Friday, May 29, 2015

ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার

অনন্ত মাহফুজ

বাংলাদেশের জনপ্রশাসন নিয়ে বহুল উচ্চারিত মন্তব্যটি হলো, এর কাঠামো ঔপনিবেশিক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামল থেকে একবিংশ শতকের বাংলাদেশে প্রশাসনিক কাজের মূল দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত আমলাতন্ত্রও সে কারণে ঔপনিবেশিক এবং পশ্চাৎমুখী। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ রাজনৈতিক সরকারের নামে হলেও প্রকৃত অর্থে মূল কাজটি করে থাকেন আমলারাই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানগণসহ রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় সর্বাংশে আমলানির্ভর। রাজনৈতিক কর্মকা-ে অধিকতর মনোনিবেশের কারণে তারা প্রশাসনিক কাজে সময় কম ব্যয় করেন। শাসন এবং শোষণ দীর্ঘায়িত করার জন্য মেরুদ-হীন এবং ইংরেজ শাসকদের ওপর নির্ভর একটি আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। কালক্রমে ব্রিটিশদের অসৎ উদ্দেশ্যে তৈরি করা আমলাতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশে আরও শক্ত খুঁটির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতক শক্তির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতিশীল প্রশাসন গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। এতে আমলাদের স্বার্থহানি এবং ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ঠিক এ রকম সময়ে পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটানো হয় এবং সংস্কার কাজ থামিয়ে দেওয়া হয়।

ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র

বাংলাদেশের বর্তমান জনপ্রশাসন ব্রিটিশ শাসকের তৈরি জনপ্রশাসনের উত্তরাধিকার বহন করছে। দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলেও জনপ্রশাসনে পরিবর্তন আনা যায়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া প্রশাসনিক কাজ শুরু করার সময় তেমন কোনো প্রশাসনিক কাঠামো ছিল না। তবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৭৬৫-১৮৫৮) আমলেই। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ রাজ সরাসরি ভারতবর্ষের ক্ষমতা গ্রহণ করলে (১৮৫৮-১৯৪৭) ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সিভিল সার্ভিস গঠন ও উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়ে। ১৭৮৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত ‘সুপারভাইজার’ নামে অভিহিত কোম্পানির স্থানীয় বাণিজ্যিক অফিসারদের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূখ-গত মালিকানা পরিচালিত হতো। কোম্পানির সিভিল সার্ভেন্টদের বলা হতো কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভেন্ট। এ সার্ভিসের সদস্যরা ভারতে চাকরির জন্য ভারত সচিবের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হতেন বিধায় এ চাকরির নাম হয়েছিল কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিস (সিসিএস)। ফোর্ট উইলিয়ামের প্রেসিডেন্সি কাউন্সিলের সভাপতি রবার্ট ক্লাইভ দেওয়ানি বিষয়ে বঙ্গদেশে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হয়ে দাঁড়ান। নায়েব দেওয়ান ও কোম্পানির মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির ভিত্তিতেই প্রারম্ভিক পর্যায়ের সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন ক্লাইভ। রবার্ট ক্লাইভের এ ডায়ার্কি বা দ্বৈতশাসনের ফলে বাংলায় ১৭৬৮-৬৯ সালের মহামন্বন্তর সৃষ্টি হয়। ১৭৭২ সালে ডায়ার্কি বা দ্বৈতশাসনের অবসান হয়।

এর কিছুদিন পর ১৭৮৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পিটস ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাস হয়। পিটস আইনে নতুন সা¤্রাজ্যের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্দেশ করে কাউন্সিলের গভর্নর জেনারেল হিসেবে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত অথচ জনপ্রিয় জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসকে নিয়োগ করা হয়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস ৪৮টি রেগুলেশন জারি করেন যা একত্রে ‘কর্নওয়ালিশ কোড’ নামে অভিহিত। ১৭৯৩ সালে নতুনভাবে বিন্যাস করা আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রশাসন থেকে বাণিজ্যের আলাদাকরণ, আকর্ষণীয় বেতন এবং দেশীয়দের প্রশাসন থেকে বাদ দেওয়া। এই রেগুলেশনের মাধ্যমে একচ্ছত্র জেলা প্রশাসনের জন্ম হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে নিয়োগ প্রদান করা হয়, যাকে অভিহিত করা হয় জেলা প্রশাসক হিসেবে। তিনি মূলত একজন ডেপুটি কমিশনার বা ডিসি। ডেপুটি কমিশনারের বাংলা কেন জেলা প্রশাসক করা হলো তাও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়।

