Tuesday, June 30, 2015

দেশের স্বপ্নে বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু ও অষ্টম বেতন স্কেল

ফিদা হাসান
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘এসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি’র অর্থায়নে সম্প্রতি পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষনায় সারকথা হিসাবে বলা হয়েছে, ‘সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাই বৃহদাকারে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিটি পরিবর্তনের জন্য প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় ছিলো।’ উন্নত বিশ্ব এমন কি উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য।

ইতিহাস বলে, তেরশো শতকের দিকে যুক্তরাজ্যর শাসকেরা যখন কেমব্রিজের মত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মান করেছিলো মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার শাসকেরা তখন নির্মান করতো উপাসনালয়। সময়ের পরিক্রমায় এখন সেই কেমব্রিজ হয়েছে আধুনিক মানুষের তীর্থস্থান।
দেশ হিসাবে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত নবীন তাই বিভিন্ন অসুবিধার পাশাপাশি সুবিধাও কিন্তু অনেক, আমরা চাইলে অন্যের অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করতে পারি যেটা সবসময় নবীনদের জন্য একটা এডভান্টেজ। কিন্তু দুর্ভাগা এই দেশ বলতেই হয়, তা না হলে এই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে যে বোকামিটা আমরা করছি তার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের দায়ী থাকতে হবে নিঃসন্দেহে।
উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশ তাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করেই ঘটনার আবর্ত তৈরি করে। এই যেমন, বিভিন্ন দেশের রেওয়াজ আছে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়ে প্রথম বক্তৃতা তিনি দেন কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিংবা কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান অন্য দেশে পরিদর্শনে গেলে সেই দেশের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। এমনই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছে, ( যদিও এই বক্তৃতার ব্যবস্থা শুধুমাত্র জনাব নরেন্দ্র মোদীর অভিপ্রায়ে হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতা দেখে সহজে অনুমেয়।) কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, বরং সাম্প্রতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রের ক্ষতিকর উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই হতে পারতো আমাদের স্বপ্ন গড়ার কারখানা। কেননা এটাই সত্য, এই বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গন অভ্যুথান, ৭১-এর স্বাধীনতা, ৯০ এর স্বৈরাচার পতন কিংবা হালের ২০০৮ এর অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সবই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু এবং এর ঘটনা প্রবাহ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক। যুদ্ধ বিগ্রহ শেষে স্বাধীনতা উত্তর সত্যিকারের দেশ গড়ায় তাই বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে প্রধান ভূমিকা রাখতে। আমাদের শুরুটাও কিন্তু ঠিক তেমনটাই ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীর সব কিছু বুর্জয়াদের অধিগ্রহনে চলে যাচ্ছে, যা ভয়াবহ কিছুর নির্দেশক।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শুরুর ঘটনা বলতে গেলে বলতে হয়, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বাধীনতা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাষনের আইন জাতীয় সংসদের পাশ করান যেটা ৭৩-এর অধ্যাদেশ নামে বহুল পরিচিত। কথিত আছে ড. কামাল হোসেন তখন বিরোধীতা করেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জবাবদিহিতার ভিতরে আনতে হবে। প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় ধমকে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের বিবেকের কাছে জবাব দিবে, তাদের আর কোন দায়বদ্ধতার প্রয়োজন নেই’।
যদিও উপরিউক্ত বিষয়টি আমার শোনা কথা, আমি চাক্ষুষ ঘটনাপ্রবাহ দেখি নি। তবে আমি যেটা দেখেছি তা থেকে ঘটনার সত্যতা নিরুপন করতেও কিন্তু বেগ পেতে হয় না।
একটু লক্ষ করে দেখুন, বঙ্গবন্ধু তার দুই কন্যাকে বিবাহ দিয়েছেন কাদের সাথে (আমাদের সমাজে তখন বিবাহ দেওয়ার রীতি যেমন ছিলো বিশেষত মেয়ের ক্ষেত্রে)। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তুলে দিয়েছিলেন একজন পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার হাতে । আর তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানাকে তিনি বিবাহ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকীর সাথে। গাড়িতে ফ্লাগ উড়িয়ে চলা মন্ত্রী, আমলা কিংবা বড় ব্যবসায়ীরা যে তখন ছিলো না, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে ভিশন বা দর্শন। তিনি ছিলেন তার জন্ম দেওয়া দেশের ভিশিয়নারী, স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই তার মেয়ে জামাই পছন্দের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে দেশকে নিয়ে তার ভিশন ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
অথচ সময়ের কি নির্মম পরিহাস, এখন আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই ইচ্ছামতো এটা সেটাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে অনলাইন পত্রিকায় দেখেছিলাম কোন এক মন্ত্রী নাকি বাংলাদেশে সেলুলার ফোনের তৃতীয় প্রজন্মের ব্যবহারকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো বলে আখ্যায়িত করেছে। তথ্যের সত্যতা জানি না, তবে আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে মিথ্যা বলে একবাক্যে উড়িয়েও দিতে পারি না। এখানে উল্লেখ্য যে, সেলুলার ফোনের প্রথম প্রজন্মেরই সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধু প্রয়াত হওয়ারও ৪ বছর পর (১৯৭৯-এ)। একইভাবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন পোস্টার ফেস্টুন দেখতে পাই, পাড়ার বখাটে ছেলেটার ছবি সেই সাথে তার মনগড়া কোন কথা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম, জনাব ওবায়দুল কাদের বলছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীর ছবি দেখে বিব্রতবোধ করেন। যা আমার উপরোক্ত অবজারভেশনকেই নির্দেশিত করে। এভাবে সব সুযোগ সন্ধানীরা দেশটাকে বিপথগামী করেছে, এখনও করে যাচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনভাবে কিছু লোক সত্য সন্ধান করুক, সত্য কথা বলুক তা সুযোগ সন্ধানীরা কখনোই চায় নি। সেই পরিক্রমায় আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আঘাত করে কন্ঠ রোধ করতে চাইছে তারা।
কথিত আছে, আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মহাম্মদ তার দেশ সেবায় আসার পর পর-ই নিজে নিজের ব্যক্তিগত ফোন দিয়ে বিভিন্ন দেশে গবেষনারত মেধাবী মালয়শিয়ানদের দেশে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করতো। এরকম একজন মালয়শিয়ানের একটি কলাম পড়েছিলাম, তিনি লিখেছিলেন, গভীর রাতে তিনি একটা ফোন পান, ফোনের ওপাশ থেকে পরিচয় আসে তিনি তার দেশের প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মহাম্মাদ, এরপর প্রধানমন্ত্রী তাকে দেশে ফিরে যাবার অনুরোধ করেন। তিনি লিখেছিলেন, মাহাথির এই কাজটি এতটাই আবেগ দিয়ে করতো যে তিনি ভুলে যেতেন যাকে ফোন দিচ্ছেন সেখানে এখন রাত না দিন। সেই মালয় লোকটি ফোন পাবার এক মাসের ভিতর সব গুছিয়ে নিজের দেশে ফিরে যান। আর এমন অসংখ্য ফোন আর মেধাবীদের ফিরে যাওয়াই আজ আধুনিক মালয়শিয়া সৃষ্টির রহস্য যা বোঝার জন্য বেগ পেতে হয় না। মাহাথিরের ছিলো ভিশন বা স্বপ্ন, আর তার বাস্তবায়নের কারিগর ছিলো মেধাবীরা।
দুর্ভাগা এই জাতি, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও মনে হচ্ছে একজন স্বপ্নদৃষ্টা অভিভাবকের অভাবে আমরা পথ হারা, তাই নিজের দেশ ছেড়ে উত্তাল সমুদ্রে ডিঙ্গি নৌকা করে সেই মাহাথিরের দেশে যেতে প্রান দেই, কিন্তু আমাদের জীবন এমন না হলেও পারতো, এক শেখ মুজিব কিন্তু ৪৪ বছর আগে সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন যা মাহাথির তার দেশে করেছিলেন বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ বড়ই অভাগা, যখনই একজন সপ্নচারী এসেছে আমরা তাকে সরিয়ে দিয়েছি। কাউকেই হাল ধরতে দেইনি।
অষ্টম বেতন স্কেল এক সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল, শুধুমাত্র এক শ্রেনীর লোক তাদের হীনমানসিকতা চরিতার্থ করতে এই পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছে যা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য অন্ধকার কিছু। এটা পরিবর্তন না করে এভাবে রেখে দিলে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসবে না, সেই সাথে স্বাধীন মানুষ তৈরি হবে না যারা জাতি্কে সংকটে পথ দেখাবে। এটা হবে ১৪ই ডিসেম্বরের মত আরো একবার বুদ্ধিজীবি হত্যা, এবং সৃষ্টির জরায়ুকে চিরতরে নষ্ট করে দেওয়া। যা কাম্য নয়, কোনভাবেই নয়।
-ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
Source: http://goo.gl/BrCH8r

