এম এম আকাশ, মোহাম্মদ তানজিমউদ্দীন খান, সেলিম রেজা নিউটন, মোহাম্মদ নাসের, সুস্মিতা চক্রবর্তী, মানস চৌধুরী, বখতিয়ার আহমেদ, আ-আল মামুন মেহের নিগার, মোশাহিদা সুলতানা, স্বাধীন সেন, কাজী মারুফুল ইসলাম, মাহমুদুল সুমন, রোবায়েত ফেরদৌস, সামিনা লুত্ফা ও ফাহমিদুল হক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং সান্ধ্য কোর্স বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাকে ঘিরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ইস্যুটি আবার সচল হয়েছে। এটা একটা চলমান ইস্যু এবং তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি চরিত্র অক্ষুণ্ন থাকবে না বেসরকারিকরণের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে—এই দুইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে।
নব্বই-পরবর্তী তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের স্রোতে ভেসে ভারী শিল্প, স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা সবকিছুর যথেচ্ছ বেসরকারিকরণ ঘটেছে। এই জোয়ারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাবন ঠেকানো যায়নি। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক বাস্তবতা। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচারে-কালচারে কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে হবে? নব্বইয়ের আগে এইসব বাণিজ্যিক কোর্সের অস্তিত্ব তেমন ছিল না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এইসব সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্সের আমদানি হয়েছে বা হচ্ছে, শিক্ষার সমপ্রসারণের উদ্দেশ্যে নয়, শিক্ষকদের আয়বৃদ্ধির বিষয়টিই এখানে প্রধান থেকেছে।
একথা ঠিক, ক্রমবর্ধমান বাজারমূল্যের বিপরীতে শুধু শিক্ষকদের কেন, খোদ সরকারি বেতনকাঠামোই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ইথিওপিয়ার মত দরিদ্র দেশ, মাথাপিছু জিডিপি অনুসারে যাদের বিশ্বে অবস্থান ১৬৯তম, তাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের সূচনা বেতনও ৮৬৪ মার্কিন ডলার, আর আমাদের ক্ষেত্রে তা ১৫০ ডলারের কাছাকাছি, যদিও জিডিপি অনুসারে আমাদের অবস্থান ১৫১তম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একজন প্রভাষকের সূচনা বেতন ৩৯৫৪ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের পরিস্থিতিও একইরকম। ইথিওপিয়া, ভারত-পাকিস্তান পারলেও আমরা পারি না। এই ধরনের বেতন কাঠামো দুর্নীতিকে উত্সাহিত করে। আর সান্ধ্য কোর্সে যুক্ত হওয়া শিক্ষকদের দিক থেকে দুর্নীতি নয়, তবে তাকে নৈতিক পতন বলা যায়, যেক্ষেত্রে একই শিক্ষককুল দিবা কোর্সে তাদের সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারেন না বলেই অভিযোগ রয়েছে। বাড়তি একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স চালু হলে দিবা কোর্স অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষকদের জন্য যদি পৃথক বা বর্ধিত বেতনকাঠামো দাঁড় করানো যেত, তবে শিক্ষকদের উপার্জন বৃদ্ধির জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্টিফিকেট বিক্রয় কেন্দ্র বানানোর প্রয়োজন পড়তো না। শিক্ষকদের পৃথক কাঠামোর দাবিটিও পুরনো হতে চলেছে, কিন্তু এটা অর্জনের জন্য শিক্ষক নেতারা নতুন কোনো খবর দিতে পারেন না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগে এটা ইস্যু আকারে আসে এবং নির্বাচনের পরে যথারীতি এটাকে ভুলে যাওয়া হয়। সর্বস্তরের শিক্ষকরাও এই দাবির প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগী না হয়ে বাজারের কষাঘাতে জর্জরিত তারা সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, সান্ধ্য কোর্স ইত্যাদির দিকে ছুটোছুটি করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং বেশ কয়েকটি বিভাগে একইসঙ্গে চালু হতে যাওয়া সান্ধ্য কোর্সের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য। জোট সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৫শ কর্মচারী এবং মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় ২০০ শিক্ষক বাজেট বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই সঙ্কট কাটাতে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ফি বাড়াতে চাচ্ছে। