়ারম্যান) নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রণীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ যথার্থ অর্থেই জাতীয় শিক্ষানীতির মর্যাদা লাভ করেছে। এটি প্রণয়নে আমাদের মহান সংবিধানের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাবলি, জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের সুপারিশ এবং পূর্বে প্রণীত বিভিন্ন কমিটি/কমিশন প্রতিবেদন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। সর্বোপরি, শিক্ষাবিদসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মন্তব্য ও পরামর্শ সংগ্রহ করে তার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেও অন্তর্ভুক্তিকরণ (inclusiveness) দর্শনের বহি:প্রকাশ লক্ষ্যনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এম পি শিক্ষানীতির ‘প্রাক্-কথন’-এ বলেন, ‘‘২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে আমরা সরকারের দায়িত্ব নেবার পর নির্ধারিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে পূর্বে প্রণীত শিক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করার জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়। সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে এই শিক্ষানীতি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়।’’ একইভাবে, শিক্ষানীতির ‘মুখবন্ধ’ -এ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নূরুল ইসলাম নাহিদ, এমপি -র বক্তব্যও শিক্ষানীতির গণমুখীতা ও যুগের সাথে এর বহমান ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন- ‘‘(১) এটা কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয় – জনগণ তথা জাতির আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। (২) শিক্ষানীতি কোন অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সব সময় উন্মুক্ত থাকবে। কোন ভুল-ত্র“টি হলে তা সংশোধন করা যাবে।’’ বর্তমান শিক্ষানীতির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, যথার্থতা ও জাতীয় মর্যাদা লাভের আরেকটি পরিমাপক হলো এর বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম পরিলক্ষিত না-হওয়া।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ন্যায় শিক্ষাও একটি প্রধান মৌলিক অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্র ও সরকার এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশের সংবিধানে এ-নিরিখে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘‘(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’’ এ-ছাড়াও ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে শিক্ষালাভে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য না করার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মহান সংবিধানের ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদে। প্রাক্ কথন মুখবন্ধ, আঠাশটি অধ্যায় ও দু’টো সংযোজনী নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর কলেবর।

আঠাইশটি (২৮টি) অধ্যায়ে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর, ধারা, ক্ষেত্র, পাঠক্রম, নারী শিক্ষা, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষার্থীকল্যান, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার, স্তর-নির্বিশেষে গৃহীতব্য পদক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ের সাবলীল বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনায় সংবিধানের উপরিউক্ত নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। আলোচ্য শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘‘শিক্ষানীতি —– দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।‘‘ বস্তুত ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়টি জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০-এর মূল ভিত্তি। এখানে ৩০ (ত্রিশ) টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করে সেসবের বাস্তবায়ন ও অর্জনের লক্ষ্যে পরবর্তী সাতাশটি অধ্যায়ে বিভিন্ন নীতি দর্শন, সুপারিশ ও করণীয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসবের মৌলিক কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে নিম্নে উপস্থাপিত হলো।
(১) প্রাথমিক শিক্ষার স্তর হবে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আট বছরব্যাপী। এখানে প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণিও সংযুক্ত থাকবে;
(২) পঞ্চম শ্রেণি শেষে জাতীয়ভাবে অভিন্ন প্রশ্নে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এটি বর্তমানে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (PSC) নামে পরিচিত। অনুরূপ অষ্টম শ্রেণি শেষে জাতীয় ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় অভিন্ন প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার নাম জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (JSC);
(৩) সন্ত্রন্ত্রভাবে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রয়োজন নেই, PSC ও JSC মেধা তালিকা থেকে বৃত্তি প্রদান করা হবে;
(৪) মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত;
(৫) বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সমগ্রদেশে প্রাথমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়সমূহে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করা হবে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধারার যথা: সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিল্ডারগার্টেন (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম), ইবতেদায়িসহ সব ধরণের মাদ্রাসার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা হবে;
(৬) প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত বিষয়ে অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে;
(৭) মাদ্রাসাসহ অন্যান্য বিশেষ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রাখার জন্য নিজস্ব বিষয়াদি বাধ্যতামূলক বিষয়ের সাথে সন্নিবেশ করা যাবে;
(৮) চার বছরব্যাপী মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে – (ক) তিনটি ধারা থাকবে – সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাধারা এবং প্রত্যেক ধারা কয়েকটি শাখায় বিভক্ত থাকবে। সব ধারাতেই কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে যথা-বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক থাকবে। (খ) প্রত্যেক ধারায় এসকল বিষয়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে স্ব স্ব বোর্ডের নেতৃত্বে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। (গ) নিজ নিজ ধারার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক ধারায় সেই ধারা সংশ্লিষ্ট আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক বিভিন্ন বিষয় থাকবে;
(৯) শিক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি ও সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া ও শিক্ষার মান অর্জনের জন্য গাইড বই, নোট বই, প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এসবের অপকারিতা বিষয়ে সচেতন করা হবে;
(১০) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সকল ধারার শিক্ষার্থীদের যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে সে প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে;
(১১) ঝরে পড়া রোধ ও অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দুপুরে পুষ্টিকর খাবার প্রদান করতে হবে এবং প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে;
(১২) নীতিগতভাবে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যাবে না, এ প্রবণতা নিরুৎসাহিত করতে হবে। ব্যতিক্রমক্ষেত্রে কোড (code) পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি বিষয়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত;
(১৩) শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নিশ্চিত করতে স্তর নির্বিশেষে সকল শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে এবং নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা বাঞ্চনীয়;
(১৪) শিক্ষা প্রশাসন জবাবদিহি, স্বচ্ছ, গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে – (ক) সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে; (খ) সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষানীতির পরিমার্জন ও পরিবর্তনের জন্য স্থায়ী ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করতে হবে; (গ) মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতির আওতাধীন ও এমপিওভুক্ত সকল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি ও পদোন্নতির জন্য সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারী শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে; (ঘ) দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয়ের জন্য এবং সেই ভিত্তিতে প্রতিবছর এগুলোর র‌্যাংকিং নির্ধারণ করা ও উন্নয়নের পরামর্শ দেয়ার জন্য যথাযথ ক্ষমতা ও দক্ষতা সম্পন্ন একটি ‘এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠা করা হবে; (ঙ) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হবে; (চ) মাদ্রাসাকেন্দ্রিক উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ফাযিল ও কামিল পর্যায়ের মাদ্রাসার অনুমোদন, পাঠক্রম প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, সনদ প্রদান ও অন্যান্য একাডেমিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় একটি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে;

