Thursday, April 24, 2014

শিক্ষকতা, সম্মান ও সম্মানী

মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার

সম্মানের দিক থেকে শিক্ষকরা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ। কিন্তু সম্মানী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা আজও বঞ্চিত। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না। শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি, নেতাদের স্লোগানে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর বিষয়টি যুগ-যুগান্তর ধরে উচ্চারিত হলেও কোনো সরকারই সম্মানজনক স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করেনি। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকের এখনও নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। শিক্ষকের ছাত্র-ছাত্রীরাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী হলেও দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের পিছু ছাড়ে না। শুধু সম্মান নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

ক্ষমতার শীর্ষে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে অথবা শিক্ষককে কাছে পেলে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দে বিগলিত হন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে মুখে রাটি পর্যন্ত করেন না। মহামান্য বিচারকরা কত শত বিষয়ে স্বপ্রণোদিত রায় প্রদান করেন অথবা আইনজীবীরা প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হন; কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের, তাদের কোনো শিক্ষার্থীই তাদের উপযুক্ত সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয় না।

সরকারি ও বিরোধী দলের সব নেতাই কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। তারাও সংসদে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিল উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এমনটি কেউ কখনও করেছেন বলে শুনিনি। বরং একজন খ্যাতিমান অধ্যাপককে সংসদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে প্রশ্ন করা হয়েছে, এত টাকা কোথা থেকে আসে? গাড়ি-বাড়ি কোথায় পান? স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও তাই শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রাপ্তির দাবি পূরণ হয়নি।

ধব ধবে সাদা পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনও হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তিকেই আমরা শিক্ষক বলে জানি। ধরেই নেই, শিক্ষকরা হবেন অতি ভদ্র, বিদ্যার ভারে তাদের মাথা নুয়ে যাবে। সাধাসিদে জীবনযাপন করবেন তারা। আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানী, পাঠান, মুঘল, ইংরেজ অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক মানেই এমন চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠে। কিন্তু আমরা ভুলেই গেছি, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। ডিজিটাল যুগে আছি আমরা। এখন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়াতে ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়। সর্বশেষ তথ্য জানাতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের যদি কম সম্মানী দেই, তাহলে তাদের পক্ষে কি ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া সম্ভব?

শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত করে গড়তে চাইলে শিক্ষকদের সম্মানীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও দেশের অনেক শিক্ষক বৈদিক যুগের মতো গুরুদক্ষিণা নিয়ে অথবা পাল যুগের মতো লজিং থেকে ছাত্র পড়ান। যারা সরকারি বেতন পান, তাদের অবস্থাও যে খুব ভালো, এমন নয়। উচ্চ বাজার মূল্যের যুগে যে বেতন তারা পান, তা দিয়ে মাসের অর্ধেকটাও চলে না।

সম্মানজনক সম্মানী না পেলেও কোনো সময়েই শিক্ষকদের সম্মানের কমতি হয়নি। প্রায় সব যুগেই শিক্ষকতা মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খলিফা হারুন তার পুত্র আমীনের শিক্ষককে ছাত্র প্রহারের যেমন অনুমতি দিয়েছেন, তেমনি মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব তার পুত্র কেন শিক্ষককে নিজ হাতে পা ধুয়ে না দিয়ে শুধু পানি ঢেলেছে, তা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু এখন শিক্ষকের সেই সম্মানটুকুও যেতে বসেছে। ছাত্র কর্তৃক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতার অবৈধ দাবি না মানায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারের টাকা কাজ না করেও তুলে নিতে বাধা দেয়ায় অথবা পান্তা-ইলিশের আয়োজন না করায় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। আর পরীক্ষার হলে নকল ধরায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কত শিক্ষককে যে বখাটে শিক্ষার্থীদের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

