Tuesday, March 17, 2015

জামাল নজরুল ইসলামঃ বাংলাদেশে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী


বাংলাদেশে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী ওই একজনই ছিলেন। আর তিনি হলেন জামাল নজরুল ইসলাম। আমরা অনেককেই প্রতিথজশা বিশিষ্ঠ বিজ্ঞানী বলি কিসের ভিত্তিতে আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্কে সত্যি ঢুকে না। আমাদের দেশে যার যতটুকু সম্মান পাওয়ার কথা ছিল তা কখনো দেওয়া হয়নি। এই মানুষটিকে যতটুকু সম্মান দেওয়ার কথা ছিল দিয়েছি কি? এই মানুষটির কাছ থেকে যতটুকু নেওয়ার কথা ছিল নিয়েছি কি? মানুষটি এই দেশটিকে প্রচন্ড ভালবাসতেন আর তাইত বিদেশে আরাম আয়েশে থাকতে পারার সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্যেও দেশে ফিরে এসেছেন। গতকাল 16 March ছিল উনার মৃত্যু দিবস। কোথাও কোন স্মরণ সভা এমন কি রেডিও TV-তে এই বিশেষ দিনের আলোকে কোন অনুষ্ঠান কি হয়েছে? আমার জানা নেই। গুনি মানুষের কদর এই দেশে কখনো হয়নি। কদর করতে না পারার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান সম্ভবত পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে শীর্ষে। তারা সম্মান দেখাতে পারেনি প্রফেসর আব্দুস সালামের মত বিজ্ঞানীকেও। আমরা তাদের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। এজন্যই গুনি বিজ্ঞানীর সংখ্যা এদেশে এত কম। প্রায় বন্ধা বলা যায়।

কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Saturday, March 14, 2015

বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি ও জার্নালের গুনগত মান

Kamrul Hassan

ধরা যাক বাংলাদেশের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রমোশন আসন্ন। প্রমোশনের কিছু নিয়ম কানুন আছে। শিক্ষক প্রমোশনের যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য কমিটি থাকে সেখানে বিষয় সংশ্লিষ্ট এক্সপার্টও থাকেন। এক সময় এই নিয়ম কানুনগুলো খুব শক্ত ছিল। শুনেছি একসময় এই এক্সপার্টরা ছিলেন বিদেশী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক। এই এক্সপার্টরা তাদের মতাতত পাঠাতেন কমিটির কাছে এমনকি তাদেরকে কমিটিতেও রাখা হত। তারা গবেষণা পত্রের আন্তর্জাতিক মান ও অন্যান্য যোগ্যতা impartially যাচাই করতেন। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে আমরা এগুলো সব কিছু পরিবর্তন করে ফেলেছি। নিয়োগ কমিটিতে এখন শুধুই দেশী এক্সপার্ট থাকেন। আবার এই দেশী এক্সপার্টদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনায় অন্তুর্ভুক্ত করা হয়। এই তথাকথিত এক্সপার্টরা কতটুকু এক্সপার্ট সে বিষয়ে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন থেকেই যায়। এখন গবেষণা পত্র আর আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে হতে হয় না। অবস্থা এখন এমন যে Nature বা Science জার্নালে প্রকাশিত করলে যে ফায়দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালে প্রকাশিত করলে ঐ একই ফায়দা। তো এদেশের শিক্ষকরা ভালো কাজ করতে উত্সাহিত হবে কেন? এবং হচ্ছেও না।

যে কথা বলছিলাম। কোন একজন শিক্ষকের যদি প্রমোশন আসন্ন হয় সে তখন কি করে এই বাংলাদেশে? প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদের নিজস্ব জার্নাল আছে এমন কি আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও। এই জার্নালগুলোর এ জন্যই তৈরী করা হয় যেন আমাদের শিক্ষকরা তাদের প্রমোশনের প্রয়োজনীয় গবেষণা পত্র অতি সহজে প্রকাশিত করে অতি দ্রুত প্রমোশন পেয়ে অধ্যাপক হতে পারেন। ওই জার্নালগুলোর এডিটর সাধারণত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একজন শিক্ষক। প্রমোশন প্রার্থীর যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক গবেষণা পত্র না থাকে কোন সমস্যা নেই। যতগুলোর ঘাটতি আছে ততগুলো গবেষণা পত্র লিখে এডিটরের কাছে ব্যাক্তিগত ভাবে গিয়ে রিকোয়েস্ট করতে পারলেই এক ইসুতে দুই বা ততোধিক গবেষণা পত্র পাবলিশ করা বা acceptance লেটার নেওয়া সম্ভব। এই acceptance লেটার দিয়েই প্রমোশন হয়েছে এরকম শিক্ষক এই খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পাওয়া যাবে। এমনটা পৃথিবীতে বিরল। আমরা এমনই। আমরা এরকম বিরল আরো অনেক ক্ষেত্রে।

