Thursday, August 20, 2015

প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলঃ স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প ও কিছু প্রশ্ন!

শেখ আলমগীর হোসেন

 প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দুই ভাবে অবমাননা করা হয়েছে। প্রথমত, সম্মানের দিক থেকে। দ্বিতীয়, আর্থিকভাবে। এই বিষয়টা এখন কারোর অজানা নয়। চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে সরিয়ে সচিবের পাশে জেলা প্রশাসককে বসানো হয়েছে, এটাও কারোর জানার বাইরে নয়। তাই একই কথা বার বার বলে আর কাল ক্ষেপণ করতে চাই না।

যেসকল সচিব বা আমলারা একটি বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো তৈরি করে সরকারের কাছে উপস্থাপন কিংবা শিক্ষক সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করার যে ঘৃণ্য প্রচেষ্টা দেখাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে একটি গল্প বলতে চাই এবং কিছু প্রশ্ন দিয়ে শেষ করব। গল্পটি বাস্তব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন নিজ চোখে দেখা।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধার সরবচ্চো স্বাক্ষর রেখে অর্থাৎ শিক্ষাবোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখতে পাই মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারিতে স্থান পাওয়ার জন্যে শুরু হয় অসংখ্য মেধাবীদের মধ্যে নতুন যুদ্ধ। কেউ সফল হয়, কেউবা বিফল! এবার মূল গল্পে আসি।
আমার এক বন্ধুর স্বপ্ন ছিল সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই ভর্তির পর থেকেই ব্যাপক পড়ালেখা করতে থাকে। তার প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট আশানুরূপ হলেও দ্বিতীয় সেমিস্টারেই বিধি বাম। রেজাল্ট আশানুরূপ হল না। আগেই বলেছি এখানে প্রথম সারিতে যাওয়ার জন্যে অনেক কষ্ট করতে হয়। প্রতিযোগিতা অনেক বেশী। কারন মেধাবী মুখের অভাব নেই। অনেকটা সোনার হরিণ পাওয়ার মত। যাইহোক আমার ঐ বন্ধু অতিব চালাক হওয়ায় তৃতীয় সেমিস্টার থেকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে বিসিএস এর জন্যে পড়ালেখা শুরু করে দেয়। আর একাডেমিক পড়ালেখা কোনরকমে চালিয়ে যায়। রেজাল্টের কথা আর নাই বা বললাম। তবে আজ সে বিসিএস ক্যাডার, ভবিষ্যতের আমলা!ও
আরও কয়েকজন বন্ধু ছিল যারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও মেধা তালিকার প্রথম সারিতে আসতে পারেনি। অবশেষে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নের মৃত্যু হয়। তবে অবশ্য তারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। যদিও সেইসব বন্ধুরা শিক্ষকতা পেশা নিয়ে এখন অনেক কথা বলে থাকেন। উপহাস করে মাস্টার বলে সম্বোধন করে থাকেন। অনেকটা আঙ্গুর ফল টকের মত।
এটা আমরা সবাই জানি যে প্রথম সারির ছাত্র না হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না বাকি সকল চাকুরিতে বা পেশায় যাওয়া যায়। যারা অন্য পেশায় রয়েছেন তাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলছি, আপনাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই, বরং রয়েছে ভালবাসা। কারন আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি একটি জাতি, একটি সমাজ, একটি দেশ এগিয়ে জেতে দেশের সর্বস্তরের জনগণের স্মমিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। তাই আমরা সবাইকে নিয়ে একসাথে পথ চলতে চাই, কাউকে ছোট করে কিংবা পিছনে ফেলে নয়। বৈষম্যমূলক মনোভাব নিয়ে আর যাইহোক দেশ সামনে অগ্রসর হতে পারে না। আমরা এখন এমন একটা সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আমরা নিজের যতটা ভাল চাই, তার চেয়ে বেশী চাই অপরের খারাপ হোক। অন্যের ক্ষতি হলে আমাদের আনন্দের মাত্রাটা বেশী বৃদ্ধি পায়। আর  কোনভাবে যদি মানুষ গড়ার কারিগর এই শিক্ষক সমাজকে ছোট করা যায়, তাহলে তো কোন কথাই নেই।
অবশেষে সেই বন্ধুবর আমলাদের প্রতি কিছু প্রশ্ন রাখতে চাইঃ
