Saturday, May 17, 2014

বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের দারুণ উদ্ভাবন!: স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালককে সতর্ক করার উপায়

গাড়ি চালানোর সময় চালক ঠিক অবস্থায় আছেন কিনা সেটা জানিয়ে দেবে একটি ডিভাইস৷ সেই পদ্ধতিই উদ্ভাবন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নেতৃত্বাধীন একদল হবু বিজ্ঞানী৷



কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে কাজ করেন ঐ বিভাগের চার শিক্ষার্থী৷ পরামর্শক হিসেবে ছিলেন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, তড়িৎ ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের লেকচারার মো. এনামুল হক চৌধুরী৷

‘ড্রাইভার ডিসট্র্যাকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' নামক ডিভাইসটি সম্পর্কে ড. রাজ্জাক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইলে কথা বললে, এসএমএস করায় ব্যস্ত হলে কিংবা চা, কফি খেলে তাকে সতর্ক করে দেয় এই ডিভাইস৷

এছাড়া চালক সামনের রাস্তার দিকে না তাকিয়ে পাশের বিলবোর্ডের দিকে নজর দিচ্ছে কিনা সেটাও খেয়াল রাখবে এই ডিভাইস৷ চালক মদ্যপ অবস্থায় আছে কিনা, তার ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে কিনা, শরীরে তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা অর্থাৎ চালক সুস্থ আছে কিনা, সে বিষয়গুলোও খেয়াল রাখা যায় এই ডিভাইসের মাধ্যমে৷''

এই বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখতে চালকের আসনের আশেপাশে কিছু সেন্সর বসানো হবে৷ অর্থাৎ চালকের শরীরের সঙ্গে কোনোকিছু লাগাতে হবে না৷ তবে তাপমাত্রা ও রক্তচাপ মাপার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রটা চালকের হাতেই লাগাতে হবে – যেটাকে ড. রাজ্জাক তাঁদের উদ্ভাবিত ডিভাইসের একটা সীমাবদ্ধতা বলে মনে করছেন৷ তবে এর বিকল্প উপায়ও খোঁজার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি৷

এছাড়া, সব কাজ যেন একটা মাত্র ডিভাইস দিয়ে করা যায় সে চেষ্টাও করা হচ্ছে, বলে জানালেন ড. রাজ্জাক৷

বর্তমানে পরিপূর্ণ ডিভাইসটি ব্যবহার করতে চাইলে খরচ পড়বে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো৷ তবে আরও গবেষণার মাধ্যমে এর মূল্যটা কমানো সম্ভব৷ ড. রাজ্জাক জানান, ইতিমধ্যে সরকার, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন পরিবহণ মালিকদের সামনে ডিভাইসটি তুলে ধরা হয়েছে৷ আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সচিব এটার প্রতি আগ্রহী হয়ে একে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন৷ এছাড়া বেসরকারি সোহাগ পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডিভাইসটি বাস্তবে কতটা কার্যকর হচ্ছে তা পরীক্ষা করে দেখতে এবং পরীক্ষামূলকভাবে এটা চালু করার জন্য যে আর্থিক সহায়তা লাগবে সেটা দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন৷

এই ডিভাইস তৈরি প্রকল্প এগিয়ে নিতে অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক ‘ইনফরমেশন সোসাইটি ইনোভেশন ফান্ড'-এর কাছ থেকে ৩০ হাজার ডলার অস্ট্রেলীয় ডলার পেয়েছিলেন ড. রাজ্জাক ও তাঁর দল৷

ড. রাজ্জাক বলেন, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ক্রিকেটার মানজার রানার মতো ব্যক্তিত্বদের সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল৷ নিজের কাজের ক্ষেত্র থেকে এ ব্যাপারে কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবতে গিয়েই তাঁর মাথায় এই ডিভাইসের পরিকল্পনা আসে বলে জানান তিনি৷ ড. রাজ্জাকের আশা, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে তাঁদের ডিভাইস হয়ত কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে৷
সড়ক দুর্ঘটনা কমানো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে ঐ বিভাগের চার শিক্ষার্থী একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন৷ পরামর্শক হিসেবে ছিলেন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, তড়িৎ ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের লেকচারার মো. এনামুল হক চৌধুরী৷ এর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব বলে আশা করছেন ড. রাজ্জাক৷