ইংল্যান্ডের নতুন উদারপন্থি পার্লামেন্ট ১৮৩৩ সালের আইনবলে কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসে (সিসিএস) চাকরি ও সার্ভিস প্রদানের আদলে দেশীয়দের ক্ষমতার ভাগ দেওয়ার অঙ্গীকার করে। ১৮৬১ সালের আইনবলে কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসের নতুন নামকরণ হয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)। তবে আইসিএসে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ব্যাপারটা মোটামুটি অসম্ভবই থেকে যায়। কারণ ভারতীয়দের লন্ডনে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হতো এবং তাদের ইংল্যান্ডে দুই বছর শিক্ষানবিস হিসেবে থাকতে হতো। আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ড যাওয়া বিপুল খরচের ব্যাপারই শুধু ছিল না, সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিধিনিষেধেরও সম্মুখীন হতে হতো। ১৮৬৩ সালের আগ পর্যন্ত কোনো ভারতীয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হতে পারেনি। সে বছর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ভারতীয় হিসেবে আইসিএস সদস্য হন।

ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাগুলো ১৯২২ সাল থেকে যুগপৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়। আইসিএস সদস্যদের বলা হতো ‘স্বর্গীয়’ সন্তান। যদিও ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইসিএস পরীক্ষা একই সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু স্বর্গীয় সন্তানরা ১৯২২ সালের আগ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা চালু করতে দেয়নি। সিভিল প্রশাসনের আমলাদের এই হস্তক্ষেপ বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশেও চলমান আছে। বাংলাপিডিয়ার প্রধান সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে তার ‘আমলাতন্ত্র ও লোকপ্রশাসন ১৭৬৫-১৯৪৭’ নিবন্ধে মন্তব্য করেন, ‘ব্রিটিশ স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনা করত একদল পেশাদার আমলা, যারা নিয়ন্ত্রিত হতো আইন ও উচ্চতর আমলাদের দ্বারা এবং কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছানুযায়ী তারা কাজ করত না যেমনটি আমরা দেখেছি মোগল স্বৈরতন্ত্রের আমলে।’ (পৃষ্ঠা ২৫১)। 

দেশভাগের পর আমলাতন্ত্র

১৯৪৭ সালের বিয়োগান্তক দেশভাগের পর ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া নিপীড়নমূলক জনপ্রশাসনই বহাল থাকে। দেশভাগের পর সিভিল সার্ভিসের ভারত অংশে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থাকলেও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে করা হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস আমলাতন্ত্রের এলিটদেরই প্রতিনিধিত্ব করত। মহকুমা, জেলা ও সচিবালয়ের সর্বোচ্চ পদগুলোতে তারাই নিয়োজিত থাকতেন। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং সামরিক নেতৃত্ব কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ফলে রাজনীতিকদের ওপর আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রবলতর হয়। আমলাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী আমলাদের জনগণের মনিব হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। অথচ ১৯৪৮ সালে জওহরলাল নেহেরু ভারতের আইসিএসদের জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। অডিট সার্ভিসের ডাকসাইটে আমলা গুলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানের প্রথম অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। একই সার্ভিসের অপর সদস্য চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) সবচেয়ে প্রভাবশালী সচিব হন। পরবর্তী সময়ে এই আমলার জন্য সরকারকে সেক্রেটারি জেনারেলের পদ সৃষ্টি করতে হয়েছিল এবং তার অবসরের পর এই পদটি বিলুপ্তও হয়েছিল। লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার দু বছর পর ১৯৫৩ সালে গুলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রায় এক বছর পর গুলাম মোহাম্মদের জায়গায় গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের সদস্য ইস্কান্দার মির্জা। তাদের সরাসরি আহ্বানেই ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন সেনাশাসক আইয়ুব খান। সিএসপিগণ বিসিএসকে ব্যঙ্গ করে বলতেন বাংলাদেশ ক্যাটেল সার্ভিস।