Saturday, June 27, 2015

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা

Kamrul Hassan

একটা দেশে কতজন ছাত্র মাস্টার্স করছে আর তার কত অংশ পিএইচডিতে এনরোল হচ্ছে সেটাও শিক্ষার মানের একটা লিটমাস টেস্ট বা ধারণা সুচক হতে পারে। বাংলাদেশে এত এত বিশ্ববিদ্যালয় এত এত ছাত্র কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্র সত্বেও পিএইচডি ছাত্র প্রায় নেই বললেই চলে। আর পোস্ট-ডক নামে কিছু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে বলেই মনে হয় না। কেউ এটার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে বলে মনে হয় না। পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক ব্যেতিত উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণা ভাবাই যায় না। আমার বয়সের, আমার মত একজন অধ্যাপকের থাকা উচিত ছিল কমপক্ষে একজন পোস্ট-ডক এবং দুইজন পিএইচডি ছাত্র। এখন একজন ছাত্র কি পিএইচডি করবে বাবার পয়সায়? না। তারজন্য সরকারকে একটা ভালো মানের ফেলোশিপ দিতে হবে। ন্যুনতম ৩০০০০ টাকা যেন তাকে সংসার চালানোর চিন্তা করতে না হয়। বাহিরের দেশে যেমন ভারতের একজন পিএইচডি ছাত্র ফেলোশিপ পায় ৪৫০০০ টাকা। আমি যদি ভারত থেকেও এক বা দুইজন পোস্ট-ডক পেতাম তাহলে বাংলাদেশ বসেই ভালো গবেষণা করা যেত।


আমাদের দিন একজন পোস্ট-ডক আর দুইজন পিএইচডি ছাত্র তারপর দেখুন এই দেশে ভালো মানের গবেষণা হয় কিনা। পোস্ট-ডক্টরাল position দিলে ভারত থেকে অনেক ভালো মানের গবেষক পাব। তাদের লাভ যে পোস্ট-ডক্টরাল এক্সপেরিয়েন্স দেখিয়ে অন্যত্র চাকুরী পাবে আর আমাদের লাভ এখানে গবেষনার একটা এনভায়রনমেন্ট তৈরী হবে। সারা পৃথিবীতে এভাবেই গবেষনা হয়। আমরা আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডস ফলো করব না, তো আন্তর্জাতিক গবেষণা হবে কিভাবে? আমাদের আছে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় যার ৯০% বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি ছাত্র নেই। ১০% বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আছে তাও নামে মাত্র। আর পোস্ট-ডক্টরাল position? সন্দেহ হয়. যারা ওগুলো চালায় তারা এ সম্মন্ধে কখনো কিছু শুনেছি কিনা। আমাদের এখানে পিএইচডি প্রাপ্ত শিক্ষক বা গবেষকের অভাব নেই কিন্তু পোস্ট-ডক্টরাল experience আছে এরকম শিক্ষক বা গবেষকের সংখ্যা আমার ধারণা খুবই কম। এগুলোও একটা দেশের শিক্ষা ও গবেষনার একটা ধারণা সূচক হতে পারে।

কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Friday, June 26, 2015

সংস্কারের বিকল্প নেই

মো. আবদুল লতিফ মণ্ডল

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আমরা ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত প্রশাসন ব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করি। এ শাসন ব্যবস্থা ছিল মূলত ঔপনিবেশিক ধাঁচের। পাকিস্তান সরকার এ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে না, এ উপলব্ধি থেকেই শুরু হয় প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ।

কীভাবে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় সরকারে পরিণত করা যায় সে ব্যাপারে সুপারিশ প্রদানের জন্য স্বাধীনতার পর পরই গঠিত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটির সুপারিশক্রমে প্রাদেশিক সচিবালয়কে জাতীয় সচিবালয়ে রূপান্তর করা হয়। এছাড়া গঠন করা হয় প্রশাসন ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি। এ কমিটিকে স্থানীয় সরকারসহ কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের পুনর্গঠন সম্পর্কে প্রস্তাব পেশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রশাসনের সব পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ণ; নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের এখতিয়ারে ক্ষমতা প্রত্যপর্ণ; জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা; থানাকে প্রশাসনের মূল ইউনিটে পরিণত এবং মহাকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর করা। তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে গঠিত হয় পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন। সার্ভিস কাঠামোর ব্যাপারে এ কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সুপারিশ ছিল (ক) সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ২৯টি ক্যাডার সার্ভিস প্রবর্তন; এবং (খ) সরকারি নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) গঠন। কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করে সরকার ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর মূল ১৪টি ক্যাডারসহ ২৯টি সার্ভিস ক্যাডার সৃষ্টির আদেশ জারি করে। তার আগে সরকার ১৯৭৯ সালের ২৩ আগস্টের এক আদেশে এসএসপি গঠন করে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক গৃহীত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস হতে এসএসপিতে সদস্য অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ থাকলেও এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি ছিল তা হলো, জনপ্রশাসনে এলিটিজম সৃষ্টি করা। এসএসপি ১০ বছর কার্যকর ছিল। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের আমলে ১৯৮৯ সালের ১৭ জুলাইয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসএসপি বাতিল করা হয়।

১৯৮২ সালের মার্চে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর পরই জেনারেল এরশাদ প্রশাসনিক সংস্কারে দুটি কমিটি গঠন করেন। এর একটি হলো মার্শাল ’ল কমিটি এবং অন্যটি প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি। কার্যপরিধির আলোকে মার্শাল ’ল কমিটি যেসব সুপারিশ পেশ করে সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মন্ত্রণালয়/বিভাগের সংখ্যা এবং বেসামরিক কর্মচারী বিশেষ করে নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস করা; প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপগুলো কমানো; সচিবালয় ও অন্যান্য নির্বাহী সংস্থাগুলোর কাজ ঢেলে সাজানো; নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর বিধিবিধানুগ ও নিয়মিতকরণ। সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপগুলো কমানো ব্যতীত কমিটির অন্যান্য সুপারিশ সরকার গ্রহণ করে।

প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একজন প্রধান নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং প্রতিনিধি পরিষদ থাকবে। পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে সংশ্লিষ্ট স্তরের সব কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ ও কর্মচারীদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হবে; প্রশাসনিক স্তর হিসেবে মহাকুমা ও বিভাগকে বাতিল করা হবে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণের জন্য গঠিত হয় ন্যাশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্ম/ রি-অর্গানাইজেশন (নিকার)। তাদের সুপারিশে স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হয় উপজেলা প্রশাসন। ১৯৮৮ সালে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ পুনর্গঠিত হলেও নির্বাচিত চেয়ারম্যানের স্থলে সরকার কর্তৃক চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান করা হয়, যা ছিল কমিটির সুপারিশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে। সংসদে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং অন্য দুটি বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি (নবম সংসদ মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিলকৃত) প্রবর্তন করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির শাসনামলে (১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬) কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় সরকার প্রশাসন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য আর কোনো সংস্কার আনা হয়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ পাস করে। তাছাড়া এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালে প্রণীত স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ ) আইন বাতিল করে জেলা পরিষদ আইন ২০০০ পাস করে। তবে ওই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার আইন দুটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩০ জুন উপজেলা পরিষদ সংক্রান্ত সব আইন বাতিল করে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং তা তাত্ক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়। এ অধ্যাদেশের অধীনে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ ২০০৮ রহিত করে উপজেলা পরিষদ (রহিত আইন পুনঃপ্রচলন ও সংশোধন) আইন ২০০৯ পাস করে। অধ্যাদেশটির অধীনে তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় আইনগত শূন্যতা এড়াতে ২০০৯ সালের আইনটিকে ৩০ জুন ২০০৮ তারিখ থেকে কার্যকারিতা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ১৯৯৮/২০০৯ সালে প্রণীত উপজেলা পরিষদ আইনে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা এবং তার পরামর্শ গ্রহণ পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে পরিষদের ওপর সংসদ সদস্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও চেয়ারম্যানের মধ্যে দ্বন্দ্বের খবর গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশ হয়। অন্যদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠার খবর পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য সূত্রে প্রায়ই পাওয়া যায়। এসবের ফলে অনেক উপজেলায় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে জেলা পরিষদ আইন ২০০০ মোতাবেক জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য বিধি প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি বাদে অন্য ৬১টি জেলা পরিষদে দলীয় ব্যক্তিদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ফলে জেলা পরিষদ প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় প্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার খবর প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। তবে এ ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোয় নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও বিএনপির শাসনামলে ১৯৯২ সালে এসব পদে পদোন্নতিতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। অনেকের মতে, প্রশাসনকে দলীয়করণেরও এটি ছিল প্রথম সুপরিকল্পিত বড় পদক্ষেপ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার পর পরই তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য পদে চাকরি প্রদান ছিল প্রশাসনকে দলীয়করণের প্রথম পদক্ষেপ।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের এক বছর পার না হতেই প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের সময় তা কাজে লাগাতে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি সরকার বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে সাতশর বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। একসঙ্গে সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে এর আগে পদোন্নতি প্রদানের নজির ছিল না। দলীয়করণের অভিযোগ ছাড়াও পত্রপত্রিকায় এ পদোন্নতিকে ‘গণপদোন্নতি’ বলে অভিহিত করা হয়। শূন্যপদ ব্যতীত পদোন্নতি দেয়া যায় না, প্রশাসনিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত এ নিয়মটির ব্যত্যয় ঘটানো হয়।

