‘শিক্ষকের জন্য বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ’ এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ কি আমরা শিক্ষকের জন্য কোনো বিনিয়োগ করছি? শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ বলতে সাধারণভাবে শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধায় বিনিয়োগ করাকেই বোঝাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমরা শিক্ষকদের জন্য তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? কিন্তু সেই বিনিয়োগ যদি ‘কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো কাগজে-কলমে হয় অথবা শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্যের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ থাকে; তবে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগও যে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সম্মানের দিক দিয়ে শিক্ষকরা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ— এমন মুলা ঝুলিয়ে আগের মতো শিক্ষকদের সম্মানী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চিত রাখলে শিক্ষাব্যবস্থার কখনই আমূল পরিবর্তন হবে না। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়— প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ অবস্থার অবসানই কেবল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি।
২০০৯ সালের বেতন কাঠামো অনুসারে বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪ হাজার ৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন ৮ হাজার ৩৬৯ ডলার। যুক্তরাজ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী নয়। তাই ভারতের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যে বেতন পান, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার কাছাকাছি বেতন দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের শিক্ষক সমাজের। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মাসে ৬০ হাজার রুপি; আর একজন অধ্যাপক ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ রূপি পর্যন্ত বেতন পেলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। (টাকার অঙ্কে বেতন বলতে লজ্জা লাগছে। তাই ডলারে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছি!) আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন ১০০ বার গালমন্দ করি, তারাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে ২ লাখ ৩ হাজার থেকে ৪ লাখ রুপি পর্যন্ত সম্মানী পান।
বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি, সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। ওইসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা বেতন পান যথাক্রমে ১ হাজার ৩৭, ৮৬৪, ২ হাজার ৭৫৮ এবং ১ হাজার ৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে ২ হাজার ৩০৪, ১ হাজার ৫৮০, ৬ হাজার ২২৯ এবং ৪ হাজার ৫৫০ ডলার।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নন; প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের আকাশ-পাতাল তফাত। মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের অবস্থাও একই। আমাদের দেশের শিক্ষকদের কম বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে যতটা না অর্থনৈতিক সংকট দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী উচ্চপর্যায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সংকীর্ণ মানসিকতা। বাংলাদেশের মানুষ সাদা পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনো হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তিকেই শিক্ষক বলে জানে। ধরেই নিই, শিক্ষকরা হবেন অতিভদ্র, বিদ্যার ভারে তাদের মাথা নোয়াবে। সাদাসিধে জীবনযাপন করবেন তারা। আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানি, পাঠান, মোগল, ইংরেজ অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক মানেই চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠে। আমরা ভুলেই গেছি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এখন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী পড়াতে ইন্টারনেট ঘাটতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের যদি আর্য-মৌর্য যুগের সম্মানী দেই, তবে তাদের পক্ষে কি শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া সম্ভব?
শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত করে গড়তে চাইলে শিক্ষকদের সম্মানীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। বৈদিক যুগের গুরু দক্ষিণা ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা শিক্ষকের জীবন নির্বাহ অথবা পাল যুগের বিহারগুলোয় থাকা খাওয়ার বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকই বৈদিক যুগের মতো গুরু দক্ষিণা নিয়ে অথবা পাল যুগের মতো লজিং থেকে ছাত্র পড়ান। আর যারা সরকারি বেতন পান, তাদের অবস্থাও খুব ভালো, এমন নয়। উচ্চ বাজারমূল্যের যুগে যে বেতন তারা পান, তা দিয়ে মাসের অর্ধেকও চলে না।
সম্মানজনক সম্মানী না পেলেও কোনো সময়ই শিক্ষকদের সম্মানের কমতি হয়নি। প্রায় সব যুগেই শিক্ষকতা মহান পেশা হিসেবে পেয়েছে স্বীকৃতি। এ ডিজিটাল যুগে এসে অবশ্য শুধু সম্মান দিয়ে শিক্ষকদের সংসার আর চলছে না। সারা মাস দোকান থেকে বাকি নেয়ার পর অথবা মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দেয়ার মতো যখন পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না; তখন একজন শিক্ষকের সম্মান অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত দোকানদার আর বাড়িওয়ালার কাছে বানের পানির মতো ভেসে যায়। তাদের অকথ্য গালিগালাজ আর কটু কথায় শিক্ষকের সম্মান জানালা দিয়ে পালায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য স্থায়ী পে কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে, কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ শিক্ষকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, জাতীয় পে-কমিশন নিশ্চয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করবে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পে-কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশ হলেও সেখানে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কোনো উল্লেখ নেই, যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের হতাশ করেছে। যদিও নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের ‘অস্ত্র নয়, শিক্ষায় বিনিয়োগ করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করছি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ওই আহ্বানের কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে? পাশাপাশি শিক্ষা খাতে তথা শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।
পরিশেষে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসা পর্যন্ত সরকার যত উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অসম্ভব। একজন ভালো মানের কারিগরের পক্ষেই উচ্চমানের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই অধিক হারে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, যখন তাদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করে সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment