Monday, October 20, 2014

ক্যাডার পছন্দঃ এডমিন কেন অথবা কেন নয়?

সাইফুল ইসলাম রিমেল,
এসিল্যান্ড,সদর দক্ষিন,কুমিল্লা ।
===========================
ক্যাডার চয়েস অনেকাংশে পারসোনালিটি নির্ভর। চলাফেরা, রুচিবোধ, চিন্তার গণ্ডি, ভাবনার রকমফের ক্যাডার পছন্দের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কে কোন ক্যাডার চয়েস দিবে তার উপর এই গ্রুপে অনেক আলোচনা এরই মাঝে হয়েছে। বিশেষত Sujan সব ক্যাডার এর তুলনামূলক যে স্ট্যাটাসটি দিয়েছে তা থেকেই মোটামোটি সিদ্ধান্তে আসতে পারবে যে কেউ।

তবু এডমিন সার্ভিস প্রায় বেশিরভাগ ছেলে মেয়ের প্রথম পছন্দ থাকে। কেউ বুঝে দেয় আবার কেউ বা হুজুগে। এডমিন সার্ভিসের একজন সদস্য হিসেবে চাকুরীতে প্রায় ৪ বছর হতে চলল। তাই ভাবলাম একটু যথাসম্ভব নির্মোহ দৃষ্টিকোন থেকে এই সার্ভিসের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে একটু লিখি!

কেন প্রশাসন আপনার প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত?
=============================
১। এক প্রশাসন সার্ভিস আপনাকে সারাজীবনে মিনিমাম ১৫ টি চাকুরী করার অভিজ্ঞতা দেবে। বৈচিত্র্য এই ক্যাডার এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। আপনার একটা পোস্টিং থেকে অন্য পোস্টিং হবে আলাদা। অন্য সকল ক্যাডার নিজের কাজটা নিয়েই থাকবে সারাজীবন। কেবল এডমিন কে সকল কাজেই আপনি পাবেন। ম্যাজিস্ট্রেট, এ সি ল্যান্ড, ইউ এন ও, ডি সি, সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব হিসেবে মন্ত্রনালয়ে, সরকারের সকল অধিদপ্তর, পরিদপ্তরে, সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে, সব কর্পোরেশন গুলোর প্রধান হিসেবে ( পাটকল, চিনিকল, মিল্ক ভিটা ইত্যাদি) আপনি পোস্টিং পাবেন। সকল ফরেন কন্সুলার অফিস এ, এফ ডি সি তে সহ সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের উপরের পদ গুলোতে আপনার পদচারনা থাকবে। আমি নিজেই অনেক পরে এসে জেনেছি যে বেসামরিক বিমান পরিবহনের ৪ টি মেম্বার পদ এডমিন থেকে যায়। সিটি কর্পোরেশন, জেলাপরিষদ এডমিন ক্যাডার চালায়। অতি আশ্চর্যের বিষয় এই যে প্রতিটা ক্যান্টনমেন্ট এ ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ নামের একটা পোস্ট আছে এডমিনের যে ক্যান্টনমেন্ট এর ভিতরের স্কুল, কলেজ, ইনফ্রাস্ত্রাকচার এসবের অভিভাবক।
বলা হয় চাদে যদি বাংলাদেশ সরকার কোন শাখা খুলে তবে প্রথমে একটা এডমিন পোস্ট সৃষ্টি করে পরে অন্য ভাবনা!


২। এই ক্যাডার এর অফিসার গন ইদানিংকালে গণ হারে ফরেন ডিগ্রি নিচ্ছেন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপের দেশগুলোতে সিনিয়র সহকারী সচিব লেভেলের প্রায় সবারই কোন না কোন ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ডিগ্রি আছে।

৩। এই ক্যাডার এর প্রধান কাজ হল অন্য সকল ক্যাডার অফিসার দের মাঝে সমন্বয় সাধন। জেলায় ডি সি রা সকল বিভাগের মাঝে সেতুবন্ধের কাজ করেন। ভাল ব্যাবহার যদি করেন, একটু যদি হেসে কথা বলেন তবে আপনি মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবেন এ কথা নিশ্চিত বলা যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপজেলায়, জেলায় ও বিভাগে আপনার অবস্থান আপনাকে একটু গর্ববোধ করার অধিকার দিতেই পারে। ইউ এন ও ও ডি সি গন সরাসরি মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকে ফলে সরকারের পলিসি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পলিসি ফিডব্যাক এডমিন অফিশিয়ালরাই দেন।