১৯৯২ সালে বিএনপি প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই অনেকটা ‘গণপদোন্নতির’ যে নজির সৃষ্টি করে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তা যত্নসহকারে অনুসরণ করে। পরবর্তীতে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা উভয়ে শূন্যপদ ছাড়া দলীয় স্বার্থে পদোন্নতি প্রদান ও প্রশাসনে দলীয়করণের গতি আরো জোরদার করেছে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোয় প্রশাসনকে নির্দলীয় ও গণমুখী করার অঙ্গীকার করে। মেনিফেস্টোয় বলা হয়, চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি হবে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা হবে। প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়ন এবং জনসেবার মানোন্নয়নে একটি কার্যকর সিভিল সার্ভিসের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের কথা বলতে শুরু করে। দেশের শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি কার্যকর সিভিল সার্ভিসের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে একটি শক্তিশালী সিভিল সার্ভিস গঠনের ওপর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক (২০১১-১৫) পরিকল্পনায় জোর দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘জনপ্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা সংস্কারমূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আলোচনা, ওয়ার্কশপ এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে এটি চূড়ান্ত করা হবে।’ পরবর্তী তিন অর্থবছরের অর্থাত্ ২০১১-১২, ২০১২-১৩ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়ও তিনি জানান, সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চৃড়ান্ত পর্যায়ে আছে এবং সরকার এটিকে আইন হিসেবে প্রণয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনের খসড়া একাধিকবার প্রস্তুত করা হলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) সেটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বর্জিত ৫ জানুয়ারির একতরফা সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর গঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা আনতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম বা সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন সম্পর্কে বক্তব্য প্রদানে বিরত রয়েছে। গত ৫ জুন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী জনপ্রশাসনে সংস্কার আনয়ন বা সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেননি। বাজেট বক্তৃতায় সচরাচর ‘জনপ্রশাসন’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ থাকে। এবারের বাজেট বক্তৃতায় সেটিও নেই। 

সংবিধানে সংসদ আইন দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা (অনুচ্ছেদ ১৩৩) থাকলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছরে সে আইন প্রণীত হয়নি। গত চার দশকে ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দল আইনটি প্রণয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৯১-২০১৩ সময়কালে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসীন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আইনটি প্রণয়নে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ চায় না মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর জনপ্রশাসন গড়ে উঠুক। কারণ আইনটি প্রণীত হলে তারা ক্ষমতায় আসীন হলে ইচ্ছামতো জনপ্রশাসনে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম চালাতে পারবে না। তাদের উভয়ের উদ্দেশ্য হলো, দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে ব্যবহার করে ক্ষমতার ভিত শক্তিশালী করা। এটিই প্রশাসনে অদক্ষতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদির মূল কারণ।

প্রশাসনকে যুগোপযোগী করতে সংস্কারের বিকল্প নেই। স্বাধীনতার পর পরই তত্কালীন সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় এবং পরবর্তী সরকারগুলো কমবেশি সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। ক্ষমতাসীন সরকার তাদের আগের মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) প্রশাসনিক সংস্কারের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন শুধু প্রশাসনিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে না, বরং এর মাধ্যমে প্রশাসনকে বহুলাংশে গতিশীল ও গণমুখী করা সম্ভব হবে।

লেখক: সাবেক সচিব ও কলাম লেখক

Published in: http://www.bonikbarta.com/2015-06-25/news/details/5876.html

আরো পড়ুন:

ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার

ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"

প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!

শিক্ষার ঋণে আনন্দভ্রমণ!



অপমানিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

ফাহমিদুল হক
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো, অথচ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পে-কমিশন শিক্ষকদের বলল অভ্যন্তরীণ ব্যয় বাড়িয়ে স্বনির্ভর হতে। উল্টো পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে কয়েক ধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ মর্যাদা চেয়ে তাঁরা যেন আরও অসম্মানিত হলেন। এ থেকে জন্ম নিয়েছে ক্ষোভ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিগুলো শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছে। শিক্ষকেরা দাবি করছেন অষ্টম জাতীয় বেতনকাঠামো বাতিল করতে হবে, শিক্ষকদের মর্যাদা
যতটুকু দেওয়া ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিটিও তাঁরা মৃদুস্বরে জানাচ্ছেন। তবে শিক্ষক নেতাদের কার্যকলাপ, বক্তব্য ও ভাবনায় একধরনের স্ববিরোধিতা ফুটে ওঠে। একদিকে তাঁরা স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো সরকারের কাছ থেকে দাবি করেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে বিশ্বাসও করেন। অথচ দুটি প্রায় বিপরীত নীতি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ আয় কীভাবে বৃদ্ধি করতে পারে? শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কোর্স চালু করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক অবয়বের প্রান্তসীমায় দোকানপাট বানিয়ে ভাড়া দিতে পারে। সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা এই কাজগুলো করেই চলেছেন। শিক্ষার্থীদের বেতন আন্দোলনের মুখে বেশি বাড়ানো না গেলেও অন্যান্য ফির পরিমাণ বহুলাংশে বেড়েছে। নতুন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনেই পড়ে। কেবল নেতারা নন, বেশির ভাগ শিক্ষকই ‘স্বনির্ভরতা’র আদর্শে বিশ্বাসী। নতুন নতুন সান্ধ্য কোর্স সে কারণেই চালু হচ্ছে। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে। বস্তুত, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করছে ২০০৫ সাল থেকে, তাতেও এই ‘স্বনির্ভরতা’র ডাকই দেওয়া হয়েছে। তাহলে প্রায় শতভাগ শিক্ষক যে ভাবনায় বিশ্বাসী, পে-কমিশন তার এখতিয়ারভুক্ত বিষয় না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বনির্ভর হওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছে, এবং তারপরেই কেবল স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো দেওয়ার যে কথা বলেছে, তাতে শিক্ষক নেতাদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ থাকছে না। কারণ তাঁরা যাতে বিশ্বাস করেন, সে কথাটিই তাঁদের শোনানো হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় বিপরীত ভাবনার দাবি হলো পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি। এতে মনে করা হয় যে রাষ্ট্র শিক্ষার উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ হাতে নেবে। এ জন্য শিক্ষকদের অন্য পেশাজীবীদের থেকে বিশেষ মর্যাদা দেবে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আয়োজিত একাধিক সভায় হাজির ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির ১৫টি পদেই এখন সরকার-সমর্থিত নীল দলের শিক্ষকেরা নির্বাচিত রয়েছেন। ইতিপূর্বে তাঁরা পৃথক বেতনকাঠামোর ব্যাপারে বেশ আশার বাণী শুনিয়েছেন সাধারণ শিক্ষকদের। কিন্তু তাঁদের সময়েই কিনা শিক্ষকদের মর্যাদা কমে গেল? ফলে সভায় বক্তাদের কণ্ঠে বেশ অভিমানের সুর ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ওপরে আস্থা সম্পূর্ণ অটুট রেখে এসবের কারণ হিসেবে তাঁরা আমলাদের ষড়যন্ত্রকে খুঁজে পেলেন। কিন্তু বহুদিন ধরেই শিক্ষক নেতাদের যেটার অভাব, নিজেদের আত্মমর্যাদা লঘু করে ফেলার দায় তাঁরা নিলেন না। রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে, শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের, বিশেষত রাজনীতিবিদ শিক্ষকদের ভাবমূর্তি আজ কোন তলানিতে ঠেকলে আমলারা নিজেদের উচ্চপদ নতুন করে সৃষ্টি করেন আর শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন ঘটানোর সাহস পান, সেদিকটায় কেউ আলোকপাত করলেন না।
অতীতে রাজনীতিবিদেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের কাছে আসতেন পরামর্শের জন্য। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজনীতিবিদদের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়ে থাকেন উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাওয়ার লোভে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দেখি, জুনিয়র শিক্ষকেরা রাজনীতি শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি ছোট বাসা পাওয়ার জন্য। আর সিনিয়র শিক্ষকেরা রাজনীতি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থানে পদ পাওয়ার জন্য। দলীয় আদর্শ সেখানে গৌণ। এ জন্য তাঁদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রে আদর্শিক, যৌক্তিক ও শিক্ষকসুলভ না হয়ে সুবিধাসন্ধানকারী রাজনীতিবিদদের মতো দেখায়। ফলে একই দলের লোক হয়েও সরকারের কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিয়ে আসার মতো নৈতিক বল ও তেজ তাঁদের নেই। শিক্ষকদের বেতনকাঠামো হিসেবে যা রাখা হয়েছে, তা দ্বারা মানবেতর জীবনযাপনই কেবল সম্ভব। বরাবরই দেখা গেছে, কেবল শিক্ষকদের নয়, সার্বিকভাবে সরকারি বেতনকাঠামোই চাকুরেদের দুর্নীতির জন্য অনেকখানি দায়ী। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি চাকুরেদের বেতন অনেক কম। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদে ভাগ বসানোর জন্য শিক্ষকেরা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, কিংবা বাড়তি উপার্জনের জন্য এখানে-ওখানে দৌড়াদৌড়ি করছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সমস্যাসহ সব সংকটকে সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করতে চাইলে আমাদের মৌলিক জায়গায় দৃষ্টি ফেরাতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে কী দৃষ্টিতে দেখতে হবে, তার ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকার, ইউজিসি, শিক্ষক নেতারা কারোর ধারণাই খুব পরিষ্কার নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন মানবসম্পদ। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে সেই মানবসম্পদ তৈরি করবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করবে। সেই বিনিয়োগের অন্যতম স্থান হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ না বাড়িয়ে বলা হয় অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির কথা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার স্থান, আয় করার স্থান নয়। শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ, গবেষণায় বিপুল বরাদ্দ না থাকলে দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন জ্ঞানের সঞ্চার হবে কী করে? শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উপযোগী নতুন আবিষ্কার আসবে কোত্থেকে? একটি দেশ সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে না তুললে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষিত হবে? বর্তমানের জিডিপি বৃদ্ধির যে হার, তা সম্পূর্ণভাবে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি, তৈরি পোশাক ও শ্রমবাজারে সস্তা শ্রম বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীত হচ্ছে। উদ্বৃত্ত শ্রমবাজারের এই সরবরাহ অসীম নয়। যখন এই শ্রমশক্তির সরবরাহ স্থিতাবস্থায় আসবে, তখনই অনুভূত হবে শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা।
কিন্তু এই জায়গায় আমাদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নেই, ফলে নতুন জ্ঞানের ঘাটতিতে উন্নয়ন কার্যক্রম অচিরেই স্থবির হয়ে পড়বে। ল্যাবরেটরি রয়েছে, কিন্তু তাতে উন্নত সরঞ্জাম নেই, একে ঘিরে বড় গবেষণা প্রকল্প নেই। অন্যদিকে ইউজিসির কার্যক্রমে বাড়তি প্রণোদনা নেই। বরং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ও পরামর্শে প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবায়ন করছে দীর্ঘমেয়াদি এক কৌশলপত্র, যাতে মৌলিক জ্ঞানের (রসায়ন, পদার্থবিদ্যা) পরিবর্তে বাজারমুখী নানান শিক্ষা কার্যক্রমের (ব্যবসায় প্রশাসন) দিকে জোরারোপ করা হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির বুলিই পুনরায় আওড়ানো হয়েছে। বেতন কিংবা ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পথ রুদ্ধ করার আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি যথেষ্ট বেশি, কিন্তু সেখানকার জনগণের আর্থিক সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু যে দেশ উন্নয়নের ধারায় যুক্ত হতে চায়, তাকে জনগণের আর্থসামাজিক সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
শিক্ষার একটি দর্শনগত দিক থাকে, নীতিগত দিক থাকে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষাকে ঠিক কীভাবে কাজ লাগানো যাবে,
সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে নীতিনির্ধারকদের। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ক্লাস নেওয়ার স্থান নয়। আর নামমাত্র গবেষণা দ্বারা উন্নয়নের উপযোগী নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হবে না। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ। আমরা সম্ভবত উল্টা পথে হাঁটছি। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ না বাড়িয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বলছি নিজের খরচ নিজে বহন করতে। এতে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় উন্নয়ন–ভাবনায় শিক্ষাকে সঙ্গে রেখে সরকার সামনের দিকে হাঁটছে না। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশই শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হয়নি।
ফাহমিদুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য।
Source: http://goo.gl/enTHDb