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ধিত ফি প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল করেছে, কিন্তু সান্ধ্য কোর্সের সিদ্ধান্ত বলবত্ থেকেছে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে গেলে তাদের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ প্রায় একত্রে হামলা করে। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে, বেশ কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। কয়েক দফা হামলার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছু ভাঙচুরও করেছে। অনেকেই বলছেন যে, এই ভাঙচুরের পেছনে সর্বত্র সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল না, শিক্ষামন্ত্রী যেমন বলেছেন, ছাত্রশিবির যুক্ত হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এই সহিংসতা দ্বিতীয় পর্যায়ের সহিংসতা, প্রাথমিক সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমেই পুলিশ বৈধ অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপরে হামলা চালিয়েছে, তাদের মদদেই ছাত্রলীগ অবৈধ অস্ত্র হাতে চড়াও হয়েছে। এখন প্রপাগান্ডা মেশিনারিজ সক্রিয় হয়েছে, শিবির জুজুকে দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিকে নস্যাত্ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন এই পুরো ঘটনার জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমে 'দুষকৃতকারী'দের বিরুদ্ধে 'যথাযথ' ব্যবস্থা নিশ্চয়ই নেয়া হবে। শতাধিক শিক্ষার্থীকে আসামি করে ছয়টি মামলা হয়েছে বিশ্বদ্যািলয় কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। যথারীতি আক্রমণকারী পুলিশ ও ছাত্রলীগের কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এরকম শোনা যাচ্ছে যে, যেসব শিক্ষক আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদেরকেও 'দেখে নেয়া' হবে এবং প্রয়োজনে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবিও উচ্চারিত হচ্ছে। নৈতিকতা কোথায় নেমে এসেছে!
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকেই সান্ধ্য কোর্স বিরোধী আন্দোলন চলছিল। তবে বর্ধিত ফির ঘোষণায় আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে গত সপ্তাহে। টানা চার-পাঁচদিন পাঁচ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিল। কেবল ২ তারিখে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার পর শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। বিচিত্র নয় যে, পরিস্থিতি ঘোলা করতে বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা জামায়াত-শিবির চক্র অন্তর্ঘাতী আচরণ করছে। কিন্তু শিবিরের উপস্থিতি ছাত্রলীগের সহিংসতাকে বাতিল করে না। অন্যদিকে যে জামায়াত-শিবির বিগত কয়েক মাস পেট্রোল বোমা নির্ভর আন্দোলন করেছে, তাদের পক্ষে সাত-আট হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে পথে নামানো অসম্ভব।
আমরা মনে করি, বর্ধিত ফির পাশাপাশি সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু হবার বিষয়টি কেবল শিক্ষকদের একতরফা সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় নয়, শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে কী মনে করছে, তাকেও আমলে নিতে হবে। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যদি কোনো সিদ্ধান্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তবে তা নিঃসন্দেহে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও আমরা জোরেশোরে উচ্চারণ করতে চাই, রাষ্ট্র কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দায় আর নেবে না, যা এতদিন তারা নিয়ে এসেছে? নব্বই দশকের শুরু থেকে গৃহীত নিওলিবারেল পুঁজিবাদী দর্শনকেই কেন একমাত্র অর্থনৈতিক দর্শন হিসাবে আমাদের মেনে নিতে হবে, যার প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বব্যাংক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেবার পরামর্শ ক্রমাগত দিতে থাকবে এবং সরকার তার আজ্ঞাবহ হয়ে সর্বাংশে পালন করার চেষ্টা করে যাবে? যদি তাই হয়, রাষ্ট্রের ভূমিকা তাহলে কী আসলে? সামষ্টিক কল্যাণ নিশ্চিত করা কি রাষ্ট্রের কাজ নয়? রাষ্ট্র যদি নিজেই 'লাভজনক বাজার' হয়ে উঠে, তাহলে এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির দরকার বা কী?