৪। সরকারের সচিবালয় যন্ত্র মূলত এডমিন ক্যাডার দিয়ে পরিচালিত। আর সচিবালয় জিনিসটা কি আশা করি সবাই বুঝেন। সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাগণ ৭৫ ভাগ কেবল এডমিন থেকে নিযুক্ত হইবেন এবং বাকি ২৫ ভাগ অন্য সকল ক্যাডার এর সিনিয়র অফিসার গনের জন্য উন্মুক্ত থাকিবে। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশকে পরিচালিত করেন মন্ত্রী মহোদয়গণ। দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করেন তাঁরা। আর এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে নিবিড় ভুমিকা দাপ্তরিক প্রধান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সচিব ও সিনিয়র সচিবের। কেউ যদি নিজেকে দেশের পলিসি তৈরিতে যুক্ত দেখতে চান, স্বপ্ন দেখেন রুপান্তরের তিনি প্রশাসনের অংশ হওয়ার আগ্রহ দেখাতে পারেন।

৫। দিন যাবে আপনার কাজের পরিধি বাড়বে। চাকুরীতে থাকাকালে আপনি গুরুত্ব পাবেন, পাবেন অবসরের পরও। সরকারের সাংবিধানিক সংস্থাগুলো তে বুড়ো বয়সে আপনার প্রাধিকার থাকবে।বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, নির্বাচন কমিশনের প্রধানগন এডমিনের প্রাক্তন সচিব ছিলেন। পত্রিকায় কলাম লিখবেন, দেশের ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে মত দিবেন, সরকারকে পরামর্শ দিবেন আপনি। কারন সারাজীবন ব্যাপিয়া আপনি তো এই কাজেই নিয়োজিত ছিলেন।

৬। রাজনীতি না করেও কেউ যদি রাজনীতিবিদদের মত গণ মানুষের কাছে যেতে চান তাঁকে এডমিন চয়েস দিতেই হবে। একমাত্র ক্যাডার এডমিন যার বিচরন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী হতে সমাজের সকল বর্ণের, গোত্রের মানুষের কাছে। ধনী দরিদ্র, ভাল খারাপ, সকল চাকুরীজীবী, ব্যাবসায়ি, সুশীল সমাজ সবার মাঝে মিশে থাকার এক দুর্লভ সুযোগ। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ আপনার বিচরনের মাঠ। ঠিক এ কারনেই অনেক ইউ এন ও ও ডি সি র বিদায়ে মানুষকে কাঁদতে দেখেছি আমি।

৭। সম্মানের জায়গাটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এখনও অনেক কিছুর পরেও উপজেলায় ইউ এন ও সবচেয়ে বেশি ফোকাস এ থাকেন, জেলায় ডি সি। আমার ৪ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি জেলায় কোন বড় আয়োজন সম্পূর্ণ হয় না ডি সি র উপস্থিতি ছাড়া। ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ব্যাক্তিক যেকোনো অনুষ্ঠানে ডি সি ও ইউ এন ও র উপস্থিতি সকলের আগে কাম্য। এ সার্ভিস এর কিংবদন্তি তুল্য গ্ল্যামর এ একটু টান পড়েছে সত্য কিন্তু তবুও আমি নিজে তো এখনও বিকল্প দেখি না!

৮। প্রমোশন সম্ভাবনা এখন অনেক বেড়েছে আমাদের। ৬ বছরে ইউ এন ও হয়ে যাওয়াটা খারাপ না কিন্তু। কিছু বড় ব্যাচ অবসরে গেলে ১০ বছরে ডেপুটি সেক্রেটারি হওয়ার সম্ভাবনা আমরা দেখি। সরকারি ও স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠানের সকলের আপনার স্ট্যাটাস পেতে চাইবে দেখেও ভাল লাগবে নিশ্চিত। যেমন অমুক এই পদে আছে যা কিনা উপসচিব পদমর্যাদার পদ!!