Wednesday, June 24, 2015

শিক্ষক সমাজ কি উন্নয়নের পরিমাপ সূচকের বাইরে?

ড. মো. শামছুল আলম

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারলাম, অষ্টম জাতীয় পে-কমিশনের বেতন কাঠামোতে সরকার কিছুটা পরিবর্তন আনছে। এর ফলে আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অসম্মানজনক যে বেতন প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা দূর হবে। আমরা সরকারের এ সঠিক উপলব্ধিকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে অষ্টম বেতন কমিশন এবং পরবর্তীকালে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু আমলা কর্তৃক যাচাই-বাছাই পূর্বক প্রণীত নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করছি। এটাও উল্লেখ করতে হয়, বেতন কাঠামোতে সরকার এখন যে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, সেটা আপনা আপনি আসছে না। সে জন্য শিক্ষক সমাজকে রোদ-বৃষ্টি সহ্য করতে হয়েছে। ন্যায্য অধিকার ও সম্মান রক্ষার দাবিতে শিক্ষক সমাজকে রাজপথে নামতে হয়েছে।
আমরা এ কথা অস্বীকার করি না, সরকার পরিচালিত হয় আমলাদের ওপর ভর করে। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, সরকারকে তার সিদ্ধান্ত বা নীতি আমলাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হয়। সে জন্য সরকার আমলাদের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষক সমাজও তাই মনে করে। আমরা আরও বলতে চাই, শিক্ষক সমাজ আমলাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না এবং আমলারা শিক্ষক সমাজের প্রতিদ্বন্দ্বীও নন। এখানে উভয়ের পেশাগত কাজের ধরন ভিন্ন। বহুকাল আগে থেকেই উচ্চারিত হয়ে আসছে যে, শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক সমাজ এই মানুষ গড়ার কারিগরি করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবমান একটি রাষ্ট্র। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষক সমাজ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। উন্নত দেশগুলোর প্রসঙ্গ এখানে অযৌক্তিক মনে হলে আমরা অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের কাছাকাছি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ভারত-পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মর্যাদা বাংলাদেশের তুলনায় বেশ উপরে। আবার এটাও ঠিক, সম্মান ও মর্যাদা স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তন হয়। এটা অনেকটা আপেক্ষিক বিষয়ও বটে। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতন স্কেল একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সমান এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের স্কেল পেয়ে থাকেন। সরকারি চাকরি বিধিতে তারা চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর মর্যাদার অধিকারী। এ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল শীর্ষ পদের আমলাদের নিচে রাখলে শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় কোথায়? এ মতের যারা সমর্থক, তাদের কাছে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে আমলাদের তুলনায় শিক্ষকদের স্কেলের অবনমন নিশ্চয় খারাপ বা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক বিষয় বিবেচিত হয়েছে।

সমাজে শিক্ষকদের অবদানের কথা কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন? শিক্ষকরা প্রতিদানের আশায় কিছুই করেন না; কিন্তু তাদের ন্যূনতম প্রাপ্যটা নিশ্চয়ই প্রতিদান নয়। একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা এ কারণে গর্ববোধ করি যে, যারা দেশ পরিচালনা করছেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। এ কথা অনেকেই বলে থাকেন যে, শিক্ষকরা ছাত্রের পিতৃতুল্য। এখন পিতৃতুল্যের সঙ্গে মাতৃতুল্য যুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ পুরুষের পাশাপাশি শিক্ষকতা পেশায় এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী যুক্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে একজন নারী অধিষ্ঠিত। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই গর্বের বিষয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মাতৃতান্ত্রিক পরিবার চালু হয়েছে। সেই গর্বে আমরা গর্বিত।

যা হোক, পিতা-মাতা বা বাবা-মা সন্তানকে বড় করে তোলেন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, সন্তান ভালো মানুষ হলে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে সে গর্ববোধ করবে, এটিই বাবা-মার প্রত্যাশা। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও তাই। একজন শিক্ষক উচ্চশিক্ষায় কিংবা কোনো সেমিনার বা অন্য কোনো কারণে বিদেশে গেলে যখন কোনো ব্যক্তি এসে পায়ে সালাম করে ছাত্র বলে পরিচয় দেন, সেই শিক্ষকের পক্ষে এর চেয়ে পরম পাওয়ার আর কিছু নেই। এটা আমাদের কোনো কোনো আমলার কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানের উত্তরসূরি হিসেবে তাদের দম্ভ ও অহমিকায় আঘাত লাগতে পারে। আর এ কারণে সে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পছন্দ করে। অনেকেই মনে করেন, হয়তো এটা ভেবেই আমরা যারা শিক্ষকতা পেশায় আছি, তাদের প্রতি মধুর প্রতিশোধ হিসেবে কোনো কোনো আমলা আমাদের সম্মান ও সম্মানীকে খাটো করার লক্ষ্য স্থির করেছেন। অন্যথায় শিক্ষকদের কপালে এমন লাঞ্ছনা জুটত না। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও দাবি। স্বপ্নের এই পালে হাওয়া লেগেছিল অষ্টম জাতীয় পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন গঠনের কথা শুনে। কিন্তু এ রিপোর্ট যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বপ্নভঙ্গের নতুন উপাখ্যান আর বঞ্চনার শেষ ধাপ। বেতন কমিশনের রিপোর্টে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো না দেয়ার কথা বলা হয়েছে, যা পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার স্পষ্ট আভাস। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কি কোনো সম্পদ আছে? ভৌত অবকাঠামো কি সম্পদ? তাহলে কি এগুলো বেসরকারি পর্যায়ে কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো কর্পোরেট অফিসের জন্য ভাড়া দিয়ে আয় বাড়ানো হবে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্টেক হোল্ডার শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হবে? বাড়ানো হলেই বা কী পরিমাণে? শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হলে ছাত্র আন্দোলন শুরু হবে। তখন এর দায় কে বহন করবে? যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আয় বাড়াতে বলেন, উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদেরই দেয়া উচিত। প্রেসক্রিপশন দেয়াই শেষ নয়, পরবর্তী অবস্থার দায়ও নিতে হয়।

অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দূরের কথা, আমাদের বর্তমান অবস্থাটাই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়নি। নিজে উপরে উঠতে গিয়ে আমাদের নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন দেখি আমাদের আগের গ্রেডটাই ধরে রাখার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব যে বেতন পান তা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান; কিন্তু যুগ্ম সচিব শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধার পাশাপাশি সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৪৫ হাজার টাকা পান। গাড়ির পেছনের মাসিক খরচটা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান। সপ্তম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সচিবদের বেতন স্কেল সমান ছিল; কিন্তু বর্তমান কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড আর টাইম স্কেল বাদ দেয়া এবং সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিব গ্রেড সৃষ্টি করে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও কখনও কোনো বেতন কমিশন বেতন স্কেলের গ্রেডকে এভাবে অবনমন করেছে বলে আমাদের জানা নেই।

বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পাশাপাশি ছাত্রদের বেতন, পরীক্ষা ও ভর্তি ফি বাড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সচিবদের বা ধনীদের ছেলেরা খুব কমই পড়ে, সবচেয়ে বেশি পড়ে মধ্যবিত্তের সন্তানরা। নিু আয়, ক্ষেত্র বিশেষে দিনমজুর পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও আজকাল উঠে আসছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রায় বিনা টাকায় পড়ার সুযোগ রয়েছে বলেই এ সব পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এ পর্যায়ে লেখাপড়ার সুযোগ ভোগ করছে।

একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা শিক্ষাকে জাতীয়করণের কথাই বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই পুরো শিক্ষক সমাজ নিয়ে। অষ্টম পে-কমিশনের রিপোর্টে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসম্মানিত করা হয়নি; দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদেরও অসম্মানিত করা হয়েছে। মর্যাদার দিক থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। পে-কমিশনে তাদের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না থাকায় দেশের এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষক এ নিয়ে দুর্ভাবনায় রয়েছেন। আমরা লাখ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনার দাবি জানাই।

সব শেষে বলতে চাই, বর্তমান সরকার বেশি করে দেশের উন্নয়নের কথা প্রচার করতে চাইছে। এ উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষক সমাজেরও সংযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের দাবি ও ন্যায্যতা উপেক্ষিত হলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাই প্রশ্ন জাগে, শিক্ষক সমাজ কি উন্নয়নের পরিমাপ সূচকের বাইরে? শিক্ষকরা সরকারের কাছে ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করে।

ড. মো. শামছুল আলম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Sunday, June 21, 2015

বেতন কাঠামো: শিক্ষকদের দাবি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর ‘ডিও লেটার’

Saturday, June 20, 2015

পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার অবমূল্যায়ন

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ‘জ্ঞানই শক্তি’এ নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত। উন্নত দেশগুলোতে জ্ঞানের ধারক-বাহক এবং পালকদের সর্বোচ্চ মর্যদা দেওয়া হয়। সেখানে মেধা-মনন, জ্ঞান-গরিমা উৎকৃষ্ট সম্পদ বলে বিবেচিত। আমাদের দেশগুলোতে জ্ঞান ক্ষমতার উৎস না হলেও জ্ঞান মর্যাদায় অভিসিক্ত। আমাদের শাসকদের পক্ষ থেকে কখনো কখনো তার প্রকাশ ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে একবার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনেক বৈপরিত্যের মাঝে এ কথা অনেকের ভালো লেগেছিল। বিশেষ করে যারা নিরন্তর জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত তাদের উৎসাহিত করেছিল। কথা ও কাজের মাঝে যে বেজায় ফাঁক তা এবার বেতন কাঠামো ঘোষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি সরকার নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করেছেন। ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত বেতন কমিশন প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে অবিশ্বাস্য রকম অবমূল্যায়ন হয়েছে। ইতিমধ্যে সচিব কমিটি কাঠামোটি পর্যালোচনা করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বেতন কাঠামো অনুমোদন করেছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। প্রকাশিত নতুন বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতনকে চতুর্থ গ্রেডে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে রয়েছেন সামরিক বাহিনীর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, মেজর জেনারেল ইত্যাদি সামরিক কর্মকর্তা। এরই সাথে সমান্তরালভবে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সংস্থাপন সচিব, সিনিয়র সচিব এবং অন্য সচিবরা। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে এখানে ক্ষমতা বনাম অক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে।



সক্ষমতার মানদণ্ড যখন ‘সম্মতি নয় শক্তি’তখন অক্ষম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো কোনো কাজে আসবে না! বিভিন্ন পর্যায়ের বিশ্লেষকরা খোলামেলাই বলেছেন: বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকার যেহেতু জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়নি, তাই সামরিক বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবিকে খুশি করে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।

আজকের অবহেলিত শিক্ষকরা একসময় আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তি ছিল। মূলত বাংলাদেশের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের সমান্তরাল ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁদের ভুমিকা ছিল অনন্য। অন্যদিকে, এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীদের সেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আর নেই। অন্যদিকে দলীয় রাজনীতির বাহক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে শতনাগরিক বনাম সহস্রনাগরিকের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকেছেন তাঁরা। সবচেয়ে দুঃখজনক একটি বিতর্কিত নির্বাচনকে দলীয় শিক্ষকরা সুষ্ঠু সার্টিফিকেট দিতেও দ্বিধা করেননি তাঁরা। এমনকি বেতন কাঠামো ঘোষিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কঠোর পদক্ষেপ তো দূরের কথা কঠিন শব্দাবলি উচ্চারণেও অপারগ থেকেছে। তার কারণ সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা রয়েছে। একটি রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্তকে তাঁরা আমলাতন্ত্রের ঘাড়ে চাপিয়েছেন।

তবে এটা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমলাতন্ত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদাযের মধ্যে একটি অদৃশ্য ঠান্ডাযুদ্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করেন,তারাই শ্রেষ্ঠ। আর আমলারা মনে করেন তারাই শ্রেষ্ঠ। দুই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ভিত্তিহীন নয়। পাকিস্তান আমলের সিএসপি বা বাংলাদেশ আমলের বিসিএস এর অর্ন্তভুক্ত যারা হচ্ছেন তাঁরা সবাই নিজ নিজ বিভাগে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। বিভাগের প্রথম ছেলেটি হয়তো শিক্ষক হয়েছে, দ্বিতীয়টি আমলা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও পেশাগত প্রতিযোগিতা অদৃশ্য বিভেদ সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ বণ্টনের বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী সিভিল সার্ভিসের কাছে কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখোমুখি হতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বাংশে সরকারি অনুদান-নির্ভর হওয়ায় এই দায়বদ্ধতা শিক্ষকদের মর্যাদা হানি ঘটায়।

বিদেশে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমলারা প্রায়ই সেই উদাহরণ টেনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বউপার্জনের উপদেশ দেন। কিন্তু বিদেশ আর এ দেশ যে এক নয় তারা তা হয়তো এড়িয়ে যান। নীতিগতভাবেই দুটো ভিন্ন জিনিস। বিদেশে প্রথমত জ্ঞান এবং অবশেষে শিক্ষা পণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর বাংলাদেশে সরকার কাঙ্ক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টির জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগ যত বেশি হবে ততই জাতীয় উন্নয়ন তরান্বিত হবে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকে বিদেশের মতো পণ্য হিসেবে গণ্য করায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। একই দেশে একজন শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ বেতন পাচ্ছেন অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনমান অনেক নিম্ন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অদ্ভুত জনসংস্কৃতি অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবিশ্বাস্য রকম কম বেতন দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, একই পিতা-মাতার যে সন্তানটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ছে তার উচ্চহারে বেতন দিতে দ্বিধা নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বাড়ালেই দোষ। অভিভাবক টাকা দেয় না। আর ছাত্র করে আন্দোলন। সরকার বেতন বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েই খালাস। আদায় করার কার্যকর পদক্ষেপ এবং কৌশল দুটোই সেখানে অনুপস্থিত।



বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠমোর দাবি একটি মৌলিক এবং যৌক্তিক দাবি। ১৯৮৬ সালে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন দীর্ঘ আন্দোলন করেও সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী পৃথক বেতন কাঠামোর আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেয়নি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তো বটেই এমনকি পার্শ্ববর্তী সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পৃথক পে-স্কেল রয়েছে। শ্রীলংকা যে শিক্ষায় অগ্রসর তার কারণ সেখানে শিক্ষকদের উচ্চহারে বেতন প্রদান। এমনকি পাকিস্তানের মতো পরোক্ষ সামরিক কর্তৃত্বের দেশেও উচ্চহারে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন অনেক উচু হারের। সুতরাং বাংলাদেশে সরকারের উচিত অবিলম্বে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো ঘোষণা করা। শিক্ষকদের উচিত কাঙ্ক্ষিত বেতন কাঠামোর জন্য অনতিবিলম্বে আন্দোলনের সূচনা করা। কেবল আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষকরা তাঁদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারেন। যদি জাতীয় বেতন কাঠামো বিন্নাসে সকল ক্যাডারের ঐকমত্য অর্জন অসম্ভব হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য উচ্চহারে শিক্ষাভাতা, গবেষণা ভাতা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ভাতা এবং বই ক্রয় ভাতা প্রবর্তন করা যায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আমলাদের অনুরূপ যানবাহন সুবিধা প্রদান করা যায়। উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট এরশাদ কাঠামোগতভাবে সেনাবাহিনীর বেতন না বাড়াতে পেরে বিভিন্ন ভাতার নামে তাদের বেতন অনেকগুণ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন।

