Sunday, February 23, 2014

আমরা কি এই বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম?

রাগিব আহসান, রুহিন হোসেন, বজলুর রশীদ, রাজেকুজ্জামান, আব্রাহাম লিংকন, বৃত্তা রায়, সাদাকাত হোসেন খান, কাফী রতন


ভাষা আন্দোলনের জঠর থেকে জন্ম নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৫-এর সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন প্রতিরোধ, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম সূতিকাগার মতিহারের সবুজ চত্বর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনকে রুখতে সমগ্র উত্তরবঙ্গে লড়াকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। উত্তরবঙ্গের ৫০ লাখ কৃষক পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা-চেতনার প্রতীক এ বিশ্ববিদ্যালয়।
অথচ দিনকে দিন মুছে ফেলা হচ্ছে উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আত্মপরিচয়। শহীদ জোহা ক্যাম্পাসকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বর্বর যুগে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ ফেব্রুয়ারির সহিংসতায় আমরা স্তম্ভিত, মর্মাহত, ক্ষুব্ধ। আমরা কখনো কল্পনা করিনি, ড. জোহার সমাধির সামনেই শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানো হবে। আমরা কখনো কল্পনা করিনি, শাজাহান সিরাজ, রিমু, রূপম, তপনের রক্তে ভেজা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের সব অর্জনকে এভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী জ্ঞানপরম্পরার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করে প্রক্টোরিয়াল বডির উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হতে পারে? গণমাধ্যমে সহকারী প্রক্টরদের মুখ বাঁধা ছবি আমাদের বিস্মিত করেছে। উনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে ড. জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। কৃষকের রক্ত আর ঘামের মূল্য তিনি বুঝেছিলেন। তাই শিক্ষার্থীর বুক বুলেটে বিদ্ধ হওয়ার আগে তাঁর বুক ভেদ করতে হয়েছে। শহীদ জোহার এই বলিদান যুগে যুগে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের চেতনা হয়ে থেকেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বজনীন জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। জ্ঞানের বিকাশে মুক্ত গবেষণা ও বিদ্যাচর্চা গড়ে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যৌথ প্রচেষ্টা তা সম্ভব করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ যেকোনো সংকট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবেন—এটাই যৌক্তিক, এটাই সবার কাম্য। গুলি চালানোর প্রয়োজন হবে কেন? গণমাধ্যমে যাদের প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করতে দেখা গেছে, তারা কারা? তারা যে ছাত্রসংগঠনেরই হোক, তারা গুটি কয়েক মাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের আপামর শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্বশীল শক্তি তারা নয়। তবে কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রগতিশীল শিক্ষার্থী নেতাসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করল? কেন বারবার অস্ত্রবাজির পরও তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা আন্দোলনের ন্যায্যতা অস্বীকার করেছেন, আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে ভ্রান্ত তথ্য প্রদান করেছেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত গবেষক দলের সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এর প্রকৃত চিত্র। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী-সংগঠকেরাই মূলত সাম্প্রতিক আন্দোলন সংগঠিত করেন। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন একাডেমিক গ্রুপগুলোই ছিল এর প্রধান চালিকাশক্তি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে: প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল অহিংস। ২ ফেব্রুয়ারি প্রশাসন ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের সমাবেশও ছিল শান্তিপূর্ণ। আমাদের প্রশ্ন, ভ্রান্ত প্রচারণা কেন? পুলিশকে গুলিবর্ষণের বৈধতা দিতেই কি এই অপকৌশল? তেমনটা হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির নিজস্ব কোনো তৎপরতার দরকার হবে না। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রগতিশীল শক্তিকে ক্ষেত্রশূন্য করতে পারাটাই তো তার জন্য যথেষ্ট!
আহত শিক্ষার্থীদের অনেকেই আমাদের ফোন করছেন। জানাচ্ছেন তাঁদের দুরবস্থার কথা। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজীব। তাঁর চোখ ছররা গুলিতে বিদ্ধ হয়েছে। ছররা গুলি এখনো ঢুকে আছে তাঁর মাথার ভেতরে। চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই আহত অসহায় শিক্ষার্থীর চিকিৎসা তো দূরে থাক, কোনো খোঁজ পর্যন্ত নেয় না। এমন পরিস্থিতি হলো কেন? শিক্ষকেরা অভিভাবকদের সামনে দাঁড়াবেন কেমন করে? শিক্ষকের উচ্চ নৈতিকতা, সংবেদনশীলতা—সবই কি মিছে হয়ে যাবে? আমরা শঙ্কিত।
বিশ্ববিদ্যালয়কে যে দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা কারও কাম্য নয়। সান্ধ্য কোর্স বাণিজ্যিক হোক আর অবাণিজ্যিকই হোক, যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তিক হোক—তা আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। তারও আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্প্রসারণ ও তার অর্থায়ন আলোচনার একটি মৌলিক প্রসঙ্গ। একা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্র এর সঙ্গে জড়িত। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর প্রশ্ন সামাজিকভাবেই উত্থাপিত হয়ে থাকে, তবে তা সব পক্ষের মধ্যে আলোচনা করেই ঠিক করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ জ্ঞান পেটেন্ট হচ্ছে। বাণিজ্য অনুষদগুলো নতুন নতুন বাণিজ্য প্রকল্প হাজির করছে। এসব জ্ঞানের শুধু সামাজিক মূল্যই নয়, বর্তমান দুনিয়ায় আর্থিক মূল্যও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে সে বিষয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহজেই যেন আলোচনা করা যায়, সে জন্য তাঁদের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে কার্যকর করা জরুরি। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তবে শিক্ষক সমিতিকে সে দাবি উত্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের গুলির মুখে দাঁড় করানোর মতো পরিস্থিতি তো কাম্য নয়।

 লেখকেরা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক নেতা ও সাবেক জাতীয় ছাত্রনেতা।
Source: http://goo.gl/xG90sJ

0 comments:

Post a Comment