উপযুক্ত সম্মানী ও যথাযথ সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্বও কম নয়। শিক্ষকরা যদি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারপন্থী আর সরকারবিরোধী পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েন, তবে শিক্ষকদের সম্মান দিন দিন কমবে বৈ বাড়বে না! আর স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রাপ্তির স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে না। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা কখনোই সরকারের কাছে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়টি উত্থাপন করবেন না। বরং নিজের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব কষে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, ব্যাংকের এমডি, পরিচালক হয়ে আখের গোছাবেন। সাধারণ শিক্ষকরা যে তিমিরেই ছিলেন, সেই তিমিরেই থেকে যাবেন। আর ওইসব লেজুড়বৃত্তিকারীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা ছাত্রনেতারা শিক্ষক লাঞ্ছিত করে পার পেয়ে যেতে থাকলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী এক শিক্ষকের মতো যদি অন্য দলবাজ শিক্ষকরাও ফতোয়া দেয়া শুরু করেন : পরীক্ষায় পাস করা লাগবে না, ছাত্রলীগ করলেই চাকরি, তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষও শিক্ষকদের আর সম্মানের চোখে দেখবে না। তাই শিক্ষকদের সম্মানজনক সম্মানী পেতে ও সম্মান ধরে রাখতে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি পরিহার করে গবেষণায় নিয়োজিত হয়ে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজেদের গড়তে হবে। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি উত্থাপন করতে হবে। ঢাবির ওই দলকানা শিক্ষকের মতো পাস না করলেও দলীয় বিবেচনায় চাকরি দেয়ার ফতোয়া বন্ধ করতে হবে।

প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আনার জন্য সরকার যত উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন, তাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অসম্ভব। একজন ভালো মানের কারিগরের পক্ষেই উচ্চমানের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই অধিক হারে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, যখন তাদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করা। সরকারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও সহকারী শিক্ষকদের কথাও ভাবতে হবে। উভয়ের সম্মানজনক সম্মানী নিশ্চিত করতে হবে।

২০১৪ সালের মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির বাস্তবায়নই পূরণ করতে পারে শিক্ষকদের সম্মানজনক সম্মানী প্রাপ্তির দীর্ঘদিনের দাবি। এক্ষেত্রে বর্তমান পে-কমিশনকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।


মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


salah.sakender@gmail.com

Published in: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2014/04/24/91722

Tuesday, April 15, 2014

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি

এম এম আকাশ, মোহাম্মদ তানজিমউদ্দীন খান, সেলিম রেজা নিউটন, মোহাম্মদ নাসের, সুস্মিতা চক্রবর্তী, মানস চৌধুরী, বখতিয়ার আহমেদ, আ-আল মামুন মেহের নিগার, মোশাহিদা সুলতানা, স্বাধীন সেন, কাজী মারুফুল ইসলাম, মাহমুদুল সুমন, রোবায়েত ফেরদৌস, সামিনা লুত্ফা ও ফাহমিদুল হক


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং সান্ধ্য কোর্স বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাকে ঘিরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ইস্যুটি আবার সচল হয়েছে। এটা একটা চলমান ইস্যু এবং তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি চরিত্র অক্ষুণ্ন থাকবে না বেসরকারিকরণের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে—এই দুইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে।

নব্বই-পরবর্তী তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের স্রোতে ভেসে ভারী শিল্প, স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা সবকিছুর যথেচ্ছ বেসরকারিকরণ ঘটেছে। এই জোয়ারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাবন ঠেকানো যায়নি। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক বাস্তবতা। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচারে-কালচারে কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে হবে? নব্বইয়ের আগে এইসব বাণিজ্যিক কোর্সের অস্তিত্ব তেমন ছিল না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এইসব সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্সের আমদানি হয়েছে বা হচ্ছে, শিক্ষার সমপ্রসারণের উদ্দেশ্যে নয়, শিক্ষকদের আয়বৃদ্ধির বিষয়টিই এখানে প্রধান থেকেছে। 

একথা ঠিক, ক্রমবর্ধমান বাজারমূল্যের বিপরীতে শুধু শিক্ষকদের কেন, খোদ সরকারি বেতনকাঠামোই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ইথিওপিয়ার মত দরিদ্র দেশ, মাথাপিছু জিডিপি অনুসারে যাদের বিশ্বে অবস্থান ১৬৯তম, তাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের সূচনা বেতনও ৮৬৪ মার্কিন ডলার, আর আমাদের ক্ষেত্রে তা ১৫০ ডলারের কাছাকাছি, যদিও জিডিপি অনুসারে আমাদের অবস্থান ১৫১তম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একজন প্রভাষকের সূচনা বেতন ৩৯৫৪ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের পরিস্থিতিও একইরকম। ইথিওপিয়া, ভারত-পাকিস্তান পারলেও আমরা পারি না। এই ধরনের বেতন কাঠামো দুর্নীতিকে উত্সাহিত করে। আর সান্ধ্য কোর্সে যুক্ত হওয়া শিক্ষকদের দিক থেকে দুর্নীতি নয়, তবে তাকে নৈতিক পতন বলা যায়, যেক্ষেত্রে একই শিক্ষককুল দিবা কোর্সে তাদের সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারেন না বলেই অভিযোগ রয়েছে। বাড়তি একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স চালু হলে দিবা কোর্স অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

