Kamrul Hassan
শিক্ষক বনাম সরকারের সচিব বা মহা-করনিক বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কটা কোন অবস্থাতেই কাঙ্খিত তো নয়ই বস্তুত এইটা অসুস্থ সমাজের একটা বহির্প্রকাশ। প্রশ্ন হলো এই বিতর্কের উদ্ভব হলো কিভাবে? আর উদ্ভব হলো তো এটাকে জিইয়ে রাখল কারা? এই অসুস্থ বিতর্কের জন্ম এবং তাকে লালন করছে ওই মহা-কারনিকরা। আর আমাদের সরকার এই কুবিতর্ক থেকে মজা লুটছে। তারা পারে এক তুড়িতে এই বিতর্ককে থামিয়ে দিতে কিন্তু ঐযে মজা লওয়ার বাসনা নিবৃত্ত করতে পারে না। প্রশ্ন হলো শিক্ষক বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে শিক্ষক কারা হন। নির্ধিধায় সকলে এক বাক্যে স্বিকার করবে যে সাধারণত ক্লাসের সেরা ছাত্রের স্বপ্ন থাকে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে, জ্ঞানন্নেষণে বিদেশ যাবে পিএইচডি, পোস্ট-ডক্টরাল করবে, গবেষণা করে জ্ঞান তৈরী এবং বিতরণ করবে। শিক্ষকতাই একমাত্র পেশা যার মাধ্যমে একজন শিক্ষক প্রতিদিন প্রতিনিয়ত জ্ঞানন্নেষণে ব্রত থাকবেন। অর্থাৎ শিক্ষক মানেই হলো তার জ্ঞান স্ট্যাটিক না। মনে রাখতে হবে বদ্ধ জলাশয়ের পানি দুর্গন্ধ ছড়ায় তেমনি যে মানুষের জ্ঞান স্ট্যাটিক সময়ের সাথে পরিবর্তন হয় না তারা পঙ্কিলতা ছড়াবে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। আমাদের সমাজের আমলারা ঠিক সেই কাজটিই করছে। কি প্রয়োজন ছিল ছল চাতুরী করে নিজেকে উপরে উঠিয়ে অন্যকে নিচে নামানোর চেষ্টা করার? ব্রিটিশ কলোনিয়াল সময়ে এবং স্বাধীনতার পূর্বেও কিছু ভালো ছাত্র শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে প্রশাসন বা মহা-করনিক হতে চেয়েছেন। সেটা চেয়েছিলেন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তখন আমরা নির্যাতিত এবং বঞ্চিত ছিলাম। আমরা ক্রমাগত দেখতাম মহা-কারনিকদের দাপট। এই প্রেক্ষাপটে কিছু ছাত্র শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্যেও মহা-করনিক হতে চেয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞান ফেকাল্টির সেরা ছাত্র যার শিক্ষক হার যোগ্যতা ছিল সেটা ছেড়ে মহা-করনিক হয়েছেন এরকম আমার জানা নেই। কয়েকজনকে জানি যারা ভালো ছাত্র ছিলেন বটে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন না।
আমরা জানি একজন ভালো ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পিএইচডি বা উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কলারশিপ নিয়ে উন্নত দেশে যান। বিদেশে চার-ছয় বছর সে শুধু যে বিষয়ে গবেষণা করে তাই শিখে না। সে সুযোগ পায় বিশ্বের নানা দেশের স্কলার থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তের নানান ধর্মের মানুষদের সাথে মেশার সুযোগ। এই ৪-৬ বছরের মধ্যে জ্ঞানের পরিবর্তনের হার সাংঘাতিক high হয় ফলে সে যখন দেশে ফিরে আসে তার বাবা-মাই চিনতে পারে না তাদের ছেলে বা মেয়েকে। আর ওই সময়ে আমাদের মহা-করনিকরা সাভারের PADC-তে মহা-করনিক হওয়ার ট্রেনিং নেন আর সেটাও দেন কোন না কোন শিক্ষক। এই ট্রেনিং-এর পর তাদের জ্ঞানের পরিধি খুব সামান্যই বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ট্রেনিং-এর মাধ্যমে একটা কাজই তারা ভালোভাবে লব্ধ করে সেটা হলো কিভাবে এবং কতরকম ভাবে মানুষকে হয়রানি করা যায়। অর্থাত হয়রানিকে তারা তাদের ক্ষমতা মাপার হাতিয়ার হিসাবে মনে করে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি যতগুলি প্রতিষ্ঠান তাদেরকে দেওয়া হয়েছে প্রচালনার জন্য তার প্রত্যেকটি ব্যর্থ যেমন বিমান, যেমন পাটকল, চিনিকল ইত্যাদি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের নাম নেওয়া যাবে। এমন কি আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার হলো আমাদের এটমিক এনার্জি কমিসনও মন্ত্রনালয়ের আন্ডারে আর তাই এটার পারফরমেন্সও পৃথিবীর এমন যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে তাদের মধ্যে এর অবস্থান প্রায় শেষের দিকে। যা বলছিলাম একজন সরকারী আমলার চাকুরী পাওয়ার দশ বছর পরও যদি এই দশ বছরে তার জ্ঞান বৃদ্ধি কতটুকু বেড়েছে মাপা হয় আমার ধারণা এটা প্রায় শুন্যের কোঠায়। যতটুকু বেড়েছে ওটা বেড়েছে due to অভিজ্ঞতা।
একজন মানুষের সম্মান এবং সম্মানী নির্ধারণ করা উচিত তার কাজ এবং সময়ের সাথে তার জ্ঞানের পরিবর্তনের হার দেখে। যে আমলা চাকুরীর ন্যুনতম যোগ্যতা অর্জন করেন কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অর্থাত তার অর্জিত জ্ঞান আসে একঝাক শিক্ষকের কাছ থেকে আর আজ সেই শিক্ষককেই বলছে তুমিতো আমার নিচে। ওই যে বললাম এধরনের উদ্ভট চিন্তা আসে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সিটি থেকে। No wonder that they suffer from inferiority complex. মানুষের প্রাপ্ত ক্ষমতা এবং লব্ধ জ্ঞান যখন commensurable না হয় তখনি এরকম inferiority complex আসতে বাধ্য। আমাদের দেশে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের ইউনিয়ন আছে। এসব ইউনিয়নের যারা নেতৃত্ব দেন তারা এক বিশাল কর্মচারীর সমিতিকে রেপ্রেসেন্ট করেন। ফলে তারা ধরে নেন তাদের বিশাল ক্ষমতা। তারা ক্ষমতাটা বুঝতে পারেন কিন্তু এত বড় ক্ষমতা ডিসচার্জ করার মত ক্ষমতা তাদের আছে কিনা এটা মেজার করার মত ক্ষমতা তাদের নেই। আর তাই অনেক সময় তাদের উপরের কর্মকর্তাদের আদেশ নিষেধ সহ অফিসের দেকরাম মানতে চান না ফলে বিশৃঙ্খলা নিশ্চিত আর হচ্ছেও তাই।
গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে এবিষয়ে এক সরকারী কর্মকর্তার লেখা পড়লাম। পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম: এত সীমাবদ্ধ তোমাদের জ্ঞান!!! উনি লিখেছেন,
"বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স তৈরি করা হয়। এই বিপুল উচ্চশিক্ষিত নাগরিকদের কী কাজে লাগানো হবে? কী হবে তাদের কর্মক্ষেত্র? তাদের অর্জিত ডিগ্রি অনুযায়ী কাজ তারা পাবে কিনা? এসব বিষয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়া উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরির এই আত্মঘাতি প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পরিকল্পনা কখনই নেয়া হয়নি! কী হাস্যকর! সারা পৃথিবীর টপ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নাই, গবেষণা নাই, সৃজনশীল উদ্যম নাই, ছোট্ট একটা দেশ হুট করে মানবিক ও কলা বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে ৪ নম্বর পজিশন পাওয়াটা আমার কাছে অস্বস্তিকর!"
ওই কর্মকর্তা যা লিখেছেন তাতে উনার জ্ঞানের দৈন্যতারই বহির্প্রকাশ ঘটেছে। প্রথমত উনি উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরিকে আত্মঘাতি প্রক্রিয়া মনে করেন। সত্যিকারের উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ বেকার থাকতে পারে না। কারণ সে তার লব্ধ জ্ঞান দিয়ে কোন না কোনভাবে self-employed হওয়ার ব্যবস্থা করবেই। সে শুধু নিজে কিছু করবে না বরং অন্য অনেকের কর্মসংস্থানও করবে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের যতটুকু উন্নতি হয়েছে তার কৃতিত্ব কিন্তু অনেকাংশে উচ্চশিক্ষিত বেকারদেরই দিতে হবে। তারা যদি সবাই আমলার চাকুরী পেয়ে যেতেন তাহলে আমাদের এত vibrant NGO নেটওয়ার্ক হতো না, ব্যক্তিখাত এত উন্নতি লাভ করত না। বেকার থাকবে এই অজুহাত দিয়ে শিক্ষাকে সংকুচিত করার মানসিকতা কুপমুন্ডুকতা। কর্ম সংস্থান নেই এই অজুহাতে আপনি তাহলে চাচ্ছেন উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা কমাতে। আমরা যদি আপনার এই উপদেশ মানি সেটাই হবে আত্মঘাতি। আর পৃথিবীর টপ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নাই, গবেষণা নাই, সৃজনশীল উদ্যম নাই এগুলোর কারণও কিন্তু আপনারা অর্থাত আপনার মত আমলারা। আপনার কি জানা আছে টপ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট কত? আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট কত? আপনার কি জানা আছে টপ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কেমন, তাদের সুযোগ সুবিধা কেমন। আপনার বুঝতে হবে ইনপুট যেমন হবে আউটপুট তেমনি হবে। তারপরও বলব ওই টপ ৫০০
বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন একটিকে বেছে নিয়ে আমাদের যত টাকা বাজেট দেওয়া হয় সেই পরিমান দিয়ে দেখুন তারা আমাদের সমান বা তার কাছাকাছি আউটপুট দিতে পারে কিনা। এত স্বল্প ইনভেস্টমেন্ট-এও আমাদের বাংলাদেশের বিস্ববিদ্যালয়গুলো যতটুকু করছে সেটা সত্যিই মিরাকেল। সমালোচনা করার পূর্বে একটু ভাবুন। তুলনা করবার আগে চিন্তা করুন। আমাদের কাছেই কিন্তু আপনার সন্তানকে পাঠাতে হবে শিক্ষার জন্য। আমাদের ছোট করে আপনার সন্তান ভালো শিক্ষক পাবে না আর ভালো শিক্ষক না পেলে তারা সুসন্তান হবে আর না হলে আপনার জীবনটা যে ষোল আনাই মিছে হবে।
কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment