প্রোবাবলি ২০০৩ এ, শহীদুল্লাহ হল ‘বাঁধন’-এর এক অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন বিশেষ অতিথি হয়ে।
প্রধান অতিথি ছিলেন ভাইস চ্যানসেলর ড. এস এম এ ফায়েজ। ইনফ্যাক্ট, অতিথিদের অর্ডার মনে নাই। তো, ঐ বাঁধন ইউনিটের সেরা রক্তদাতা প্লাস সংগঠকদের ক্রেস্ট ও পুরষ্কার দেয়া শেষ করে যখন একে একে অনুষ্ঠানের আলোচনা ইত্যাদি শুরু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ তখন হঠাৎ উপস্থাপককে ইশারায় বললেন, আমি একটু আর্লি বলতে চাচ্ছি,
অন্যদের বক্তব্যের আগেই। এতে এতক্ষণের সভা একটু হোঁচট খেল। বিশেষ অতিথি তো পরে বলবেন। আসর জমে উঠলে। তার উপর হুমায়ূন আহমেদ, বস মানুষ! সবাই শুনতে আগ্রহী। যা হোক সিরিয়াল ব্রেক করে হুমায়ূন আহমেদের ফ্লোর আসল। নুহাশ (সম্ভবত) এবং শীলা আহমেদও ছিলেন অডিয়েন্সে, সামনের সারিতেই।
কিন্তু এই তাড়াহুড়ায় তিনি যা বললেন তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। যাকে বলে একেবারে ফ্ল্যাবারগাস্টেড হয়ে যাওয়া।
হুমায়ূন বলা শুরু করলেন যে, তিনি অনেকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। পরে অ্যামেরিকা থেকে পিএইচডি’ও করে এসেছেন। এবং তারও পরে অনেক দিন হল। অনেক বছর গেল। এখন কেমিস্ট্রির নামজাদা শিক্ষক তিনি, প্লাস জনপ্রিয় লেখক। তার কিছু পেপারও পাবলিশড হল। কিন্তু তবুও তিনি প্রফেসর আর হন না। মানে উপরের র্যাঙ্কে আর যেতে পারেন না। প্রমোশান আটকে থাকে। কী করার? মেজাজ খারাপ তার। এই অবস্থায় কেউ একজন রাস্তা বাতলে দিলেন। তখন প্রথম বিএনপি সরকার ক্ষমতায়।
হুমায়ূন বলতে থাকেন। তখনকার জাঁদরেল শিক্ষক নেতা ছিলেন ফায়েজ স্যার। তো আমি ঘটনা বুঝে কিছুদিন ফায়েজ স্যারের পিছনে ঘুরলাম। ব্যস। কাজ হয়ে গেল। এর কিছু পরই লিস্টে আমার নাম উঠল এবং আমি ঝটপট ‘প্রফেসর’ হয়ে গেলাম।
অনুষ্ঠানে সেদিন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বড়সড় এক আয়োজনই ছিল সেটা। ইউসুফ হায়দার স্যার ছিলেন কি? মনে হয়। ছাত্রদলের সিনিয়র নেতারাও অনেকেই ছিলেন।
তো ঘটনার পর আমাদের সবার এক চোখ আইনস্টাইনের মত গোঁফ-চেহারার ফায়েজ স্যারের দিকে, অন্য চোখ বক্তা হুমায়ূনের দিকে।
এর মাঝেই কিছু কথা বলে হঠাৎ ফায়েজ স্যারকে উদ্দেশ্য করে হুমায়ূন আহমেদ বলে উঠলেন, স্যার, স্বাধীনতার অনেকদিন পার হয়েছে। দেশে এখন এই ধরনের শিক্ষক রাজনীতির তো আর প্রয়োজন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের আলাদা রাজনীতি প্লিজ আপনি উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করে দিন! এইভাবে পিছনে পিছনে ঘুরাঘুরি করে প্রফেসর হতে হবে কেন? (কথাটা আজও, এই ২০১৫ তেও কি প্রযোজ্য? হু নোওজ!)
বলেই মাইক্রোফোন রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন। একদম সীমানার বাইরে। পুরা রুম চুপ। কী হোল এটা!
এনিওয়ে, ফায়েজ স্যার স্মার্ট পিপল। অলওয়েজ। তিনি হুমায়ূন আহমেদ যেতে না যেতেই মাইক নিয়ে এক মুহূর্তেই কিছু বললেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে। সেটাও ভাল ছিল। পুরাটা থাক, শেষ লাইনটা ছিল অনেকটা এমন, “এই যে হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি সমালোচনা করলেন, এরকম মুক্ত রাজনীতি টিকে থাকুক।”
হুমায়ূন আহমেদ যখন চলে যাচ্ছেন আমরা জুনিয়র স্টুডেন্ট যারা ফার্স্ট ইয়ারে বা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি গেলাম পিছন পিছন। ঘুরঘুর। কারণ, এখনই তো মজা। আজকে যা হবে না!
