অরুণ কুমার গোস্বামী
বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কর্তৃক প্রশংসিত হচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’ ঘোষণা করেছেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে, যথাক্রমে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই সঙ্গে এটিও লক্ষ্য করা দরকার যে, বর্তমান শতাব্দীকে এশীয় শতাব্দী হিসেবে আখায়িত করা হচ্ছে। এশীয় শতাব্দীর তাৎপর্য হচ্ছে বর্তমান ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য বিশ্ব যে অর্থনৈতিক অবস্থানে আছে, বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোও সেই পর্যায়ে পৌঁছবে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের এই বিষয়টিও অপরিহার্যভাবে মনে রাখতে হবে, বর্তমানে যে প্রজন্ম কর্মরত আছেন, তারা পুরনো বা সেকেলে কর্মসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে পারলেও, ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’-এর দ্বারা কোনোক্রমেই বাস্তবায়ন হবে না। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে। এই ‘ভিশন’ দুটি বাস্তবায়নের জন্য অনেক কিছু পরিবর্তন করা এখন সময়ের দাবি। পরিবর্তনযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার চূড়ান্ত পর্যায়ের অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর দেয়া। দেশে শিক্ষার জন্য এ যাবৎ যা কিছু করা হয়েছে তার সবকিছুই করা হয়েছে মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য। উচ্চ শিক্ষার জন্য সম্প্রতি উচ্চ শিক্ষার গুণগতমান সম্প্রসারণ প্রকল্প বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর একটি কম্পোনেন্ট হচ্ছে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি) এবং সেলফ এসেসমেন্ট কমিটি (এসএসি)। শিক্ষার গুণগতমান পরিমাপ করার এই পদক্ষেপ দ্বারা অনুধাবন করা যায় সরকারি কর্তৃপক্ষ উচ্চ শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ালিটি এসুয়েরেন্সের জন্য ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক গঠিত নিয়ন্ত্রণকারী বডির অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা উচ্চ শিক্ষার গুণগত মানের ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে সবচেয়ে অপরিহার্য ক্ষেত্র। শিক্ষার সব স্তর পার হয়ে এসে চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থাৎ কর্ম জগতে প্রবেশের আগের পর্যায় হচ্ছে ‘উচ্চ শিক্ষা’। আর উচ্চ শিক্ষার গুণগত মান যাদের ওপর নির্ভর করছে তারা হলেন মূলত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চূড়ান্ত পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষা যাদের ওপর নির্ভর করছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ও উচ্চতর বেতন স্কেল এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারই ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছরে উন্নীত করেছেন।
এ বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেন যে, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে বিগত যে কোনো সরকারের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ সফলতা ও উন্নতি সাধন করেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এই সব সফলতার একটি নিদর্শন।
সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করতে যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে দুঃখজনকভাবে সিনিয়র অধ্যাপকদের (সিলেকশন গ্রেড) বেতন কাঠামো পদায়িত সচিবদের বেতন কাঠামো থেকে এক ধাপ নিচে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূল বেতন সপ্তম বেতন কাঠামো থেকেও এক ধাপ কমিয়ে আনা হয়েছে। এই প্রস্তাবনায় সিলেকশন গ্রেড বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এই প্রস্তাব পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। তারা সিলেকশন গ্রেড অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছে। একইভাবে সিনিয়র অধ্যাপক ও অধ্যাপকদের মূল বেতন যথাক্রমে সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিবের বেতনের সমতুল্য করার জোর দাবি জানিয়েছে। পরবর্তী ধাপসমূহ যেমন, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতন কাঠামোও ক্রমানুসারে নির্ধারণ করার কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেক ধাপে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত অন্যান্য যে সুযোগ-সুবিধা প্রদেয়, তা শিক্ষকদের জন্য নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