৯। জুডিশিয়ারি নাই বলে অনেকে হাহাকার করেন। কিন্তু মোবাইল কোর্ট এর অধীনে তাৎক্ষনিক ২ বছর পর্যন্ত সাজা দিয়ে প্রায় সব সামাজিক অপরাধের বিচারের ভার এই দেশ আপনার কাঁধে দিয়েছে। দেশের মানুষকে মোবাইল কোর্ট খাবারের বিষয়ে সচেতন করে শাস্তি দিয়ে বিপ্লব সাধন করেছে। এক মুনির চৌধুরী ও রোকন উদ দোলার কল্যাণে মানুষ এক্সপায়ার ডেট দেখে খাদ্য সামগ্রী কিনতে শিখেছে, ইভটিজিং রোধ, নদী খাল ভরাট রোধ, বাল্যবিবাহ ঠেকানো, ফরমালিন এর অভিশাপ ও মাদক মুক্ত দেশ গড়ার অভিযানে এই মোবাইল কোর্ট এখন এক মুক্ষম অস্ত্র।

১০। সরকারের যেকোনো অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন কে করবে? জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজ কার হাতে সপে দেয়া হবে? প্রশাসনের হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ওয়েব পোর্টাল কে তৈরি করেছে ? ডি সি অফিস। সারা দেশে ৫০০০ ইউনিয়ন ডিজিটাল সার্ভিস সেন্টার কাদের সক্ষমতায় তৈরি হয়েছে? সহকারী কমিশনার, এ ডি সি, ডি সি, ইউ এন ও র হাত ধরে। সকল সরকারি অফিস ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় আনার কাজ কে করছে ? ডি সি অফিস। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে মাঠ প্রশাসনে কারা নিরন্তর কাজ করে চলেছে? এ টু আই প্রকল্প কারা গড়েছে? এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অংশীদার হতে চাইলে এডমিন এ আসুন!


এডমিন কেন নয়???
===========

১। কাজের প্রেসার ও প্রটোকল কখনও আপনাকে পাগল বানিয়ে দেবে এই সার্ভিস এ। আর্মির বাইরে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ফর্মালিটি এডমিন সার্ভিস মেনে চলে। জুনিয়র লেভেলে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে। আমার নিজের ও হত এক সময়। ছুটি ও অবসর ভুলে গেলেই ভাল। সরকারি ছুটি ও শুক্র শনি বার আপনার ইচ্ছা মত ছুটি অবশ্যই পাবেন না। ডি সি স্যার এর মর্জির উপর আপনাকে ভরসা করতে হবে। ইউ এন ও/ ডি সি হলে অথবা অন্য অনেক পোস্ট এ থাকা কালে ঈদ ও আপনার জব ষ্টেশন এ করতে হতে পারে।

২। আপনার পালিত দায়িত্তের তুলনায় প্রশংসা আপনি কখনই পাবেন না। বরঞ্চ পান থেকে চুন খসলে ঝাড়ি নিশ্চিত। এডমিন অফিসারদের ভুল করার বিলাসিতা দেখানো যায় না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুগম্ভীর পরিবেশ থাকবে আপনার আশপাশে।

৩। যেখানেই থাকুন না কেন আপনি সবসময় ফোকাস এ থাকবেন বলে সমালোচনা সবচেয়ে বেশি আপনার। আপনি ৫ টাকা ঘুষ খাবেন তো জাতীয় পত্রিকার নিউজ। আপনার ব্যাচেরই কোন কোন ক্যাডার এর অফিসার মাসে অকল্পনীয় ঘুষ খাবেন কিন্তু কোন নিউজ হবে না, শব্দ ও হবে না। একজন জেলা প্রশাসক ও যদি ২ বছর নিয়মমাফিক ঘুষ খান তবু অনেক ক্যাডার এর জুনিয়র লেভেলের অফিসার এর এক বছরের ঘুষের সমপরিমান হবে না। কিন্তু আপনি যদি ঘুষ নাও খান তবু পরিস্থিতির কারনে খবরের শিরোনাম হয়ে যাবেন! এবং এডমিন সার্ভিস এ জব করার কারনে আপনি অত্যন্ত ভদ্রলোক হওয়ার পর ও বন্ধু পাবেন না তেমন! কারন আপনি হবেন অন্য অনেকের কাবাবে হাড্ডির মত অনাহুত।

