আমরা যারা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা খোঁজখবর রাখি সবাই কথায় কথায় বলে থাকি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই। প্রতিটি সরকারও তার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ক্ষমতা ছাড়ার সময় পর্যন্ত (আর বিরোধী দলে থাকাকালীন ক্ষমতায় আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত) প্রতিনিয়তই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথাও বলে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন পর্যায়ে পাসের হার বাড়ছে (বিশেষত শহর এলাকায়)। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটছে এর উল্টোটা। এর কারণ হিসেবে কি বলা যাবে যে, প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রীরা মেধাবী না বা কম মেধাবী? মোটেও সেটি বলা যাবে না। প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক মেধাবী, যাদের নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা (শহর এলাকার ১০ ভাগের ১ ভাগ দিতে পারলেও) দিতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বা তাক লাগানোর মতো কিছু ঘটতে পারত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে কোনোমতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে পরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীর (এমনকি প্রথম/দ্বিতীয়/... স্থান অধিকার করে ফেলে) তালিকায় ঢুকে যায়। আবার পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফল করে এসেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে খুব খারাপ ফল করাটা অতি স্বাভাবিক। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে যে, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে মুখস্থ করার প্রবণতা এবং প্রাইভেট কোচিংয়ের একটা প্রভাব থাকে, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও প্রকটভাবে দেখা যায় না। তবে সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষার মান নিয়ে কেউই সন্তুষ্ট না_ না সরকারের মন্ত্রীরা, না শিক্ষাবিদরা, না অভিভাবকরা। এরই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে গত ২৪ জুলাই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রীর শিক্ষার মান নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে (শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে)। তার মতে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে অবহেলিত ও দুর্বল মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আসবে। দল-মত সবাই এ ব্যাপারটিতে একমত হবেন! বর্তমানে আমরা ছাত্রছাত্রীদের যে শিক্ষা দিচ্ছি তাহলো চাকরিমুখী শিক্ষা_ লেখাপড়া শেষে যেভাবেই হোক তাকে একটা চাকরি পেতেই হবে!
মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন কারা? বেশিরভাগই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রী, যাদের অধিকাংশই অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বা ভর্তির সুযোগ পায়নি। তাদের বেশিরভাগকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পেতে হয়। এবার শুরু হলো তার শিক্ষকতা। আমরা বলি ভালো বীজে ভালো ফসল, আর এ ক্ষেত্রে ভালো ফসল হলো ভালো ছাত্র। তাহলে কতটুকু ভালো ছাত্র আশা করা যায়? এরই ঠিক কয়েক বছর পর আবার বর্তমানের ভালো ছাত্রটিই (!) আবার পূর্বের প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবে ওই স্কুল-মাদ্রাসাটিতে। তাহলে শিক্ষার মান প্রতিনিয়তই বাড়বে না কমবে? এই সমস্যাটি থেকে উত্তরণের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে আলাদা একটি কমিশন বা অনুরূপ কিছু করা যেতে পারে, যারা কেন্দ্রীয়ভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করবেন।
এবার আসা যাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মানের ব্যাপারে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি বলেই (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ৬০-৬৫ নম্বর পেয়ে চাকরি না পেলেও বিভিন্ন কোটায় ৫০ নম্বর পেয়ে চাকরি পেয়ে গেল। সেখানেও যে নিয়োগে অনিয়ম হয় না সেটাও বলা যাবে না। তবে তার তীব্রতা-মাত্রা কিছুটা কম। কারণ সেখানে একটি লিখিত পরীক্ষায় একেবারেই অযোগ্যদের ছেঁকে নেওয়া হয়। আবার মৌখিক পরীক্ষায়, এখানেও থাকেন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা (সাধারণত সরকারি দলের)। সব মিলিয়ে এখানেও যে আমরা খুব ভালো ছাত্রছাত্রীটিকে শিক্ষক হিসেবে পাচ্ছি তা বলা যাবে না। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকেই শুরু হয় শিক্ষার মানের ব্যাপারটি।
এরপর হলো শিক্ষার মানটি ধরে রাখা বা উন্নীত করা। এটি করতে হলে প্রতিনিয়তই আমাদের সচেষ্ট হতে হবে, কেমন করে ভালো ছাত্রছাত্রীটিকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। যেন একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার পর অন্য চাকরি না খোঁজেন, তিনি যেন এখানে তার অবস্থায় তৃপ্ত হন তার ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টাটুকু অব্যাহত রাখতে। সেখানেই আসে শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রসঙ্গ। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একটা বড় ক্ষোভ হলো এই পদোন্নতি নিয়ে। দেখা যায়, একই পদে সারাজীবন চাকরি করে অবসর নিতে হয়। অথচ একই পদমর্যাদার অন্য চাকরির বেলায় পদোন্নতিসহ অধিকতর আর্থিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই চাকরি প্রার্থীরা শিক্ষকতার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা তো আরও করুণ। তাদের দীর্ঘ সময়ের দাবি প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা দান করা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকের অনুরূপ দাবি মেনে নিলেও প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যাপারে কোনো আন্তরিকতা দেখা যায়নি। আবার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি করার ঘোষণা (প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক) দিলেও এখনও সেগুলোর কোনোই সুরাহা হয়নি_ এখন সেগুলো না রেজিস্টার্ড, না সরকারি! তারা আরও হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। ফলে অনেক হতাশা আর বঞ্চনা নিয়ে তারা এখন আবার আন্দোলন শুরু করেছেন (যা বর্তমানে চলমান)। বিভিন্ন খাতে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও এই খাতে সরকার একটু সহানুভূতিশীল হলে ভবিষ্যতে অধিকতর মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেতে পারত অধিকতর উন্নত শিক্ষা।
সবগুলো সরকার এসেই বলে যে, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিতে হবে, নইলে ভালো ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতায় আসবে না, শিক্ষার মান বাড়বে না ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে কি কিছু হচ্ছে? কারও কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তাকে তো অন্তত কিছু দিতে হবে। শিক্ষকরা যখন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ শুধু আশ্বাস আর দাবি নিয়েই চলছেন, তখন অন্য অনেকেই স্বতন্ত্র বেতন স্কেল-ভাতা পেয়ে গেলেন। সুতরাং সরকারের এখন বুঝতে হবে যে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি না করে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্বমানের কর্মমুখী শিক্ষা লাভ করতে পারে। আর এই দায়িত্বটুকু শিক্ষকদের ওপর না দিয়ে সরকারকেই আরও আন্তরিক হতে হবে। বর্তমান অবস্থায় এটি কখনও সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে রাজনীতি না করে বাস্তবতার নিরিখে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে দেশের সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
iqbal21155@bau.edu.bd
Published in: http://archive.samakal.net/2013/11/02/17378
0 comments:
Post a Comment