ডিভাইসটি যা করবে
গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইলে কথা বললে, এসএমএস করায় ব্যস্ত হলে কিংবা চা, কফি খেলে তাকে সতর্ক করে দেবে৷ এছাড়া চালক সামনের রাস্তার দিকে না তাকিয়ে পাশের বিলবোর্ডের দিকে নজর দিচ্ছে কিনা সেটাও খেয়াল রাখবে এই ডিভাইস৷




তাপমাত্রা, রক্তচাপ পরিমাপ
মদ্যপ অবস্থায় আছে কিনা, তার ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে কিনা, শরীরে তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা, অর্থাৎ চালক সুস্থ আছে কিনা, সে বিষয়গুলোও খেয়াল রাখা যাবে এই ডিভাইসের মাধ্যমে৷


কয়েকটি সেন্সর
প্রতিটি বিষয় খেয়াল রাখার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা সেন্সর৷ তবে সব কাজ যেন একটা মাত্র ডিভাইস দিয়ে করা যায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান ড. রাজ্জাক৷






ব্যাবহার
ড. রাজ্জাক জানান, ইতিমধ্যে সরকার, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন পরিবহণ মালিকদের সামনে ডিভাইসটি তুলে ধরা হয়েছে৷ বেসরকারি সোহাগ পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডিভাইসটি বাস্তবে কতটা কার্যকর হচ্ছে তা পরীক্ষা করে দেখতে এবং পরীক্ষামূলকভাবে এটা চালু করার জন্য যে আর্থিক সহায়তা লাগবে সেটা দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন৷

দাম ২৫-৩০ হাজার টাকা
বর্তমানে পরিপূর্ণ ডিভাইসটি ব্যবহার করতে চাইলে খরচ পড়বে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো৷ তবে আরও গবেষণার মাধ্যমে এর মূল্যটা কমানো সম্ভব৷


যেভাবে পরিকল্পনার শুরু
ড. রাজ্জাক বলেন, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ক্রিকেটার মানজার রানার মতো ব্যক্তিত্বদের সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল৷ নিজের কাজের ক্ষেত্র থেকে এ ব্যাপারে কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবতে গিয়েই তাঁর মাথায় এই ডিভাইসের পরিকল্পনা আসে বলে জানান তিনি৷


সহায়তা
এই ডিভাইস তৈরি প্রকল্প এগিয়ে নিতে অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক ‘ইনফরমেশন সোসাইটি ইনোভেশন ফান্ড’-এর কাছ থেকে ৩০ হাজার ডলার অস্ট্রেলীয় ডলার পেয়েছিলেন ড. রাজ্জাক ও তাঁর দল৷

DW.COM এর সাথে সাক্ষাতকার


সাক্ষাৎকার: জাহিদুল হক

আরো সাক্ষাতকার ও আলোচনাঃ






সম্পাদনা: দেবারতি গুহ

Sunday, May 11, 2014

সাংঘাতিক ভাবনা


Hanif Seddiqui

একটি বিষয় আমাকে সাংঘাতিকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মাত্র কয়দিন হলো- শিক্ষক অধিকার নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। বলেছিলাম- আমার তরুণ সহকর্মীগণ একেকজন ভীষণ মেধাবী। কেউ ডীন পুরস্কার প্রাপ্ত, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে এযাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নম্বর প্রাপ্ত। তাদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করি- আপনি কেন শিক্ষকতায় এসেছেন? কেউ বলেন না যে, তিনি টাকার জন্য শিক্ষকতায় এসেছেন। কিছুদিন আগে আমার এক তরুণ সহকর্মী বললেন, তার সাথে ৩.১৮ সিজিপিএ নিয়ে পাশ করা একজন বন্ধু ব্যাংকে ঢুকে এরই মধ্যে পঞ্চাশ হাজারের বেশী বেতন পাচ্ছেন। আমি অবাক হই নি। সমাজের সবচেয়ে মেধাবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তরুণ সহকর্মী পান সর্বসাকুল্যে বিশ হাজার টাকার মত। অবিবাহিত তরুণ শিক্ষকদের যখন বিয়ের কথা আসে, তারা লজ্জার ভান করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কখনো কখনো বলেন, সামনের অতিরিক্ত টাকাটা পেলেই...। কাজেই এটি তাদের লজ্জা নয়, বরং ভয়। সমাজের সবচেয়ে মেধাবী তরুণের অযোগ্যতা ধরা পড়ার ভয়। এটাও কোন সাংঘাতিক বিষয় নয়। কেননা, এইসব যোগ্য মানুষদের আর্থিক অনটনের বিষয়টা অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রায় প্রতি মাসে ধার-দেনা করা নিতান্ত রুটিন কাজ। বন্ধুর কাছে। রাস্তার পাশের দোকানীর কাছে। বাসার মালিকের কাছে। কাজেই এটা এখন সমাজের কাউকেই আর ভাবায় না।

