Wednesday, August 5, 2015

গবেষণায় অর্থ ব্যয় করে না ১০ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

সাইফ সুজন | ২০১৫-০৮-০৫ ইং


গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, ধারণ ও বিতরণ— এই হলো উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আর বিষয়ানুগ গবেষণার ক্ষেত্রে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার চিত্র অত্যন্ত নাজুক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনই
(ইউজিসি) বলছে, ২০১৩ সালে দেশের মোট ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টিই গবেষণার পেছনে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। আর কোনো গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি, এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫টি। তাই গবেষণাবিহীন শিক্ষার মাধ্যমে সনদধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেও তৈরি হচ্ছে না দক্ষ জনশক্তি, এমনটাই বলছেন শিক্ষাবিদরা।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. অজয় রায় এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে স্লোগানে স্লোগানে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। আর দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয় না বা গবেষণা ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয় না, সেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে না; সেগুলোর মান কলেজ পর্যায়ের।’
চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এটি দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও। অথচ চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণার জন্য ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক রুহুল আমিন ভূইয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে ব্যয় করা না হলেও ইউজিসির উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়া বার্ষিক বাজেটে গবেষণা খাতে খুব কম বরাদ্দ দেয় ইউজিসি।
বস্ত্র শিল্পে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে পোশাক শিল্পের অগ্রগতির লক্ষ্যে আধুনিক মানের টেক্সটাইল প্রকৌশলী গড়ে তুলতে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। গবেষণা খাতে কোনো ব্যয় ও বরাদ্দও নেই তাদের। তাই বাস্তবায়ন হয়নি কোনো ধরনের গবেষণা প্রকল্প।
গবেষণা খাতে অর্থ ব্যয় না হওয়ার কথা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গবেষণা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিষয়। গবেষণা খাতে কোনো অর্থ ব্যয় না হওয়াটা আসলে দৃষ্টিকটু। শিক্ষকরা বিদেশ থেকে গবেষণা করে আসেন। তবে দেশে ফিরে শিক্ষকরা ওভাবে আর গবেষণা করেন না।’
প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগার থেকে গবেষণায় কোনো অর্থ ব্যয় করেনি প্রাণিসম্পদ বিষয়ে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
গবেষণায় ব্যয় না করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস মাহফুজুল বারী বলেন, ইউজিসি বার্ষিক যে বাজেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদন দেয়, তা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই শেষ হয়ে যায়। ফলে মোট বরাদ্দে গবেষণার জন্য আর উল্লেখযোগ্য অংশ থাকে না।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গবেষণা খাতে কোনো অর্থই ব্যয় হয়নি, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আরো রয়েছে— ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি।
প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বরাদ্দ, শিক্ষকদের গবেষণার চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস গ্রহণ, কনসালট্যান্সি ও প্রেষণে অন্যত্র চাকরির প্রতি আগ্রহ, গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন না করাকেই এর কারণ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে। সবাই এখন ডিগ্রি অর্জনের দিকে ঝুঁকছে; গবেষণার দিকে নয়। অথচ জ্ঞান সৃষ্টি হয় গবেষণার মাধ্যমে। ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ালেই শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হয় না। শিক্ষকরা বেশির ভাগ সময় শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকেন। অবসরে গবেষণা করার কথা থাকলেও অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে থাকেন। এছাড়া গবেষণা করার জন্য মানের শিক্ষকের সংখ্যাও অপ্রতুল।’
দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছরই খোলা হচ্ছে নতুন নতুন বিভাগ। বাড়ছে শিক্ষক সংখ্যাও। তবে এর কোনো সুপ্রভাবই দেখা যাচ্ছে না গবেষণা ক্ষেত্রে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। নেই আন্তর্জাতিক মানের কোনো প্রকাশনাও।
ইউজিসির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে গবেষণা খাতে সর্বাধিক ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা প্রকল্প পরিচালনায় মোট ২ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করে এ বিদ্যাপীঠ, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১ শতাংশেরও কম। দ্বিতীয় সর্বাধিক ১ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। গবেষণা প্রকল্পের দিক দিয়েও এগিয়ে রয়েছে বাকৃবি। এর গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা ১৩৬টি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) গবেষণার জন্য ব্যয় করেছে মাত্র ৫৫ লাখ টাকা। আর বছরজুড়ে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বাস্তবায়িত গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা মাত্র ৭। গবেষণা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হলেও কোনো গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি এ বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণাকে উৎসাহিত করা না হলেও কিছু আগ্রহী শিক্ষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করছেন। এসব গবেষণা বিশ্বের নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এ ধরনের আগ্রহী শিক্ষক সংখ্যায় কম হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের গবেষণা খাত আরো সমৃদ্ধ হবে।
Source: http://www.bonikbarta.com/news/details/45094.html

0 comments:

Post a Comment