সত্যি সত্যিই যদি দেশকে মধ্যম আয়ের অথবা উন্নত আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা থাকে তাহলে সকল পর্যায়ে উত্তম মেধাকে ব্যবহারের জন্য উত্তম বেতন কাঠামো দিতে হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সকল পর্যায়ের সকল শিক্ষককে পদ ও মর্যদায় সকল ক্যাডারের উর্ধে স্থান দিতে হবে। কেবল তখনই কাম্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব হবে।


লেখক : অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Published in: http://www.ntvbd.com/opinion/12293/

Friday, June 19, 2015

বেতন কাঠামোতে সম্মানী নয়, সম্মান চাই

রাহিদুল ইসলাম রাহি

অষ্টম জাতীয় পে কমিশনের বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অপমানজনক প্রস্তাবনায় বিস্মিত শিক্ষক সমাজ। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই শিক্ষকতা পেশাকে সমাজে ও ব্যক্তিজীবনে সর্বোচ শ্রদ্ধা ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। এখনও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান ও সম্মানী দুটিই দেওয়া হয়। 
সমাজে শিক্ষকদের অবদানের কথা বলাই বাহুল্য। যদিও শিক্ষকরা প্রতিদানের আশায় কিছুই করেন না; কিন্তু তাদের নূ্যনতম প্রাপ্যতা চাওয়াটা নিশ্চয়ই প্রতিদান নয়। আমরা গর্ববোধ করি, যারা দেশ পরিচালনা করছেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদেরই ছাত্র। বাবা-মা যেমন সন্তানদের বড় করেন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, তাদের সন্তানরা ভালো মানুষ হবে, ভালো থাকবে_ এটাই তাদের প্রত্যাশা, পরম পাওয়া। আমরা শিক্ষকরাও ছাত্রদের পড়াই তাদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়, ছাত্ররা মানুষের মতো মানুষ হবে, ভালো কিছু করবে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অবশ্য আমাদের দেশের অনেক আমলা ব্রিটিশ সিভিলিয়ানের উত্তরসূরি হিসেবে দাম্ভিকতা, অহমিকা আর ক্ষমতার দাপট দেখাতে পছন্দ করেন। তাই হয়তো আমাদের শিষ্যরা মধুর প্রতিশোধ হিসেবে বেছে নিলেন আমাদের সম্মান ও সম্মানীকে! স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া লেগেছিল অষ্টম জাতীয় পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন গঠনের কথা শোনে। কিন্তু এ রিপোর্ট যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বপ্নভঙ্গের নতুন উপাখ্যান আর বঞ্চনার শেষ ধাপ। বেতন কমিশনের রিপোর্টে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার আরেক রূপ। রিপোর্টটি পড়ে মনে হয়েছে, যারা বলেন_ 'পড়াশোনা করে কী হবে, সার্টিফিকেট কিনব টাকা দিয়ে, চাকরি নেব টাকা দিয়ে, টাকাই ইনকাম করব।' যেন তাদের কথাই ঠিক!

কথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোার স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিল্পকারখানা স্থাপন করে ছাত্র-শিক্ষকরা সেখানে কাজ করে আয় করতে হবে অথবা ছাত্রদের কাছ থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো টাকা নিতে হবে! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো টাকা নেয়, তবে দেশের গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি উচ্চ হারে টাকা দিয়ে পড়তে হতো, তাহলে আমি লেখাপড়া করতেই পারতাম না। শুধু আমি নয় এই দলে হয়তো দেশের অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিরাও পড়তেন। 
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্বতন্ত্র বেতন স্কেল তো দুঃস্বপ্ন। এখন দেখি আগের গ্রেডটাই ধরে রাখার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব যে বেতন পান তা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান; কিন্তু যুগ্ম সচিব শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধার পাশাপাশি সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৪৫ হাজার টাকা পান। গাড়ির পেছনের মাসিক খরচটা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান, যা পণ্ডিত মশাইয়ের তিন পা-ওয়ালা কুকুরের অঙ্কের মতোই। সপ্তম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সচিবদের বেতন স্কেল সমান ছিল; কিন্তু বর্তমান কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড আর টাইম স্কেল বাদ দেওয়া এবং সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিব গ্রেড সৃষ্টি করে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা এত সম্মানী চাই না, আমাদের আগের সম্মানটুকুই ফেরত চাই। পৃথিবীর কোথায়ও, কোনো সময়ে, কখনও কোনো বেতন কমিশন বেতন স্কেলের গ্রেডকে এভাবে অবনমন করেছে কি?
 
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই_ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা আগের মতো আর নেই। তাদের অনেকে আজ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, নৈতিক স্খলন, লবিং-গ্রুপিং, সান্ধ্যকালীন কোর্স, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, কনসালট্যান্সিসহ নানাবিধ কাজে ব্যস্ত। নিয়মিত ক্লাস, ল্যাব ও গবেষণার চেয়ে বাইরের কাজেই বেশি উৎসাহী ও মনোযোগী। তবে এর সংখ্যা শতকরা হিসাবে খুব বেশি নয়। যদিও তা শিক্ষক সমাজের সম্মানহানির জন্য যথেষ্ট। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় না আসা বা আসতে না দেওয়া, গবেষণা সুবিধার অপর্যাপ্ততা, পেশাগত উৎকর্ষতা বাড়ানোর সুযোগ-সুবিধার অভাব সর্বোপরি তুলনামূলক নিম্ন বেতন কাঠামোসহ নানাবিধ বিষয় পেশা হিসেবে শিক্ষকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যে সমস্যাগুলো শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করছে সেগুলো সমাধানে যথার্থ পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো শিক্ষকদের বেতন গ্রেড অবনমন করা জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যতারই পরিচায়ক। 
দেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো সম্পর্কে অবগত এবং যথার্থ পদক্ষেপও নেবেন। তার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পর শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন একজন শিক্ষককে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শও নিতেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে উপস্থিত থাকতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' ঘোষণা দিতেন। প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয় আমাদের বিষয়টি দেখবেন। যেখানে তিনিই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদাসহ শিক্ষকদের বিভিন্ন সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের দাবি মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল। যে দাবির কথা সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন। আমরা চাই, সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা রাখবে এবং খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো পরিবর্তন করে আমাদের আস্থার প্রতিদান দেবে।

সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল, পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

published in: http://www.samakal.net/2015/06/20/144292

Wednesday, June 17, 2015

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক


সিনথিয়া পারভীন কাকলী

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা সচিব সমমর্যাদার। ৭ম জাতীয় বেতন কাঠামোতেও তারা ১ ও ২ গ্রেডে বেতন পেতেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একসময়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের তাদের নিজেদের থেকে দুই ধাপ নিম্নমর্যাদা দিয়ে ৩ ও ৪ গ্রেডভুক্ত করতে চান। প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে এভাবেই সুপারিশ করেছেন সচিব কমিটির সদস্যরা যা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেই জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে। এটা ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চরম অবমাননাকর হবে

মানুষ গড়েন যিনি, শিক্ষক তিনি। একটি শিশুকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের রয়েছে অগ্রণী ভুমিকা, সীমাহীন ত্যাগ। প্রাথমিক অবস্থায় শিশু থাকে কাঁদা-মাটির ন্যায় আকৃতিহীন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষকরা সেটিকে ধীরে ধীরে একটা আকৃতি দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আকৃতিটাকে পোড়া দেয়া ও রং করার কাজে নিয়োজিত শিল্পী। এত কষ্টে তৈরি সমগ্র আকৃতিটির শিল্প মর্যাদার সার্থকতা নির্ভর করে এই শিল্পীদের তুলির অনুপম কারুকার্যের ওপর। আগুয়ান সভ্যতায় তার অবস্থান কোথায় থাকবে সেটা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ঠিক হয়ে যায়। সামান্য ভুল হলে চলে যাবে বাতিলের খাতায়। শিল্পী বেখেয়াল হলেই শিল্পটির অর্থ হয়ে যাবে ভিন্ন। তাই এই শিল্পীদের মনোযোগ ও আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎ। তারাও যে বৈষম্যের শিকারে পরিণত হবেন, আর সেটা ঠেকাতে মানববন্ধন ও কর্মবিরতির মত কর্মসূচি পালন করতে হবে ভাবিনি। 