কিন্তু আজকের বিষয়টি সত্যিই সাংঘাতিক। না, এখনো শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হয় নি বলে সাংঘাতিক নয়। অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি, শিক্ষকবৃন্দের জন্য আলাদা বেতন স্কেল দেবেন সরকার। আমাদের করিৎকর্মা শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়- প্রায় ছয় বছর ধরে বলে আসছেন। আলাদা বেতন স্কেল দেব, দিচ্ছি। কিন্তু তিনি পারছেন না। অনেক দেশে শুনেছি- না পারলে, দায় নেয়। জানিনা তিনি এটি দায় মনে করেন কিনা। তবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, তিনি এ উপলক্ষে দ্রুত কাজ করছেন।

ধরুন, একজন ডাক্তার অপারেশনে ঢুকেছেন। ব্রেইন অপারেশন। রোগীর খুলি খুলে ফেলা হয়েছে। থকথকে মগজ বের হয়েছে। অস্ত্রোপচার চলছে। হঠাৎ তিনি আনমনা হয়ে গেলেন। অন্য কাজের কথা মনে পরলো। প্রিয় পাঠক, চিন্তা করুন রোগীর কী অবস্থা হবে? অশিক্ষা যদি আমাদের সামাজিক ব্যাধি হয়, এই রোগ সারাবেন একজন শিক্ষক। মা-বাবা মানব সন্তানের জন্ম দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখার ব্যবস্থা করে দেন ঠিকই। কিন্তু একজন শিক্ষক (যে কোন পর্যায়ের) মানব-শিশুর মধ্যে অদৃশ্য কিন্তু অতীব জরুরী একটি তৃতীয় নয়নের জন্ম দেন। ধরুন, গুরু তার সমস্ত বোধ দিয়ে, দর্শন দিয়ে নিজের ভেতরের জ্ঞানের সকল আলো শিষ্যের মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে উদ্যত হয়েছেন। হঠাৎ সংবাদ এলো, রাস্তার পাশের দোকানীটার দেনার টাকা খুব দরকার। কিংবা খবর এলো টাকার অভাবে তার প্রিয়জনকে হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছে না। গুরু আনমনা হলেন। তৃতীয় অদৃশ্য নয়ন বিকলাংগ হলো। এবার আমাদের সমাজের দিকে একটু তাকিয়ে এর চিত্র দেখার চেষ্টা করি।

সম্প্রতি ইউনিসেফের তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, পৃথিবীর প্রায় একশ কোটি মানুষ খোলা আকাশের নীচে তাদের প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। এরমধ্যে ষাট কোটি মানুষ ভারতের। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো স্বল্প-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও এখানে এর উল্টা চিত্র। এখন খুব কম মানুষ প্রকৃতি দূষণ করে থাকে। কৃষকগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ খাদ্যে আজ প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন। বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকগণ অশিক্ষিত অথবা অল্পশিক্ষিত। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সকল সময়ের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। এই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে বিদেশে কর্মরত অল্পশিক্ষিত শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে। বাংলাদেশ পোশাক শিল্পে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আয় করে। এখানেও স্বল্প শিক্ষিত আর অশিক্ষিত মানুষ, মূলত নারী শ্রমিকের একচ্ছত্র অবদান। এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামের সাধারণ পরিবারের অল্প-শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত মানুষের অবদানের জন্যই জন্মনিয়ন্ত্রণ, শিশুমৃত্যু এবং মাতৃস্বাস্থ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। কী নিরন্তর তাদের খাটা-খাটনি। অক্লান্ত পরিশ্রম। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হানাহানি, গুম, হত্যা এবং সর্বোপরি অবিশ্বাসের এই দেশ এগিয়ে চলেছে। নিরন্তরভাবে এগিয়ে চলেছে। আমার মনে হয়, এটি একটি বড় প্যারাডক্স। অশিক্ষিত অথবা অল্প-শিক্ষিত মানুষ জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবস্থান পরিস্কার করেছে। আর একটি সম্প্রদায় আছে- শিক্ষিত সম্প্রদায়, যাদের কলমের একটি খোঁচায় কৃষক, প্রবাস-শ্রমিক, গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকের সকল অর্জন পাচার হয়ে যেতে পারে বিদেশে। আমরা কি নিশ্চিত যে, এই শিক্ষিত সমাজ তাদের শ্রেষ্ট অর্জন শিক্ষাকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করছে? শিক্ষা আছে। কিন্তু বোধ নেই। মানবতা নেই। এই তৃতীয় নয়ন কি বিকলাংগ নয়?

