মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
সম্প্রতি পে-কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রদান না করার সুপারিশ করেছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বহুবারই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সব পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সর্বশেষ আলাপেও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়টি উঠে এসেছে। 'স্বতন্ত্র পে-স্কেল অচিরেই বাস্তবায়ন করা হবে'- এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পে-কমিশনের প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা যাবে না মর্মে সুপারিশ থাকায় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বর্তমান পে-কমিশনের সুপারিশ সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বস্তরের শিক্ষকদের চরমভাবে হতাশ করেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বিদ্যমান বেতন কাঠামোতে বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪০৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন ৮৩৬৯ ডলার। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী না হলেও শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পার্থক্য এভারেস্ট সমান। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক প্রতি মাসে ৬০ হাজার রুপি; আর একজন অধ্যাপক এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেলেও এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন একশ'বার গালমন্দ করি। সেই পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে দুই লাখ তিন হাজার থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান।
বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, ইথোপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। ওই সব দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বেতন পান যথাক্রমে : ১০৩৭, ৮৬৪, ২৭৫৮ এবং ১৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে : ২৩০৪, ১৫৮০, ৬২২৯ এবং ৪৫৫০ ডলার।
যদিও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বহুবার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চবেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। 'সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সাল কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই' শীর্ষক প্রবন্ধে 'শিক্ষা' উপ-শিরোনামেও বিষয়টি বলা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে : '২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে' ('ভিশন ২০২১', ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা : ২০০৯, পৃ. ৫১)। ২০০৮ ও ১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ইশতেহারেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল প্রদান ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল (পৃ. ৩৪)। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে : 'আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে' (পৃ. ৫৮)। এসব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর 'অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার' আহ্বান শিক্ষকদের আশান্বিত করেছিল যে, অচিরেই হয়তো তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও পে-কমিশনের 'স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা যাবে না' মর্মে সুপারিশ সব স্তরের শিক্ষকদের হতাশ করেছে। উপরন্তু এমন বক্তব্য ভবিষ্যতে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয়।
দুই. নির্বাচনী ইশতেহার, জাতীয় শিক্ষানীতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলদের বারবার প্রতিশ্রুতি প্রদান প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের বহুবার আশান্বিত করেছে। বর্তমান সরকার তাদের যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করবে বলে তারা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও পে-কমিশনের সুপারিশে সে বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় শুভঙ্করের ফাঁকি ধরা পড়েছে। আর ওই বক্তব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সেবার বদলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে উৎসাহিত করবে। তারাও অন্যান্য লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতো নিজের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত বেতনের বোঝা চাপিয়ে দিতে অথবা নানা প্রাসঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক খাত দেখিয়ে অর্থ আদায়ের সুযোগ খুঁজবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ বর্তমান পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। অধিক অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করার প্রবণতা বাড়বে; তেমনি অন্য স্তরের শিক্ষকরাও নানা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়াতে উদ্যোগী হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চ অর্থ ব্যয় করে শিক্ষাগ্রহণ করা শিক্ষার্থীর অভাব হবে না। ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পাশাপাশি ছাত্রদের বেতন, পরীক্ষা ও ভর্তি ফি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পে-কমিশনের এই সুপারিশ বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনের 'কপি অ্যান্ড পেস্ট' বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বহুবার শিক্ষায় বিনিয়োগের বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
পরিশেষে, বর্তমান পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে নতুন একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করছি। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল : 'সব স্তরের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতনভাতাসহ সুযোগ-সুবিধার জন্য যথাযথ ব্যবস্থার সুপারিশ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব মহলের প্রতিনিধিত্ব সংবলিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে।' প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জোর দাবি জানাচ্ছি। আর সরকারি-বেসরকারি অথবা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য রোধে প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকদের মূল বেতন একই নির্ধারণের বিষয়টি ভাবতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
salah.sakender@gmail.com
Source: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/01/14/56035
0 comments:
Post a Comment