একটা গল্প বলে বাকি লেখাটা শেষ করতে চাই। ঢাকার কোন এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক বিভাগের বেশ কিছু শিক্ষকের প্রমোশন হচ্ছে না প্রয়োজনীয় গবেষণা পত্র নেই বলে। তো তারা সকলে একত্রিত হয়ে তারা তারা মিলে একটা জার্নাল প্রকাশের ডিসিশন নেন। যেই কথা সেই কাজ। প্রথম দুয়েক ইসুতেই তাদের, শুধু মাত্র তাদের, গবেষণা পত্র দিয়ে তাদের যা প্রয়োজন ছিল মিটিয়ে ফেলেন এবং প্রমোশন পেয়ে যান। তারপর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এটা আবার চালু হয় যখনই কিছু জনের খুব প্রয়োজন হয়। শিক্ষক যদি এমন ছলচাতুরী করে তো এরা আমাদের ভবিষ্যত প্রন্মকে কি শেখাবে?

নিজেদের জার্নাল, নিজেরদের লোক এডিটর এবং রেফারি এগুলো শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। এগুলো করে রিসার্চ-এর মান কখনো ভালো হবে না এবং হচ্ছেও না। কারণ কোন কিছু না করে শুধু কিছু গোজামিল দিয়ে যদি রিসার্চ পেপার হয়ে যায় আর সেইগুলো দিয়েই যদি সব কাজ চলে তো ভালো এবং কষ্টকর কাজ কোন বলদ করবে?

কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Friday, March 13, 2015

এক বাংলাদেশির অসাধারণ কীর্তি

মোহাম্মদ কায়কোবাদ


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগ কম্পিউটারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম বিভাগ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলকভাবে নবীন। ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করে এই বিভাগ। মেধাবী ছাত্ররা এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুবাদে শুরু থেকেই শিক্ষায় উৎকর্ষ বজায় রেখে চলেছে। ইকরাম হোসাইন আমাদের বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র হলেও অনেক কিছুতেই প্রথম। যেমন আমাদের বিভাগ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করা স্নাতকদের মধ্যে সে প্রথম পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের স্নাতকদের মধ্যে সে-ই প্রথম আইইইইর (ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স) একাধিক জার্নালের সম্পাদক হয়েছে। পরিশেষে সে-ই প্রথম স্নাতক, যে আইইইইর অত্যন্ত সম্মানজনক ফেলো নির্বাচিত হয়েছে।

আমাদের বিভাগে মাস্টার্স কোর্স করার সময় ইকরামের অধ্যবসায়, একাগ্রতা ও শিক্ষাগবেষণার প্রতি নিবেদন চোখে পড়ে। দিনের যেকোনো সময়ে তাকে ল্যাবরেটরিতে পাওয়া যেত এবং গভীর রাত পর্যন্ত সে কাজ করত।

১৯৯৭ সালে সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি করার পর পারফেক্ট গ্রেড নিয়ে ২০০১ সালে কানাডার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে। স্বীয় কর্মদক্ষতা ও গবেষণা উৎকর্ষ দ্বারা সে সময়ের আগেই সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়। ২০১০ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পায়, যখন তার বয়স ৩৭ বা ৩৮-এর বেশি হবে না। কগনিটিভ ও সেলুলার রেডিও নেটওয়ার্কে স্পেকট্রাম ও রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে আইইইইর ফেলো নির্বাচিত করা হয়।

