শরীফুল আলম সুমন
এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবস্থারই তুলনা করা হয়। আর শিক্ষাব্যবস্থায় যেকোনো সংযোজন-বিয়োজন হলেও মডেল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকেই ধরা হয়। এমনকি জাতীয় বাজেটেও শিক্ষা খাতে মিল থাকে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে। অথচ শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে সফর করা হয় ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার দেশে দেশে। সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) অধীনে ৩৬ জন কর্মকর্তা যান ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডায়। একই প্রকল্পে শিগগিরই নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়ও ট্যুর রয়েছে। আর সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি এনহান্সমেন্ট প্রজেক্টের (সেকায়েপ) অধীনে ১৫ জনের একটি টিমের ব্রাজিল সফরও নির্ধারিত হয়েছে। চলতি বছরই এ প্রকল্পের অধীনে আরো কয়েকটি ট্যুরে জার্মানি, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, বেলজিয়াম যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। দুই প্রকল্প মিলে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার দেশগুলোতে এ বছরই ঋণের টাকায় সফর করছেন ৯২ জন কর্মকর্তা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই ধরনের ট্যুর মূলত এক প্রকার আনন্দভ্রমণ। একটি নতুন দেশে গিয়ে আট-দশ দিনে তেমন কিছুই জানা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকে কিছু দেখে এলে তা আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করাও সম্ভব নয়। তাই সফরগুলো আমাদের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেশেই হওয়া উচিত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হেকেপ প্রকল্প শেষ হবে ২০১৮ সালে। এই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৬২ কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার। বাকি সবই বিশ্বব্যাংকের ঋণ। আর সেকায়েপ প্রকল্পের ব্যয় প্রায় তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা শেষ হবে ২০১৭ সালে। এর মধ্যে মাত্র ৩০৬ কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার, বাকি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। দুটি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই শিক্ষার মানের উন্নয়ন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষার যেকোনো ট্যুরের ক্ষেত্রে যে দেশগুলো দ্রুত উন্নতির দিকে যাচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেখানেই যাওয়া উচিত। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কার শিক্ষাব্যবস্থা দেখাটাই যুক্তিযুক্ত।
কারণ আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও তারা শিক্ষায় আমাদের নিচে ছিল, কিন্তু এখন ৫০ গুণ এগিয়ে গেছে। তাই কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা দেখলে আমাদের খুব একটা লাভ নেই। আর যদি হয়, দেখলাম আর ঘুরে এলাম তাহলে তো কোনো ফলই হবে না। এসব ট্যুরে যাঁরা কারিকুলাম ও এডুকেশনের সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরই রাখা উচিত।'
ইউজিসি সূত্র জানায়, হেকেপের একচেঞ্জ ও স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় মোট ছয়টি ট্যুর আছে। এর মধ্যে দুটি ট্যুর হয়েছিল ২০১২ সালে। বাকি চারটি ট্যুর হচ্ছে চলতি বছর। প্রতি দলে থাকছেন ১২ জন সদস্য। এর মধ্যে প্রথম গ্রুপ ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র ট্যুর করে ২৩ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত। দ্বিতীয় গ্রুপ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ট্যুর করে ১৫ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। তৃতীয় গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ট্যুর করে ২০ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে এই প্রোগ্রামের শেষ ট্যুরটি হবে, যার আওতায় যাওয়া হবে সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া।
জানা যায়, প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুযায়ী, পলিসি মেকাররাই এই সফরে যাবেন, যাতে কোনো কিছু পরিদর্শন করে তাঁরা তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় প্রতি সফরে একজন করে কর্মকর্তা মনোনয়ন দিতে পারে। কিন্তু প্রতিটি ট্যুরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথম ট্যুরে ছিলেন শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। আর দ্বিতীয় ট্যুরে ছিলেন ইউজিসি চেয়ারম্যানের পিএস মো. শাহীন সিরাজ। কিন্তু তাঁদের দ্বারা এই প্রকল্প কিভাবে উপকৃত হবে, এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কেউ। এ ছাড়া শর্তানুযায়ী, উপসচিব পদমর্যাদার নিচে কেউ এই ট্যুর করতে পারবেন না। অথচ কয়েকজন সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ইতিমধ্যে ট্যুর করে এসেছেন। এ ছাড়া সফরগুলোতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা রয়েছেন। অথচ শিক্ষকদের জন্যই মূলত এই প্রোগ্রাম। এ ছাড়া এই তিনটি ট্যুরে এমন দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁরা সফর শেষের কয়েক দিন পরই অবসরে চলে যাবেন। আর গত তিনটি ট্যুরে ইউজিসির ১২ জন কর্মকর্তা ছিলেন, যাঁদের অনেকেই দাপ্তরিক কাজ করেন; কখনোই এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আবার একটি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সফর শেষেই অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে গেছেন।
