ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে তিনটি দাবি পেশ করে আসছিল। এগুলো হলো :এক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদাদান, দুই. শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান এবং তিন. পদমানক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক স্থান নির্ধারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ কর্তৃক দাবিগুলো উত্থাপিত হলেও এগুলো যে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকেই উত্থাপিত; তা না উল্লেখ করলেও চলে। অষ্টম জাতীয় বেতন কমিশন এবং সচিব কমিটি কর্তৃক যে প্রস্তাব সম্প্রতি উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে উলি্লখিত তিনটি দাবিই
উপেক্ষিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবস্থানকে কয়েক ধাপ অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে নিচেও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজকের আলোচনা সে বিষয় নিয়েই।
২০০৫ সালে ষষ্ঠ এবং ২০০৯ সালে সপ্তম বেতন স্কেল ঘোষিত হয়েছিল। ষষ্ঠ বেতন স্কেলে ১ম, ২য় এবং ৩য় গ্রেডের বেতন নির্ধারিত হয়েছিল যথাক্রমে ২৩,০০০, ১৯,৩০০ এবং ১৬,৮০০ টাকা। আর সপ্তম বেতন স্কেলে ওই গ্রেডগুলোর বেতন নির্ধারিত হয়েছিল যথাক্রমে ৪০,০০০, ৩৩,৫০০ এবং ২৯,০০০ টাকা। স্কেল দুটিতে গ্রেডগুলো প্রযোজ্য হয়েছিল যথাক্রমে সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম সচিব কর্মকর্তাদের জন্য। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও সমতুল্য পদগুলোর জন্য ষষ্ঠ স্কেলে ১ম গ্রেড ২৩,০০০ টাকার সঙ্গে ১,৫০০ টাকা যোগ করে ২৪,৫০০ টাকা এবং সপ্তম স্কেলে ১ম গ্রেড ৪০,০০০ টাকার সঙ্গে ৫,০০০ টাকা যোগ করে ৪৫,০০০ টাকা মূল বেতন নির্ধারিত হয়েছিল। ফলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবসহ সমপদাধিকারীরা অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পেলেও ১ম গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদার সমস্তর এবং ১ম গ্রেডের পর্যায়ভুক্তই ছিলেন। সমতুল্য পদের পর্যায়ভুক্ত থাকায় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানরা অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পেলেও তারাও ১ম গ্রেডেরই পর্যায়ভুক্ত ছিলেন। ষষ্ঠ এবং সপ্তম বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ ছিলেন তিনটি গ্রেডভুক্ত :এক. অধ্যাপক পদে নিযুক্তির সময় ৩য় গ্রেড, দুই. কয়েক বছর পর টাইম স্কেল প্রাপ্তি সাপেক্ষে ২য় গ্রেড এবং তিন. ২য় গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠ এক-চতুর্থাংশ সিলেকশন গ্রেড প্রাপক হিসেবে ১ম গ্রেড। অর্থাৎ বিগত স্কেল দুটি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকবৃন্দ মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান এবং সচিবদের সমস্তরের, যদিও সচিব ভিন্ন অন্যরা আর্থিক দিক থেকে কিয়ৎ পরিমাণে অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে এসেছেন। পদমানক্রমেও তারা জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের ওপরে ছিলেন। আর্থিক দিক থেকে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকবৃন্দ সচিবদের সমস্তরের। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বিগত সময়ের গুটিকয়েক সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের অবস্থান উলি্লখিতদের তুলনায় অধঃপতিত হয়েছে এবং অষ্টম জাতীয় বেতন কমিশন এবং সচিব কমিটির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আরও অধঃপতিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। বর্তমান বেতন স্কেল কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে এই অধঃপতনও চূড়ান্ত হবে।
এবার সে দিকটা দেখি। কয়েক বছর আগে মেজর জেনারেল এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর সমতুল্যরা ছিলেন যতদূর জানা আছে, জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের সমমর্যাদাসম্পন্ন। লে. জেনারেল ও জেনারেল পদ সৃষ্টি এবং সামরিক বাহিনীর পদমানক্রম উন্নয়নের ফলে ব্রিগেডিয়ার এবং সমপদাধিকারীরা জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের সমমর্যাদার অধিকারী হন। অর্থাৎ অধ্যাপকবৃন্দ মেজর জেনারেলদের থেকে এক ধাপ নিচে নেমে যান, বেতনেও স্বাভাবিভাবেই পড়ে এর প্রতিফলন।
বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হওয়ার পূর্বে, যতদূর জানি, জেলা জজবৃন্দ সহযোগী অধ্যাপক (উপসচিব), হাইকোর্টের বিচারপতিবৃন্দ অধ্যাপক (নিযুক্তিকালীন ৩য় গ্রেড, যুগ্ম সচিব) এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের (সচিব) পদমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। বিচার বিভাগে কর্মরতদের জন্য পরবর্তী পর্যায়ে স্বতন্ত্র এবং উচ্চতর বেতন স্কেল প্রবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ তাদের তুলনায় পূর্ব অবস্থান থেকে অধঃপতিত হয়ে পড়েন। সম্প্রতি বিচার বিভাগ প্রদত্ত এক জাজমেন্টের ফলে তাদের পদমানক্রমও উন্নততর হয়ে ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের অবস্থান তাদের পূর্বাবস্থানের তুলনায়ও নিম্নগামী হয়ে পড়ে।
বছরাধিককাল আগে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে সচিবদের একটি অংশ জ্যেষ্ঠ সচিব পদে অধিষ্ঠিত হন। ফলে সচিবদের ওই অংশটি জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের থেকে সুপিরিয়র বনে যান।
