মো. আবদুল মাজেদ পাটোয়ারী
অসির চেয়ে মসি বড়। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। জনৈক দার্শনিক বলেছিলেন, 'আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব।' শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা, শিক্ষকের মর্যাদা আমরা ভুলতে বসেছি! জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এ কথা সত্য। আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছি। দিন দিন নতুন নতুন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে। শিক্ষার অগ্রযাত্রার পেছনে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষক। আর তাকেই কিনা পদে পদে অপমানিত হতে হচ্ছে? এই অপমানের গ্লানি কতদিন সহ্য করতে হবে? কে দেবে এর সদুত্তর?
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবক্ষেত্রে আজ শিক্ষকরা বঞ্চিত। কেন? দোষ কি কেবল শিক্ষকদের? যদি শিক্ষকদের হয়, তবে শাস্তির ব্যবস্থা করুন। দোষী ব্যক্তির অবশ্যই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাওয়া উচিত। দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত না করে পুরো শিক্ষকসমাজকে একই সঙ্গে দায়ী করবেন, এটা কেমন বিচার? দোষী ব্যক্তি যে-ই হোক, রাষ্ট্রের আইনের কাছে তো সবাই সমান। পরিতাপের বিষয়, অষ্টম পে-স্কেল নামক শব্দত্রয় রাষ্ট্রের শিক্ষকসমাজকে দিন দিন হেয়প্রতিপন্ন করছে, অপরাধী মানসিকতার যন্ত্রণা দিচ্ছে।
অষ্টম পে-স্কেল তৈরির গুরুদায়িত্ব যার হাতে ন্যস্ত হয়েছিল, তিনি কেমন করে যেন বিচারক সাজতে গেলেন। তার বিচারিক দক্ষতায় উঠে এলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যা করে তা হলো অকর্ম, তাদের কাজের মূল্য অন্য সব সরকারি পেশার চেয়ে কম মূল্যের, বিশ্ববিদ্যালয় অনুৎপাদনশীল। সুতরাং তাদের বেতন কমিয়ে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন ও তার কমিটি তাই করল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সবার জানা। বিশ্ববিদ্যালয় যদি অনুৎপাদনশীল হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দিয়ে সারা দেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা অনর্থক। বিশ্ববিদ্যালয় না করে কলেজ করাই যুক্তিযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় হলো গবেষণানির্ভর, আর কলেজ ক্লাসনির্ভর। সরকার যেহেতু গবেষণার পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে প্রস্তুত নয়, তাহলে কেন নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়? নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেখানে কর্মবিমুখদেরই তো পাঠাতে হবে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ থাকবে, অন্তত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতি নির্ধারণে তিনি যেন প্রথম থেকে সক্রিয় থাকেন। তা না হলে সেখানে শিক্ষকরা তাড়াতাড়ি অধ্যাপক হয়ে যাবেন। তার বাজেট ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অর্থমন্ত্রীর কাছে আরেকটি বিনীত অনুরোধ থাকবে, শিক্ষকদের জীবন-মানের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করা। আমার বিশ্বাস ওই গবেষণায় বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজের জীবন-মানের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠবে। তারপর না হয় তাদের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
আমরা উন্নত দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখি, কখনো কি আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে উন্নত দেশ, উন্নত কেন? শিক্ষা ও গবেষণা ব্যতীত উন্নত দেশ গঠন কি সম্ভব? বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশে শিক্ষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীর বেতন সর্বোচ্চ। এর একমাত্র কারণ, শিক্ষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলী সম্মিলিতভাবে দেশকে সেবা দেয়, ফলে দেশ উন্নত হয়। সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া উন্নত দেশ গঠন অসম্ভব। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবা কয়েকদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, কারণ সেখানে শিক্ষকদের বেতন ডাক্তারদের চেয়েও বেশি। সরকার যদি আমাদের দেশীয় শিক্ষকদের প্রতি আস্থা না রাখে, তবে সৌদি আরবের মতো বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেন। নিয়োগ দিয়ে দেখেন, কেবল তখনই আপনাদের উপলব্ধি হবে, দেশীয় শিক্ষকরা কতটা বঞ্চিত। সঠিক সুযোগ পেলে এ দেশের ছাত্র-শিক্ষকরা কী করতে পারে, আজ তা কারও অজানা নয়।
আমাদের ছাত্র-শিক্ষকরা বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে গর্ববোধ করেন। কেন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চতর ডিগ্রির গুণগত মান বিশ্বমানের করার উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কবে আমরা এ দেশে উচ্চতর ডিগ্রি করে ধন্য হবো। উচ্চতর ডিগ্রি নির্ভর করে গবেষণার বিষয়বস্তু ও গুণগত মানের ওপর। মানসম্মত ডিগ্রির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। আমাদের দেশে উচ্চতর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব রয়েছে। কলা ও সমাজবিজ্ঞান গবেষণায় কিছু কিছু সুযোগ সৃষ্টি হলেও বিজ্ঞান গবেষণায় পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। কোনো কোনো গবেষক তাদের অধিগত বিদ্যা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন না। অন্যদিকে উচ্চতর গবেষণার জন্য বাজেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বহু গবেষক কোনো রকম বৃত্তি ছাড়াই গবেষণা সম্পাদন করে থাকেন।
পরিশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, জনগণের কল্যাণে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয়, দেশপ্রেমিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করুন। শিক্ষকদের তাদের প্রাপ্য হিস্যা দিতে আপত্তি কেন? দেশের উন্নয়নে তাদের প্রতিপক্ষ না ভেবে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন কর্তৃক দাবিকৃত চার দফা বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করুন, ধনী দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখুন। না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
Source:http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/08/18/100607
0 comments:
Post a Comment