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের আন্দোলনের কথা অনেকবার শুনেছি। তাদের গায়ে “পিপার স্প্রে” গরম পানি ঢালা ও লাঠিচার্জের দৃশ্যও দেখেছি। এই প্রথম দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাঁচার তাগিদে, সম্মান বাঁচাতে ভিন্ন আঙ্গিকে মাঠে নেমেছেন। ছোট বেলায় স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছে শুনতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। আর তাদের লাইফ “So Luxirious” । কথাটি জীবনে এতবার শুনেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি আমার এক ধরনের হিংসা জন্মায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এ হিংসা থেকে বাদ পড়েনি। সে হিংসা আজ আর হিংসা নেই। চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে পরিনত হয়েছে ক্রোধে। তবে এ ক্রোধ শিক্ষকদের প্রতি নয়, যারা উঁচু স্থানে থেকে সমপদমর্যাদার মানুষগুলোকে পদদলিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজ সব সংকোচ দূর করে, দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেন জানাচ্ছেন সমাজে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার মানুষ আরো আছে। 

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা সচিব সমমর্যাদার। ৭ম জাতীয় বেতন কাঠামোতেও তারা ১ ও ২ গ্রেডে বেতন পেতেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একসময়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের তাদের নিজেদের থেকে দুই ধাপ নিম্নমর্যাদা দিয়ে ৩ ও ৪ গ্রেডভুক্ত করতে চান। প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে এভাবেই সুপারিশ করেছেন সচিব কমিটির সদস্যরা। যা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেই জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে। যেটা ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চরম অবমাননাকর হবে। ১৯৭৩ সালের বিশেষ এ্যাক্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতির বিবেক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়, পাশাপাশি তাদের বিশেষ কিছু অধিকারও দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সচিবরা নিচের দিকের দু’একটি গ্রেড ছাড়া অন্যান্য স্তরের বেতন ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির ব্যাপারে অমত হলেও নিজেদের বেতন ঠিকই ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছেন। যা অবশ্যই নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠতম শিক্ষকরা সচিব পদমর্যাদার অধিকারী হলেও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে উভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। সচিবদের জন্য আছে গাড়ি-বাড়িসহ আরো কত কি? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাড়ি-বাড়ি তো দূরের কথা বসার জন্য একটি নিজস্ব অফিস কক্ষ পর্যন্ত নেই। একটা কক্ষের মধ্যে ঠিক করা হয় ৩/৪ জন শিক্ষকের বসার জায়গা। ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে তাদের বঞ্চিত করে দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এটা কেন করা হয়েছে আমাদের সবার প্রশ্ন। একই সাথে রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে দাবি যেন বিষয়টির সমতা বিধান করা হয়। প্রতিবছর এই শিক্ষকদের হাত দিয়ে অসংখ্য নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটসহ হাজার হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তৈরি হয়। তারাই একসময় হন বড় আমলা। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে কেমন করে পিতৃতুল্য শিক্ষকদের ভুলে যান বুঝে আসে না। 

৮ জুন সারাদেশের ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো বাতিল করে পুনঃনির্ধারণ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে নিজ নিজ কর্মস্থলে কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। ধর্মঘট থেকে তারা বলেছেন চলতি মাসের মধ্যে এ বিষয়ে ঘোষণা না এলে কঠোর কর্মসূচি দেবেন। তাদের এই আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক হিসেবেই লেখা থাকবে। বিশ্বের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যারা সমাজের বৈষম্য দূর করতে ব্যস্ত, তাদেরকেই আজ নিজেদের বৈষম্যের সে াতে না ভাসানোর জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। এটা কারো কাম্য নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটা দিন গুরুত্তপূর্ণ। প্রতিনিয়ত এখানে ছন্দের তালে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এজন্য ক্লাস ও পরীক্ষা দুটিই তাদের কাছে অধিক গুরুত্ব বহন করে। শিক্ষকদের কঠোর কর্মসূচির হুমকিতে শিক্ষার্থীরা আতংকিত না হয়ে পারে না। ক্লাস বা পরীক্ষা বন্ধ করে শিক্ষকদের যেন আর মানববন্ধন-অবস্থান ধর্মঘট বা অন্য কোনো কর্মসূচি পালন করতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া তাদের দাবি তো অযৌক্তিক নয়। বৈষম্য দূর করে তাদের সুনিশ্চিত জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্ক্ষিকরা আর বাড়তি উপার্জনের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হবেন না। জাতিকে উন্নত প্রজন্ম উপহার দিতেও নিশ্চিন্ত বোধ করবেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Published in: http://www.bangladeshshomoy.com/news.php?id=12387

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন আন্দোলন করছেন?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার


৮ম পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা প্রদানের পর থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উপযুক্ত বেতন ও যথাযথ মর্যাদা প্রদানের দাবিতে আন্দোলন করছেন। সচিব কমিটির সুপারিশে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এ আন্দোলনে নামতে হয়েছে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের সচিব পদমর্যাদায় অর্থাৎ গ্রেড-১ বা ৪০ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের এক-চতুর্থাংশ অধ্যাপক এই বেতন স্কেল পেয়ে থাকেন।
কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সেই সুযোগ আর থাকছে না। ফলে বর্তমানে বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সচিব পদমর্যাদা বা গ্রেড-১ বেতন পেলেও প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতনের ধাপ হবে যুগ্ম সচিব সমমর্যাদার গ্রেড-৩ স্কেল। তাই প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা দুই-ই দুই ধাপ কমে যাবে বলেই তারা আন্দোলন করছেন।
সাদা চোখে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে গ্রেডের হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন দুই ধাপ নিচে নামবে এ কথা সত্য। তবে পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে দুই ধাপ নয়, তিন ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ সপ্তম জাতীয় পে-স্কেলে সিনিয়র সচিব বলে আলাদা কোনো পদ ও বেতন স্কেল ছিল না। তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরেই ছিল সচিবদের বেতন (গ্রেড-১)। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা এই সচিবের সমমানের পে-স্কেল অর্থাৎ গ্রেড-১ স্কেলে বেতন পাওয়ায় তাদের বেতন ও মর্যাদা উভয়ই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত পে-স্কেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে সিনিয়র সচিব পদ এবং তাদের বেতন সচিবদের উপরে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদায় আরও একধাপ অবনমন ঘটবে। অর্থাৎ বর্তমান বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরেই বেতন পান। কিন্তু প্রস্তাবিত পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব অর্থাৎ তিন ধাপ পরের স্কেলে বেতন পাবেন। যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদারও অবনমন হবে। তবে এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, প্রচলিত বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত বেতন নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত বেতন কাঠামো যথেষ্ট না হলেও এই বেতন কাঠামোয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু ৮ম পে-স্কেলে সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এখন আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। প্রচলিত বেতন কাঠামো অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে হলেও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রাপ্তির মাধ্যমে সচিব পদমর্যাদায় বেতন পেতেন। কিন্তু ৮ম পে-কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী হলে সেই সুযোগ আর থাকবে না। ফলে তাদের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড-৩ বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
দুই. ২০০৯ সালের বেতন কাঠামোও যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যথেষ্ট ছিল তা নয়, বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন অনেক কম। কারণ বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪০৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন ৮৩৬৯ ডলার। যুক্তরাজ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী নয়। তাই ভারতের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যে বেতন পান এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার কাছাকাছি বেতন দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশের শিক্ষকসমাজের। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক প্রতি মাসে ৬০ হাজার রুপি; আর একজন অধ্যাপক ১ লাখ ৫ পঞ্চাশ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেলেও এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। (টাকার অঙ্কে বেতন বলতে লজ্জা লাগছে তাই ডলারে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছি!) আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন একশবার গালমন্দ করি, সেই পাকিস্তানও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে ২ লাখ ৩ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান। বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখিস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। ওই সব দেশসমূহে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বেতন পান যথাক্রমে - ১০৩৭, ৮৬৪, ২৭৫৮ এবং ১৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে- ২৩০৪, ১৫৮০, ৬২২৯ এবং ৪৫৫০ ডলার।
তিন. ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতাদের 'অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার' আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বনেতাদের মতো আমরাও প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বরং এবার বাজেটে শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতেই বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষা আইনের বাস্তবায়ন দাবি করছে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়িত না হচ্ছে অর্থাৎ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর ঘোষণা বাস্তবায়িত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোষিত ৮ম পে-স্কেলের যৌক্তিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও মর্যাদা প্রদানের দাবি জানাচ্ছে।
পরিশেষে, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে সামরিক খাতের ব্যয় আরও বৃদ্ধি করলেও আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই; কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও উপযুক্ত বরাদ্দ প্রদান ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের ঘোষণার বাস্তবায়ন হতে পারে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীত করে যথাক্রমে- বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড, সিনিয়র অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড এবং অধ্যাপকদের সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড প্রদানের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান হতে পারে। আর এ ধারাক্রম অনুসরণ করে প্রভাষক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত নতুন বেতন কাঠামো ও পদমর্যাদা প্রদানের যে দাবি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন সমিতির পক্ষ থেকে করা হয়েছে সেই দাবি বাস্তবায়নেরও জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
salah.sakender@gmail.com

Source: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/06/17/87802

Tuesday, June 16, 2015

উচ্চশিক্ষার নিম্ন যাত্রা!

