Sunday, August 9, 2015

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কবে বুঝবে বাংলাদেশ?

কামরুল হাসান
সুহূদ পাঠক, সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি দৃশ্যপট লক্ষ করুন। দৃশ্যপট এক. গত অর্থবছরের (২০১৪-২০১৫) বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের তুলনায় বর্তমান অর্থাত্ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কি বেড়েছে? দৃশ্যপট দুই. কিছুদিন আগে একজন পুলিশ সার্জেন্ট কর্তৃক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক লাঞ্ছনার শিকার হন। দৃশ্যপট তিন. প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হ্রাসকরণ। দৃশ্যপট চার. বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সন্তোষজনক অবস্থানে নেই।

আপনি কি মনে করেন বিশ্ব র্যাকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো একটির নাম থাকা উচিত ছিল? আমি মনে করি, না থাকাই স্বাভাবিক। এটা উপলব্ধি করার জন্য উপরের উদাহরণগুলোই যথেষ্ট। এ রকম আরো অসংখ্য উদাহরণ উল্লেখ করা যাবে। ২০১৩ সালে কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংয়ে ৩০০ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের ১১টি ও পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং বাংলাদেশের কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অথচ দেখুন, এ তিন দেশ একই উপনিবেশিক শাসন-শোষণের উত্তরাধিকার ধারণ করছে। আরো একটু দৃষ্টি খুলুন, পাকিস্তান প্রায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্র। বাংলাদেশ এর চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে বহু পিছিয়ে। আর ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনার কথা চিন্তায়ই আনা যায় না। এখানে আমার প্রশ্ন, একই উত্তরাধিকার ধারণকারী তিনটি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রের (বিশেষত উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের) দুটির চিত্র এক রকম এবং অন্যটির চিত্র ভিন্ন কেন? সম্মানিত পাঠক, পার্শ্ববর্তী তিনটি দেশের (ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা) উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেট, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করুন, তাহলে সহজেই আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। উল্লিখিত তিনটি দেশেই শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো তো দূরে থাক, পূর্বে যা ছিল তা হ্রাস করার চেষ্টা চলছে।
প্রিয় পাঠক, একটু চিন্তা করুন, বাংলাদেশে যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, তত্কালীন দেশের অগ্রগতি এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের অগ্রগতি; কিংবা বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না অথবা নামমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে কিন্তু মান থাকবে না, তখন দেশের অগ্রগতি কেমন হবে। এ সূত্রে আমি পাঠকদের জন্য বর্তমান সরকারের তথ্য কমিশনার, বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগমের বিশ্ববিদ্যালয় সর্ম্পকিত একটি গবেষণাকর্মে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেন, একটি দেশের অগ্রগতির অন্যতম প্রধান মৌল নির্ধারক জ্ঞানসমৃদ্ধ, জীবনঘনিষ্ঠ, গণমুখী ও কার্যকর শিক্ষাক্রমে বিন্যস্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এর অন্যথায় মেধা ব্যবহারপূর্বক জীবন ও জগতের জন্য কল্যাণকর দর্শন ও নিদের্শনা লাভে, দেশের সম্পদ ব্যবহারে পরিকল্পনা প্রণয়নে, বিজ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবনে, সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় কুশলী নেতৃত্ব। প্রগতির মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণগত আবহ বিন্যাসে, এক কথায় উন্নতি ও সভ্যতা নির্মাণে ব্যর্থ হবে বাংলাদেশ। বিশ্ব অঙ্গনের সব প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। তিনি তার গবেষণায় আরো বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে পাশ কাটিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘অকার্যকর’ রেখে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা দেশ সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।
দেশকে অগ্রগতি-প্রগতির পথে দিকনির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজকের পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো রাষ্ট্রীয় স্থাপত্যের গণজীবনসম্মত শক্তিশালী গাঁথুনি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্মাণে যেমন পথনির্দেশ করে, তেমনি সার্বভৌমত্বের কার্যকারিতার অভিব্যক্তিও ঘটায়। সোজা কথায়, আধুনিক জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি ভূমিকা পালন করে। প্রথমত. বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান উত্পাদন করে; যা দেশ ও বিশ্বের কল্যাণে অত্যাবশ্যক। দ্বিতীয়ত. ওই সব জ্ঞানের বাস্তবায়নে দক্ষ-যোগ্য প্রশাসনিক নেতৃত্ব তৈরি করে। ক্লাসঘরে সারি সারি বসে থাকা মেধাদীপ্ত তরুণ ছেলেমেয়েকে বিশেষজ্ঞরূপে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। দেশের জনগণ নিজেদের সন্তানদের পায় সৃজনশীল মননে। তৃতীয়ত. বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে একটি জনপদের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব উদ্ভাবন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গণমুখী অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দর্শন নির্ধারণ করে এবং সেসব বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা দেয়। দেশের মনীষা বিশ্বসমক্ষে ভাস্বর হয়ে ওঠে। সারা বিশ্বকেও কল্যাণের পথে নেতৃত্ব প্রদানে ভূমিকা পালনে সমর্থ হয় দেশ এবং বিশ্বে উচ্চপর্যায়ে আসীন হয় দেশের অবস্থান। এভাবেই দেশ এগিয়ে যায়, বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে, সভ্যতার পথে।
এখানেই বঞ্চিত বাংলাদেশ। আজ বহুদিন। বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করতে বাংলাদেশকে তাই ফিরে দাঁড়াতে হবে। এবং বাংলাদেশের ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, ইতিহাস-ঐতিহ্য-ভাষা-সংস্কৃতি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মেধা, গাছপালা-পশুপাখি, নদী-সাগর, বাঙালি জাতিসহ সব ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত জনগণ এবং জনসত্তায় অন্তর্লীন প্রতি ব্যক্তির জীবনের কল্যাণে রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shimantoju@gmail.com

0 comments:

Post a Comment