Tuesday, August 11, 2015

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন অস্থির না হয়

  • ড. আনন্দ কুমার সাহা
ড. শামসুজ্জোহা নামটি অনেকের কাছে পরিচিত। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি। ড. জোহার আত্মাহুতির মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলন বেগবান হয়। বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ড. জোহা। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ শিক্ষক যেমন- প্রফেসর ড. সাইদুর রহমান খান, প্রাক্তন উপাচার্য,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, যিনি পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন; প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান, প্রাক্তন উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; প্রফেসর মলয় কুমার ভৌমিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব; প্রফেসর ড. চৌধুরী সরওয়ার জাহান, বর্তমান উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; প্রফেসর ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার, প্রাক্তন ছাত্র উপদেষ্টা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, গণযোগাযোগ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক নির্যাতিত হন। এমনিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ প্রথিতযশা শিক্ষক সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতার হন এবং তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের শিক্ষকরা এক দিনের গণছুটি নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামে যুব সম্প্রদায় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষকরা যে ভূমিকা গ্রহণ করেন অন্যদের সে ভূমিকায় দেখা যায় না। পেশাগত কারণে তাঁরা হয়ত আসতে পারেন না- এটা ঠিক, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্যান্য পেশার অনেকে তাঁদের নিজেদের রং পরিবর্তন করতে দ্বিধা বোধ করেন না।
সুকৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরাসরি সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে কেন? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ বানানোর একটা অপচেষ্টা করা হয়েছিল, যা সফল হতে পারেনি। ৮ম বেতন স্কেল নিয়ে ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তা অঙ্কুরেই বিনাশ করা উচিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছেন। আমরা আশা করি তিনি সঙ্কট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে বার এ্যাসোসিয়েশন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ জাতীয় রাজনীতিতে একটা ভূমিকা রাখেন। শিক্ষকতা পেশায় থেকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, এটা অনেকেই ভাল চোখে দেখেন না। তাছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক অসন্তোষ এবং কোন কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত। এমনিভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০-২৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করে। সেখানে সংঘর্ষ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, যদিও এটা আমাদের কাম্য নয়। সেনাবাহিনী, বিজিবি, কিংবা ক্যাডার সার্ভিসে চেন অব কমান্ড থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত মনের চিন্তা বিকাশের জায়গা। আমরা হয়ত কেউ কেউ ’৭৩ এ্যাক্টের অবমূল্যায়ন করে থাকি, সেটাও আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ৮ম বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যে অবমূল্যায়ন বা মর্যাদাহানি করা হয়েছে, সেটাও প্রত্যাশিত নয়। এর পেছনে কি অন্য কারণ রয়েছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন তুলনামূলকভাবে শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এই শান্ত পরিবেশের পেছনে সরকারের যেমন ভূমিকা, ঠিক তেমন ভূমিকা রয়েছে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের। জানি না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অশান্ত করার কোন ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত চলছে কি না?
যারা সরকারি চাকরি করেন, স্বাভাবিকভাবেই তাদের বেতন স্কেল গ্রেডে থাকা উচিত। শুধুমাত্র জনপ্রতিনিধি যেমন মন্ত্রী, এমপি মহোদয়রা বেতন স্কেলের বাইরে থাকতে পারেন। একই বেতন স্কেলে থেকেও অনেকে যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা হয়ত অন্যরা পান না। এভাবেই অনেক সরকারী কর্মকর্তার মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। যেমন, বলা যেতে পারে কেবিনেট সেক্রেটারি বা মুখ্যসচিবই তাঁদের মর্যাদা কি সচিবের সমমান? নিশ্চয় নয়। বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা বেতন স্কেলের মধ্যে থেকেও যে সুযোগ-সুবিধা পান, সেই সুযোগ অন্যরা পান না। এমনিভাবে একই গ্রেডে রেখেও পার্থক্য করা যায়।
বেতন ও চাকরি কমিশন প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে ১৬টি বেতন স্কেল/গ্রেড এর প্রস্তাব করে। সচিব কমিটি আগের মতো ২০টি গ্রেডই রেখে দেয় এবং সিনিয়র সচিব, পদায়িত সচিব/সচিব এর পদ গ্রেডের বাইরে রাখে- যা অনাকাক্সিক্ষত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ধরনের বৈষম্যমূলক প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য পেশাজীবীর স্বার্থ ক্ষুণœকারী; এই বেতন কাঠামো শিক্ষকসমাজের কাছে তাই কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পৃথিবীর যে সকল দেশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেশি করেছে, সে সকল দেশ আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্য সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ় অবস্থানে রয়েছে এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব প্রদান করছে। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। হয়ত সে কারণে শিক্ষা খাতে কাক্সিক্ষত গুণগত পরিবর্তন আজও আসেনি, যদিও ঝরে পড়ার হার কমেছে এবং পাসের হার বেড়েছে। তবে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে গুণগত কোন পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায় আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে-
১. অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তন করা হোক;
২. শিক্ষকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যবর্তী সময়ে ঘোষিত বেতন কাঠামো পুনঃনির্ধারণ করে সকল বৈষম্য দূরীকরণপূর্বক সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা সিনিয়র সচিবের সমতুল্য করা; অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা পদায়িত সচিবের সমতুল্য করা, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতন কাঠামো ক্রমানুসারে নির্ধারণসহ শিক্ষকদের যৌক্তিক বেতন স্কেল নিশ্চিত করা হোক;
৩. রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে আমাদের প্রত্যাশিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী পদমর্যাদাগত অবস্থান নিশ্চিত করা হোক।
সমাজে একজন শিক্ষক কতটুকু সুবিধা ভোগ করেন? নিজের ঘরে নিজেকে চা তৈরি করতে হয়, পেয়ালা-পিরিচ অনেক সময় নিজেকে পরিষ্কার করতে হয়। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার সরকার থেকে কতটুকু সুবিধা পান? একজন ইমেরিটাস প্রফেসর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি সুবিধা গ্রহণ করেন? উল্লেখ করার মতো কোন সুবিধাই পান না। ক্যাম্পাসে থাকলে বাসা ভাড়া কেটে নিলে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা। 
দু’টি সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মেটানোর পরে সংসার চালানো কষ্টকর। নিজের যোগ্যতায় বিদেশ থেকে পিএইচ.ডি করার সময় যে অর্থ সঞ্চয় হয়, তা দিয়ে হয়ত একটি গাড়ি হয়, কিন্তু ড্রাইভার রাখা যায় না। কিন্তু একজন প্রফেসরের সমান যোগ্যতা নিয়ে অন্য পেশায় যারা থাকেন, একবার তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সেনাবাহিনী ইত্যাদি পেশায় যারা থাকেন- তাদের তুলনায় শিক্ষকরা আর্থিকভাবে কতটা সচ্ছল? কিন্তু সমাজে আমাদের যে মর্যাদা ছিল, আমরা যেমন কিছুটা নষ্ট করেছি, অন্যদিকে জোর করে প্রস্তাবিত অষ্টম পে-স্কেলে শিক্ষকদেরকে তিন ধাপ নিচে নামিয়ে মর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল প্রভৃতি দেশে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিলেন স্বতন্ত্র পে-কমিশন গঠন করে শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকবৃন্দ এখনও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো আশা করেন। শিক্ষকদের বঞ্চিত করে জাতির উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা কোনভাবেই সম্ভব নয়। 
বাংলাদেশের জনগণের আস্থার একটি জায়গা- জননেত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষকবৃন্দ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত দাবি এবং মর্যাদা অক্ষুণœ থাকবে- এটা প্রত্যাশা করে। আমরা যেমন মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছি, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছি। নিঃসন্দেহে অধিকার নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি উত্থাপন করতে পারি এবং তিনি আমাদের মর্যাদা রাখবেন বলে বিশ্বাস করি।

লেখক : প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও 
সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: http://www.dailyjanakantha.com/news_view_top.php?p=details&csl=128291

0 comments:

Post a Comment