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার দিকে মনোযোগী হবার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই দায়িত্ব পালন করেও এসেছে। কেবল ভাষা আন্দোলন বা স্বাধিকার আন্দোলন নয়, স্বাধীনতার পরেও যখনই একনায়কতন্ত্র বা মিলিটারিতন্ত্রের হাতে দেশ কুক্ষিগত হয়েছে, তা থেকে দেশকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফল পুরো দেশই ভোগ করেছে, সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছেন সম্ভবত রাজনীতিবিদরাই, যারা পরে গণতান্ত্রিক সরকারের অংশ হয়েছেন। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ একজন অত্যন্ত গরিব কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীকেও উচ্চশিক্ষা নেবার সুযোগ করে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার চরিত্র নিয়ে যতদিন বাঁচবে, বাংলাদেশ ততদিন বাঁচতে পারবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পাবলিক' চরিত্র নষ্ট হলে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ সর্বাংশে বাজারমুখী-নিষ্ঠুর-দরিদ্রবিদ্বেষী এক দেশে পরিণত হবে।
আমরা মনে করি, আমাদের মতো (উন্নয়নশীল) দেশে প্রাইমারি থেকে টার্শিয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা হবে ফ্রি। রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য মানবসম্পদ দরকার। সরকার নিজ উদ্যোগে নিজের প্রয়োজনে বিনিয়োগ করে সেই মানবসম্পদ তৈরি করবে। বিনিময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে নগদ অর্থ দেবে না, কিন্তু এমন এক মানবসম্পদ দেবে যারা দেশকে আর্থিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমর্থ। তাই বাজারচরিত্র বা মুনাফার বিচারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করার মানে হলো, আমাদের নীতিনির্ধারকরা দূরের জিনিস দেখার দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে বসেছেন। পশ্চিমা দেশের উচ্চ টিউশন ফির উদাহরণ এক্ষেত্রে টানার প্রয়োজন পড়বে কেন? আর ওদের ওখানেও স্থানীয়দের জন্য ফি অনেক কম, উচ্চ ফি তারা বিদেশির ঘাড়ে চাপায়। আর ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে ফি বৃদ্ধির কারণেই প্রবল ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। উদাহরণ দিতে হবে শ্রীলঙ্কার, ফ্রি এডুকেশন সিস্টেমের কারণে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গঠন করতে পেরেছে তারা। এখন প্রশ্ন উঠবে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি দেবার অর্থ আসবে কোথা থেকে? উত্তর, বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সমরবান্ধব না হয়ে শিক্ষাবান্ধব হতে হবে সরকারকে। মিগ বিমান না কিনে তার অর্থ দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা সেবা দেয়া যাবে, তার হিসাব করতে হবে। আর যে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর আমরা পাই কিছুদিন পর পর তাতে প্রমাণিত হয়, দেশের অর্থনীতির রিজার্ভ এরকম লুটপাটকে যদি প্রশ্রয় দেবার বিলাসিতা করতে পারে, তবে শিক্ষাখাতে বাজেটবৃদ্ধিও তার জন্য কঠিন কোনো বিষয় নয়।
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো, প্রকৃত শিক্ষাবিদদের দিয়ে স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে, যেই কমিশন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-রাজনীতিবিদ সবার সঙ্গে কথা বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রকে পুনঃসংজ্ঞায়ন করবে। সমান্তরাল উদ্যোগ হিসাবে শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে অনেক সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি অর্থ নয়, মেধার যোগ্যতায় সব আর্থিক স্তরের মানুষ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, তার জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি ন্যূনতম রাখতে হবে। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সসমূহ বাতিল করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়কে খুলে দিতে হবে। সকল মামলা প্রত্যাহার করে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি দিয়ে সহিংসতার বিপরীতে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
লেখকগণ: বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
একথা ঠিক, ক্রমবর্ধমান বাজারমূল্যের বিপরীতে শুধু শিক্ষকদের কেন, খোদ সরকারি বেতনকাঠামোই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ইথিওপিয়ার মত দরিদ্র দেশ, মাথাপিছু জিডিপি অনুসারে যাদের বিশ্বে অবস্থান ১৬৯তম, তাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের সূচনা বেতনও ৮৬৪ মার্কিন ডলার, আর আমাদের ক্ষেত্রে তা ১৫০ ডলারের কাছাকাছি, যদিও জিডিপি অনুসারে আমাদের অবস্থান ১৫১তম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একজন প্রভাষকের সূচনা বেতন ৩৯৫৪ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের পরিস্থিতিও একইরকম। ইথিওপিয়া, ভারত-পাকিস্তান পারলেও আমরা পারি না। এই ধরনের বেতন কাঠামো দুর্নীতিকে উত্সাহিত করে। আর সান্ধ্য কোর্সে যুক্ত হওয়া শিক্ষকদের দিক থেকে দুর্নীতি নয়, তবে তাকে নৈতিক পতন বলা যায়, যেক্ষেত্রে একই শিক্ষককুল দিবা কোর্সে তাদের সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারেন না বলেই অভিযোগ রয়েছে। বাড়তি একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স চালু হলে দিবা কোর্স অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষকদের জন্য যদি পৃথক বা বর্ধিত বেতনকাঠামো দাঁড় করানো যেত, তবে শিক্ষকদের