(১৫) বর্তমানে সকল স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকহারে বেতন আদায়ের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। চাঁদা আদায়ের বিষয়টিও নীতিমালার আওতায় আনতে হবে;
(১৬) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষার কোন স্তরেই শিক্ষার্থী যাতে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;
(১৭) নির্দিষ্ট অনুপাতে (১:৩০) প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যাবশ্যক অবকাঠামো সংযোজন করে ২০১৮ -এর মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষানীতির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ধারাসমূহ বাস্তবায়ন করা হবে;
(১৮) শিক্ষার্থীকে মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন পাঠ্যসূচি মোতাবেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পুস্তক রচনা করতে হবে। ২০১৩-র মধ্যে এই নতুন পাঠ্য পুস্তক প্রবর্তন করতে হবে;

উল্লিখিত সুপারিশ, প্রস্তাবনা ও প্রতিবেদনসহ চূড়ান্ত খসড়া শিক্ষানীতি ৭ ডিসেম্বর ২০১০ মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। নীতিগতভাবে এসব এখন সরকারের সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, এরূপ ভালো ভালো সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য বিগত সময়ের বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদ/সুপারিশেও ছিল। কিন্তু ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর সাথে সেসবের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে- আর তা হলো বাস্তবায়ন বা কার্যকর করার প্রশ্নে। এই একমাত্র শিক্ষানীতি যা কোন সরকার বাস্তবায়ন করছে, ধাপে ধাপে। উল্লেখ্য, এই প্রথমবারের মত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৮ জুন ২০১১ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে আহবায়ক করে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কেন্দ্রীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। উপবৃত্তি সম্প্রসারণ, শিক্ষা সহায়ক ভাতা প্রদান, কতিপয় এলাকায় দুপুরের খাবার সরবরাহ কার্যক্রম গ্রহণ প্রভৃতি পদক্ষেপের ফলে ২০১২-এ প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ভর্তির হার ৯৫%-এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৫-এর পূর্বেই শতভাগ ভর্তির সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDG) অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাদ্রাসাসহ সকল ধারার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এত বিপুল সংখ্যক (প্রায় ২৫ কোটি) পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে সরবরাহ বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১লা জানুয়ারি এ-পুস্তক প্রদান কার্যক্রম সরকার প্রধান উদ্বোধন করেন। ১লা জানুয়ারি এখন পাঠ্য পুস্তক দিবস। নতুন শিক্ষাক্রম পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পুস্তক রচনা ও ছাপানোর কাজ এগিয়ে চলছে। ২০১৩ সন থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক পাঠদান শুরু করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ২০১২-এ চল্লিশ হাজারেরও বেশি বিদ্যালয়ে প্রাক্ প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা হয়েছে বলে জানা যায়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষে যথাক্রমে সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুযোগের বৈষম্য দূর হয়ে, গুটিকতকের বৃত্তি পরীক্ষার সুযোগ ও কোচিং বন্ধ হয়ে এখন সকল শিক্ষার্থী সমাপনী পরক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং সে ফলাফলের ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। দেশের সকল প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শ্রেণি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে ‘শিক্ষার্থী সংসদ’ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যমে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনার মধ্যে খুদে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রচর্চার পাঠ শুরু হয়েছে। নির্ধারিত শিক্ষাপঞ্জির ভিত্তিতে এখন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি এবং এইচ এস সি ও সমমানের পরীক্ষা ১ এপ্রিল শুরু হয় এবং ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলে অনেক অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রচলন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া সরবরাহসহ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসার কারিক্যুলাম উন্নয়ন করা হয়েছে। এবতেদায়ি ও জুনিয়র দাখিল পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করা হচ্ছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম চালু করে ভর্তি-বাণিজ্য রোধ করার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে এককালীন দেয় ফি ও অনুদান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। যারা নির্ধারিত অর্থের অতিরিক্ত আদায় করেছে, তাদেরকে তা ফেরৎ দিতে বা সমন্বয় করতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বিশেষায়িত ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে টেক্সটাইল বিশ্ববিদাালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং লেদার টেকনোলজি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট হিসেবে ন্যস্ত করা হয়েছে। তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদাালয় স্থাপন করা হয়েছে- ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদাালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। মাদ্রাসার ফাযিল ও কামিলস্তরের শিক্ষা প্রসারের জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খসড়া আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনয়ন ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য “The Private University Act 2010″ কার্যকর হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায়, প্রতীয়মান হয় যে, দু’বছরে শিক্ষানীতির প্রায় ২০% – ২৫% বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন, ১৫-৪৫ বছর বয়সীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানক্রম নির্ধারণের জন্য ‘এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংযোজন, স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন প্রভৃতি কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদিও প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে খবর বেরিয়েছে, কিন্ত ফলপ্রসূ কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়।এতদসত্ত্বেও সম্ভাবনা অনেক। শিক্ষা গবেষক, শিক্ষা আন্দোলনের নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদ যথার্থই বলেন, ‘‘সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব না থাকলে এবং সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে সরকারের এ-মেয়াদে শিক্ষানীতির অন্তত: ৩০% অর্জন সম্ভব হবে।’’ কেউ যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করেন তবে একবাক্যে বলবেন যে, শিক্ষা নীতির বাস্তবায়নের দিকটি সময় ও জাতির সীমিত স¤পদের মানদন্ডে, নি:সন্দেহে, সন্তোষজনক।

শিক্ষানীতির সমালোচনা করে কিছু পেশাজীবী সংগঠন স্ববিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তারা বলেন, ‘‘ইতোপূর্বেকার কুদরাত-ই-খুদা ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত্ব না পাওয়ার বরাবরই এ-জাতি সে বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০-কেও খুদা এবং হক কমিশনেরই প্রতিরূপ (replica) বলে মনে হয়েছে। এজন্যই এ শিক্ষানীতিতে অনেক ভাল প্রস্তাব থাকার পরও জাতি তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না।’’ তারা আরো বলেন, ‘‘—– এ শিক্ষানীতি বাস্তাবায়িত হলে একজন সাধারণ ধারার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের সূচনা হতে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে এ-শিক্ষানীতি কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না।’’ (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ.৪, ১৬) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একমাত্র শিক্ষানীতি যেখানে শিক্ষাধারা নির্বিশেষে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাধ্যতামূলক। সুতরাং উল্লিখিত মন্তব্য যে ভিত্তিহীন, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উস্কানিমূলক তাতে কোন সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিয়া ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম. ওসমান ফারুক শিক্ষানীতির যে পর্যালোচনা ও সমালোচনা করেছেন তা উল্লেখের দাবিদার। তাদের বক্তব্যে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন বিষয়ে সংশয় প্রকাশ পেলেও তা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। প্রফেসর মিয়া বলেন যে, ‘প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০ -এর অনেক কিছু পূর্বেও ছিল। প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার বিষয়টি নতুন নয়, আগেও এ – সুপারিশ ছিল, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কেউ তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি; এসরকারও পারবে না।’ ড. ওসমান ফারুক বলেন যে, ‘শিক্ষানীতিতে বেশ সহজ সাবলীল ভাষায় রচিত, সকলে এটি বুঝতে পারবে।’ তিনি শিক্ষানীতিকে সমর্থন করে ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে ‘প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে পারলে ভালো; কিন্তু এটা অনিবার্য নয়, বাস্তবে এটা অসম্ভবও বটে।’ তিনি মূলত শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নের প্রতিই গুরুত্বরোপ করেছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ জুন ২০১০)। তাদের উভয়ের মতে, শিক্ষানীতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনায় অনেক উৎকৃষ্ট উপাদান রয়েছে; তবে সেসব বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কেননা, প্রয়োজনীয় বাজেট লাগবে, ভৌত অবকাঠামো লাগবে, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ লাগবে। এ বক্তব্যের সাথে খুব বেশি দ্বিমত না করেই শুধু একথা সংযোজন করা যায় যে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ – এসব কিছুই শিক্ষা নীতির অংশ বিশেষ। আর একথা সত্য যে কোন কিছুর বাস্তবায়নই হলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নি:সন্দেহে, সীমিত সম্পদের দেশে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও হতে হবে ধারাবাহিক, পর্যায়ক্রমিক।

