ড. মুনীর উদ্দিন আহমদ
গবেষণা প্রসঙ্গে একটু বলি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় প্রত্যেক শিক্ষককেই যথেষ্ট গবেষণা করতে দেখা যায় এবং তা প্রকাশিতও হয় বিভিন্ন জার্নালে। যদিও এসব প্রকাশনার গুণগত মান নিয়ে অনেকের মতো আমারও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের গবেষণা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচারে এসব প্রশ্ন ধোপে টেকেনি। আমি এমনও হতে দেখেছি- কোনোদিন ল্যাবে না গিয়ে শুধু শুভাকাক্সক্ষী সহকর্মীদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কেউ কেউ অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধের অথার হয়ে গেছেন। এসব শুভাকাক্সক্ষী সহকর্মী দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ কোনো গবেষণা না করা সত্ত্বেও কারও কারও নাম তাদের গবেষণা প্রবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের প্রমোশনে বা শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন উন্নতিতে সাহায্য করে আসছেন। অনেক বৈজ্ঞানিক শিক্ষক আবার এমন করিতকর্মা যে প্রতি দু-এক মাস অন্তর বিভিন্ন জার্নালে তাদের গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়। কোনো কোনো গবেষণা প্রবন্ধে অথার এবং কো-অথারের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যেতে দেখা যায়! সিলেকশন কমিটিতে শুধু একসেপটেন্স লেটার উপস্থাপনের মাধ্যমে আজকাল অনেকেই শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন বা পদোন্নতি লাভ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে গবেষণা প্রবন্ধের ম্যানুসক্রিপ্ট জমা না দিয়েই জার্নালের সম্পাদকের সঙ্গে সুসম্পর্কের বদৌলতে একসেপটেন্স লেটার সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে ফায়দা লুটছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নয়নে গবেষণার নামে মূল্যবোধ ও নৈতিকতাবোধের এই অবক্ষয় জালিয়াতি বা দুর্নীতির সমতুল্য।
প্রকাশ : ১৩ জুলাই, ২০১৫
আজকাল বিভিন্ন মহল থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য করা হচ্ছে। কেউ কেউ নাকি বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ অধ্যাপকই প্রভাষক হওয়ার যোগ্য নন আর প্রভাষকরা শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নন। এ ধরনের কথাবার্তার সত্যতা যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তবে জাতীয় বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দিয়ে এবং শিক্ষকদের দুই ধাপ নিচে নামিয়ে যেভাবে তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, তাতে কথাগুলো অবিশ্বাস করতে পারি না। সেদিন এক ঘরোয়া আলোচনায় এক আমলা বলছিলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্নীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোকের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়সহ অন্যান্য
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর পড়াশোনা হয় না, শুধু দলবাজি হয়। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন না, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় দিতে গিয়ে নিজেদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করেন, দলবাজির মাধ্যমে বড় বড় সরকারি-বেসরকারি পদ হাসিলের অপতৎপরতায় তারা বেশি সময় কাটান, গবেষণা করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো একদম মিথ্যা, তা আমি বলব না। তারপরও আমাদের অনেক কথা বলার আছে, যা আমি আমার এ প্রবন্ধে উপস্থাপন করব। ভদ্রলোকের মতে, শিক্ষকদের নিষ্ঠাবান হতে হবে, ঠিকমতো পড়াতে হবে, গবেষণা করতে হবে। নতুবা সব অযোগ্য শিক্ষককে চিহ্নিত করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দিতে হবে। সব অযোগ্য শিক্ষককে চিহ্নিত করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেয়ার কথাটি বক্তার মুখের কথা, না মনের কথা, বোঝা গেল না। তা যদি নিছক মুখের কথা হয়, তবে কোনো কথা নেই। আর যদি মনের কথা হয়, তবে কিছু কথা আছে, সমস্যাও আছে। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যদি মঙ্গল হয়, তবে তাতে কারও অমত থাকার কথা নয়। কিন্তু কে নেবে বা কিভাবে নেবে এই পদক্ষেপ? এসব অযোগ্য শিক্ষককে মূল্যায়নের দায়িত্বই বা কে নেবে? কোন মাপকাঠিতে এদের যোগ্যতার বিচার করা হবে? কোন নীতিমালার ভিওিতে অযোগ্য শিক্ষকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করা হবে, তা কে ঠিক করবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায়ের কোনো নজির এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর পড়াশোনা হয় না, শুধু দলবাজি হয়। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন না, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় দিতে গিয়ে নিজেদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করেন, দলবাজির মাধ্যমে বড় বড় সরকারি-বেসরকারি পদ হাসিলের অপতৎপরতায় তারা বেশি সময় কাটান, গবেষণা করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো একদম মিথ্যা, তা আমি বলব না। তারপরও আমাদের অনেক কথা বলার আছে, যা আমি আমার এ প্রবন্ধে উপস্থাপন করব। ভদ্রলোকের মতে, শিক্ষকদের নিষ্ঠাবান হতে হবে, ঠিকমতো পড়াতে হবে, গবেষণা করতে হবে। নতুবা সব অযোগ্য শিক্ষককে চিহ্নিত করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দিতে হবে। সব অযোগ্য শিক্ষককে চিহ্নিত করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেয়ার কথাটি বক্তার মুখের কথা, না মনের কথা, বোঝা গেল না। তা যদি নিছক মুখের কথা হয়, তবে কোনো কথা নেই। আর যদি মনের কথা হয়, তবে কিছু কথা আছে, সমস্যাও আছে। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যদি মঙ্গল হয়, তবে তাতে কারও অমত থাকার কথা নয়। কিন্তু কে নেবে বা কিভাবে নেবে এই পদক্ষেপ? এসব অযোগ্য শিক্ষককে মূল্যায়নের দায়িত্বই বা কে নেবে? কোন মাপকাঠিতে এদের যোগ্যতার বিচার করা হবে? কোন নীতিমালার ভিওিতে অযোগ্য শিক্ষকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করা হবে, তা কে ঠিক করবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায়ের কোনো নজির এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
গবেষণা প্রসঙ্গে একটু বলি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় প্রত্যেক শিক্ষককেই যথেষ্ট গবেষণা করতে দেখা যায় এবং তা প্রকাশিতও হয় বিভিন্ন জার্নালে। যদিও এসব প্রকাশনার গুণগত মান নিয়ে অনেকের মতো আমারও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের গবেষণা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচারে এসব প্রশ্ন ধোপে টেকেনি। আমি এমনও হতে দেখেছি- কোনোদিন ল্যাবে না গিয়ে শুধু শুভাকাক্সক্ষী সহকর্মীদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কেউ কেউ অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধের অথার হয়ে গেছেন। এসব শুভাকাক্সক্ষী সহকর্মী দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ কোনো গবেষণা না করা সত্ত্বেও কারও কারও নাম তাদের গবেষণা প্রবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের প্রমোশনে বা শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন উন্নতিতে সাহায্য করে আসছেন। অনেক বৈজ্ঞানিক শিক্ষক আবার এমন করিতকর্মা যে প্রতি দু-এক মাস অন্তর বিভিন্ন জার্নালে তাদের গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়। কোনো কোনো গবেষণা প্রবন্ধে অথার এবং কো-অথারের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যেতে দেখা যায়! সিলেকশন কমিটিতে শুধু একসেপটেন্স লেটার উপস্থাপনের মাধ্যমে আজকাল অনেকেই শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন বা পদোন্নতি লাভ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে গবেষণা প্রবন্ধের ম্যানুসক্রিপ্ট জমা না দিয়েই জার্নালের সম্পাদকের সঙ্গে সুসম্পর্কের বদৌলতে একসেপটেন্স লেটার সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে ফায়দা লুটছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নয়নে গবেষণার নামে মূল্যবোধ ও নৈতিকতাবোধের এই অবক্ষয় জালিয়াতি বা দুর্নীতির সমতুল্য।
গবেষণার নামে এসব অপকর্ম আমরা সমর্থন করি না। তবে আমরা সমর্থন করি বা না করি, তাতে এসব তথাকথিত বিজ্ঞানীর কিছু আসে যায় না। প্রশাসনেরও কিছু আসে যায় না। কারণ তারা যুক্তি দেখান- গুণগতমানের বিচারে সব মানুষ সমান হয় না। কে করবে এসব গবেষণার মূল্যায়ন? কোনটি গুণগত মান সম্পন্ন বা কোনটি নয় তার বিচারও আপেক্ষিক। যোগ্যতার মাপকাঠিতে সব শিক্ষক যেমন সমান হয় না, সব গবেষণার মানও তেমন এক হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এ প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপক হওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা আছে। এ ন্যূনতম যোগ্যতা না মেনে যদি অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয়, তার দায়ভার বহন করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের। তারা যদি কোনো প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, গুণগত মান এবং গবেষণার সংখ্যা ও মান যথার্থভাবে মূল্যায়ন না করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষক নিয়োগ বা পদোন্নতি দিয়ে থাকেন, তবে এই দুর্নীতি বা অনিয়মের জন্য গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে প্রথমে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের বিদায় দিতে হয়। কিন্তু তা দেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন শুধু মাননীয় আচার্য। আবার মাননীয় আচার্য যদি তার দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় অযোগ্য উপাচার্য বা প্রো-উপাচার্য নিয়োগ দেন, তবে অযোগ্য শিক্ষক বা অযোগ্য অধ্যাপক তৈরি হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে অযোগ্য