আমাদের আগে আগে শীলা আর নুহাশও তখন বের হয়ে টিভি রুমের দোতলা থেকে নিচে নিমে গেলেন, উঠলেন কালো একটা গাড়িতে।
সিঁড়িতে হঠাৎ স্যারকে থামালেন কেমিস্ট্রির এক ইয়াং টিচার। তিনি খুব বিনীতভাবেই জানালেন, স্যার আমি ডিপার্টমেনটের লেকচারার হয়েছি গত বছর।
হুমায়ূন স্ট্রেইট জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার রেজাল্ট কী হয়েছে?’
—স্যার, আমি সেকেন্ড হয়েছি।
আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে ফার্স্ট হোল সে কই?’
—স্যার, সে তো বিদেশে চলে গেছে।
এই শুনে হুমায়ূন বললেন, হ্যাঁ, এইই তো হবে! তোমরা সব টিচার হবা, আর ফার্স্টগুলা বিদেশে চলে যাবে!
আমরা এইবার ডাবল মাস্তি নিয়ে নিচে নেমে হুমায়ূন আহমেদকে বিদায় দিলাম, অনেকটা হৈ হুল্লোড় করতে করতেই। তিনি শহীদুল্লাহ হলের এক্স হাউজ টিউটর। সবাই তাঁকে চেনে।
তাঁর বক্তৃতায় সেদিন এও বলেছিলেন যে, এরপরও কিছুদিন তিনি ঢাবিতে ছিলেন। বড় মেয়ে নোভা কম্পিউটার সাইন্স-এ ভর্তি হওয়ার পর তিনি অধ্যাপনার চাকরিটা ছেড়ে দেন। এসব কিছুই তিনি একনাগাড়ে অল্প কতক্ষণের ভিতরই বলে গিয়েছিলেন। যেন বন্ধুদের আড্ডায় বলছেন। শান্ত, কেমন শীতল একটা টোনে।
হাউ-এভার। সেই যুগে, সকল রথী মহারথীদের সামনেই তিনি ‘ঐ কথা’ বলতে পেরেছিলেন। জ্বী, পেরেছিলেন! হুমায়ূন অন্য কোথাও বলেছিলেন, ‘না’ বলতে শিখতে হয়। ঠিক। ঐ ‘না’ বলার এবং সেদিনের সেই ‘সাহস’ তাঁর ছিলই।
লেখকঃ শাহরিয়ার সাব্বির তানবীর
প্রধান অতিথি ছিলেন ভাইস চ্যানসেলর ড. এস এম এ ফায়েজ। ইনফ্যাক্ট, অতিথিদের অর্ডার মনে নাই। তো, ঐ বাঁধন ইউনিটের সেরা রক্তদাতা প্লাস সংগঠকদের ক্রেস্ট ও পুরষ্কার দেয়া শেষ করে যখন একে একে অনুষ্ঠানের আলোচনা ইত্যাদি শুরু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ তখন হঠাৎ উপস্থাপককে ইশারায় বললেন, আমি একটু আর্লি বলতে চাচ্ছি,
অন্যদের বক্তব্যের আগেই। এতে এতক্ষণের সভা একটু হোঁচট খেল। বিশেষ অতিথি তো পরে বলবেন। আসর জমে উঠলে। তার উপর হুমায়ূন আহমেদ, বস মানুষ! সবাই শুনতে আগ্রহী। যা হোক সিরিয়াল ব্রেক করে হুমায়ূন আহমেদের ফ্লোর আসল। নুহাশ (সম্ভবত) এবং শীলা আহমেদও ছিলেন অডিয়েন্সে, সামনের সারিতেই।
কিন্তু এই তাড়াহুড়ায় তিনি যা বললেন তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। যাকে বলে একেবারে ফ্ল্যাবারগাস্টেড হয়ে যাওয়া।
হুমায়ূন বলা শুরু করলেন যে, তিনি অনেকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। পরে অ্যামেরিকা থেকে পিএইচডি’ও করে এসেছেন। এবং তারও পরে অনেক দিন হল। অনেক বছর গেল। এখন কেমিস্ট্রির নামজাদা শিক্ষক তিনি, প্লাস জনপ্রিয় লেখক। তার কিছু পেপারও পাবলিশড হল। কিন্তু তবুও তিনি প্রফেসর আর হন না। মানে উপরের র্যাঙ্কে আর যেতে পারেন না। প্রমোশান আটকে থাকে। কী করার? মেজাজ খারাপ তার। এই অবস্থায় কেউ একজন রাস্তা বাতলে দিলেন। তখন প্রথম বিএনপি সরকার ক্ষমতায়।
হুমায়ূন বলতে থাকেন। তখনকার জাঁদরেল শিক্ষক নেতা ছিলেন ফায়েজ স্যার। তো আমি ঘটনা বুঝে কিছুদিন ফায়েজ স্যারের পিছনে ঘুরলাম। ব্যস। কাজ হয়ে গেল। এর কিছু পরই লিস্টে আমার নাম উঠল এবং আমি ঝটপট ‘প্রফেসর’ হয়ে গেলাম।