এখানে বিশ্বের অন্যান্য কয়েকটি দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্রয় ক্ষমতার সমতা (পার্সেজিং পাওয়ার পেরিটি/পিপিপি) অনুসারে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশ্বের অন্য দেশের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক কম বেতন পেয়ে থাকে। প্রতিবেশী সার্কভুক্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার শিক্ষকদের চেয়ে অনেক কম বেতন পান বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছিল ‘শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন স্কেল নিশ্চিত করা হবে এবং শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস কমিশন গঠন করা হবে।’ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল করার কথা বলা হয়েছে। উচ্চতর শিক্ষার টেকসই উন্নতির জন্য এবং মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষকতার পেশায় আনার জন্য শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামো খুবই প্রয়োজনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিম্ন বেতন তাদের অন্য পথে উপার্জনের দিকে ঠেলে দেয়।
পিপিপি মাসিক (মার্কিন ডলার)হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন নিম্নরূপ-
বাংলাদেশ : এন্ট্রি ১৩৫, টপ ৪১৩
ইথিওপিয়া : এন্ট্রি ৮৬৪, টপ ১৫৮০
কাজাখস্থান : এন্ট্রি ১০৩৭, টপ ২৩০৪
ব্রাজিল : এন্ট্রি ১৮৫৮, টপ ৪৫৫০
তুরস্ক : এন্ট্রি ২১৭৩, টপ ৩৮৯৮
নাইজেরিয়া : এন্ট্রি ২৭৫৮, টপ ৬২২৯
মালয়েশিয়া : এন্ট্রি ২৮২৪, টপ ৭৮৬৪
জাপান : এন্ট্রি ২৮৯৭, টপ ৪৬০৮
অস্ট্রেলিয়া : এন্ট্রি ৩৯৩০, টপ ৭৪৯৯
ভারত : এন্ট্রি ৩৯৫৪, টপ ৭৪৩৩
যুক্তরাজ্য : এন্ট্রি ৪০৭৭, টপ ৮৩৬৯
[ উৎস : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।]
উপরের সারণিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যতীত প্রতিটি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল উচ্চতর। এ ক্ষেত্রে ইথিওপিয়া, কাজাখস্থান, ব্রাজিল, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন স্কেলের কথা সুপারিশ করেছেন যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতার প্রতি আকৃষ্ট হন। বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেলের কথা বলা হয়েছে। দেশের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেলের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক ২০০৯-এর জাতীয় বেতন কমিশন অনুযায়ী ৯ম গ্রেডে ১১,০০০ টাকা স্কেলে বেতন পান। সহকারী অধ্যাপক ৬ষ্ঠ গ্রেডে ১৮,৫০০ টাকা বেতন পান।
জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ৪র্থ গ্রেডে ২৫,৭৫০ টাকা স্কেলে বেতন পান। অধ্যাপক পান ৩য় গ্রেডে ২৯,০০০ টাকা স্কেলে। এ ছাড়া শিক্ষকর বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত ২৮টি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলাদেশের পাবলিক শিক্ষকদের বেতন স্কেল সর্বনিম্ন।
ভারতে একজন প্রভাষক ৬০,০০০ রুপি এবং একজন প্রফেসর ১.৫০ লাখ রুপি থেকে ২.০০ লাখ রুপি স্কেলে বেতন পেয়ে থাকেন। পাকিস্তানে একজন প্রফেসর ২.৩ লাখ থেকে ৪ লাখ রুপি স্কেলে বেতন পেয়ে থাকেন। শ্রীলঙ্কায় ১.৪ লাখ রুপি স্কেলে বেতন পান একজন প্রফেসর। বাংলাদেশে স্বল্প বেতনের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০০০ শিক্ষক অনুমোদন ছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে থাকেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উচ্চতর বেতন স্কেলের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক কিছু শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। যেহেতু শুধু ভালো ফলাফলই ভালো শিক্ষকের নিশ্চয়তা নয় সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশায় বিশেষত প্রভাষক পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ডক্টরেট বা পোস্ট ডক্টরেট বা গবেষণার এক্সট্রা যোগ্যতার শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। বর্তমানে শুধু মাস্টার্সই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য যথেষ্ট। যা অন্যান্য রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পৃথক স্কেল দেয়া হলে অবশ্যই শিক্ষকের শিক্ষাদানের গুণগত মান এবং নিয়মানুবর্তিতার বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে। ন্যূনপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি অনুসরণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে মফস্বল এবং ব্যয়বহুল শহরের মধ্যে ব্যবধানের বিষয়টিও দেখা যেতে পারে। তবে যেভাবেই হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পৃথক পে-স্কেল দেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশের উচ্চ শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র ও উচ্চতর বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হবে, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সঙ্গত কারণেই এই আশা সংশ্লিষ্ট সবাই করে।
অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Published in: http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2015/05/18/33010.php
0 comments:
Post a Comment