Sunday, February 9, 2014

বিশ্ববিদ্যালয়: উচ্চশিক্ষার অভিমান ও আত্মপ্রতারণা

আবুল মোমেন 



বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, খুব সাধারণ বিচারেও, বর্তমানে মানহীন ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের চোখের সামনেই এই পতন ঘটে চলেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার পর অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ পেয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে একথা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য ডিগ্রি ও সনদপত্র বিক্রয়ের বাণিজ্য। এই খাতের সফল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্য এসেছে মূলত ব্যবসায়িকভাবেই, অ্যাকাডেমিক সাফল্য এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারেনি আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলোতেও আয়-উপার্জন বাড়ানোর প্রবণতা ক্রমেই মুখ্য হয়ে উঠছে-শিক্ষক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই। এ নিয়ে মাঝে মাঝে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে থাকে, যার অনিবার্য পরিণতি দীর্ঘকালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হয়ে গেল।


একটু বলা দরকার, যদি সমাজে কোনো বিষয় নিয়ে সঠিক পথে মুক্ত আলোচনা, যথার্থ কিংবা সুস্থ বিতর্ক না হয় তাহলে নানা রকম উড়ো/উটকো ধারণা/সিদ্ধান্তের ফলে সে বিষয়ে করণীয় ও সমাজের প্রত্যাশায় ফারাক হয়ে যায়। আমার ধারণা উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যাশায় বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ সত্যিই উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রিধারী চাকুরের প্রত্যাশাই করে থাকে। এছাড়া ডিগ্রি, কাগুজে ভালো ফল ও সনদপত্রের প্রতি মোহগ্রস্ত  এ সমাজ। ফলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলে মিলে নিষ্ঠার সাথে পরীক্ষা-ডিগ্রি-সনদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। কোর্সের পড়া, প্রয়োজনীয় টিউটরিয়াল, লাইব্রেরিসহ ছাত্রের প্রয়োজনীয় পঠনপাঠন মানসম্পন্নভাবে শেষ হয়েছে কিনা তা মোটেও বিবেচ্য বিষয় নয়। কয়েকটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ক্লাস করার বিশেষ গুরুত্ব নেই, আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন পাওয়া ও তার উত্তর সংগ্রহ করে শেখার ওপরই ছাত্রের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ভর করে। কিন্তু প্রশ্ন হল উচ্চশিক্ষায় করণীয় কি এবং উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য কি?


২০০৯ সনের বহুল প্রশংসিত জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এসব বিষয়ে কী বলা আছে তা দেখে নিতে পারি আমরা। এতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল -

* কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং মানবিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা দান।
* নিরলস জ্ঞানচর্চা ও নিত্য নতুন বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমপ্রসারণ।
* জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী হতে জ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি।
* মেধার বিকাশ এবং সৃজনশীল নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন।
* জ্ঞান সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নাগরিক সৃষ্টি।
যে ল্যাটিন শব্দ থেকে ইউনিভার্সিটি শব্দটির উৎপত্তি তার সম্পূর্ণ অর্থ হল ‘শিক্ষা ও গবেষক সম্প্রদায়’। পরে শব্দটির আধুনিক ব্যবহার সম্পর্কে অভিধান বলছে: স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দানের ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রধানত ‘ non-vocational subjects’ এর চর্চা হয়।
এসব কথা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাই চার ধরনের সম্পদের সমাহার -গবেষণায় আগ্রহী চিন্তাশীল জ্ঞানীর সমন্বয়ে শিক্ষকসমাজ, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় উৎসাহী ছাত্রসমাজ ইন্টারনেট সুবিধাসহ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, আধুনিক উন্নত সরঞ্জামসহ গবেষণাগার। এ কথা বলা বাহুল্য তরুণদের চাই শরীরে মনে সুস্থজীবন। তাই জিমনেশিয়াম ও খেলার মাঠ, সুইমিং পুলসহ শরীরচর্চার ব্যবস্থা, নিয়মিত অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া 
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল সৃজনশীল সুকুমার কলা চর্চার উপযোগী পরিবেশ, ব্যবস্থা, অবকাঠামো, সরঞ্জাম ইত্যাদির আয়োজন। আমার জানা মতে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কিছুই ঠিকভাবে নেই, আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ সবই আজ ধুলো-জমা স্মৃতির বিষয়।
এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গুণগত পরিবর্তনের জন্যে দ্রুত সংস্কার কাজে হাত না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় - সব বিশ্ববিদ্যালয় - পতনের শেষ সীমায় পৌঁছাবে, উচ্চশিক্ষা তলিয়ে যাবে চরম নৈরাজ্যে।
সংস্কার বলতে আয় বাড়ানোর কৌশল নয়, দরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থবহভাবে কার্যকর করা। উচ্চ শিক্ষার মূল লক্ষ্য তিনটি - কোনো বিষয়ে উচ্চতর ও বিশেষজ্ঞীয় জ্ঞান অর্জন, শিক্ষানীতি ও প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা ও উচ্চতর ভাবনার ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন ও নতুনতর জ্ঞান সৃজন, এবং অর্জিত ও সঞ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে মানবসমাজের কল্যাণে অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি স্মরণীয়। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা কি ? কবি ছোট্ট উত্তরে বলেছিলেন - যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চেয়েছেন নানা দেশের নানা বিষয়ের প-িতদের সমবেত করতে যাঁরা নিজনিজ গবেষণা চালিয়ে যাবেন আর ছাত্ররা সহযোগী হিসেবে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিই এ ধরনের লক্ষ্য ও করণীয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টি বিভাগে কত ছাত্র (এবং শিক্ষক) এই লক্ষ্য-করণীয় পূরণ করেন তা আনুবীক্ষণিক অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। তবে একদম হয় না একথা আমি বলব না। দেশে এখনও প-িত ব্যক্তি আছেন, ভালো গবেষকও আছেন, সত্যিকারের জ্ঞানী শিক্ষকও আছেন। ছাত্রদের মধ্যে গবেষণায় আগ্রহী, মৌলিক ভাবনায় পারদর্শী এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানবহিতৈষী মেধাবী তরুণ-তরুণীর দেখা পাই এখনও। দুর্ভাগ্যের বিষয় এরকম শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্যে আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল একরাশ হতাশাই তৈরি করে থাকে। 
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং করণীয় যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে আমাদের বাস্তবতা ও প্রবণতাকে কী বলব? প্রথমেই আমাদের জানা এবং মানা দরকার শিক্ষা অধিকার বটে কিন্তু উচ্চশিক্ষা সংরক্ষিত থাকে শুধুমাত্র অধিকারীর জন্যে। অর্থাৎ যে উচ্চশিক্ষার অধিকার অর্জন করে তার জন্যে। এ কেবল মেধার বিষয় নয়, জীবনভর জ্ঞানার্জন, জ্ঞান অনুশীলনের এবং সেই সাথে ছাত্রদেরকে জ্ঞানচর্চার পথে উদ্বুদ্ধ করা ও পথনির্দেশ দানের মানসিকতা থাকা আবশ্যিক। 