উপার্জন বৃদ্ধির জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্টিফিকেট বিক্রয় কেন্দ্র বানানোর প্রয়োজন পড়তো না। শিক্ষকদের পৃথক কাঠামোর দাবিটিও পুরনো হতে চলেছে, কিন্তু এটা অর্জনের জন্য শিক্ষক নেতারা নতুন কোনো খবর দিতে পারেন না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগে এটা ইস্যু আকারে আসে এবং নির্বাচনের পরে যথারীতি এটাকে ভুলে যাওয়া হয়। সর্বস্তরের শিক্ষকরাও এই দাবির প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগী না হয়ে বাজারের কষাঘাতে জর্জরিত তারা সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, সান্ধ্য কোর্স ইত্যাদির দিকে ছুটোছুটি করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং বেশ কয়েকটি বিভাগে একইসঙ্গে চালু হতে যাওয়া সান্ধ্য কোর্সের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য। জোট সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৫শ কর্মচারী এবং মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় ২০০ শিক্ষক বাজেট বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই সঙ্কট কাটাতে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ফি বাড়াতে চাচ্ছে। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ধিত ফি প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল করেছে, কিন্তু সান্ধ্য কোর্সের সিদ্ধান্ত বলবত্ থেকেছে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে গেলে তাদের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ প্রায় একত্রে হামলা করে। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে, বেশ কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। কয়েক দফা হামলার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছু ভাঙচুরও করেছে। অনেকেই বলছেন যে, এই ভাঙচুরের পেছনে সর্বত্র সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল না, শিক্ষামন্ত্রী যেমন বলেছেন, ছাত্রশিবির যুক্ত হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এই সহিংসতা দ্বিতীয় পর্যায়ের সহিংসতা, প্রাথমিক সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমেই পুলিশ বৈধ অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপরে হামলা চালিয়েছে, তাদের মদদেই ছাত্রলীগ অবৈধ অস্ত্র হাতে চড়াও হয়েছে। এখন প্রপাগান্ডা মেশিনারিজ সক্রিয় হয়েছে, শিবির জুজুকে দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিকে নস্যাত্ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন এই পুরো ঘটনার জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমে 'দুষকৃতকারী'দের বিরুদ্ধে 'যথাযথ' ব্যবস্থা নিশ্চয়ই নেয়া হবে। শতাধিক শিক্ষার্থীকে আসামি করে ছয়টি মামলা হয়েছে বিশ্বদ্যািলয় কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। যথারীতি আক্রমণকারী পুলিশ ও ছাত্রলীগের কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এরকম শোনা যাচ্ছে যে, যেসব শিক্ষক আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদেরকেও 'দেখে নেয়া' হবে এবং প্রয়োজনে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবিও উচ্চারিত হচ্ছে। নৈতিকতা কোথায় নেমে এসেছে!
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকেই সান্ধ্য কোর্স বিরোধী আন্দোলন চলছিল। তবে বর্ধিত ফির ঘোষণায় আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে গত সপ্তাহে। টানা চার-পাঁচদিন পাঁচ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিল। কেবল ২ তারিখে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার পর শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। বিচিত্র নয় যে, পরিস্থিতি ঘোলা করতে বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা জামায়াত-শিবির চক্র অন্তর্ঘাতী আচরণ করছে। কিন্তু শিবিরের উপস্থিতি ছাত্রলীগের সহিংসতাকে বাতিল করে না। অন্যদিকে যে জামায়াত-শিবির বিগত কয়েক মাস পেট্রোল বোমা নির্ভর আন্দোলন করেছে, তাদের পক্ষে সাত-আট হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে পথে নামানো অসম্ভব।
আমরা মনে করি, বর্ধিত ফির পাশাপাশি সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু হবার বিষয়টি কেবল শিক্ষকদের একতরফা সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় নয়, শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে কী মনে করছে, তাকেও আমলে নিতে হবে। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যদি কোনো সিদ্ধান্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তবে তা নিঃসন্দেহে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও আমরা জোরেশোরে উচ্চারণ করতে চাই, রাষ্ট্র কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দায় আর নেবে না, যা এতদিন তারা নিয়ে এসেছে? নব্বই দশকের শুরু থেকে গৃহীত নিওলিবারেল পুঁজিবাদী দর্শনকেই কেন একমাত্র অর্থনৈতিক দর্শন হিসাবে আমাদের মেনে নিতে হবে, যার প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বব্যাংক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেবার পরামর্শ ক্রমাগত দিতে থাকবে এবং সরকার তার আজ্ঞাবহ হয়ে সর্বাংশে পালন করার চেষ্টা করে যাবে? যদি তাই হয়, রাষ্ট্রের ভূমিকা তাহলে কী আসলে? সামষ্টিক কল্যাণ নিশ্চিত করা কি রাষ্ট্রের কাজ নয়? রাষ্ট্র যদি নিজেই 'লাভজনক বাজার' হয়ে উঠে, তাহলে এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির দরকার বা কী?