নাম প্রকাশ না করে ট্যুর থেকে ফিরে আসা ইউজিসির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অনেকেরই চাকরিজীবনে আকাঙ্ক্ষা থাকে ইউরোপ-আমেরিকা যাবেন। এই প্রোগ্রামের আওতায় সেই সুযোগ মিলছে। বিদেশে অনেকেই যে কাজে গেছেন তার চেয়ে অন্য কাজেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। সফরের আগে অনেক ধরাধরি লাগলেও সফর শেষে একটি রিপোর্ট দিলেই দায়িত্ব শেষ। তারপর আর এ বিষয়ে কেউ কোনো খোঁজখবর নেয় না।'
এসব বিষয়ে হেকেপ প্রকল্প পরিচালক ড. গৌরাঙ্গ চন্দ্র মহান্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যারা নির্বাচিত হয় তারা সবাই এই প্রকল্পের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। আর আরডিপিপি অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকেও সফরে নেওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই ঠিক করে কে যাবে না যাবে।'
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সেকায়েপ প্রকল্পের অধীনে চলতি বছরে তিনটি ট্যুর আছে। এর মধ্যে ব্রাজিল ট্যুরের জন্য ১৫ জনের সরকারি আদেশও হয়ে গেছে। তাঁদের গত ৩ আগস্ট যাওয়ার কথা থাকলেও ভিসা জটিলতার কারণে এখনো যেতে পারেননি। এরপর বাকি দুটি ট্যুরে জার্মানি, ফিলিপাইন, মেক্সিকো ও বেলজিয়াম যাওয়ার কথা রয়েছে। উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন বিষয়েই এসব ট্যুর।
জানা যায়, ব্রাজিল ট্যুরে পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এলজিইডি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন; মাউশির দুজন, সেকায়েপ প্রকল্পের চারজন কর্মকর্তা রয়েছেন; আর দুটি কলেজের দুজন শিক্ষক রয়েছেন। মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক রোকসানা আক্তার ও যশোর সরকারি সিটি কলেজের প্রভাষক সাহেদ শাহান কিভাবে ভূমিকা রাখবেন তা বুঝতে পারছেন না প্রকল্পেরও একাধিক কর্মকর্তা। তবে যাঁরা এই প্রোগ্রাম মাঠপর্যায়ে পরিচালনা করেন তাঁদের কেউ নেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মকর্তাকে এই সফরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মাউশি সূত্র জানায়, বাকি দুটি ট্যুরেও প্রায় একইভাবে কর্মকর্তাদের নির্বাচন করা হচ্ছে। তবে মাউশির উপপরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা তিনটি ট্যুরেই নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পেরেছেন। তিনি আগেও সেকায়েপের অধিকাংশ সফরে গেছেন। আর আগে যাঁরা একাধিকবার সেকায়েপের ট্যুরে গেছেন, তাঁদের এবারও নির্বাচিত করা হয়েছে।
সেকায়েপের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংক এত কিছু দেখে না, ভাবেও না। তারা দেখে ঋণের টাকা খরচ করা হয়েছে কি না। এতেই তারা খুশি। আর শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের বাইরের লোক নিলেই তারা বেশি খুশি হয়। সেভাবেই আরডিপিপি করা হয়েছে। কিন্তু বাইরের লোক গিয়ে কিভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাবে, তা আমরা নিজেরাই বুঝছি না। নেওয়ার দরকার ছিল মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের। অথচ তাঁরা একবারও সুযোগ পান না।'
গত বছর স্পেন, ইতালি ও যুক্তরাজ্যেও সেকায়েপ প্রকল্পের ট্যুর ছিল। ১২ জনের টিমে বেশির ভাগই ছিল প্রকল্পের বাইরের লোক। এর আগে কানাডায় ১৫ জনের একটি টিম যায়। সেখানেও ছিল একই অবস্থা।
এসব বিষয়ে সেকায়েপ প্রকল্প পরিচালক ড. মাহমুদ-উল-হকের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'যারা ট্যুরে যায় তাদের সবারই এই প্রকল্পে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। কেউ যদি ট্যুর থেকে এসে বদলিও হয়ে যায়, তারা সেখান থেকেই ভূমিকা রাখবে। আর ট্যুরগুলো কোন দেশে হবে তা বিশ্বব্যাংক ঠিক করে দেয়। ওই সব দেশের মডেল দেখে এসে আমরা তা আমাদের দেশে কাজে লাগাই।'
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঋণের শর্তের মধ্যেই ট্যুর আছে। তাই যাওয়াটা বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন দেশ দেখার পাশাপাশি উন্নত দেশও দেখা উচিত। দুটোর সমন্বয় সাধন করেই যাওয়া উচিত। কারণ আমরা এখন আর গরিব দেশ নই। তবে সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এলে হবে না। নানা কারণে আমি নিজে এসব ট্যুরে যাই না। তবে অবশ্যই ব্যাপারটা আরো ভাবতে হবে। পরবর্তী সময় চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেব।'
Published in:http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/08/26/261022
আরো পড়ুনঃ
আরো পড়ুন:
বিভিন্ন সরকারী ট্রেনিং এ কারা যায়? কি করে?
'শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা' নিতে আমলারাও যাচ্ছেন বিদেশে - শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা সুযোগ পান না
সংস্কারের বিকল্প নেই
ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার
ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"
প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!
আমলাতন্ত্রের আমলনামা ও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন
আরো পড়ুন:
বিভিন্ন সরকারী ট্রেনিং এ কারা যায়? কি করে?
'শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা' নিতে আমলারাও যাচ্ছেন বিদেশে - শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা সুযোগ পান না
সংস্কারের বিকল্প নেই
ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার
ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"
প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!
আমলাতন্ত্রের আমলনামা ও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন
0 comments:
Post a Comment