রাশেদুজ্জামান কানন
বিদ্যাশিক্ষার প্রারাম্ভেই দেশ ও জাতির জন্য শিক্ষা এবং শিক্ষাগুরুর মর্যাদা নিয়ে লেখা কবিতা বা গল্প আওড়াতে আওড়াতে বড় হয় প্রতিটি শিক্ষার্থী। শিক্ষা জীবনের সকল শিক্ষা ভুলে গেলেও এই সব নীতিশিক্ষা মানুষ কোনো দিনই ভুলে যেতে পারে না। শিক্ষক শব্দটা উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ছাতা হাতে মলিন বস্ত্রে বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া অংকের রগচটা শিক্ষকের মুখ। ক্লাস রুমের ভেতরে এবং বাইরে যার ভয়ে সবাই জবুথবু। যতটা না ভয়ে, তার চেয়ে বেশি সম্মানে। সেখানে বাদশা নামবাদের ছেলে আর মাঝি বাড়ির গৌতমের ছেলের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই সমান।
এই মলিন বস্ত্রধারী মানুষটির বাইরের রূপ সকলেই দেখলেও তার ভেতরের মানুষটিকে চেনা খুব সহজ ছিল না কোনো শিক্ষার্থীর জন্য। শুধু শিক্ষার্থী কেন? ঘরের চৌকাঠের বাইরের কুমড়োর লতাটাও বুঝি জানে না সেই কষ্টটা। তাই আমরা শিক্ষার্থীরা যারা একদিন দেশের কর্ণধার হয়েছি তারা সেই মলিন বস্ত্রের মাস্টার মশাইকে শুধু মর্যাদাই দিয়েছি। কিন্তু শুধু মর্যাদা দিয়েই যে পেট ভরে না তা আমরা বেমালুম ভুলেই গেছি। হয়ত আমরা ধরেই নিয়েছি মাস্টার মশাইকে বিনে পয়সার এই মর্যাদাটুকু দিলেই তার দিনপাত চলে যাবে। হয়ত এরা মর্যাদা খেয়েই বেঁচে থাকে! হয়ত বা তাই।
ঢাকা শহর দেশের সবচেয়ে ঘনবসতি-পূর্ণ আর সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে গুনতে হয় হাজার হাজার টাকা। সেখানে একজন শিক্ষকের মাসিক বাড়ি ভাড়া বাবদ বরাদ্ধ কত জানেন? ৩০০ টাকা। আপনি অসুস্থ। ডাক্তারের কাছে যাবেন? ওষুধ বাদেই শুধু ডাক্তার ফি কত? সর্বনিম্ন ৭০০ টাকা? একজন শিক্ষকের চিকিৎসা ভাতা কত জানেন? ২০০ টাকা। আর টাকা কোথা থেকে আসবে সে খবর কি নিয়েছেন কোনদিন? চুরি করে নাকি ডাকাতি করে? কিন্তু এই সব মানুষের আবার আত্মসম্মান-বোধটাও স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি। সুতরাং কষ্ট ভোগ করো?
বইয়ের পাতার কঠিন কঠিন সমীকরণ যিনি বিনা বাধায় নিমিষেই করে দেন তিনি কিভাবে জীবনের সমীকরণ মেলান তা হয়ত তিনিই জানেন। অন্য কারো জানার কোনো উপায় নেই। ঐ যে সেই কুমড়োর লতাটিও না।
শিক্ষক নাকি জাতির শ্রেষ্ঠ নাগরিক। কোনো কোনো দেশ সেই মর্যাদা দিয়েও থাকে। আর আমাদের দেশে? শিক্ষকদের ক্লাস ছেড়ে শহীদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান ধর্মঘট করতে হয়। সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকার তাগিদে মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে সরকার প্রধানের কাছে বলতে হয়- ‘আমাকে অন্তত সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো অর্থ দাও’। এ লজ্জা কার? আর সম্মানের যে ফাঁকা বুলির কথা বলা হয় সেখানেও শিক্ষকের অবস্থান দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়।
একজন বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সরকারের গ্রেডের ৩য় শ্রেণীর কর্মকর্তা। যদিও অতি সম্প্রতি সরকারি স্কুলের শিক্ষককে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে কিন্তু দেশে সরকারি স্কুল আছেই বা কয়টা? যেখানে সমগ্র দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই নির্ভর করে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপর সেখানে সেই সব স্কুলের শিক্ষকদের অবহেলা করার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
বাদশা আলমগীর তার সন্তানের শিক্ষার গুরুকে কত টাকা মাইনে দিতেন জানা নেই। তবুও তো সন্মান দিতে এতটুকু দ্বিধাও করেন নাই। আর আমরা না দেব সন্মান, না দেব শিক্ষা-গুরুর দক্ষিণা। শিক্ষকদের মর্যাদা হেয় করে তাদের কাছ থেকেই দেশের জন্য উন্নততর আগামী প্রজন্ম প্রত্যাশা করা কি বাতুলতা নয়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার যোগ্যতা অর্জন করেন। তারচেয়ে তুলনামূলক ভাবে যারা একটু খারাপ তারা হয়ত সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক বা অন্যান্য দপ্তরে চাকুরি নিয়ে জীবন যাপন করে থাকেন। আর ক্লাসের সবচেয়ে শেষের বেঞ্চের শিক্ষার্থীকেই দেখা যায় রাজনীতি এবং অপরাজনীতির মাঠ গরম করতে। আর সুখ বিলাসের চিত্রটা যেন পুরোপুরি বিপরীত।
একজন রাজনীতিবিদের বাড়ি যান মনে হবে স্বর্গে এসেছেন। তারা ঘুরে বেড়ায় প্রাডো বা পাজেরোতে চড়ে। আর একজন সরকারি কর্মকর্তা? তিনি প্রাডোতে না চড়তে পারলেও অন্তত একটা চার চাকার যান ঠিকই যোগাড় করে ফেলেন আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে কিনা সবচেয়ে মেধাবী ছিলেন তিনি সাত নাম্বার বাসে ঝুলে ঝুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এভাবেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা ঝুলে থাকেন বাসের হাতল ধরে। আর নাম স্বাক্ষরের যোগ্যতাবিহীন রাজনীতিবিদরা তাদের উপরেই আঙ্গুল ঘোরান।
একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। শিক্ষার মান বজায় রাখতে হলে শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে আর কতদিন এগিয়ে আসবে শিক্ষকেরা বলবেন কি মাননীয় মন্ত্রী?