শিক্ষকদের জন্য যদি পৃথক বা বর্ধিত বেতনকাঠামো দাঁড় করানো যেত, তবে শিক্ষকদের উপার্জন বৃদ্ধির জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্টিফিকেট বিক্রয় কেন্দ্র বানানোর প্রয়োজন পড়তো না। শিক্ষকদের পৃথক কাঠামোর দাবিটিও পুরনো হতে চলেছে, কিন্তু এটা অর্জনের জন্য শিক্ষক নেতারা নতুন কোনো খবর দিতে পারেন না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগে এটা ইস্যু আকারে আসে এবং নির্বাচনের পরে যথারীতি এটাকে ভুলে যাওয়া হয়। সর্বস্তরের শিক্ষকরাও এই দাবির প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগী না হয়ে বাজারের কষাঘাতে জর্জরিত তারা সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, সান্ধ্য কোর্স ইত্যাদির দিকে ছুটোছুটি করেন। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং বেশ কয়েকটি বিভাগে একইসঙ্গে চালু হতে যাওয়া সান্ধ্য কোর্সের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য। জোট সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৫শ কর্মচারী এবং মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় ২০০ শিক্ষক বাজেট বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই সঙ্কট কাটাতে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ফি বাড়াতে চাচ্ছে। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ধিত ফি প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল করেছে, কিন্তু সান্ধ্য কোর্সের সিদ্ধান্ত বলবত্ থেকেছে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে গেলে তাদের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ প্রায় একত্রে হামলা করে। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে, বেশ কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। কয়েক দফা হামলার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছু ভাঙচুরও করেছে। অনেকেই বলছেন যে, এই ভাঙচুরের পেছনে সর্বত্র সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল না, শিক্ষামন্ত্রী যেমন বলেছেন, ছাত্রশিবির যুক্ত হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এই সহিংসতা দ্বিতীয় পর্যায়ের সহিংসতা, প্রাথমিক সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমেই পুলিশ বৈধ অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপরে হামলা চালিয়েছে, তাদের মদদেই ছাত্রলীগ অবৈধ অস্ত্র হাতে চড়াও হয়েছে। এখন প্রপাগান্ডা মেশিনারিজ সক্রিয় হয়েছে, শিবির জুজুকে দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিকে নস্যাত্ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন এই পুরো ঘটনার জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমে 'দুষকৃতকারী'দের বিরুদ্ধে 'যথাযথ' ব্যবস্থা নিশ্চয়ই নেয়া হবে। শতাধিক শিক্ষার্থীকে আসামি করে ছয়টি মামলা হয়েছে বিশ্বদ্যািলয় কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। যথারীতি আক্রমণকারী পুলিশ ও ছাত্রলীগের কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এরকম শোনা যাচ্ছে যে, যেসব শিক্ষক আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদেরকেও 'দেখে নেয়া' হবে এবং প্রয়োজনে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবিও উচ্চারিত হচ্ছে। নৈতিকতা কোথায় নেমে এসেছে! 

জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকেই সান্ধ্য কোর্স বিরোধী আন্দোলন চলছিল। তবে বর্ধিত ফির ঘোষণায় আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে গত সপ্তাহে। টানা চার-পাঁচদিন পাঁচ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিল। কেবল ২ তারিখে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার পর শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। বিচিত্র নয় যে, পরিস্থিতি ঘোলা করতে বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা জামায়াত-শিবির চক্র অন্তর্ঘাতী আচরণ করছে। কিন্তু শিবিরের উপস্থিতি ছাত্রলীগের সহিংসতাকে বাতিল করে না। অন্যদিকে যে জামায়াত-শিবির বিগত কয়েক মাস পেট্রোল বোমা নির্ভর আন্দোলন করেছে, তাদের পক্ষে সাত-আট হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে পথে নামানো অসম্ভব। 