স্বাধীন বাংলাদেশে জনপ্রশাসন এবং আমলাতন্ত্র

১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য প্রশাসন ও চাকরি পুনর্গঠন নামে একটি কমিটি গঠন করে। ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো এবং বেসামরিক চাকরির পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের নীতি কী হবে সে ব্যাপারে পরামর্শদানের জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গঠিত রশিদ কমিশন অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপের সুপারিশ করে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, রশিদ কমিশন অত্যন্ত আলোচিত এবং সবসময়ের জন্য যুৎসই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রস্তাব করে। তা হলো সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) নামে একটি পৃথক ক্যাডার সৃষ্টি যেখানে উপসচিব পর্যায়ে সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হবে এবং তা সব ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সিনিয়র সার্ভিস পুলকে (এসএসপি) একটা পৃথক ক্যাডার হিসেবে গঠনের ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করে এবং ১৯৭৯ সালে সেই বিধি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে। তবে এসএসপিতে রিক্রুটমেন্টের জন্য লিখিত পরীক্ষার পাঠ্যসূচি নিয়ে সরকারি কর্মকমিশনের সঙ্গে একমত হতে সরকারের দীর্ঘ ১০ বছর সময় লেগে যায়। অনেকে মনে করেন, এই কালক্ষেপণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। ১৯৮৯ সালের ১২ জুলাই এসএসপি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিসিএস (প্রশাসন) ও বিসিএস (সচিবালয়) একীভূত করার ফলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ক্যাডারের বর্তমান সংখ্যা ২৯।

রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর এরশাদ বিচার এবং প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। উপজেলা আদালতের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ’৮৩ সালে ৬৫০ জনের বিশাল একটি ব্যাচ নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের লিখিত পরীক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র এমসিকিউর মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়। নিয়োগের শর্ত ছিল এরা উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেই অবসরে যাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক তদবিরে এ শর্ত প্রত্যাহার করে এদের সিভিল প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় যুক্ত করা হয়। ’৮৩ সালের পর ’৮৪ ব্যাচে ৪৫০ এবং ও ’৮৫ ব্যাচে ৫৫০ জনকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কাছাকাছি সময়ে উপর্যুপরি তিনটি ব্যাচে অধিক লোক নিয়োগের ফলে সিভিল সার্ভিসে অপেক্ষাকৃত দুর্বলরাও প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যান। ওই সময় নির্বাচন অফিসার ও সেনানিবাসের নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও সিভিল প্রশাসনে আত্মস্থ করার ফলে প্রশাসন নড়বড়ে হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আত্মস্থ হওয়া প্রশিক্ষণবিহীন অফিসারদের পেশাদার মনোবৃত্তির ঘাটতির কারণে প্রশাসন ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনপ্রশাসন সঠিকভাবে কাজ না করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাদার চেহারা না গড়ে ওঠার পশ্চাতে অনেক কারণ আছে। রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং অতিরিক্ত আমলানির্ভরতা অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া আছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী না করতে পারা, ন্যাপোটিজম, সিএসপি-বিসিএস দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, ব্যাচে ব্যাচে কোন্দল, কাঠামোহীন কর্মপদ্ধতি এবং প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনের অভাব। প্রশাসনকে গতিশীল এবং জনকল্যাণমুখী করার জন্য অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্পয়েল সিস্টেমের মতো একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ থেকে সামরিক শাসনসহ ’৯৭ সাল পর্যন্ত সবকয়টি সরকারের সময়ে গঠিত হয়েছে মোট ১৩টি কমিশন। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে গঠিত হওয়া এটিএম শামসুল হকের কমিশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছে। এই কমিশন নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্টের (এনপিএম) ধারণা সম্বলিত মোট ১৩৭টি সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ হলো স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমমনা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে ক্লাস্টার্স সিস্টেমের প্রচলন করে কর্মকর্তাদের ওই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বদলি সীমিত করা। সিনিয়রিটি, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য সুপিরিয়র ম্যানেজমেন্ট পুল (এসএমপি) গঠন করা এবং কোটা প্রথা বাতিলের সুপারিশ করা হয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন, প্রতিষ্ঠান ও জনশক্তির আধিক্য কমানো এবং স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়।

জনপ্রশাসনে বঞ্চনা

স্বাধীন বাংলাদেশে একটি সুষম সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠবে, এ রকম একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বিসর্জন দিতে হয়েছে ত্রিশ লাখ জীবন আর লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম। আর এ জন্য জনকল্যাণমুখী, সমাজবান্ধব, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত একটি জনপ্রশাসন প্রয়োজন। অথচ ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। জনপ্রশাসনে প্রশাসনবহির্ভূত অন্য ক্যাডার বা অবশিষ্ট ২৮টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন থেকে নানাভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছেন। সময়মতো পদোন্নতি না পাওয়াসহ আছে নানা বঞ্চনা। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ২৫% কোটা কখনো মানা হয় না। প্রশাসন ক্যাডারের জুনিয়রদের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের কয়েকটি ব্যাচ সিনিয়রদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হয়। যুগ্মসচিব পদে বর্তমানে ৩০% কোটা না থাকলেও পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না।

