এ এস এম মাকসুদ কামাল
গত ৮ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি-দাওয়া ও প্রস্তাবিত অষ্টম বেতনকাঠামোতে অবমাননার বিষয় তুলে ধরেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদনমতে, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম দাশ মন্ত্রীকে জানান, একবার সার্কিট হাউসে শিক্ষাবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তিনি এক সচিবের পাশে বসেন। জেলা প্রশাসক দেরিতে সভায় উপস্থিত হয়ে উপাচার্যকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে সেই আসনে নিজে বসেন। একজন উপাচার্যের প্রতি একজন
আমলার এ আচরণে শিক্ষক সমাজ ক্ষুব্ধ, অপমানিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের যথার্থতা এই আমলার আচরণেও নিহিত। প্রস্তাবিত বেতনকাঠামো ঘোষণার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন। সবাই দাবিগুলোর পক্ষে মতামত দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী উত্থাপিত দাবিগুলোর পক্ষে সংশ্লিষ্ট সচিবদের ডিও লেটার দিয়েছেন, জবাবে মন্ত্রী উত্তর পেয়েছেন কি না, জানি না। ডেইলি স্টার-এ ২৭ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে জনৈক সচিব বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ব্যাপকভাবে প্রমোশন পেয়ে থাকেন, তাঁদের দাবি পূরণ হলে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা বইতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। অথচ সচিব মনে করেন, শিক্ষার বিনিয়োগ বোঝা।
শুধু বিএ পাস করে এমনকি শিক্ষাজীবনে একটি তৃতীয় শ্রেণি পেয়েও অনেকে সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। আমলাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ কোটাভিত্তিক। বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমেও আমলা নিয়োগ করা হয়। গত কয়েক বছরে আমলাদের ব্যাপক প্রমোশন হয়েছে, তাই সিনিয়র সচিব, পদায়িত-অপদায়িত সচিবসহ নতুন পদের নাম যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি আমলাতন্ত্রের অন্যান্য স্তরে প্রমোশনের ভারে জট লেগে যাওয়ার বিষয়ও আলোচিত। জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে মেধাতালিকায় শীর্ষস্থান অর্জনকারী সেরারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ থাকার পরেও ডক্টরাল ডিগ্রি না থাকায় অধ্যাপক হতে ন্যূনতম ২৫ বছর লাগে। ডক্টরাল ডিগ্রি থাকলে এবং স্বীকৃত দেশি-বিদেশি জার্নালে ন্যূনতম ১৫টি গবেষণা প্রবন্ধ থাকলে অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে কিছু কম সময়ে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট—চাকরির বয়সসীমার সঙ্গে নয়। সচিব আরও বলেছেন, শিক্ষকদের চাকরিতে অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বছর, আমলাদের ৫৯—শিক্ষকেরা একজন আমলার থেকেও বেশি সময় বেতন-ভাতা পান। একজন শিক্ষক বেশি বয়স পর্যন্ত চাকরি করেও আর্থিকভাবে একজন আমলা থেকে কতটুকু স্বাবলম্বী, তা এই সমাজ জানে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাজ, মেধা-অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ; করণিকের কাজ নয়। ভারত ও শ্রীলঙ্কায়ও শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বছর।
শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানে মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় প্রতিটি স্তরে শিক্ষকেরা মূল বেতনের প্রায় আড়াই গুণ ভাতা পান। ভারতে বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের কারণে সমতুল্য আমলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেশি
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হন, এটি বলা হয়। কিছু শিক্ষকের এ রকম সুবিধা আছে, যার অনুপাত ৭ শতাংশেরও কম। জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে সৎ পথে অর্থ উপার্জন করা কি অপরাধ? সরকারি অনেক কর্মকর্তাও বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এতে প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জ্ঞান ব্যবস্থাপনার একটি সেতুবন্ধ গড়ে উঠছে।
প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান সপ্তম থেকে দুই ধাপ নামানো হয়েছে। সিলেকশন গ্রেড বাতিল হলে তা আরও নামবে। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ১৬ ধাপের প্রতিবেদন সচিব কমিটিতে যাওয়ায় তাঁরা সপ্তমের ন্যায় ২০ ধাপের প্রস্তাব করেন। যুগান্তর-এ প্রকাশিত ১৪ মের তথ্যমতে, সচিব কমিটির প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোতে ধাপ ২২টি। সপ্তম বেতনকাঠামোতে সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকেরা গ্রেড-১-এ ছিলেন, যেখানে ৪০ হাজার টাকা নির্ধারিত ছিল, বেতন স্কেলের মূল কাঠামোতে মুখ্য সচিব বা মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সিনিয়র সচিবের মতো সুপার-গ্রেড ছিল না, যা এখন রাখা হয়েছে। এই বেতন স্কেলের ৩ অনুচ্ছেদের (২) পাদটীকায় ভাতা যোগ করে ৪৫ হাজার টাকা (নির্ধারিত) হবে। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে একটি প্রজ্ঞাপনে সিনিয়র সচিব পদ উল্লেখ করে মূল বেতনের সঙ্গে দুই হাজার টাকা ভাতা প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা সপ্তম বেতন স্কেলে ছিল না। তাই প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোতে ২০টি গ্রেডের বাইরে দুটি সুপার গ্রেড রাখায় এখন ধাপ ২২টি, যা পাকিস্তানের চলমান বেতনকাঠামোর অনুরূপ। সচিব কমিটি সুপার গ্রেডের বেতন-ভাতা সরাসরি দ্বিগুণ বৃদ্ধি এবং অন্যদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণের কম বৃদ্ধির সুপারিশ করে, যা পক্ষপাতপুষ্ট ও নীতি-নৈতিকতায় অগ্রহণযোগ্য। স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নেই এমন কমিটি অষ্টম বেতনকাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করলে সবাই সুবিচার পাবেন।