(১) শিক্ষকদের প্রতি আপনাদের এত ক্ষোভ কেন? আপনি শত চেষ্টা করেও শিক্ষক হতে পারেন নাই সেই জন্যে কি?
(২)  আপনি আজ আমলা হয়েছেন কাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহন করে?
(৩) পড়ালেখা না করে কি পৈতৃক সুত্রে আমলা হয়েছেন?
(৪) আপনি যদি দুর্নীতি করে টাকা বানান, তাহলে হয়ত আপনার সন্তানকে বিদেশে পড়াতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন সেখানেও কিন্তু আপনার সন্তানকে পড়াবেন আমাদের মত কোন শিক্ষক। পার্থক্য একটায় আমরা দেশী, তারা বিদেশী! তাহলে দেশের আপামর জনসাধারনের টাকা নিয়ে কেন এত বিদেশ প্রীতি?
(৫) আর যদি দুর্নীতির টাকা না থাকে, তাহলে তো আপনার সন্তান পড়বে এদেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ে। যে শিক্ষকরা তাকে পড়াবে, তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আপনারা সদা ব্যস্ত কেন?
(৬) একবার ভাবুন আপনি যাকে সম্মান করেন না, আপনার সন্তান তাকে সম্মান করবে কি?
(৭) আর যে সন্তান তার শিক্ষককে সম্মান করে না, সে কখনও তার মা-বাবাকে সম্মান করতে পারে না। অন্যদের কথা আর বলার দরকার আছে কি?
(৮) আপনি কি আপনার সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে চান না? যদি চান, তাহলেই শিক্ষকদের পিছনে লেগে আছেন কেন?
(৯) এই শিক্ষক সমাজই পারে আপনার সন্তানকেই সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সেটা আপনি ঘরে বসে নিজে পারবেন কি?
(১০) শিক্ষক সমাজ বেশী ভদ্রতা দেখাচ্ছে, এটা কি দুর্বলতা হিসেবে নিচ্ছেন?
(১১) আমরা দুর্বল নই। সর্বক্ষণ আমাদের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের মঙ্গল কামনা করি। তাইতো আমাদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের অংশ হিসেবে শোকের মাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আগস্টের প্রতি রবিবার তিন ঘণ্টা কর্মবিরতি রেখে অবস্থান কর্মসূচী পালন করলেও তা পরীক্ষার আওতামুক্ত। আমাদের যত কষ্ট হোক না কেন তাতে যেন আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের কোন ক্ষতি না হয় সেটা সবসময় মাথায় রাখি। সেসব  বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে কি?
(১২) আপনার সন্তানকে যদি কমপক্ষে আপনার মত আমলা বানাতে চান, সেটা শিক্ষক সমাজের সাহায্য ছাড়া পারবেন কি?
(১৩) সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারিতে নিজের নামটা না রাখতে পারার ক্ষোভটা কি এখনো ভোলা যায় না?
(১৪) আমাদেরকে দুশমন না ভেবে, দেশটাকে আরও কিভাবে সুন্দর করা যায় সেই চিন্তা কি করা যায় না?
(১৫) হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে থেকে একবার কি খেয়াল করেছেন, এই শিক্ষক সমাজের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল? স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটেও শিক্ষাখাতে তিনি রেখেছিলেন  উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ, যখন দেশে রাস্তাঘাট কিছুই ছিল না। কারন জাতির পিতা ভাল করেই জানতেন শিক্ষার উন্নতি না হলে একটি জাতি কখনো মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে না। আপনি কি তা মনে করেন? না জাতির পিতার চিন্তার সাথে একমত হতে পারছেন না? জাতির পিতা শিক্ষককে সরবচ্চো সম্মান দেখাতে পারলে, আপনারা কেন পারছেন না? আপনাদের সমস্যা কি?
(১৬) সর্বশেষে বলতে চাই, জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা, গণতন্ত্রের মানস কন্যা, দেশরতœ, তিনবারের  সফল প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বোকা বানিয়ে আপনাদের এই মনগড়া বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো পাশ করাতে পারবেন কি? তাহলে আমাদের যোক্তিক দাবি মেনে নিতে ক্ষতি কোথায়ৃ???

শেখ আলমগীর হোসেন
শিক্ষক, ফিন্যান্স বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Source: http://www.amadershomoys.com/newsite/2015/08/21/378732.htm

0 comments:

Post a Comment