প্রত্যেক ক্যাডারের নিজ নিজ লাইনপোস্ট রয়েছে। এ হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারেরও লাইনপোস্ট আছে। কিন্তু ক্যাডার সৃষ্টি হওয়ার শুরু থেকে সাবেক সচিবালয় ক্যাডার ও প্রশাসন ক্যাডার সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্যাডার হওয়ায় সচিবালয়ে সরকারের সহকারী সচিব থেকে সচিব এবং সমমর্যাদার প্রায় সবকয়টি পদ একচেটিয়া তাদেরই দখলে। প্রকৃচির (প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসক) আন্দোলনের মুখে সচিবালয়ের এই পদগুলোতে ক্যাডারের রেশিও অনুযায়ী সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন করে উপসচিব থেকে কিছু কিছু করে কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার সিনিয়র সার্ভিস পুল ভেঙে দিয়ে ২০০২ সালে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করে। সেখানে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য উপসচিব পদে ২৫% এবং যুগ্মসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে ৩০% পদোন্নতির কোটা রাখা হয়। কোটা পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হলে হাইকোর্ট কোটা পদ্ধতি অবৈধ ঘোষণা করেন। সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিলের রায়ে উপসচিব পদে ২৫% কোটা বহাল রেখে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি রহিত করা হয়। কর্মকর্তারা বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার অনেক পর তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় আপিল করে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা আপিলের রায় তাদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

প্রশাসনে বহুবিধ সমস্যা ও বৈষম্য রোধে প্রকৃচি ও ছাব্বিশ ক্যাডার সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত দাবি জানানো হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রকৃচি ও ছাব্বিশ ক্যাডার সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া তিনটি দাবির মধ্যে দুটি দাবি মেনে নেওয়া হয়। যার একটি প্রতিটি ক্যাডারে গ্রেড-১র পদ সৃষ্টি করা এবং অপরটি বেতন স্কেলের ৫ম গ্রেডে ৮ বছরের বেশি সময় পার করা কর্মকর্তাদের চতুর্থ গ্রেডের সিলেকশন প্রদান করা। সব ক্যাডারে কমপক্ষে ১টি করে গ্রেড-১র পদ সৃষ্টি করার বিষয়টি আটকে আছে। সম্প্রতি পুলিশ ক্যাডারের জন্য গ্রেড-১র কয়েকটি পদ সৃষ্টি করা হলেও অন্য ক্যাডারে তা করা হচ্ছে না। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে সব ক্যাডারের সমান হারে প্রবেশের অধিকার রয়েছে। এসব পদ নির্দিষ্ট কোনো ক্যাডারের জন্য হতে পারে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সমনীতি বলবৎ নেই।

একটি ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে আখ্যায়িত করার অর্থ হলো অন্য কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত নন বা বাকি ২৮টি ক্যাডারে কোনো প্রশাসন এবং প্রশাসনিক কাজ নেই। প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্য ২৮টি ক্যাডার স্ব স্ব কর্মস্থলে অবশ্যই প্রশাসনিক কাজ করে থাকে। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান তার লেখা ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামো : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ (উত্তরণ, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৯) গ্রন্থে বলেন, একটি বিশেষ ক্যাডার সার্ভিস তাকেই বলা হয় যার ল্যাডার থাকে সচিব পর্যন্ত অর্থাৎ একটা বিশেষ ক্যাডারভুক্ত (এনক্যাডারড) সদস্যরাই অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ এবং পদোন্নতির সাহায্যে স্ব স্ব ক্যাডারের ল্যাডার বেয়ে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ সচিব পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ লাভ করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, যিনি কৃষি সার্ভিসের ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন তিনিই অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতি লাভ করে সংশ্লিষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যন্ত সমুদয় পদে যাওয়ার অধিকারী হবেন। এ কথা সত্য যে, মাঠ পর্যায়ে যিনি যে বিষয়ে কাজ করেন, তার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে বেশি হবে। মাঠ পর্যায়ে অর্জিত জ্ঞান সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে কাজে লাগানো গেলে প্রশাসনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাজে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থাকার প্রয়োজন বেশি।