যে কোনো দেশের মত আমাদেরও উদীয়মান তরুণ জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগ চাকুরি-প্রত্যাশী। কিন্তু একে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে খুব ধীরে এবং তার ওপর কর্মবাজারের চাহিদার কোনো নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য কারও হাতে নেই, ফলে কোনো ভবিষ্যত চিন্তা ও কৌশল ছাড়াই সবাই গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দেয়। এদিকে চাকুরির অনিশ্চয়তা আর এখনও বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সামাজিক মূল্য থাকার ফলে যে কোনো তরুণ উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি শেষ করে ¯স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চায়। লক্ষ্য করার বিষয় হল এভাবে অধিকাংশ ছাত্রের লক্ষ্যের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনের লক্ষ্যের কোনো সঙ্গতি থাকে না। অথচ তাদের জন্যে অন্য কোনো উপযুক্ত আকর্ষণীয় বিকল্প না থাকায় অনিশ্চিত বেকার জীবনের গ্লানি বহনের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বকে অন্তত একটি সম্মানজনক বিকল্প পরিচয় ভাবে ছাত্র ও তার অভিভাবকরা। এভাবে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমাগত এমন ছাত্রের চাপ বেড়ে চলেছে যাদের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন ও চর্চার কোনো আগ্রহ থাকে না। তদুপরি বাজারের চাহিদা ও সামাজিক মূল্য বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতা-আগ্রহ-নির্বিশেষে ছাত্ররা নির্দিষ্ট কোনো কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে চায়। স্বভাবতই সবার জন্যে সে সুযোগ থাকে না। ফলে সত্য হল, আজ পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র তার অপছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা করে! এই বাস্তবতার কারণে যে কোনো বিশ্ববিদালয়ে অনিচ্ছুক ছাত্ররাই সংখ্যাগুরু হওয়ায় এদের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ক্ষুণœ হতে বাধ্য। আর শ্রেণিকক্ষে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি হওয়ায় ক্রমে শিক্ষকও আন্তরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ, ভালোভাবে ক্লাস নেওয়ার প্রণোদনা হারিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় বা চলতে দেওয়ায় দেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ও অর্জনে মারাত্মক অবনতি ঘটে গেছে। আজ আমাদের দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের মান-নির্ধারণী তালিকায় একশতের মধ্যেও নেই। এখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিই আর বিশ্বের উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমমর্যাদায় স্বীকৃত নয়। এ পরিণতি কি আমরা চেয়েছিলাম?
যদি তা না চেয়ে থাকি তাহলে এ হযবরল অবস্থা চলতে দেওয়া কি উচিত? উচ্চশিক্ষার নামে কেবল ডিগ্রি ও সনদপত্রের বাণিজ্য বা এগুলো বিতরণ করার জন্যে কেন বিশ্ববিদ্যালয়?
আমরা লক্ষ্য করছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের কর্ম বাজারের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে কেবলমাত্র বিবিএ, এমবিএ, আইন, কম্প্যুটার প্রকৌশল মূলত এই ক’টি বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। এর পাশাপাশি উন্নয়ন, পরিবেশের মত সম্ভাবনাময় কিছু বিষয়ও চালু করছে। কিন্তু কোথাও মৌলিক বিদ্যা অর্থাৎ দর্শন, গণিত, বিভিন্ন শাখার ভৌত বিজ্ঞান, বিভিন্ন শাখার প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর জ্ঞান চর্চা ও ডিগ্রির কোনো আয়োজন নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় থাকলেও ভালো ছাত্রদের আগ্রহ এতে কম। ফলে কোথাও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি বা রবীন্দ্রনাথের  ভাষায় বিদ্যা উৎপাদনের কোনো পরিবেশ নেই। অনেক শিক্ষক এবং ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যোগ দিয়ে আর অনেক শিক্ষক বিদেশ থেকে জ্ঞানে ও উদ্দীপনায় সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে এলে সত্যিই কিছু করতে চেয়ে বিরূপ পরিবেশে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। এভাবে আজ একদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হল হাল ভাঙা জাহাজ আর অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেন বাণিজ্যপোত। পরিণতিতে দেশে মেধাবী তরুণ প্রচুর থাকলেও মেধা লালনের অভাবে, আর লক্ষ্যহীন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে সকলেই চলেছে হতাশার শেষ প্রান্তে।
সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা ও রাজশাহীতে ছাত্রসংখ্যা ত্রিশ হাজার ছাড়িয়েছে, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরে পনের হাজারের মত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা কুড়ি হাজারের বেশি। এমন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের কথাও শুনেছি যেখানে ছাত্র সংখ্যা অর্ধলক্ষের বেশি! আমাদের কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থায় এত ছাত্রের (এবং শিক্ষক-কর্মচারীর) প্রশাসনিক সকল দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসের যেসব কক্ষ একজন ছাত্রের জন্যে নির্ধারিত ছিল সেগুলোতে ৪/৫জন থাকছে, বারান্দায় বিছানা পেতে থাকছে, কমনরুমও ছাত্রদের দখলে চলে গেছে। যুদ্ধাবস্থায় সাময়িকভাবে গাদাগাদি করে দু:সময় পার করা যায়, কিন্তু সেটাই যদি স্থায়ী ব্যবস্থা হয় তাহলে এই অস্বাভাবিক জীবনের প্রভাব তো ছাত্রের শরীর-মনে পড়বেই। পড়ছেও। অধিকাংশের লক্ষ্য হয়ে পড়েছে কোনো মতে একটি ডিগ্রি ও সনদ জোগাড় করা। পড়াশুনার বাস্তব কোনো পরিবেশ না থাকায় এর জন্যে সহজ উপায় তাদের খুঁজতে হয়েছে, শিক্ষকদেরও এতে শরিক হতে হচ্ছে। ফলে অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত ‘তারুণ্যের অপচয়’ মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ কোনো খেলাধুলা নেই, লাইব্রেরির ব্যবহার নেই, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই, এমনকি ছাত্র-শিক্ষক মিলে সত্যিকারের শিক্ষা-সফরও হয় না (পিকনিক হয়)। কোনো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে ঘাস গজিয়েছিল।
মানতে হবে রাতারাতি অবস্থা পাল্টানো যাবে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে এই নৈরাজ্য ও অপচয় রোধ করে সঠিক অবস্থায় ফেরার কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। তবে একটি সহজ কথা হল,গুণগত পরিবর্তনের কাজটি শীর্ষ থেকে শুরু করার নয়, নিচের থেকে ধাপে ধাপেই তা হতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সবার অধিকার এবং এ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকার ভর্তির বিবেচনায় তা পূরণ করেছেন, এখন মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে অন্তত অষ্টম শ্রেণি 
পর্যন্ত ভর্তি হওয়া সব ছাত্রছাত্রীকে ধরে রাখা যাতে একসময় এটুকু শিক্ষিত একটি জাতি তৈরি হয়। নবম শ্রেণি থেকে বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখায় ভাগ হয়ে যায় ছাত্ররা। আমার মনে হয় বাংলা-ইংরেজি-সাধারণ বিজ্ঞানের  মত অবশ্য পাঠ্য বিষয়ের সাথে সব শাখার বিষয়গুলো উন্মুক্ত রেখে তা থেকে ৪/৫টি বিষয় বেছে নিয়ে ছাত্ররা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়লে ভালো হয়। ততদিনে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারবে জীবিকা এবং আগ্রহের বিচারে কার জন্যে কোন ধারায় শিক্ষাগ্রহণ ঠিক হবে। এভাবে এক সময় সমমানের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত জাতি গঠন সম্ভব হবে। এরপরে বৃত্তিমূলক ও পেশাগত বিদ্যা এবং বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে ডিপ্লোমা ও স্নাতক ডিগ্রির জন্যে কলেজ, ইন্সটিটিউট থাকবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অধীনে এ ধরনের ডিগ্রি প্রদানের  কলেজ, ইন্সটিটিউট চালু করতে পারে। ধীরে ধীরে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণ করতে হবে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শর্ত, চাহিদা পূরণ করবে। এই উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানের  ছাত্র সংখ্যা হবে কম, শিক্ষকদের বেতন হবে দেশে সর্বোচ্চ মানের।
আশা করি একে কেউ উচ্চশিক্ষা সংকোচনের দূরভিষন্ধি মনে করবেন না। আমার বিনীত নিবেদন হল উচ্চ শিক্ষার নামে যা চলছে তা বাস্তবে কোনা শিক্ষাই নয়, শিক্ষার পরিহাস। একটি জাতি এভাবে উচ্চশিক্ষার অভিমান পুষে বছরের পর বছর আত্মপ্রতারণা চালিয়ে যেতে পারে না। জাতীয় স্বার্থেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত।

