Wednesday, August 19, 2015

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তিবাণিজ্যঃ দেখার কেউ নেই

ড. আবদুল্লাহ ইকবাল


সম্প্রতি প্রকাশিত হল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রস্তূতি নিচ্ছে কিভাবে ভর্তি হওয়া যায় পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানে, আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তূতি নিচ্ছে কিভাবে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আয় করে নেয়া যায় মোটা অংকের টাকা!

আগামী আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়/মেডিকেল কলেজ সমূহে ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে লেভেল-১ সিমেষ্টার-১/১ম বর্ষে এ ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। আমাদের দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, একই পরীক্ষার্থীকে একাধিক প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে হয়। কেউ কেউ আবার একটি পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে/প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায়ই অংশগ্রহন করে। আর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে হলে ১জন ছাত্র/ছাত্রীকে নির্দিষ্ট পরিমান ভর্তি ফি প্রদান করে ফরম পূরণ করতে হয়। পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া সহ অনেক প্রকার ভোগান্তি পোহাতে হয় (ছাত্রী হিসেবে এই কষ্ট কয়েকগুন বেশী পোহাতে হয়, কারন তার সাথে অন্ততঃ ১ জন অভিভাবক থাকেন)। আর এভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে চাইলে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের পরিবারের জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি কষ্টকর ও ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। তার সাথে প্রতিবছরই পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে ভর্তি ফরমের দাম! আমরা অবশ্যই অস্বীকার করতে পারবনা যে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের দেশের খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান যারা অভিভাবকের স্বল্প আয়ের উপর নির্ভরশীল। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন করার পরও আবেদনকৃতদের সকলেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারে না (যদিও সকলের কাছ থেকে আবেদনের জন্য নির্ধারিত ফি নেওয়া হয়)।

এর ফলে এসমস্থ প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষককেই আবেদনকারী/অভিভাবকদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়-যা একান্তই অনাকাংখিত। আর এই অনাকাংখিত পরিস্থিতিতির জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানসমুহের ভর্তি নীতিমালাই এককভাবে দায়ী। এতে করে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমুহের শিক্ষকসমাজ এবং সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানসমুহের ভাবমূর্তি ও উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াসহ ব্যবসায়িক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে। কোন উচ্চ শিক্ষার পবিত্রতম স্থান থেকে এমন আচরন কারো কাছেই কাম্য নয়। 

প্রতিবছরই ভর্তি ফরমের দাম বাড়ানোর পিছনে কারন হিসেবে বলা হয় ভর্তি-সংশ্লিষ্ট ব্যয় মেটানোর জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যেকোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা/প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ভর্তি ফরমের দাম সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া যেতে পারে (বিগত শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমের দাম ৩৫০-৬৫০ টাকা পর্যন্ত ছিল, যেমন- শাবিপ্রবি-৬০০-৬৫০ টাকা/ইউনিট, যবিপ্রবি-২৫০-৫৫০টাকা/ইউনিট, ঢাবি ৩৫০টাকা/ইউনিট, বাকৃবি ৬০০ টাকা)। আবার একজন ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীকে একই বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইউনিটে পরীক্ষা দিতে হলে তাকে আলাদা আলাদাভাবে ফরমের দাম পরিশোধ করতে হয়। যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানসমুহের সারা বছরব্যাপি নিজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা না করে প্রতিনিয়ত পদের অধিক/অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে (বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী), ঠিক তখনি আয় বাড়ানোর জন্য দেশের সাধারন জনগন/তাদের ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে ভর্তি ফরমের দাম বাড়িয়ে অধিক টাকা নিচ্ছে! এটা রীতিমত হাস্যকর! আমি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সাথে (যাদের কেউ কেউ আমার সরাসরি ছাত্র/সমসাময়িক) কথা বলে বুঝেছি অনেক সময় উনারা বেশ গর্ব ও আগ্রহভরে বলে থাকেন যে-আমরাতো ভর্তি পরীক্ষার সময় -----টাকা পারিতোষিক পাই (যা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশী)। কিন্তূ আমার বিবেকে প্রশ্ন জাগে, যে দেশের গরীব মানুষের টাকায় আমার বেতন হচ্ছে, আমার পরিবার-পরিজন চলছে, সেই মানুষদের ছেলে মেয়েকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার ১টি দিনেই আমাকে এতটা(!) আয় করতে হবে? আমরা কি এই একটি দিন/কয়েকটি ঘন্টা বিনা পয়সায় কাজ/দায়িত্ব পালন করতে পারিনা? আর সেটিও যদি না পারি তাহলে অন্ততঃ যতটুকু সময় কাজ করি ততটুকু সময়ের পারিতোষিক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী প্রদান করলেও/নিতে রাজি হলেও ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের খরচের পরমাণ অনেকটাই কমে যেত। সেই সাথে আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধটুকুও পালন করা হতো। অন্যভাবে, যদি “Umbrella Examination” এর মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত (যেমন- কৃষি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তির জন্য ১টি পরীক্ষা, প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তির জন্য ১টি পরীক্ষা...)তাহলে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের কষ্ট ও খরচের পরমাণ বহুলাংশে কমানো যেত (সম্প্রতি শাবিপ্রবি ও যবিপ্রবি এমনি একটি উদ্যোগ নিয়েছে যার ফলে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ১টি পরীক্ষা দিলেই চলবে-যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার)। কিন্তূ ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের হয়ে এই গুরুদায়িত্বটুকু পালন করবে কে-শিক্ষামন্ত্রনালয় নাকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন?

(ড. আবদুল্লাহ ইকবাল)
সহযোগী অধ্যাপক
ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

Published in:   http://shobujbangladesh24.com/


0 comments:

Post a Comment