শিক্ষকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় দেয়ার পরিবর্তে অযোগ্য শিক্ষক ও অধ্যাপক তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া অধিক ফলপ্রসূ নয় কি? এখন আবার গবেষণা রাজনীতির পরিপূরক। অনেক শিক্ষক গবেষণার জন্য ভালো ছাত্র-ছাত্রী শিকার করে বেড়ান, যাতে করে তাদের পাস করিয়ে শিক্ষক বানিয়ে দল ভারি করা যায়। এসব শিক্ষকের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকে। উল্টো রাজনৈতিক দলগুলো এদের সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ শিক্ষক এ রকম নয়। আর তাই হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও পচে যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। শুধু শিক্ষাদীক্ষায় নয়, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের অবদান অপরিসীম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতি, শোষণ-নিষ্পেষণ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া ও জীবন উৎসর্গ করার ব্যাপারে সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের একটি অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এই ঐতিহ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব, মান-মর্যাদার প্রতীক। এই ঐতিহ্য যেমন উজ্জ্বল, তেমনি সমুন্নত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৪ বছরের ইতিহাস শুধু মানমর্যাদা, ঐতিহ্য আর ক্রমোন্নতির ইতিহাস নয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ ৪৫ বছরের ইতিহাস অনেক উত্থান-পতনের ইতিহাস। আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা আর হতাশার ইতিহাস। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অঘটন ঘটেছে; হত্যা, রাহাজানি, খুনখারাবি হয়েছে, অসংখ্য লাশ পড়েছে, বহুবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, সেশনজটে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, জর্জরিত হয়েছে ছাত্র-শিক্ষক, ক্ষতিগ্রসস্ত হয়েছে জাতি। স্বাধীনতা উত্তরকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেপরোয়া ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, রাজনীতির পেছনে সরকারি-বিরোধী দলের মদদদান, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও দুর্নীতি, শিক্ষকদের কনসালটেন্সি, এনজিও এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আর্থিক ফায়দা অন্বেষণ, ক্লাস ফাঁকি এবং কর্তব্যকর্মে অবহেলা যার ফলস্বরূপ শিক্ষার মানের অবনতি, সর্বত্র দলাদলি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের রাজনীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এর অপব্যবহারসহ আরও বহু অভিযোগ সর্বক্ষেত্রে অমূলক ও অসত্য নয়। তবে এসবের জন্য একক ও ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করাটা অন্যায় হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় আইসোলেটেড বা ইনসুলেটেড কোনো দ্বীপ নয়। দেশের ক্রমাবনতিশীল সার্বিক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গনে পড়বে না- এ ধরনের অবাস্তব মনোভাব পোষণ করা সমীচীন নয়।
অনেকে মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ অপব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা ধ্বংস করছেন। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হল ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভোট কনসেপ্ট। এই কনসেপ্ট প্রভাষক থেকে প্রফেসর পর্যন্ত সবাইকেই সমভাবে পরম ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই ওয়ান ম্যানের ওয়ান ভোট বিভিন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এত বেশি অপরিহার্য বলে গণ্য হয় যে, ভোটার শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা অনেক সময় গৌণ হয়ে যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে শিক্ষকরা প্রার্থী হিসেবে যেভাবে ভোট ভিক্ষা করেন এবং প্রতিশ্র“তি দিয়ে থাকেন, তাতে করে নবীন শিদকদের মধ্যে অনেকেই বুঝে ফেলেন যে, যোগ্যতার চেয়ে সাফল্যের সিঁড়ি হল রাজনৈতিক বা দলীয় পরিচয়। এ কারণেই অনেক শিক্ষক পড়াশোনা আর গবেষণা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত হন বেশি। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অপরাজনীতির প্রত্যক্ষ মদদদাতা। জনমনে আরও একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ স্বায়ত্তশাসনকে খুব নোংরাভাবে অপব্যবহার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কারও দ্বারা, কোনো নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন না। তিনি নিজের বিবেকের কাছে নিজে দায়বদ্ধ থাকবেন, এটা সবাই আশা করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আইন-কানুনের জটিলতা, সংগঠনের চাপ এবং লবিং, স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা এবং দলীয় পরিচিতিসহ তথাকথিত মানবতাবোধ আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ সংরক্ষণকেই বেশি উৎসাহী করে আসছে এবং এখনও করছে। এসব কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, সামনেও হবে।
আমি আগেই বলেছি, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে আইসোলেটেড ও ইনসিউলেটেড দ্বীপ হিসেবে ভাবতে পছন্দ করি। যে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাস, খুন-খারাবি, রাহাজানি, ধর্ষণ, ঘুষ, কালোবাজারি দৈনন্দিন জীবনের নিত্যনৈমিওিক ঘটনা, যে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতেও জানমালের নিরাপত্তা থাকে না, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সন্ত্রাসের উস্কানি দেয়া হয়, যে দেশে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা একে অপরের চরিত্র হননের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, কাদা ছোড়াছুড়িতে সদা সচেষ্ট, সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে দেশের পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত, পুত-পবিত্র তীর্থস্থান এবং দেশের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাব ছাত্র-শিক্ষকের ওপর পড়বে না- এসব ভাবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও দেশের পাঁচ/দশজন মানুষের মতোই মানুষ। সবার মতো শিক্ষকদেরও চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ-অনুভূতি রয়েছে। কাক্সিক্ষত না হলেও অন্য পেশার মানুষের মতো শিক্ষকদেরও পদস্খলন ঘটে এবং তারা মাঝে মাঝে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের দেশে একজন কাস্টম অফিসার বা পুলিশ অফিসার ঘুষ খেয়ে কোটিপতি হলে একে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে গণ্য করা হয়, কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এনজিও, কনসালটেন্সি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মাধ্যমে কিছু বাড়তি উপার্জনে তৎপর হলেই হৈচৈ পড়ে যায়। একজন শিক্ষককে সৎ ও দায়িত্ববান হতে বলবেন, আর তার ভরণপোষণের জন্য ন্যূনতম অর্থ জোগান দেবেন না, তা কি হয়? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবিরোধী আমলা ও নীতিনির্ধারকদের জিজ্ঞেস করি- আপনারা কি জানেন, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় শিক্ষকদের কী মর্যাদায় রাখা হয়েছে এবং সেসব দেশে শিক্ষকদের বেতন কত? বলছি শুনুন। ভারতে একজন অধ্যাপকের সর্বনিু বেতন ১ লাখ ৩৫ হাজার রুপি, যেখানে সেদেশের কেবিনেট সেক্রেটারি বেতন পান ৯০ হাজার রুপি। পাকিস্তানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সর্বনিু বেতন ২ লাখ ৩৪ হাজার এবং সর্বোচ্চ বেতন ৪ লাখ ৫ হাজার পাকিস্তানি রুপি। আর শ্রীলংকায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সর্বনিু বেতন ১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রীলংকান রুপি। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় শিক্ষকরা মূল বেতনের ৩৫-৫০ শতাংশ গবেষণা ভাতা পেয়ে থাকেন। আর বাংলাদেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতি মাসে ৭৫০ টাকা গবেষণা ভাতা দেয়া হয়। ড. ফরাসউদ্দিন পে কমিশনের সম্মানিত সদস্য ও আমলারা এসব পরিসংখ্যান জানেন বা জানতেন বলে মনে হয় না। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পরও কেটেছেটে আমি বেতন পাই মাত্র ৩০ ও ৪০ হাজারের মাঝামাঝি। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা আপনারা ভোগ করে থাকেন, তার কয়টি আমরা ভোগ করি মাননীয় সচিব ও সিনিয়র সচিবগণ? আপনাদের মনে রাখা উচিত, আমরাই আপনাদের গুরু, আমরাই আপনাদের কারিগর। অর্থকড়ির কথা বাদ দিলাম, অন্তত সম্মানটুকু দিতে কার্পণ্য করবেন কেন?
আমাদের সবার কিছু না কিছু দোষক্রটি রয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক, প্রশাসন, নেতা-নেত্রী, দেশবাসী- কেউই এ থেকে মুক্ত নন। শিক্ষাঙ্গনে যেসব দোষক্রটি আমাদের অপছন্দ, তা থেকে উত্তরণে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে। শুধু শিক্ষকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। যদি কোনোদিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করা যায়, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং মানোন্নয়নের জন্য ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ওপর থেকে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হয়, তখনই শুধু দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ছুড়ে ফেলে দিয়ে আইনকানুন এবং বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে আমরা নিজেদের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে রক্ষা করতে পারব এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত করে সম্মানজনক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে পারব।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : প্রফেসর, ক্লিনিক্যাল ফামের্সি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্য্যলয়
0 comments:
Post a Comment