আমরা মনে করি, বর্ধিত ফির পাশাপাশি সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু হবার বিষয়টি কেবল শিক্ষকদের একতরফা সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় নয়, শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে কী মনে করছে, তাকেও আমলে নিতে হবে। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যদি কোনো সিদ্ধান্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তবে তা নিঃসন্দেহে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও আমরা জোরেশোরে উচ্চারণ করতে চাই, রাষ্ট্র কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দায় আর নেবে না, যা এতদিন তারা নিয়ে এসেছে? নব্বই দশকের শুরু থেকে গৃহীত নিওলিবারেল পুঁজিবাদী দর্শনকেই কেন একমাত্র অর্থনৈতিক দর্শন হিসাবে আমাদের মেনে নিতে হবে, যার প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বব্যাংক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেবার পরামর্শ ক্রমাগত দিতে থাকবে এবং সরকার তার আজ্ঞাবহ হয়ে সর্বাংশে পালন করার চেষ্টা করে যাবে? যদি তাই হয়, রাষ্ট্রের ভূমিকা তাহলে কী আসলে? সামষ্টিক কল্যাণ নিশ্চিত করা কি রাষ্ট্রের কাজ নয়? রাষ্ট্র যদি নিজেই 'লাভজনক বাজার' হয়ে উঠে, তাহলে এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির দরকার বা কী? 

বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার দিকে মনোযোগী হবার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই দায়িত্ব পালন করেও এসেছে। কেবল ভাষা আন্দোলন বা স্বাধিকার আন্দোলন নয়, স্বাধীনতার পরেও যখনই একনায়কতন্ত্র বা মিলিটারিতন্ত্রের হাতে দেশ কুক্ষিগত হয়েছে, তা থেকে দেশকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফল পুরো দেশই ভোগ করেছে, সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছেন সম্ভবত রাজনীতিবিদরাই, যারা পরে গণতান্ত্রিক সরকারের অংশ হয়েছেন। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ একজন অত্যন্ত গরিব কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীকেও উচ্চশিক্ষা নেবার সুযোগ করে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার চরিত্র নিয়ে যতদিন বাঁচবে, বাংলাদেশ ততদিন বাঁচতে পারবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পাবলিক' চরিত্র নষ্ট হলে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ সর্বাংশে বাজারমুখী-নিষ্ঠুর-দরিদ্রবিদ্বেষী এক দেশে পরিণত হবে। 

আমরা মনে করি, আমাদের মতো (উন্নয়নশীল) দেশে প্রাইমারি থেকে টার্শিয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা হবে ফ্রি। রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য মানবসম্পদ দরকার। সরকার নিজ উদ্যোগে নিজের প্রয়োজনে বিনিয়োগ করে সেই মানবসম্পদ তৈরি করবে। বিনিময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে নগদ অর্থ দেবে না, কিন্তু এমন এক মানবসম্পদ দেবে যারা দেশকে আর্থিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমর্থ। তাই বাজারচরিত্র বা মুনাফার বিচারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করার মানে হলো, আমাদের নীতিনির্ধারকরা দূরের জিনিস দেখার দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে বসেছেন। পশ্চিমা দেশের উচ্চ টিউশন ফির উদাহরণ এক্ষেত্রে টানার প্রয়োজন পড়বে কেন? আর ওদের ওখানেও স্থানীয়দের জন্য ফি অনেক কম, উচ্চ ফি তারা বিদেশির ঘাড়ে চাপায়। আর ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে ফি বৃদ্ধির কারণেই প্রবল ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। উদাহরণ দিতে হবে শ্রীলঙ্কার, ফ্রি এডুকেশন সিস্টেমের কারণে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গঠন করতে পেরেছে তারা। এখন প্রশ্ন উঠবে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি দেবার অর্থ আসবে কোথা থেকে? উত্তর, বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সমরবান্ধব না হয়ে শিক্ষাবান্ধব হতে হবে সরকারকে। মিগ বিমান না কিনে তার অর্থ দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা সেবা দেয়া যাবে, তার হিসাব করতে হবে। আর যে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর আমরা পাই কিছুদিন পর পর তাতে প্রমাণিত হয়, দেশের অর্থনীতির রিজার্ভ এরকম লুটপাটকে যদি প্রশ্রয় দেবার বিলাসিতা করতে পারে, তবে শিক্ষাখাতে বাজেটবৃদ্ধিও তার জন্য কঠিন কোনো বিষয় নয়। 

আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো, প্রকৃত শিক্ষাবিদদের দিয়ে স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে, যেই কমিশন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-রাজনীতিবিদ সবার সঙ্গে কথা বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রকে পুনঃসংজ্ঞায়ন করবে। সমান্তরাল উদ্যোগ হিসাবে শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে অনেক সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি অর্থ নয়, মেধার যোগ্যতায় সব আর্থিক স্তরের মানুষ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, তার জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি ন্যূনতম রাখতে হবে। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সসমূহ বাতিল করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়কে খুলে দিতে হবে। সকল মামলা প্রত্যাহার করে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি দিয়ে সহিংসতার বিপরীতে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।

লেখকগণ: বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
Source: http://goo.gl/fGN3Iq