শিক্ষকরা নাকি পড়াশোনা করেন না। মাননীয় মন্ত্রী একবার একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো কত টাকা বরাদ্ধ দিয়েছেন শিক্ষকের গবেষণার জন্য? গাছের ফল খেতে চাইলে গাছে পানি ঢালতে হয়। পানি না ঢেলেই ফল খাবেন? প্রকৃতি আর কত দিন সাপোর্ট দিবে?
এই আমাদের দেশেই একজন পুলিশ অফিসার তার নেশাগ্রস্থ সন্তানের জন্য সাপ্তাহিক হিসেবে লক্ষ লক্ষ টাকা হাত খরচ দিয়ে থাকেন। সেখানে শিক্ষক তার সন্তানের স্বাভাবিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেয়ে যান। নিজের সন্তানকে অভাবের দৈন্যদশায় রেখে অন্যের সন্তানদের মেধা ও মননের পরিচর্যা কিভাবে করবেন বলবেন কি মাননীয় মন্ত্রীসমাজ? এত অবহেলার পরও শিক্ষকদের কাছ থেকে জাতি এত বেশি কিছু কিভাবে আশা করে? দেশ নামক শাসনযন্ত্রের কি এতটুকুও লজ্জা করে না?
আমরা কথায় কথায় পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ টেনে আনি। এই ক্ষেত্রে কি একটু টেনে আনা যায় না? ভারত, নেপালের চিত্রটা কি একটু বিবেচনা করা যায় না? ওরা শিক্ষাগুরুর মর্যাদা দিতে জানে বলেই ওরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে। ওদের শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে বসে রাতের খাবারের কথা বা সন্তানের কলেজের মাইনের কথা চিন্তা করতে হয় না বলেই সেই সব শিক্ষক জাতিকে উপহার দিতে পারছেন ভবিষ্যতের মূল্যবান রত্ন।
এরপর থেকে হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটি আর শিক্ষক হতে চাইবেনা। ভালোভাবে পড়ালেখার পরিবর্তে মেধাবী ছাত্রটিও হয়ে যাবে ব্যাকবেঞ্চার। দেশ ভরে যাবে রাজনীতিবিদে। একটু ভালোভাবে বাঁচার সাধ কার না জাগে? আর সেই ভালো থাকার তাগিদেই নীতি শিক্ষার গুরুও হয়ত ভুলে যাবেন নীতিবোধ।
অবশেষে একদিন শিক্ষক নামক শব্দটাই হারিয়ে যাবে বাস্তবতার নির্মম রোষানলে। স্থান নিবে যাদুঘরে। আর সত্যিই যদি এমনটাই ঘটে তবে দেশের ভবিষ্যত কোন দিকে ধাবিত হবে তা চিন্তা করতেই শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আশা করি এমনটি কোনোদিনই হবে না।
ধর্মান্ধ, নীতিবোধ বর্জিত, স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করা যে অর্থহীন তা শিক্ষক সমাজ ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু সরকার যখন অসাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি- তখন তার কাছে প্রত্যাশাও স্বভাবগত ভাবেই অনেকখানি বেশি। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও শিক্ষক সমাজ যা পান নাই তা তারা পাবেন এই প্রত্যাশা নিয়েই হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মাঠে নেমেছেন। প্রগতিশীল সরকার শিক্ষাগুরুর মর্যাদা রক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখড়ে এটাই সবার কাম্য।
লেখক: ইংরেজি বিভাগ, ৪র্থ বর্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Published on: http://www.banglamail24.com/news/102605
0 comments:
Post a Comment