সোহরাব হাসান


উচ্চশিক্ষা নিয়ে তিনটি নামকরা সংস্থার তিনটি প্রতিবেদন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) শিক্ষার মান, গবেষণাসহ বিভিন্ন মানদণ্ডে ২০১৫ সালে এশিয়ার যে ১০০টি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, তার কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই। এ তালিকায় জাপান ও চীনের প্রাধান্য রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের নয়টি বিশ্ব
বিদ্যালয়ও জায়গা করে নিতে পেরেছে।
সাংহাইভিত্তিক একাডেমিক র্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি (এআরডব্লিউইউ) ২০১৩ সালে বিশ্বের ৫০০টি মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দিয়েছে, তাতেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পায়নি। এটি এশিয়ার টিএইচই নামে পরিচিত। একই সময়ে কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি নামে আরেকটি সংস্থা ৩০০ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মানক্রম করেছে, তাতে বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পেয়েছে। অথচ এই তালিকায় ভারতের ১১টি ও পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর শীর্ষ ১০০-এর মধ্যে চীনেরই আছে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা পাকিস্তানেরও নিচে নেমে গেলাম!
একটি দেশ কখন বড় হয়? যখন দেশটি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যায়। একটি দেশ কখন শিক্ষায় এগিয়ে যায়? যখন সেই শিক্ষা যুগের চাহিদা মেটায়, অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করে এবং মানবিকবোধের বিকাশ ঘটায়। সেই শিক্ষা নতুন নতুন আবিষ্কার করে, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটায় এবং তৈরি করে একটি সুদক্ষ ও সংস্কৃতিমনস্ক জনগোষ্ঠী। এর কোনো বিচারেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উত্তীর্ণ হয় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কেরানি বানানো কিংবা পাকিস্তান আমলে বশংবদ আমলা তৈরির যে শিক্ষা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে তারই অন্ধ ও অক্ষম অনুকরণ চলছে। আমরা একের পর এক শিক্ষানীতি করেছি, কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের জন্য যে নিষ্ঠা ও অনুশীলন দরকার, সেটি করতে আমরা প্রস্তুত নই। অন্যান্য বিষয়ের মতো শিক্ষা-সমস্যারও শর্টকাট সমাধান খুঁজছি।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষাকে বলা হয় ভবিষ্যতের বিনিয়োগ, যার প্রতি আমরা অমার্জনীয় অবহেলা ও উদাসীনতা দেখিয়ে এসেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রম, বিষয় যে দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, তিনটি সংস্থার জরিপই তার প্রমাণ।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাকিস্তান আমলে হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করলেও এখন করতে পারছে না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের একাংশ পাঠ শেষ হওয়ার আগেই বিদেশে পাড়ি জমায়, আরেক অংশ পাঠ শেষ করে। আবার কেউ বিদেশ থেকে ফিরে এলেও দলীয় ও গোষ্ঠী রাজনীতির কারণে থাকতে পারেন না। কেন এমনটি হলো? একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু এই দুটো প্রতিষ্ঠানের বর্তমান হাল কী? সেখানে গবেষণায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে? একই কথা প্রযোজ্য চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ প্রথম প্রজন্মের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, শিক্ষক-প্রশাসনসহ ক্যাম্পাসের গাছপালাকে দিয়েও তাদের বন্দনা গাওয়ানো হয়। তাহলে মেধাবীরা কেন থাকবেন?
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানচর্চার জায়গা। এখানে যুক্তি, তর্ক ও গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে স্বপ্ন দেখাবে, পথের দিশা দেবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয় রাজনীতির চর্চায় যতটা সক্রিয়, জ্ঞানচর্চায় ততটা উদাসীন। এখানে ছাত্ররাজনীতির নামে হল দখল, ক্যাম্পাস দখলের মহড়া চলে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্ররাজনীতির কারণে কলুষিত ছিল। এখন শিক্ষকদের মধ্যেও সেই রাজনীতি ঢুকে গেছে। আগের আমলে ১০০ অমেধাবীকে জায়গা দিলে পরের আমলে ২০০ অমেধাবীকে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢোকানো হয়। এখানে গবেষণার জন্য কোনো তহবিল থাকে না; অথচ বিপুল অর্থ ব্যয় করে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। কেন এসব বিভাগ, উত্তর নেই।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলছি, অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। স্বাধীনতার পর শিক্ষা নিয়ে আমরা একের পর এক পরীক্ষা করে চলেছি। কিন্তু আসল যে পরীক্ষা, অভিন্ন ধারার একটি শিক্ষাব্যবস্থা, তা গড়ে তুলতে পারিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার হয়তো ঘটছে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হয়তো গড়ে উঠেছে, কিন্তু আমরা মান ধরে রাখতে পারিনি। আমরা পরীক্ষায় পাসের হার বাড়িয়েছি; কিন্তু একটি সম্পন্ন শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি।
২.
ঢাকা শহরের নিউমার্কেট-ধানমন্ডি এলাকায় দুটি পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি ঢাকা কলেজ ও বেসরকারি ঢাকা সিটি কলেজ। দুটোই রাজধানীর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকের পর দুটোতেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা দেওয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এই মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকবে।
এই যে সরকারি ও বেসরকারি ভাগাভাগি, সেটি কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে? সরকার কি ধরে নিচ্ছে, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো লেখাপড়া হচ্ছে, সুতরাং সেগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়াই উচিত। আর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান যেহেতু খারাপ, সেহেতু সেগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে দেওয়াই শ্রেয়। সরকারের এই চিন্তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি পুরোনো ও জটিল সমস্যার অতি সরলীকরণ সমাধান বলেই ধারণা করি। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো মনে করছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো চলছে। অতএব, তাদের ওপর আরও দায়িত্ব চাপানো হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনোটাই ঠিকমতো চলছে না।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সময়ের প্রয়োজনে। যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজ পর্যায়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে পারছিল না, তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দুষ্টচক্রের খপ্পরে পড়ে। এখানে দলীয় লোকদের বসানো হয়, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন বা মান ধরে রাখার চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ত ছিলেন। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে একজন উপাচার্য প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় নানা কেলেঙ্কারি ঘটান। তিনি নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করে অপ্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ করতে থাকেন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও তারা ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। একদা বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামীপন্থী হয়ে যান। কিন্তু যাঁদের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সুবিধা-অসুবিধার কথা কেউ ভাবেননি। একসময় তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস, উত্তরপত্র গায়েব ও অমেধাবী লোকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তিন বছরের স্নাতক কোর্স কিংবা চার বছরের স্নাতক সম্মান কোর্স শেষ হতে যথাক্রমে পাঁচ ও ছয় বছর লেগে যেত। পরীক্ষা চলত বছরজুড়ে। বর্তমান উপাচার্য সেশনজট কমাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি। এখনো দেড় থেকে দুই বছরের সেশনজট চলছে। অতটা প্রকট না হলেও এই সমস্যা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি আছে। সময়মতো ভর্তি, সময়মতো কোর্স শেষ করতে পারছে না কেউই।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে যে উচ্চশিক্ষার সমস্যাটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকা না-থাকার নয়। সমস্যাটি হলো মানের, গুণের, মেধার, চিন্তার, যা শিক্ষার কোনো স্তরেই নিশ্চিত করা যায়নি। আমরা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি। কিন্তু তাঁরা কী শিক্ষা পেলেন, এই শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কি না, সেসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা আগেও ছিল না, এখনো নেই। একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর কোর্স খোলা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। এ সমস্যা বেসরকারি-সরকারি দুটোতেই সমভাবে আছে। শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির কারণ মেধাবী শিক্ষকের অভাব। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ নেই। ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষাও হয় না। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি ভাগ করে তাৎক্ষণিক সমাধান খোঁজা তুঘলকি সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো শিক্ষানীতি, ইতিহাসের অদলবদল, পাসের হার, সৃজনশীল প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও শিক্ষার মানের প্রতি কখনোই মনোযোগ দেয়নি।
বর্তমানে উচ্চশিক্ষা (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের মতো; যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই প্রায় ২১ লাখ। এই ২১ লাখের মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে সাত লাখ। সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সাত লাখ শিক্ষার্থী একদিকে থাকবেন, ১৪ লাখ অন্যদিকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি সরকারি কলেজের তুলনায় তো বটেই, খোদ ঢাকা কলেজও ফলাফলে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে পিছিয়ে আছে। একইভাবে ঢাকা নটর ডেম কলেজের কথা চিন্তা করুন। সরকারের এই প্রস্তাব কার্যকর হলে সেটিও যাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজটি সরকারি হওয়ার কারণে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো, লোকবল, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু কারও মাথাব্যথার অর্থ এই নয় যে মাথা কেটে ফেলতে হবে।
সরকার যখন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপাতে চাইছে, তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী? কোনোটিতে উপাচার্য অপসারণের জন্য আন্দোলন চলছে, কোনোটিতে উপাচার্য-সহ-উপাচার্য দ্বন্দ্ব চরমে, কোনোটিতে ছাত্রলীগ নিজেদের মারামারিতে লিপ্ত কিংবা কোনোটিতে প্রশাসন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। অতএব, তাদের ওপর বাড়তি দায় চাপানো কতটা সমীচীন হবে, তা আরও একবার ভেবে দেখুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
hsohrab55@gmail.com
Source:http://goo.gl/Yg9MfL