প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান সপ্তম থেকে দুই ধাপ নামানো হয়েছে। সিলেকশন গ্রেড বাতিল হলে তা আরও নামবে। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ১৬ ধাপের প্রতিবেদন সচিব কমিটিতে যাওয়ায় তাঁরা সপ্তমের ন্যায় ২০ ধাপের প্রস্তাব করেন। যুগান্তর-এ প্রকাশিত ১৪ মের তথ্যমতে, সচিব কমিটির প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোতে ধাপ ২২টি। সপ্তম বেতনকাঠামোতে সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকেরা গ্রেড-১-এ ছিলেন, যেখানে ৪০ হাজার টাকা নির্ধারিত ছিল, বেতন স্কেলের মূল কাঠামোতে মুখ্য সচিব বা মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সিনিয়র সচিবের মতো সুপার-গ্রেড ছিল না, যা এখন রাখা হয়েছে। এই বেতন স্কেলের ৩ অনুচ্ছেদের (২) পাদটীকায় ভাতা যোগ করে ৪৫ হাজার টাকা (নির্ধারিত) হবে। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে একটি প্রজ্ঞাপনে সিনিয়র সচিব পদ উল্লেখ করে মূল বেতনের সঙ্গে দুই হাজার টাকা ভাতা প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা সপ্তম বেতন স্কেলে ছিল না। তাই প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোতে ২০টি গ্রেডের বাইরে দুটি সুপার গ্রেড রাখায় এখন ধাপ ২২টি, যা পাকিস্তানের চলমান বেতনকাঠামোর অনুরূপ। সচিব কমিটি সুপার গ্রেডের বেতন-ভাতা সরাসরি দ্বিগুণ বৃদ্ধি এবং অন্যদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণের কম বৃদ্ধির সুপারিশ করে, যা পক্ষপাতপুষ্ট ও নীতি-নৈতিকতায় অগ্রহণযোগ্য। স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নেই এমন কমিটি অষ্টম বেতনকাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করলে সবাই সুবিচার পাবেন।
শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানে মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় প্রতিটি স্তরে শিক্ষকেরা মূল বেতনের প্রায় আড়াই গুণ ভাতা পান। ভারতে বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের কারণে সমতুল্য আমলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেশি। পাকিস্তানে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষা কমিশন টেনিউর ট্র্যাক পদ্ধতি চালু করে উচ্চ মানের গবেষক-শিক্ষকদের উচ্চ বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে। এই পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বেসিক পে-স্কেলের শিক্ষকদের থেকে ন্যূনতম তিন গুণ বেশি বেতন পান। এমনকি দক্ষতা ও গবেষণার মান অনুযায়ী পাকিস্তানে বেসিক পে-স্কেলের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ অধ্যাপককে বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ২২তম ধাপ প্রদান করা হয়, যা মুখ্য সচিবের সমতুল্য। অধ্যাপকদের গ্রেড ২১তম, যা সচিবদের সমতুল্য। দেশটিতে একজন প্রভাষক চাকরি শুরু করেন ১৮তম ধাপে, যেখানে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার প্রারম্ভিক ধাপ ১৭তম।
এসব উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানাই। স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যবর্তী সময়ে প্রস্তাবিত অষ্টম বেতনকাঠামো পুনর্নির্ধারণ করে সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা সিনিয়র সচিবের সমতুল্য; অধ্যাপকদের সচিবের সমতুল্য; সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতন ক্রমানুসারে নির্ধারণ করারও প্রস্তাব জানাই। এভাবে বেতন-ভাতা নির্ধারিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের জন্য আনুমানিক সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি টাকা প্রতিবছর বিনিয়োগ করতে হবে, যা হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে লোপাট হওয়া অর্থের ৮ শতাংশ মাত্র।
রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল অনুযায়ী সম্মান দেওয়া হয়নি। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের অবস্থান ১৯তম সমবেতনের সচিবদের অবস্থান ১৬তম। এমনকি উপাচার্যদের ১৭তম অবস্থানে রাখা হয়েছে। জনগণের করের টাকায় প্রাপ্ত একই বেতনের একজনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বেশি, অন্যজনের কম—এ কেমন বিচার? তাই, বেতনকাঠামো নির্ধারণ করে, ওই সাপেক্ষে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত করা হোক।
যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার আমলা গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসেবে পান মাসিক ৪৫ হাজার টাকা। জনগণের করের টাকায় আমলারা যদি এ সুবিধা পেতে পারেন, তাহলে অন্যরা কেন পাবেন না? শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আট বছর চাকরির পর শুল্কমুক্ত গাড়ি কিনতে পারেন, যা পাঁচ বছর অন্তর নবায়নযোগ্য।
আমরা শিক্ষকদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার কথাই শুধু বলছি না, শিক্ষকদের জবাবদিহির দিকেও নজর রাখা উচিত। ২০১৫-উত্তর বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের এজেন্ডায়ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন?
অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল: সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও মহাসচিব, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন
0 comments:
Post a Comment