সম্প্রতি আমি একটা ঘটনার সাক্ষী। ঘটনাটিকে অনায়াসে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। মাত্র কয়দিন আগে একজন তরুণ শিক্ষকের সঙ্গে দেখা। আলাপ-চারিতা চলছে। প্রসঙ্গ ক্রমে আসলো এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি। ছোট ছোট কোমলমতি বাচ্চাদের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। তারা দুর্নীতি শিখে অথবা সমাজের প্রতি তীব্র গৃণা নিয়ে বড় হচ্ছে। আমি বিষয়টি নিশ্চিত নই, কিন্তু প্রশাসনের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হচ্ছিল, এই দুর্নীতি প্রবণ দেশে দুর্নীতিটাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে স্বাভাবিক করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা। সে যাই হোক, আমাদের আলাপ-চারিতা এগিয়ে যেতে থাকলো। তরুণ শিক্ষক আমাকে বললেন,
-স্যার, কয়েকদিন ঘুমাতে পারছি না।
-কেন? 
-প্রতিরাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে করতে হয়রান!
-কী বলেন!
আমি শিউরে উঠলাম। প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। মা-বাবা সন্তানের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন তুলে দিয়ে সন্তানকে হত্যা করছেন। এটি কোন বিষয় নয়! প্রশাসন চাইলেই দৃঢ় এবং কার্যকরী পদক্ষেপে প্রশ্নপত্র-ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব। মা-বাবা প্রশ্ন না পেলে তার সন্তানকে হত্যা করা বন্ধ করবেন। কিন্তু একজন শিক্ষক যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে দেন, তিনি পরীক্ষা কক্ষে ফাঁস (!) হওয়া প্রশ্নের উত্তর তার প্রিয় ছাত্রকে কি তৈরি করে দেবেন না?

সমাজে বিকলাংগ তৃতীয় নয়ন নিয়ে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষ আজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৃষক-শ্রমিক-নারীর অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বিদেশে স্থায়ী হচ্ছে। বিদেশে ব্যবসা, বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থায়ী আবাসন সুবিধা নিচ্ছে। স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে উচ্চ-পর্যায় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত নিয়োগ বাণিজ্য এখন একটি সফল ব্যবসার (!) নাম। ঘুষ দীর্ঘদিন থেকে একটি অর্থ উপার্জনের অনিবার্য মাধ্যম। কারা করছে? বিকলাংগ তৃতীয় নয়নধারী তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। এ দায় কার?

বিকলাংগ তৃতীয় নয়নের কাউকে দোষারোপ করার আগে এ দায় শিক্ষকের। শিক্ষককে দায়ী করার আগে একবার অন্যভাবে ভেবে দেখুন। একজন শিক্ষকের (যে কোন পর্যায়ের) কাছে মানব-শিশুর মধ্যে অদৃশ্য কিন্তু অতীব জরুরী একটি তৃতীয় নয়নের জন্ম দেবার সময় একটি সংবাদ এসেছিলো। রাস্তার পাশের দোকানীটার দেনার টাকা শোধ করার। কিংবা টাকার অভাবে তার প্রিয়জনকে হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছে না- সেই সংবাদ। গুরুর আনমনা হবার জন্য কে দায়ী? অদৃশ্য তৃতীয় বিকলাংগ নয়নের জন্য কে দায়ী? সবচেয়ে মেধাবী তরুণকে আজ কে আনমনা করেছে?

