Thursday, January 8, 2015

স্বল্প সম্মানী ও ডিজিটাল শিক্ষার প্রত্যাশা

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার


‘শিক্ষকের জন্য বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ’ এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ কি আমরা শিক্ষকের জন্য কোনো বিনিয়োগ করছি? শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ বলতে সাধারণভাবে শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধায় বিনিয়োগ করাকেই বোঝাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমরা শিক্ষকদের জন্য তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? কিন্তু সেই বিনিয়োগ যদি ‘কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো কাগজে-কলমে হয় অথবা শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্যের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ থাকে; তবে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগও যে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সম্মানের দিক দিয়ে শিক্ষকরা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ— এমন মুলা ঝুলিয়ে আগের মতো শিক্ষকদের সম্মানী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চিত রাখলে শিক্ষাব্যবস্থার কখনই আমূল পরিবর্তন হবে না। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়— প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ অবস্থার অবসানই কেবল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি।
২০০৯ সালের বেতন কাঠামো অনুসারে বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪ হাজার ৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন ৮ হাজার ৩৬৯ ডলার। যুক্তরাজ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী নয়। তাই ভারতের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যে বেতন পান, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার কাছাকাছি বেতন দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের শিক্ষক সমাজের। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মাসে ৬০ হাজার রুপি; আর একজন অধ্যাপক ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ রূপি পর্যন্ত বেতন পেলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। (টাকার অঙ্কে বেতন বলতে লজ্জা লাগছে। তাই ডলারে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছি!) আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন ১০০ বার গালমন্দ করি, তারাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে ২ লাখ ৩ হাজার থেকে ৪ লাখ রুপি পর্যন্ত সম্মানী পান।
বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি, সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। ওইসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা বেতন পান যথাক্রমে ১ হাজার ৩৭, ৮৬৪, ২ হাজার ৭৫৮ এবং ১ হাজার ৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে ২ হাজার ৩০৪, ১ হাজার ৫৮০, ৬ হাজার ২২৯ এবং ৪ হাজার ৫৫০ ডলার।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নন; প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের আকাশ-পাতাল তফাত। মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের অবস্থাও একই। আমাদের দেশের শিক্ষকদের কম বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে যতটা না অর্থনৈতিক সংকট দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী উচ্চপর্যায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সংকীর্ণ মানসিকতা। বাংলাদেশের মানুষ সাদা পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনো হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তিকেই শিক্ষক বলে জানে। ধরেই নিই, শিক্ষকরা হবেন অতিভদ্র, বিদ্যার ভারে তাদের মাথা নোয়াবে। সাদাসিধে জীবনযাপন করবেন তারা। আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানি, পাঠান, মোগল, ইংরেজ অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক মানেই চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠে। আমরা ভুলেই গেছি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এখন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী পড়াতে ইন্টারনেট ঘাটতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের যদি আর্য-মৌর্য যুগের সম্মানী দেই, তবে তাদের পক্ষে কি শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া সম্ভব?
শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত করে গড়তে চাইলে শিক্ষকদের সম্মানীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। বৈদিক যুগের গুরু দক্ষিণা ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা শিক্ষকের জীবন নির্বাহ অথবা পাল যুগের বিহারগুলোয় থাকা খাওয়ার বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকই বৈদিক যুগের মতো গুরু দক্ষিণা নিয়ে অথবা পাল যুগের মতো লজিং থেকে ছাত্র পড়ান। আর যারা সরকারি বেতন পান, তাদের অবস্থাও খুব ভালো, এমন নয়। উচ্চ বাজারমূল্যের যুগে যে বেতন তারা পান, তা দিয়ে মাসের অর্ধেকও চলে না।
সম্মানজনক সম্মানী না পেলেও কোনো সময়ই শিক্ষকদের সম্মানের কমতি হয়নি। প্রায় সব যুগেই শিক্ষকতা মহান পেশা হিসেবে পেয়েছে স্বীকৃতি। এ ডিজিটাল যুগে এসে অবশ্য শুধু সম্মান দিয়ে শিক্ষকদের সংসার আর চলছে না। সারা মাস দোকান থেকে বাকি নেয়ার পর অথবা মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দেয়ার মতো যখন পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না; তখন একজন শিক্ষকের সম্মান অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত দোকানদার আর বাড়িওয়ালার কাছে বানের পানির মতো ভেসে যায়। তাদের অকথ্য গালিগালাজ আর কটু কথায় শিক্ষকের সম্মান জানালা দিয়ে পালায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য স্থায়ী পে কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে, কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ শিক্ষকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, জাতীয় পে-কমিশন নিশ্চয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করবে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পে-কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশ হলেও সেখানে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কোনো উল্লেখ নেই, যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের হতাশ করেছে। যদিও নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের ‘অস্ত্র নয়, শিক্ষায় বিনিয়োগ করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করছি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ওই আহ্বানের কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে? পাশাপাশি শিক্ষা খাতে তথা শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।
পরিশেষে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসা পর্যন্ত সরকার যত উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অসম্ভব। একজন ভালো মানের কারিগরের পক্ষেই উচ্চমানের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই অধিক হারে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, যখন তাদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করে সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Published in: http://www.bonikbarta.com/printpage/preview/24680.html