অনুষ্ঠানে সেদিন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বড়সড় এক আয়োজনই ছিল সেটা। ইউসুফ হায়দার স্যার ছিলেন কি? মনে হয়। ছাত্রদলের সিনিয়র নেতারাও অনেকেই ছিলেন।
তো ঘটনার পর আমাদের সবার এক চোখ আইনস্টাইনের মত গোঁফ-চেহারার ফায়েজ স্যারের দিকে, অন্য চোখ বক্তা হুমায়ূনের দিকে।
এর মাঝেই কিছু কথা বলে হঠাৎ ফায়েজ স্যারকে উদ্দেশ্য করে হুমায়ূন আহমেদ বলে উঠলেন, স্যার, স্বাধীনতার অনেকদিন পার হয়েছে। দেশে এখন এই ধরনের শিক্ষক রাজনীতির তো আর প্রয়োজন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের আলাদা রাজনীতি প্লিজ আপনি উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করে দিন! এইভাবে পিছনে পিছনে ঘুরাঘুরি করে প্রফেসর হতে হবে কেন? (কথাটা আজও, এই ২০১৫ তেও কি প্রযোজ্য? হু নোওজ!)
বলেই মাইক্রোফোন রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন। একদম সীমানার বাইরে। পুরা রুম চুপ। কী হোল এটা!
এনিওয়ে, ফায়েজ স্যার স্মার্ট পিপল। অলওয়েজ। তিনি হুমায়ূন আহমেদ যেতে না যেতেই মাইক নিয়ে এক মুহূর্তেই কিছু বললেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে। সেটাও ভাল ছিল। পুরাটা থাক, শেষ লাইনটা ছিল অনেকটা এমন, “এই যে হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি সমালোচনা করলেন, এরকম মুক্ত রাজনীতি টিকে থাকুক।”
হুমায়ূন আহমেদ যখন চলে যাচ্ছেন আমরা জুনিয়র স্টুডেন্ট যারা ফার্স্ট ইয়ারে বা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি গেলাম পিছন পিছন। ঘুরঘুর। কারণ, এখনই তো মজা। আজকে যা হবে না!
আমাদের আগে আগে শীলা আর নুহাশও তখন বের হয়ে টিভি রুমের দোতলা থেকে নিচে নিমে গেলেন, উঠলেন কালো একটা গাড়িতে।
সিঁড়িতে হঠাৎ স্যারকে থামালেন কেমিস্ট্রির এক ইয়াং টিচার। তিনি খুব বিনীতভাবেই জানালেন, স্যার আমি ডিপার্টমেনটের লেকচারার হয়েছি গত বছর।
হুমায়ূন স্ট্রেইট জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার রেজাল্ট কী হয়েছে?’
—স্যার, আমি সেকেন্ড হয়েছি।
আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে ফার্স্ট হোল সে কই?’
—স্যার, সে তো বিদেশে চলে গেছে।
এই শুনে হুমায়ূন বললেন, হ্যাঁ, এইই তো হবে! তোমরা সব টিচার হবা, আর ফার্স্টগুলা বিদেশে চলে যাবে!
আমরা এইবার ডাবল মাস্তি নিয়ে নিচে নেমে হুমায়ূন আহমেদকে বিদায় দিলাম, অনেকটা হৈ হুল্লোড় করতে করতেই। তিনি শহীদুল্লাহ হলের এক্স হাউজ টিউটর। সবাই তাঁকে চেনে।
তাঁর বক্তৃতায় সেদিন এও বলেছিলেন যে, এরপরও কিছুদিন তিনি ঢাবিতে ছিলেন। বড় মেয়ে নোভা কম্পিউটার সাইন্স-এ ভর্তি হওয়ার পর তিনি অধ্যাপনার চাকরিটা ছেড়ে দেন। এসব কিছুই তিনি একনাগাড়ে অল্প কতক্ষণের ভিতরই বলে গিয়েছিলেন। যেন বন্ধুদের আড্ডায় বলছেন। শান্ত, কেমন শীতল একটা টোনে।
হাউ-এভার। সেই যুগে, সকল রথী মহারথীদের সামনেই তিনি ‘ঐ কথা’ বলতে পেরেছিলেন। জ্বী, পেরেছিলেন! হুমায়ূন অন্য কোথাও বলেছিলেন, ‘না’ বলতে শিখতে হয়। ঠিক। ঐ ‘না’ বলার এবং সেদিনের সেই ‘সাহস’ তাঁর ছিলই।
লেখকঃ শাহরিয়ার সাব্বির তানবীর
0 comments:
Post a Comment