৪। রাজনৈতিক রেষারেষির সবচেয়ে বড় বলি হয় এডমিন ক্যাডার অফিসাররা। ও এস ডি, বাজে পোস্টিং, বদলি, মানসিক প্রেসার এসব সহজভাবে নেয়া শিখতে হবে। এবং রাজনিতিবিদগন বেশীর ভাগ সময়েই আপনার ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকারে বের হবেন। নেতা ও পাতি নেতা সামলানো এই সময়ে এডমিন সার্ভিসের সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

এখন এসব কিছু নিয়ে ভাবুন। বিবেচনায় নিন। যদি নেতৃত্ব দিতে চান, চ্যালেঞ্জ নিতে চান, সাহস থাকে, রিস্ক নেয়ার, কষ্ট করার ও দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তবেই এডমিনে আসুন।

Admin Service can sometimes be very painful, stressful, challenging , frustrating but i can bet, it can never be boring.

And We the admin officers are here to lead the country from the front , towards greater development equipped with greater insights, modern outlook and knowledge base.


Advance Welcome to Bangladesh Administrative Service (BAS) !!!

সাইফুল ইসলাম রিমেল,
এসিল্যান্ড,সদর দক্ষিন,কুমিল্লা ।

Published in: https://www.facebook.com/BCS.CADRE.A.Z/posts/803512106354581

Sunday, October 12, 2014

প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!