তবে এটি ঠিক যে, শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত বাজেট আশাব্যঞ্জক নয়। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ ও মোট বাজেটের ২০ ভাগ বরাদ্দের কথা থাকলেও ২০১১-২০১২ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ১২ শতাংশ। এ চিত্র আরো হতাশাগ্রস্থ করে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের সংশ্লিষ্ট খাতের বাজেট। বাজেটের আয়তন বড় হওয়ায় ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে ১৫৭১ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, তবে জিডিপির এবং মোট বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট, তিলে তিলে হলেও, বৃদ্ধি পাবে, সেখানে উল্টো ২০১১-২০১২ -এ শিক্ষাখাতে (প্রাথমিক, গণশিক্ষা, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা প্রযুক্তি, মাদ্রাসাসহ) জিডিপির ২.৩% ও মোট বাজেটের ১২% -এর স্থলে ২০১২-২০১৩ -এ যথাক্রমে ২.২% ও ১১.৫% বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র তিন বছরে সরকারের যে অভূতপূর্ব সাফল্য তাই হয়তো বাজেট প্রণেতাদের এ-ক্ষেত্রে দৃষ্টি কাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত: ‘বেশি ভালো ভালো না’ – প্রাচীন সেই বাংলা প্রাবাদটি শিক্ষা-বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয়েছে। প্রসঙ্গত, দক্ষিন এশিয়ার আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুগ্মভাবে বাংলাদেশ ও নেপালের শিক্ষা-বাজেট নিম্নতম, সর্বোচ্চ হলো শ্রীলঙ্কার। উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর নীতিমালায় শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬% এবং মোট বাজেটের ২৫% বরাদ্দের পরামর্শ রয়েছে।

সদ্দিচ্ছা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে সীমিত স¤পদের মধ্যেও যে মহৎ কিছু করা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’। ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মত ও পরামর্শ ধারণ করেই প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে এ শিক্ষানীতি। অন্যসবের বিপরীতে বাস্তবায়নের মধ্যেই রয়েছে এর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা শিক্ষানীতির একটি মৌলিক দর্শন। মানবিক ও নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কর্মমুখী মানবস¤পদ বিনির্মানে সহায়ক গুনগত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা ও নীতিমালা রয়েছে এ-শিক্ষানীতিতে। মৌলিক অধিকার হিসেবে সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যে রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব তার প্রতিফলন ঘটেছে এর পাতায় পাতায়। তবে দায়িত্বের সঙ্গে দায় আছে। এই দায় আর্থিক দায়। আর্থিক দায় বহন ছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে কী? কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘‘শিক্ষার বাহন’’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘‘শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই।’’ রবীন্দ্রনাথ( সঙ্কলন, বিশ্বভারতী, ১৪০১, পৃ. ২৩)। মূলত: আমাদের কথা, কাজ ও চাহিদা -এসবের মধ্যে প্রয়োজন অধিকতর সামঞ্জস্য, সমন্বয়; গড়মিল বা হেরফের নয়। আর হেরফের থাকলে কাঙ্খিত সাফল্য আবদার হিসেবেই থাকবে। কবি গুরুর ‘‘শিক্ষার হেরফের’’ শীর্ষক প্রবন্ধ এক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে: ‘‘আমাদের হেরফের ঘুচিলেই আমরা চরিতার্থ হই। শীতের সহিত শীতবস্ত্র, গ্রীষ্মের সহিত গ্রীষ্মবস্ত্র কেবল একত্র করিতে পারিতেছিনা বলিয়াই আমাদের এত দৈন্য, নহিলে আছে সকলই। এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাই আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও।’’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঙ্কলন, বিশ্বভারতী, ১৪০১, পৃ. ১৫)

ডক্টর মো. আখতারুজ্জামান: জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য। অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Published in: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/6225

0 comments:

Post a Comment