২০০৮ সালে মহাজোটভুক্ত দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করা। মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ অনেকেই শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। সে ঘোষণার বাস্তবায়ন তো নেই, বরং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবনতি সাধন করা হচ্ছে। বিশ্বে উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত অনেক রাষ্ট্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো রয়েছে। বাংলাদেশেই ভিন্ন চিত্র।
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে এই বৈষম্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বহু রকম সীমাবদ্ধতা নিয়ে চাকরি করেন। এর সঙ্গে করে যুক্ত হলো নতুন বঞ্চনা। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার নতুন সুবিধা যোগ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সারাজীবনে তিনটি পদোন্নতি হয়। প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা পদোন্নতি পান সাতবার। সহকারী কমিশনার পদে যোগ দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এখন আবার সচিবের পর সিনিয়র সচিব। এতগুলো ধাপ থাকার কারণে তাদের চাকরিতে সিনিয়র স্কেল, সিলেকশন গ্রেড কোনো কিছুর তেমন প্রয়োজন হয় না। এখন পদ শূন্য না থাকলেও পদোন্নতি ব্যবস্থার কারণে তুলনামূলক কিছুটা কম বয়সে সচিব পর্যন্ত হতে পারবেন এ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। সচিবরাও যেন একই পদে বেশি দিন না থাকেন সে জন্য সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সিনিয়র স্কেল কিংবা সিলেকশন গ্রেড প্রয়োজন হয় তাদের, যাদের একই পদে অনেক দিন থাকতে হয়।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বর্তমান বেতন কাঠামোতে (যেহেতু নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হয়নি) ২৯ হাজার টাকা মূল বেতন পান। এরপর একটি টাইম স্কেল পেয়ে ৩৩ হাজার ৫শ' টাকায় উন্নীত হন। প্রত্যেক বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপকরা তাদের এক-চতুর্থাংশ সিলেকশন গ্রেড পেয়ে ৪০ হাজার টাকায় উন্নীত হন। সচিবরা এই গ্রেডে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ১৭ নম্বর ধাপে, সিলেকশন গ্রেড পাওয়া অধ্যাপকরা ১৯ নম্বর ধাপে এবং অধ্যাপকরা ২২ নম্বর ধাপে। এটারও সংশোধন প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বেতন স্তরের সঙ্গে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স পুনর্গঠন করা উচিত। বর্তমান বেতন কাঠামো থেকে টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়া হলে এবং সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চার ধাপ নিচে নামানো হবে এবং তারা সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকের পদে উন্নীত হতে পারবেন না।
প্রশাসন ক্যাডারে যারা চাকরি করেন তাদের অনেকের স্কুলিং মাত্র ১৪ বছরের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্কুলিং ১৬ বছরের নিচে নেই। শুধু তাই নয়, এসব শিক্ষকের অনেকেরই রয়েছে দেশ-বিদেশের ৩-৪ বছর মেয়াদি উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা। প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এখনও ৬ বছর বেশি চাকরি করেন। তাহলে বেশি স্কুলিং, উচ্চতর ডিগ্রি এবং বেশি সময় চাকরি করেও সম্মান বিবেচনায় নিচে থাকতে হবে কেন? চাকরিতে উচ্চতর বেতন কাঠামো যারা পান তার জন্য কিছু যৌক্তিক কারণ প্রয়োজন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে সবচেয়ে উঁচুতে রাখতে হবে, এ রকম কি কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে? বরং সে দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা করতে পারেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য যে যোগ্যতা চাওয়া হয় তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা দেশের আর কোনো চাকরিতেই চাওয়া হয় না। বর্তমানে যারা প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করেন, তাদের শতকরা ১০ শতাংশেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আবেদনের শর্ত পূরণ করতে পারবেন কি-না সন্দেহ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের যোগ্যতা ছিল প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির আবেদনের। এই বাস্তবতার নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপরে আর কারও বেতন হওয়া সমীচীন নয়।
ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকারের বেশি প্রয়োজন প্রশাসন বিভাগ। এর অন্যতম কারণ, আমাদের দেশে এখন রাজনীতি করেন ব্যবসায়ী কিংবা সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা। ব্যবসায়ীরা যখন মন্ত্রী হন তখন তারা মন্ত্রণালয় পরিচালনায় বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন আমলাদের ওপর। নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকতে তাদের প্রয়োজন হয় আমলাদের ওপর নির্ভরতা। প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার কথা ছিল পিরামিডের মতো। কিন্তু এখন পিরামিড উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা। পদ শূন্য থাকুক আর না-ই থাকুক পদোন্নতি চলছেই। একজন জেলা প্রশাসক যদি পদোন্নতি পেয়ে থাকেন এবং পদায়ন না হয় তাহলে তিনি লেখেন জেলা প্রশাসক (যুগ্ম সচিব)। কারণ জেলা প্রশাসক পদটি উপসচিব পর্যায়ের। এ বছর যে নতুন পে স্কেল দেওয়া হচ্ছে, সেখানে সিনিয়র সচিব বলে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সিনিয়র সচিব থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। এই পদ সৃষ্টি করতে হলে প্রজাতন্ত্রের সব বিভাগের কর্মকর্তাদেরও একইভাবে পদের উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
মহাজোট সরকার উচ্চশিক্ষা কমিশন গড়ার কাজে হাত দিয়েছিল। এর মাধ্যমে সেখানে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় থাকার কথা ছিল। কমিশন করা সম্ভব হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেতে হতো না। যতদূর জানা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বাধার মুখে এ কাজ মুখ থুবড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয় হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ছাত্র অবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন, গ্রেফতারও হন। আর তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানের অবনমন হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সরকারের নতুন বেতন কাঠামোর পুনর্গঠনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংগঠিত আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পক্ষে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করা হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো সংস্কারের দাবি জানিয়েছে। সংগঠনের পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী-অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধানমূলক সিদ্ধান্ত হয়নি। অষ্টম বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণসহ স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করার দাবিতে আন্দোলন চলছে। সরকারের উচিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া। মেধাবীদের আকৃষ্ট করা যায় এমন বেতন কাঠামো করা না হলে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাবিমুখ হবেন। সেটা জাতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। তবে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে স্বতন্ত্র বেতন প্রদান।
Source: http://www.samakal.net/2015/08/22/156816
0 comments:
Post a Comment