প্রশাসনে কাঠামোগত জটিলতার পাশাপাশি আমলাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব আছে। সিভিল সার্ভিসের রাজনীতিকরণের বিষয়টিও গত দুই দশকে জনগণের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কোনো সরকারই জোরালো করতে পারেনি। স্থানীয় প্রশাসন জোরদার করে সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রশাসনিক এবং উন্নয়ন কাজ করাতে হবে। গ্রাম পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের মাধ্যমে পরিষদগুলো পরিচালিত করতে হবে। সিনিয়র সহকারী কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার যথাক্রমে উপজেলা এবং জেলার প্রশাসক হতে পারেন না। নির্বাচিত প্রতিনিধিই প্রশাসক হবেন। 

স্বাধীনতার চার যুগের বেশি সময় পরও বাংলাদেশের জনপ্রশাসন এবং আমলাতন্ত্র যুগোপযোগী এবং দক্ষ হয়ে ওঠেনি। এ কারণে প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ে বহুদিন থেকে আলোচনা হচ্ছে। স্বার্থহানির আশঙ্কায় সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ কোনো সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে দেন না বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। বাংলাদেশের জনপ্রশাসনকে গতিশীল এবং উন্নয়নমুখী করতে হলে দ্রুত সংস্কারে হাত দিতে হবে। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্য সবকয়টি ক্যাডার থেকে উপসচিব পদমর্যাদায় ২৫% নেওয়া হয়। এ কারণে অন্য ২৮টি ক্যাডারের বহু মেধাবী এবং সৎ কর্মকর্তা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন না। এ কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে যেমন হতাশার সৃষ্টি হয়, তেমনি ক্রমে জনপ্রশাসন মেধাশূন্য হতে থাকে। কোটার ভিত্তিতে অন্য ক্যাডার থেকে আসা অনেক কর্মকর্তা তার নিজের ক্যাডারের পদমর্যাদার নি¤œস্তর উপসচিব পদে গেলেও পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের খুব মর্যাদাসম্পন্ন পদে তাদের নিয়োগ প্রদান করা হয় না। এই ২৫% কোটা প্রথা বাতিল করতে হবে। পরিবর্তে উপসচিব পর্যায়ে ২৯টি ক্যাডার থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মকর্তা নিতে হবে। রশিদ কমিশন এবং শামসুল হুদা কমিশনের প্রস্তাবগুলো এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

প্রত্যেক কর্মকর্তার স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ সচিব পদ পর্যন্ত যাওয়ার প্রস্তাব করে প্রশাসনিক সংস্কার করা যেতে পারে। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা পদোন্নতির মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন এবং এখানে অন্য কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ আসতে পারবেন না- এভাবে ক্যাডার বিন্যাস করা যেতে পারে। তবে অনেকে মনে করেন, বর্তমান ক্যাডার সিস্টেম বহাল রেখে কেবল উপসচিব পদ সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য উন্মুক্ত করা যায় যেখানে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পাবেন। এতে করে একদিকে দক্ষ কর্মকর্তাগণ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যেতে পারবেন। অন্যদিকে কর্মকর্তাদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হবে এবং দক্ষতা বাড়ানোর দিকে তারা মনোযোগী হবেন। ঔপনিবেশিক সময়ের সরকারি চাকুরেদের সার্ভিস রুলস যুগোপযোগী করা দরকার। আসাদুজ্জামান তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘...একটা বিশেষ সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিস (রেভিনিউ) করার পরিবর্তে সিভিল সার্ভিস (এডমিন বা প্রশাসন) নামক উদ্ভট, হাস্যকর, অযৌক্তিক ও অবাস্তব নামে অভিহিত করে। বাংলাদেশের চাকরি ব্যবস্থায় সব বিপত্তি ও বিভেদের কারণ এটাই।’

জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান প্রশাসন কাঠামো রেখে তা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমলাদের কারণে সরকারের সফলতা মার খাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তার আশঙ্কা অমূলক নয়। যুগোপযোগী, সেবার মনোভাবসম্পন্ন, ইনফরমেশন টেকনোলজির সঙ্গে সুপরিচিত, দক্ষ এবং উন্নয়নমুখী জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে না পারলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

লেখক : সহকারী পরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

0 comments:

Post a Comment