মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার
সম্মানের দিক থেকে শিক্ষকরা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ। কিন্তু সম্মানী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা আজও বঞ্চিত। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না। শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি, নেতাদের স্লোগানে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর বিষয়টি যুগ-যুগান্তর ধরে উচ্চারিত হলেও কোনো সরকারই সম্মানজনক স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করেনি। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকের এখনও নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। শিক্ষকের ছাত্র-ছাত্রীরাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী হলেও দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের পিছু ছাড়ে না। শুধু সম্মান নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
ক্ষমতার শীর্ষে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে অথবা শিক্ষককে কাছে পেলে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দে বিগলিত হন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে মুখে রাটি পর্যন্ত করেন না। মহামান্য বিচারকরা কত শত বিষয়ে স্বপ্রণোদিত রায় প্রদান করেন অথবা আইনজীবীরা প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হন; কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের, তাদের কোনো শিক্ষার্থীই তাদের উপযুক্ত সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয় না।
সরকারি ও বিরোধী দলের সব নেতাই কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। তারাও সংসদে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিল উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এমনটি কেউ কখনও করেছেন বলে শুনিনি। বরং একজন খ্যাতিমান অধ্যাপককে সংসদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে প্রশ্ন করা হয়েছে, এত টাকা কোথা থেকে আসে? গাড়ি-বাড়ি কোথায় পান? স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও তাই শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রাপ্তির দাবি পূরণ হয়নি।
ধব ধবে সাদা পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনও হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তিকেই আমরা শিক্ষক বলে জানি। ধরেই নেই, শিক্ষকরা হবেন অতি ভদ্র, বিদ্যার ভারে তাদের মাথা নুয়ে যাবে। সাধাসিদে জীবনযাপন করবেন তারা। আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানী, পাঠান, মুঘল, ইংরেজ অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক মানেই এমন চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠে। কিন্তু আমরা ভুলেই গেছি, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। ডিজিটাল যুগে আছি আমরা। এখন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়াতে ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়। সর্বশেষ তথ্য জানাতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের যদি কম সম্মানী দেই, তাহলে তাদের পক্ষে কি ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া সম্ভব?
শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত করে গড়তে চাইলে শিক্ষকদের সম্মানীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও দেশের অনেক শিক্ষক বৈদিক যুগের মতো গুরুদক্ষিণা নিয়ে অথবা পাল যুগের মতো লজিং থেকে ছাত্র পড়ান। যারা সরকারি বেতন পান, তাদের অবস্থাও যে খুব ভালো, এমন নয়। উচ্চ বাজার মূল্যের যুগে যে বেতন তারা পান, তা দিয়ে মাসের অর্ধেকটাও চলে না।
সম্মানজনক সম্মানী না পেলেও কোনো সময়েই শিক্ষকদের সম্মানের কমতি হয়নি। প্রায় সব যুগেই শিক্ষকতা মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খলিফা হারুন তার পুত্র আমীনের শিক্ষককে ছাত্র প্রহারের যেমন অনুমতি দিয়েছেন, তেমনি মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব তার পুত্র কেন শিক্ষককে নিজ হাতে পা ধুয়ে না দিয়ে শুধু পানি ঢেলেছে, তা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু এখন শিক্ষকের সেই সম্মানটুকুও যেতে বসেছে। ছাত্র কর্তৃক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতার অবৈধ দাবি না মানায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারের টাকা কাজ না করেও তুলে নিতে বাধা দেয়ায় অথবা পান্তা-ইলিশের আয়োজন না করায় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। আর পরীক্ষার হলে নকল ধরায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কত শিক্ষককে যে বখাটে শিক্ষার্থীদের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
উপযুক্ত সম্মানী ও যথাযথ সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্বও কম নয়। শিক্ষকরা যদি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারপন্থী আর সরকারবিরোধী পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েন, তবে শিক্ষকদের সম্মান দিন দিন কমবে বৈ বাড়বে না! আর স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রাপ্তির স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে না। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা কখনোই সরকারের কাছে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়টি উত্থাপন করবেন না। বরং নিজের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব কষে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, ব্যাংকের এমডি, পরিচালক হয়ে আখের গোছাবেন। সাধারণ শিক্ষকরা যে তিমিরেই ছিলেন, সেই তিমিরেই থেকে যাবেন। আর ওইসব লেজুড়বৃত্তিকারীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা ছাত্রনেতারা শিক্ষক লাঞ্ছিত করে পার পেয়ে যেতে থাকলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী এক শিক্ষকের মতো যদি অন্য দলবাজ শিক্ষকরাও ফতোয়া দেয়া শুরু করেন : পরীক্ষায় পাস করা লাগবে না, ছাত্রলীগ করলেই চাকরি, তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষও শিক্ষকদের আর সম্মানের চোখে দেখবে না। তাই শিক্ষকদের সম্মানজনক সম্মানী পেতে ও সম্মান ধরে রাখতে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি পরিহার করে গবেষণায় নিয়োজিত হয়ে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজেদের গড়তে হবে। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি উত্থাপন করতে হবে। ঢাবির ওই দলকানা শিক্ষকের মতো পাস না করলেও দলীয় বিবেচনায় চাকরি দেয়ার ফতোয়া বন্ধ করতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আনার জন্য সরকার যত উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন, তাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অসম্ভব। একজন ভালো মানের কারিগরের পক্ষেই উচ্চমানের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই অধিক হারে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, যখন তাদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করা। সরকারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও সহকারী শিক্ষকদের কথাও ভাবতে হবে। উভয়ের সম্মানজনক সম্মানী নিশ্চিত করতে হবে।
২০১৪ সালের মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির বাস্তবায়নই পূরণ করতে পারে শিক্ষকদের সম্মানজনক সম্মানী প্রাপ্তির দীর্ঘদিনের দাবি। এক্ষেত্রে বর্তমান পে-কমিশনকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@gmail.com
Published in: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2014/04/24/91722
Published in: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2014/04/24/91722
0 comments:
Post a Comment