আশরাফুল হক রাজীব


বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। দুর্নীতির অভিযোগে ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয় তার বেশির ভাগই এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতিতে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছেন চিকিৎসকরা। এর পরই অবস্থান পুলিশের। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে দুর্নীতির মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগেই কর্মকর্তারা নতুন করে পোস্টিং পাচ্ছেন। ফলে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা তাঁদের অবস্থানে থেকে তদবিরের মাধ্যমে মামলায় প্রভাব খাটানোর সুযোগ পান, যা সুষ্ঠু বিচারের অন্তরায়।
২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুদকের মামলাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ সময়ে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট ৭৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৮০ জন কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ৪৮ জন, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ২৩ জন এবং পুলিশ ক্যাডারের রয়েছেন ছয়জন। এ ছাড়া প্রাণিসম্পদের পাঁচজন, শিক্ষার চারজন, টেলিযোগাযোগ ও গণপূর্ত ক্যাডারের তিনজন করে এবং কর ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা রয়েছেন। দুর্নীতির মামলার এ ধারা গত আট মাসেও অব্যাহত ছিল। এসব মামলায়ও এগিয়ে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪২টি মামলার চার্জশিট হয়েছে। দাখিল করা এসব চার্জশিটে ২৯ কর্মকর্তার নাম রয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের ২৮টি ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডারের। এ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন। জমির মালিকানার নামজারি, সরকারের পক্ষে জমি হুকুমদখল, ইজারার মতো সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁরা যেমন কাজ করেন, তেমনি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মতো অত্যাধুনিক কাজও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে করতে হয়। নানা পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে অনেক সময় সরকারি সিদ্ধান্তের কারণেও মামলার শিকার হন তাঁরা।  
পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা অপেক্ষাকৃত কম হলেও দুর্নীতি নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেক্টরগুলোর মধ্যে পুলিশ অন্যতম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পুলিশ প্রভাব বিস্তার করে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে নিজেদের আড়াল করে। দুদক এবং টিআইবির দুর্নীতিবিষয়ক তথ্যের অন্যতম উৎস গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য হলেও পুলিশের বিরুদ্ধে প্রকাশিত তথ্য আমলে নেয় না দুদক। আমলে নিলে পুলিশের দুর্নীতিই বেশি হতো বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা হয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে। এটা হতে পারে তাঁদের কাজের ধরনের জন্য। চাকরিজীবনের শুরুতেই তাঁরা জমি অধিগ্রহণ, নামজারিসহ গণমানুষের সরাসরি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করেন। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে বেশি মামলা হয়। আর পুলিশের বিরুদ্ধে কম অভিযোগের কারণ হতে পারে সাধারণ মানুষের ভয়। গণমাধ্যমে পুলিশের হয়রানি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। এসব রিপোর্ট হয়রানিসংক্রান্তই বেশি। মনে রাখতে হবে, হয়রানি আর দুর্নীতি এক বিষয় নয়। এ কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা কম হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে হয়রানির কারণে আমরাও পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকি। দুর্নীতির অভিযোগ থেকে তাদের ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সেক্টরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দুর্নীতি আজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে প্রশাসন ক্যাডার বেশি করছে, অন্য ক্যাডার কম করছে- বিষয়টা এমন নয়। যাদের সুযোগ আছে তারা সবাই করছে। এ অবস্থায় দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। আর এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত বা মামলা চলা অবস্থায় নতুন জায়গায় পদায়ন না করাই ভালো। আর টিআইবির দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদনে পুলিশকে যে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বলা হয়েছে তা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই।
এক কর্মকর্তা জানান, জমিজমার মালিকানা, নামজারি, বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি হয়। এসব নিয়ে মামলাও হয়। এগুলো নতুন কিছু নয়। কিন্তু যে দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ ওঠে না বা মামলা হয় না সেটা সবার আড়ালেই থেকে যায়। এমন একটি দুর্নীতি হচ্ছে এলআর (লোকাল রিলেশন) ফান্ড দুর্নীতি। জেলা প্রশাসকদের কাছে এলআর ফান্ড নামে একটি তহবিল থাকে। এটি জেলা প্রশাসকদের দুর্নীতির স্বীকৃত ফান্ড বলে পরিচিত। এ ফান্ডের বিষয়ে কখনোই অডিট হয় না। এ ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়, মন্ত্রী বা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার জেলা সফরকালে সার্কিট হাউসে আপ্যায়ন করানো হয়। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে কোনো খাত নেই। তাই জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিভিন্ন লাইসেন্স গ্রহণকালে এলআর ফান্ডের জন্য একটি চাঁদা নেওয়া হয়। ইটভাটা থেকে চাঁদা নেওয়া হয়। এসব চাঁদার অর্থ কোথায় যায় তার কোনো হদিস থাকে না। বর্তমানে মন্ত্রী বা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা যখন জেলা পর্যায়ে সফরে যান, সাধারণত যে মন্ত্রণালয়ের কাজে যাচ্ছেন, জেলা পর্যায়ের সেই দপ্তর অতিথিদের আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু এর পরও এলআর ফান্ড সংগ্রহের ধারা বিদ্যমান রয়েছে। অডিট না হওয়ায় এ খাতের অর্থ নিয়ে পুরোপুরিই দুর্নীতি হচ্ছে।
প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের ফান্ড শুধু ডিসিদের জন্যই নয়, পুলিশেও রয়েছে। পুলিশের যে সোর্স মানি তারও কোনো অডিট হয় না। সব ধরনের গোয়েন্দাকাজের সোর্স মানিরও একই অবস্থা।
২০১৩ সালে ২২ ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। উল্লেখযোগ্য একটি হলো ৪০০ একর সরকারি জমি হাতিয়ে নেওয়ার মামলা। গাজীপুর সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৮৫টি দাগে প্রায় ৪০০ একর খাসজমির খতিয়ান জাল করে সরকারি জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুদক এ বিষয়ে তদন্ত শেষে মামলা করেছে। অভিযোগ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ওই কর্মকর্তাকে গাজীপুর থেকে সরিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি জমি হাতছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে গাজীপুরের আরেক সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) অতুল সরকারের বিরুদ্ধেও। তিনি অর্থের বিনিময়ে অর্পিত সম্পত্তি ব্যক্তির নামে খারিজ ও নামজারি করে দেওয়ার জন্যও অভিযুক্ত। এ কর্মকর্তাকে গাজীপুর থেকে সরিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) করা হয়। পরে তাঁকে সেখান থেকেও বদলি করা হয়েছে। আইন অগ্রাহ্য করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ০.৫৫ একর সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানায় নামজারি করে দেওয়ার অভিযোগে ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জনেন্দ্র নাথ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। সেখান থেকে তাঁকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছিল। খুলনার বটিয়াঘাটার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাজেদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা চলা অবস্থায় তাঁকে পাঠানো হয় চুয়াডাঙ্গায়। সরকারি খাস খতিয়ানের ৩.২৯ একর জমি আত্মসাৎ করার অভিযোগে বগুড়ার সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ইফতেখারুল ইসলাম খান ও বগুড়ার শেরপুরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেওয়ান মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা চলা অবস্থায় একজনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং আরেকজনকে ঢাকার নবাবগঞ্জে পদায়ন করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনে কর্মরত থাকার সময় প্রকল্প পরিচালক মো. শাজাহান মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়। সেখান থেকে তাঁকে বদলি করা হয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। দিনাজপুর জেলার হাকিমপুরের সাবেক ইউএনও তোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা চলা অবস্থায় তাঁকে পাঠানো হয়েছিল গাইবান্ধার পশালবাড়ীতে।
এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে তাঁদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রাম ডিসি অফিসের ভূমি হুকুমদখল কর্মকর্তা সানজিদা শারমিন, সিরাজগঞ্জের সাবেক ডিসি মো. আমিনুল ইসলাম, কানাইঘাটের সাবেক ইউএনও মিজানুর রহমান, ঢাকার তেজগাঁও সার্কেলের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আব্দুর রউফ তালুকদার ও ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মাসুদ করিম। চট্টগ্রামের এশিয়ান ওমেন ইউনিভার্সিটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করতে গিয়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তন দেখিয়ে ৭৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয় সানজিদা শারমিনের বিরুদ্ধে। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুর হাট ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে মামলা চলছে সিরাজগঞ্জের সাবেক ডিসি মো. আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। নামজারির অবৈধ আদেশ দেওয়ার অভিযোগে ঢাকার তেজগাঁও সার্কেলের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আব্দুর রউফ তালুকদার ও ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মাসুদ করিমের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ইজারাগ্রহীতাকে ১৭.৯৩ একর ভূমির স্থলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে ১০৪.১১ একর ভূমি ভোগদখলের সুযোগ করে দিয়ে সরকারকে ৩৬ লাখ টাকা রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করায় কানাইঘাটের সাবেক ইউএনও মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
এ ছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানসচিব ড. শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে মামলা চলছে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ডাকসচিব আবু বকর সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে দুদকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক শহিদুর রহমানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। গোপালগঞ্জের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মতিনের বিরুদ্ধে গত ২৪ আগস্ট মামলা করেছে দুদক। শাহরিয়ার মতিনসহ ২১ কর্মকর্তা সরকারি জমির ওপর নির্মিত অবকাঠামো ও ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করেছেন। ১০ লাখ টাকার ১২টি ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সাবেক ইউএনও সুজিত রায়ের বিরুদ্ধে। ময়মনসিংহের ভালুকার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে ১০ দশমিক ৪৬ একর সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের মামলা চলছে।
কমিশনে নির্ধারিত সময়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেননি চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
দুর্নীতিতে কম যান না নন-ক্যাডাররাও : ক্যাডার কর্মকর্তাদের তুলনায় নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ বেশি। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ১৬০টি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় ৪৯২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযুক্ত। একই সময়ে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ২৩২টি মামলার। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ৪৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

Saturday, October 11, 2014

শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেল সময়ের দাবি

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
পূজা ও ঈদের ছুটির মধ্যেই এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস (৫ অক্টোবর) পালিত হয়েছে। মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান দুটি বার্ষিক উৎসবের মধ্যবর্তী সময় হওয়াতে তাই নামকাওয়াস্তে কিছু কর্মসূচি ছাড়া বিশ্ব শিক্ষক দিবস নিয়ে কোনো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। শিক্ষকদের মতোই এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস অবহেলার শিকার হয়েছে। যদিও এবারের প্রতিপাদ্য : 'শিক্ষকের জন্য বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ' প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌও কি আমরা শিক্ষকের জন্য কোনো বিনিয়োগ করছি? শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ বলতে সাধারণভাবে শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধায় বিনিয়োগ করাকেই বোঝাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমরা শিক্ষকদের জন্য তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? কিন্তু সেই বিনিয়োগ যদি 'কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই' প্রবাদের মতো কাগজে-কলমে অথবা শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্যের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ থাকে; তবে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগও যে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।


শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানীর নিশ্চয়তা প্রদানই কেবল এবারের শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্যকে ভবিষ্যতে সার্থক করে তুলতে পারে। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকের 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থার অবসানই কেবল এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির চাবিকাঠি।

২০০৯ সালের বেতন কাঠামো অনুসারে বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক চার হাজার ৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন আট হাজার ৩৬৯ ডলার। যুক্তরাজ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী নয়। তাই ভারতের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যে বেতন পান, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার কাছাকাছি বেতন দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের শিক্ষকসমাজের! ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক প্রতি মাসে ৬০ হাজার রুপি; আর একজন অধ্যাপক এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেলেও এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন ১০০ বার গালমন্দ করি, সেই পাকিস্তানও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে দুই লাখ তিন হাজার থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান। বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি, সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ও সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েক গুণ বেশি। ওই দেশগুলোতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বেতন পান যথাক্রমে : এক হাজার ৩৭, ৮৬৪, দুই হাজার ৭৫৮ ও এক হাজার ৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে : দুই হাজার ৩০৪, এক হাজার ৫৮০, ছয় হাজার ২২৯ ও চার হাজার ৫৫০ ডলার।

কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়; প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের আকাশ-পাতাল তফাত। মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের অবস্থাও একই। এ দেশের শিক্ষকদের কম বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে যতটা না অর্থনৈতিক সংকট দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী উচ্চপর্যায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সংকীর্ণ মানসিকতা। বাংলাদেশের মানুষ ধবধবে সাদা পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনো পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তিকেই শিক্ষক বলে জানে। ধরেই নিই, শিক্ষকরা হবেন অতিভদ্র, বিদ্যার ভার তাঁদের মাথা নোয়াবে। সাদাসিধে জীবনযাপন করবেন তাঁরা। আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানি, পাঠান, মোগল, ইংরেজ অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক মানেই এমন চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠে। কিন্তু আমরা ভুলেই গেছি, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। ডিজিটাল যুগে আছি আমরা। এখন একজন শিক্ষককেও শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে পড়াতে ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়। সর্বশেষ তথ্য জানতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের যদি আর্য-মৌর্য যুগের সম্মানী দিই; তবে তাঁদের পক্ষে কী শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব?

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য স্থায়ী পে কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে; কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ শিক্ষকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে জাতীয় পে কমিশন নিশ্চয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করবে। কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন পে কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশিত হলেও সেখানে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কোনো উল্লেখ নেই, যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের চরমভাবে হতাশ করেছে। যদিও নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতাদের 'অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার' আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বনেতাদের মতো আমরাও প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সমর্থন করছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ওই আহ্বানের কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে? এ দেশে এখনো শিক্ষা খাতে যত ব্যয় করা হয়, তার থেকে বেশি ব্যয় করা হয় প্রতিরক্ষা খাতে। দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে এই খাতের ব্যয় আরো বৃদ্ধি করলেও আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই; কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষা খাতে তথা শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।

পরিশেষে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসা পর্যন্ত সরকার যত উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অসম্ভব। একজন ভালো মানের কারিগরের পক্ষেই উচ্চমানের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই অধিক হারে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, যখন তাঁদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করে সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Published in: http://www.kalerkantho.com/feature/sub-editorial/2014/10/11/138137/print

আরো পড়ুনঃ "স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"