ড. ফরাসউদ্দিন কমিশন যে প্রস্তাব করেছে, তাতে ১৬টি গ্রেডের কথা বলা হলেও কৌশলের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে গ্রেড করা হয়েছে ১৮টি। ১ম গ্রেডকে সচিবদের জন্য রেখে এর ওপরে আরও দুটি বিশেষ ধাপ রাখা হয়। এ দুটির প্রথমটি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব এবং সমতুল্যদের (কমিশন-প্রস্তাবিত মূল বেতন ১ লাখ) এবং দ্বিতীয়টি জ্যেষ্ঠ সচিবদের (কমিশন-প্রস্তাবিত মূল বেতন ৯০,০০০)। এ ধরনের প্রস্তাব শুভঙ্করের ফাঁকি এবং মানুষকে বোকা বানানোর নামান্তর বৈ আর কিছুই নয়। বিশেষ দুটি ধাপ কি প্রকারান্তরে উচ্চতর দুটি গ্রেডই নয়? ১ম গ্রেডের ওপরেও কি গ্রেড থাকে? যে ছেলেটি পরীক্ষায় ১ম হলো, তার থেকেও কি ভালো ছাত্র থাকে? ব্যাপারটি স্পষ্ট করা যাক। ষষ্ঠ এবং সপ্তম বেতন স্কেলে ১ম গ্রেডের ওপরে কোনো ধাপ বা গ্রেড ছিল না। ওই দুই স্কেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব এবং সমতুল্যদের মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ম গ্রেডের সঙ্গে যথাক্রমে ১,৫০০ টাকা এবং ৫,০০০ টাকা যোগ করে। অর্থাৎ আর্থিক অতিরিক্ত কিছু সুবিধা পেলেও তারা ছিলেন ১ম গ্রেডভুক্তই। কিন্তু এবারের স্কেলে তাদের মূল বেতন ১ম গ্রেডের ৮০,০০০ টাকার সঙ্গে ২০,০০০ টাকা যোগ করে ১ লাখ টাকা নির্ধারিত হয়নি; নির্ধারিত হয়নি ৪০,০০০ টাকার সঙ্গে ১০,০০০ টাকা যোগ করে জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য মূল বেতন ৯০,০০০ টাকাও। ফলে এ দুটি ধাপ প্রকৃতপক্ষে দুটি পৃথক গ্রেডই হয়ে উঠেছে। এই বিচারে কমিশন-প্রস্তাবিত ১ম গ্রেডটি প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় গ্রেড। ভবিষ্যতে যে শিক্ষক অধ্যাপক পদে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় ৩য় গ্রেডে নিযুক্ত হবেন, কমিশন কর্তৃর্ক টাইম স্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড বাতিলের সুপারিশ করায় ২য় এবং ১ম গ্রেড দুটি সেই অধ্যাপক পাবেন না। ফলে তিনি সারাজীবন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায়ই অধিষ্ঠিত থাকবেন। কমিশন প্রকৃতপক্ষে অধ্যাপকদের চার ধাপ নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
সচিব কমিটি যা করেছে, তা আরও খারাপ। কমিশন-প্রস্তাবিত ১ম গ্রেডের সচিব পদকে দুই টুকরো করে প্রথমটিকে বানিয়েছে অত্যদ্ভুত প্রকৃতির পদায়িত সচিব, যার জন্য বেতন প্রস্তাব করা হয়েছে বিশেষ ধাপের তৃতীয় ধাপ, দ্বিতীয়টিকে রাখা হয়েছে ১ম গ্রেডে। এই কমিটির প্রস্তাবে গ্রেড হয়ে পড়েছে প্রকৃতার্থে বিশেষ ধাপের ৩টিসহ মোট ২৩টি এবং অধ্যাপকবৃন্দ পাঁচ ধাপ অবনমিত হয়ে চলে গেছেন ষষ্ঠ ধাপে, যা প্রস্তাবিত দৃশ্যমান গ্রেডগুলোর ৩য় গ্রেড।
তার মমার্থ এই যে, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, কমিশন, সামরিক-বেসামরিক আমলা প্রভৃতি কর্তৃক গৃহীত নানা সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ক্রমাগত মর্যাদা হারিয়েছেন ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং আরও মর্যাদা হারানো ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখে পড়ে গেছেন। এর পরও এ কথা বলতেই হয় যে, বিষয়টি যতটা না বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের বেতন সংক্রান্ত, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে মর্যাদা রক্ষার। এ জন্যই কাম্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ-উত্থাপিত দাবিকে সম্মান জানিয়ে বেতন স্কেল পুনর্নির্ধারণ করা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদাদান প্রশ্নে কমিশনের যে বক্তব্য, তা প্রবল আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে_ এক. স্বতন্ত্র স্কেল প্রদানে বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থেকে পনেরোই আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণে সমর্থ হতেন, তাহলে সে দিনই এটি 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' ঘোষিত হয়ে বিশেষ মর্যাদায় সম্মানিত হতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং একজন আমলার মধ্যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে, প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে মেধার। যে যোগ্যতা (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর কমপক্ষে একটি অথবা উভয়টিতেই প্রথম শ্রেণী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১ম, ২য় বা তৎপরবর্তী স্থান এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি) নিয়ে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হন, তার থেকে নিম্নতর যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিযুক্ত হন সিংহভাগ আমলা। এ জন্যই সর্বোচ্চ মর্যাদা এবং অর্থ প্রাপ্য শিক্ষকদেরই।
এই পর্যায়ে রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে :রাষ্ট্র কি জ্ঞান ও যোগ্যতাভিত্তিক একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার দিকে, নাকি আমলা স্বার্থমুখী সমাজব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারপ্রধানকেই, যিনি শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে শতভাগ বরাভয় দিতে পারেন সেই শিক্ষক সমাজকে।
স অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Source: http://www.samakal.net/2015/07/03/147159
0 comments:
Post a Comment