বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগ কম্পিউটারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম বিভাগ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলকভাবে নবীন। ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করে এই বিভাগ। মেধাবী ছাত্ররা এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুবাদে শুরু থেকেই শিক্ষায় উৎকর্ষ বজায় রেখে চলেছে। ইকরাম হোসাইন আমাদের বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র হলেও অনেক কিছুতেই প্রথম। যেমন আমাদের বিভাগ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করা স্নাতকদের মধ্যে সে প্রথম পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের স্নাতকদের মধ্যে সে-ই প্রথম আইইইইর (ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স) একাধিক জার্নালের সম্পাদক হয়েছে। পরিশেষে সে-ই প্রথম স্নাতক, যে আইইইইর অত্যন্ত সম্মানজনক ফেলো নির্বাচিত হয়েছে।
আমাদের বিভাগে মাস্টার্স কোর্স করার সময় ইকরামের অধ্যবসায়, একাগ্রতা ও শিক্ষাগবেষণার প্রতি নিবেদন চোখে পড়ে। দিনের যেকোনো সময়ে তাকে ল্যাবরেটরিতে পাওয়া যেত এবং গভীর রাত পর্যন্ত সে কাজ করত।
১৯৯৭ সালে সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি করার পর পারফেক্ট গ্রেড নিয়ে ২০০১ সালে কানাডার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে। স্বীয় কর্মদক্ষতা ও গবেষণা উৎকর্ষ দ্বারা সে সময়ের আগেই সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়। ২০১০ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পায়, যখন তার বয়স ৩৭ বা ৩৮-এর বেশি হবে না। কগনিটিভ ও সেলুলার রেডিও নেটওয়ার্কে স্পেকট্রাম ও রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে আইইইইর ফেলো নির্বাচিত করা হয়।
একজন মানুষ কতটা নিবেদিতপ্রাণ হতে পারে, তা ইকরামের কর্মযজ্ঞ পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। অধ্যাপক হোসাইন IEEE Communications Surveys and Tutorials-এর মুখ্য সম্পাদক, তা ছাড়া IEEE Journal on Selected Areas in Communications - Cognitive Radio Series and IEEE Wireless Communications-এর একজন সম্পাদক। এ ছাড়া সে IEEE Press ও IEEE Transactions on Wireless Communications-এর সম্পাদনা পরিষদের একজন সদস্য।
কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে এ পর্যন্ত সে দশটি বই লিখেছে। তার লেখা অনেক গবেষণাপত্রই বিজ্ঞানী সমাজের নজর কেড়েছে এবং অনেকবার উদ্ধৃত হয়েছে। সে আইইইই কমিউনিকেশনস সোসাইটির ডিস্টিঙ্গুইস্ট লেকচারার। ছাত্রজীবন থেকেই উন্নত মানের গবেষণার জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত, যার বিশদ বৃত্তান্ত http://home.cc.umanitoba.ca/~hossaina/ekram_vita.pdf -এ রয়েছে। দেশেও সে একাডেমিক অবদানের জন্য ড. এম এ রশীদ স্বর্ণপদক পেয়েছে ২০০১ সালে।
ভাবতে অবাক লাগে, ১২ বা ১৩ বছর সময়ের মধ্যেই সে ১২৯টি জার্নাল পেপার, দুটি আমেরিকান প্যাটেন্ট, ১৮টি বইয়ের অধ্যায় ও ১৩৮টি কনফারেন্স পেপার প্রকাশ করেছে, উদ্ধৃতি প্রায় ১০ হাজার! বছরের যেকোনো সময়ে ছাপানোর অপেক্ষায় যে পেপারগুলো থাকে, তার তালিকা দেখলেই বোঝা যায় যে সে কী গতিতে কাজ করে। এ পর্যন্ত নয়জন ছাত্রের পিএইচডির কাজ সফলতার সঙ্গে তত্ত্বাবধান করেছে। বর্তমানে সাতজন ছাত্র ও আটজন পোস্টডক্টরাল ফেলো তার তত্ত্বাবধানে গবেষণা করছে। এ পর্যন্ত ১২টি জার্নালের সম্পাদনা পরিষদে কাজ করেছে, তার বেশির ভাগই আইইইইর। এ ছাড়া ১৮টি জার্নালের অতিথি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে। প্রায় ২৫টি কনফারেন্স, ওয়ার্কশপের চেয়ার কিংবা কো-চেয়ার হিসেবে কাজ করেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে অধ্যাপক ইকরাম হোসাইনের গবেষণা নিশ্চয়ই খুব উঁচু মানের হবে। সাধে তো আর আইইইই তাকে ফেলো নির্বাচিত করেনি, যেখানে আমাদের দেশের একজনও নেই। আমরা যদি শুধু সংখ্যার দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের একজন অধ্যাপক হয়তো তার ৫০ ভাগের এক ভাগ কাজ করে না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা-ই সত্য, যদিও আমি ইকরামের একজন শিক্ষক এবং স্নাতক পর্যায়ে তার থিসিস সুপারভাইজার ছিলাম।
কিছুদিন আগে হাইডেলবার্গ লরেট ফোরামে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম, যেখানে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিতের সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। এই বিষয়গুলোতে নোবেল পুরস্কার নেই বলে কম্পিউটারের টুরিং পুরস্কার ও গণিতের ফিল্ডস মেডালকে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য ধরা হয়। সেই আসরে ভারত কিংবা ভিয়েতনাম থেকে লরেট ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একজনও নয়, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকেও নয়। আমি কামনা করি, ইকরাম তার প্রশংসনীয় গবেষণা তৎপরতাকে আরও বেগবান করবে এবং আমাদের দেশও ওই আসরে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করবে।
ইকরাম হোসাইনকে আবারও অভিনন্দন। সিএসই পরিবার ও গোটা দেশ তার অর্জনে গর্বিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানে গবেষণায় ইকরাম হোসাইন আরও অসাধারণ অর্জন করবে, এই প্রত্যাশায় রইলাম।
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/476113
0 comments:
Post a Comment