একজন মানুষ কতটা নিবেদিতপ্রাণ হতে পারে, তা ইকরামের কর্মযজ্ঞ পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। অধ্যাপক হোসাইন IEEE Communications Surveys and Tutorials-এর মুখ্য সম্পাদক, তা ছাড়া IEEE Journal on Selected Areas in Communications - Cognitive Radio Series and IEEE Wireless Communications-এর একজন সম্পাদক। এ ছাড়া সে IEEE Press ও IEEE Transactions on Wireless Communications-এর সম্পাদনা পরিষদের একজন সদস্য।

কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে এ পর্যন্ত সে দশটি বই লিখেছে। তার লেখা অনেক গবেষণাপত্রই বিজ্ঞানী সমাজের নজর কেড়েছে এবং অনেকবার উদ্ধৃত হয়েছে। সে আইইইই কমিউনিকেশনস সোসাইটির ডিস্টিঙ্গুইস্ট লেকচারার। ছাত্রজীবন থেকেই উন্নত মানের গবেষণার জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত, যার বিশদ বৃত্তান্ত http://home.cc.umanitoba.ca/~hossaina/ekram_vita.pdf -এ রয়েছে। দেশেও সে একাডেমিক অবদানের জন্য ড. এম এ রশীদ স্বর্ণপদক পেয়েছে ২০০১ সালে।

ভাবতে অবাক লাগে, ১২ বা ১৩ বছর সময়ের মধ্যেই সে ১২৯টি জার্নাল পেপার, দুটি আমেরিকান প্যাটেন্ট, ১৮টি বইয়ের অধ্যায় ও ১৩৮টি কনফারেন্স পেপার প্রকাশ করেছে, উদ্ধৃতি প্রায় ১০ হাজার! বছরের যেকোনো সময়ে ছাপানোর অপেক্ষায় যে পেপারগুলো থাকে, তার তালিকা দেখলেই বোঝা যায় যে সে কী গতিতে কাজ করে। এ পর্যন্ত নয়জন ছাত্রের পিএইচডির কাজ সফলতার সঙ্গে তত্ত্বাবধান করেছে। বর্তমানে সাতজন ছাত্র ও আটজন পোস্টডক্টরাল ফেলো তার তত্ত্বাবধানে গবেষণা করছে। এ পর্যন্ত ১২টি জার্নালের সম্পাদনা পরিষদে কাজ করেছে, তার বেশির ভাগই আইইইইর। এ ছাড়া ১৮টি জার্নালের অতিথি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে। প্রায় ২৫টি কনফারেন্স, ওয়ার্কশপের চেয়ার কিংবা কো-চেয়ার হিসেবে কাজ করেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে অধ্যাপক ইকরাম হোসাইনের গবেষণা নিশ্চয়ই খুব উঁচু মানের হবে। সাধে তো আর আইইইই তাকে ফেলো নির্বাচিত করেনি, যেখানে আমাদের দেশের একজনও নেই। আমরা যদি শুধু সংখ্যার দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের একজন অধ্যাপক হয়তো তার ৫০ ভাগের এক ভাগ কাজ করে না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা-ই সত্য, যদিও আমি ইকরামের একজন শিক্ষক এবং স্নাতক পর্যায়ে তার থিসিস সুপারভাইজার ছিলাম।

কিছুদিন আগে হাইডেলবার্গ লরেট ফোরামে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম, যেখানে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিতের সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। এই বিষয়গুলোতে নোবেল পুরস্কার নেই বলে কম্পিউটারের টুরিং পুরস্কার ও গণিতের ফিল্ডস মেডালকে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য ধরা হয়। সেই আসরে ভারত কিংবা ভিয়েতনাম থেকে লরেট ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একজনও নয়, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকেও নয়। আমি কামনা করি, ইকরাম তার প্রশংসনীয় গবেষণা তৎপরতাকে আরও বেগবান করবে এবং আমাদের দেশও ওই আসরে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করবে।

ইকরাম হোসাইনকে আবারও অভিনন্দন। সিএসই পরিবার ও গোটা দেশ তার অর্জনে গর্বিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানে গবেষণায় ইকরাম হোসাইন আরও অসাধারণ অর্জন করবে, এই প্রত্যাশায় রইলাম।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/476113