    Saturday, January 3, 2015

    শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল ও শিক্ষানীতিতে অঙ্গীকার


    আবু সালেহ সেকেন্দার



    সম্প্রতি পে-কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রদান না করার সুপারিশ করেছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বহুবারই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সব পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সর্বশেষ আলাপেও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়টি উঠে এসেছে।
    ‘স্বতন্ত্র পে-স্কেল অচিরেই বাস্তবায়ন করা হবে’– এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পে-কমিশনের প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ণ করা যাবে না মর্মে সুপারিশ থাকায় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, বর্তমান পে-কমিশনের সুপারিশ সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল স্তরের শিক্ষকদের চরমভাবে হতাশ করেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

    বিদ্যমান বেতন কাঠামোতে বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪,০৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও, একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন ৮,৩৬৯ ডলার।


    ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী না হলেও শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পার্থক্য এভারেস্ট সমান। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক প্রতি মাসে ৬০,০০০ রুপি, আর একজন অধ্যাপক ১ লাখ ৫ পঞ্চাশ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেলেও এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

    আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন একশতবার গালমন্দ করি, সেই পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে ২ লাখ ৩ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান!

    বাংলাদেশের কাছাকাছি যে সব দেশের জিডিপি, সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখিস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েক গুণ বেশি। ওই সব দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বেতন পান যথাক্রমে, ১,০৩৭ ডলার, ৮৬৪ ডলার, ২,৭৫৮ ডলার এবং ১,৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে: ২,৩০৪ ডলার, ১,৫৮০ ডলার, ৬,২২৯ ডলার এবং ৪,৫৫০ ডলার।

    বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বহুবার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। ‘সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সাল কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘শিক্ষা’ উপ-শিরোনামেও বিষয়টি বলা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে:

    ‘‘২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়ণে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’’

    [‘ভিশন ২০২১’, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ৫১]


    ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ইশতেহারেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল প্রদান ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

    [পৃ. ৩৪]

    ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে:

    “আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।”

    [পৃ. ৫৮]

    এই সব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর ‘অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার’ আহবান শিক্ষকদের আশান্বিত করেছিল যে, অচিরেই হয়তো তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও, পে-কমিশনের ‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা যাবে না’ মর্মে সুপারিশ সকল স্তরের শিক্ষকদের হতাশ করেছে। উপরন্তু এমন বক্তব্য ভবিষ্যতে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয়।

    দুই.

    নিবার্চনী ইশতেহার, জাতীয় শিক্ষানীতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলদের বারবার প্রতিশ্রুতি প্রদান প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের বহুবার আশান্বিত করেছে। বর্তমান সরকার তাদের যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করবে বলে তারা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও পে-কমিশনের সুপারিশে সেই বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়াতে শুভঙ্করের ফাঁকি ধরা পড়েছে।

    আর ওই বক্তব্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেবার বদলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে উৎসাহিত করবে। তারাও অন্যান্য লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতো নিজের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত বেতনের বোঝা চাপিয়ে দিতে অথবা নানা প্রাসঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক খাত দেখিয়ে অর্থ আদায়ের সুযোগ খুঁজবে।


    শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ বর্তমান পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। অধিক অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করার প্রবণতা বাড়বে; তেমনি অন্য স্তরের শিক্ষকরাও নানা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়াতে উদ্যোগী হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চ অর্থ ব্যয় করে শিক্ষা গ্রহণ করা শিক্ষার্থীর অভাব হবে না। ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পাশাপাশি ছাত্রদের বেতন, পরীক্ষা ও ভর্তি ফি বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

    পে-কমিশনের এই সুপারিশ বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনের ‘কপি অ্যান্ড পেস্ট’ বলে মনে হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে বহুবার শিক্ষায় বিনিয়োগের বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

    পরিশেষে, বর্তমান পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে নতুন একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করছি। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল:

    ‘‘সকল স্তরের শিক্ষকদের মর্যদা ও বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধার জন্য যথাযথ ব্যবস্থার সুপারিশ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতিনিধিত্ব সংবলিত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে।’’

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জোর দাবি জানাচ্ছি। আর সরকারি, বেসরকারি অথবা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য রোধে প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকদের মূল বেতন একই নির্ধারণের বিষয়টি ভাবতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করছি।


    প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ:

    ১.

    http://www.moedu.gov.bd/index.php?option=com_content&task=view&id=338&Itemid=416

    ২.

    http://www.eduicon.com/News/Details/3627.html

    আবু সালেহ সেকেন্দার: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

    Published in: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/23800