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার দিকে মনোযোগী হবার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই দায়িত্ব পালন করেও এসেছে। কেবল ভাষা আন্দোলন বা স্বাধিকার আন্দোলন নয়, স্বাধীনতার পরেও যখনই একনায়কতন্ত্র বা মিলিটারিতন্ত্রের হাতে দেশ কুক্ষিগত হয়েছে, তা থেকে দেশকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফল পুরো দেশই ভোগ করেছে, সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছেন সম্ভবত রাজনীতিবিদরাই, যারা পরে গণতান্ত্রিক সরকারের অংশ হয়েছেন। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ একজন অত্যন্ত গরিব কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীকেও উচ্চশিক্ষা নেবার সুযোগ করে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার চরিত্র নিয়ে যতদিন বাঁচবে, বাংলাদেশ ততদিন বাঁচতে পারবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পাবলিক' চরিত্র নষ্ট হলে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ সর্বাংশে বাজারমুখী-নিষ্ঠুর-দরিদ্রবিদ্বেষী এক দেশে পরিণত হবে।
আমরা মনে করি, আমাদের মতো (উন্নয়নশীল) দেশে প্রাইমারি থেকে টার্শিয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা হবে ফ্রি। রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য মানবসম্পদ দরকার। সরকার নিজ উদ্যোগে নিজের প্রয়োজনে বিনিয়োগ করে সেই মানবসম্পদ তৈরি করবে। বিনিময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে নগদ অর্থ দেবে না, কিন্তু এমন এক মানবসম্পদ দেবে যারা দেশকে আর্থিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমর্থ। তাই বাজারচরিত্র বা মুনাফার বিচারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করার মানে হলো, আমাদের নীতিনির্ধারকরা দূরের জিনিস দেখার দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে বসেছেন। পশ্চিমা দেশের উচ্চ টিউশন ফির উদাহরণ এক্ষেত্রে টানার প্রয়োজন পড়বে কেন? আর ওদের ওখানেও স্থানীয়দের জন্য ফি অনেক কম, উচ্চ ফি তারা বিদেশির ঘাড়ে চাপায়। আর ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে ফি বৃদ্ধির কারণেই প্রবল ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। উদাহরণ দিতে হবে শ্রীলঙ্কার, ফ্রি এডুকেশন সিস্টেমের কারণে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গঠন করতে পেরেছে তারা। এখন প্রশ্ন উঠবে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি দেবার অর্থ আসবে কোথা থেকে? উত্তর, বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সমরবান্ধব না হয়ে শিক্ষাবান্ধব হতে হবে সরকারকে। মিগ বিমান না কিনে তার অর্থ দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা সেবা দেয়া যাবে, তার হিসাব করতে হবে। আর যে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর আমরা পাই কিছুদিন পর পর তাতে প্রমাণিত হয়, দেশের অর্থনীতির রিজার্ভ এরকম লুটপাটকে যদি প্রশ্রয় দেবার বিলাসিতা করতে পারে, তবে শিক্ষাখাতে বাজেটবৃদ্ধিও তার জন্য কঠিন কোনো বিষয় নয়।
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো, প্রকৃত শিক্ষাবিদদের দিয়ে স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে, যেই কমিশন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-রাজনীতিবিদ সবার সঙ্গে কথা বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রকে পুনঃসংজ্ঞায়ন করবে। সমান্তরাল উদ্যোগ হিসাবে শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে অনেক সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি অর্থ নয়, মেধার যোগ্যতায় সব আর্থিক স্তরের মানুষ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, তার জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি ন্যূনতম রাখতে হবে। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সসমূহ বাতিল করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়কে খুলে দিতে হবে। সকল মামলা প্রত্যাহার করে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি দিয়ে সহিংসতার বিপরীতে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
লেখকগণ: বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
Source: http://goo.gl/fGN3Iq
0 comments:
Post a Comment