সাংঘাতিক বিষয়টি এখনো বলা হলো না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি হতে হয়েছে। কাজেই শিক্ষকদৃন্দের সমস্যা অনুধাবন করার জন্য তাদের উপর একটি জরিপ চালালাম। সবাইকে তাদের সর্বোচ্চ তিনটি সমস্যার কথা লিখতে বলা হলো। সবাই লিখলেন। এবার টালি করার পালা। বেশকিছু সমস্যা উঠে এসেছে- শিক্ষকবৃন্দের আবাসন সমস্যা, ডরমিটরিতে অযৌক্তিকভাবে ভাড়া নির্ধারণ, ক্যাফেটেরিয়াতে খাবারের মান, স্বাস্থ্য বীমা সহ বেশ কিছু শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে মতামত। খেয়াল করলাম- খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মত তিনটি মৌলিক বিষয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ট মেধাবী সন্তানরা উদ্বিগ্ন। ব্যাপারটি আমার কাছে কিছুটা গা সওয়া। কিন্তু সাংঘাতিকভাবে একটি সমস্যা নজরে এলো- শিক্ষকবৃন্দের জন্য পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা। শিক্ষকবৃন্দ যখন বলছেন, তখন সমস্যাটা প্রকট। কিন্তু কতটা প্রকট? কথাটা গোপনীয়। কিন্তু বলাটা জরুরী। প্রিয় পাঠক- কাউকে বলবেন না যেন। একাডেমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীনের দায়িত্ব নিঃসন্দেহে উপাচার্যের পরের পদ। একটি বিল্ডিং এ পাঁচজন ডীন বসেন, সেখানে টয়লেটে কখনো কখনো পাঁচ দিনের উপরেও পানি থাকে না। দুর্মুখেরা বলে, প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় টাকা বাঁচিয়ে কয়েক কোটি টাকা ফেরত পাঠায়। আমি অবশ্য এইসব দুর্মুখোদের কথা বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাস করার মত মানসিক জোরও রাখি না। ব্যাপারটি কিন্তু গুরুতর। আমার ছোট মেয়ে জাফরিন। টয়লেট পছন্দ না হলে, টয়লেটে যাবে না। বিরক্ত করবে। অস্থির হবে। কান্নাকাটি করবে। কিন্তু টয়লেটে যাবে না। ধরুন, তীব্র পেট ব্যথা নিয়ে ক্লাসে গিয়ে একজন শিক্ষক কি শেখাবেন? গোপালভাঁড়ের গল্পটি মনে পড়লো- পৃথিবীর সবচেয়ে সুখ কিসে? গল্পটি নিশ্চয় সবাই জানেন বলে এখানে আর উল্লেখ করলাম না।

থামুন। এবার আপনাদের হাসিটি বন্ধ করুন। ভবিষ্যৎ দেখার শক্তি না থাকলে বর্তমানকেই দেখুন- গোড়া কেটে ফেলা একটি সমাজ কিভাবে ঘূঁনে ধরে? যাদের হাতে সমাজ তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছেন, তাদের মৌলিক অধিকারের দিকে নজর না দিলে কি ঘটতে পারে? সমাজপতি, আপনাদের এই সর্বনাশা খেলা বন্ধ করুন। ভুলে যাবেন না, আপনারাও পাবলিকের টাকায় চলেন। যখন বলেন- আমি চাকরি দিয়েছি, তখন আমার ভীষণ লজ্জা হয়। কারণ, এতে আপনার দুর্নীতি প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। কারো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও আপনি চাকুরি দিয়েছেন। আর যোগ্যতমরা চাকুরি পেলে তো, আপনি দেন নি। বরং সে-ই তার যোগ্যতায় অর্জন করেছে। কয়দিন আগে শিক্ষক অধিকার নিয়ে লেখার মধ্যে 'করে দিয়েছি'র গল্প বলেছিলাম। এই করে দেওয়া যদি শিক্ষককে বলেন- তখন পাপ হয়। শিক্ষকের মাথা উঁচু রাখার জন্য যা যা করতে হয়, তাই তাই করুন। সমাজের সকল মানুষ যাদের কোন না কোন আত্মীয় শিক্ষা গ্রহন করছেন, তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সমাজের কথা চিন্তা করে- শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা করুন। কেননা, আজকের কর্ণধারগণের যোগ্যতা শিক্ষকজাতির জন্য, আমলাদের যোগ্যতা, ব্যাংকার, সামরিক বাহিনীসহ সকল স্তরের মানুষের যোগ্যতা কোন না কোন শিক্ষকের অবদান। শিক্ষকবৃন্দের মৌলিক অধিকার এবং আলাদা মর্যাদা দিয়ে দায়িত্ব দিন। বলুন- জাতির জন্য কোন পর্যায়ে কত মানব সম্পদ দরকার। অশিক্ষিত ও অল্প-শিক্ষিত সম্প্রদায় যেমন জাতীয়ভাবে তাদের অবদান নিশ্চিত করেছে, শিক্ষিতরাও জাতীয়ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পরিস্কার করলে- জাতি প্রবল বেগে এগিয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।