Source: http://abulmomen.blogspot.kr/2014/02/blog-post_10.html

Sunday, November 24, 2013

জাতীয় বেতন কমিশন গঠন


সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন, ২০১৩ গঠন করেছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় গতকাল রোববার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কমিশন ২০১৪ সালের ১৭ জুনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিশন আগামী ১৭ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।

যোগাযোগ করলে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। ১৩ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর জন্য কিছু করা যাবে মনে করে অন্য কোনো দায়িত্বের পরিবর্তে আমি এটি গ্রহণ করেছি।’

বেতন কমিশন নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী। নির্বাচনকালীন সরকার বেতন কমিশন গঠন করতে পারে না—একটি দৈনিক সংবাদপত্রে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের এমন মন্তব্য প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ইটস জাস্ট স্টুপিড। এখনো নির্বাচনের শিডিউল ঘোষিত হয়নি। সাখাওয়াত হোসেন একজন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। তিনি এমন কথা বলতে পারেন না। শিডিউল ঘোষণার আগের সরকার নির্বাচনকালীন সরকার নয়।’ 

এবারের কমিশনে তিনজন সদস্য হলেন দুই সাবেক সচিব মুহম্মদ আবুল কাশেম ও শেখ খুরশীদ আলম এবং সাবেক হিসাব মহানিয়ন্ত্রক মো. সাহাদ চৌধুরী। ১২ জন খণ্ডকালীন সদস্য হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাফর খালেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মমতাজউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুৎফুল হাসান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো বিনায়ক সেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ রুহুল আমীন, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহ্মদ, মেট্রো চেম্বারের সাবেক মহাসচিব সি কে হায়দার, ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ কে এম রফিকুল ইসলাম, অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইমদাদুল হক, আইন বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ আমিনুল ইসলাম এবং সশস্ত্র বাহিনীর একজন প্রতিনিধি। তবে, কমিশন প্রয়োজনবোধে খণ্ডকালীন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। কমিশনের সদস্যসচিব হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. এহসানুল হক। 

কমিশনের কার্যপরিধি: প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পর্যালোচনাপূর্বক সরকারের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করবে কমিশন। 

সুপারিশ তৈরির সময় মা-বাবাসহ ছয়জনের একটি পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় এবং দুই সন্তানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বিবেচনায় রাখতে হবে। এর আগে ২০০৮ সালের কমিশনে অবশ্য চারজনের জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনার কথা ছিল। 

একটি সময়োপযোগী বেতন কাঠামো ও অবসর সুবিধা নির্ধারণ; বিশেষায়িত চাকরিজীবীদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ এবং বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, যাতায়াত, আপ্যায়ন, প্রেষণ, কার্যকর, মহার্ঘ্য, উৎসব ও শ্রান্তি বিনোদন ভাতা নির্ধারণের কাজ করবে কমিশন। কমিশন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বয়ের পদ্ধতিও নিরূপণ করবে। 

টাইমস্কেল, সিলেকশন গ্রেড এবং ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসংগতিও দূর এবং রেশন-সুবিধা যৌক্তিকীকরণ করা হবে। 

২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গঠিত বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ২০০৯ সালের ১ জুলাই সর্বশেষ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়। চলতি বছরের ৭ অক্টোবর তাঁদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার, যা গত ১ জুলাই কার্যকর হয়েছে।

Published in: http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/81928/

আরো পড়ুনঃ

Friday, November 1, 2013

শিক্ষার মানোন্নয়ন বনাম শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া

ড. আবদুল্লাহ ইকবাল

আমরা যারা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা খোঁজখবর রাখি সবাই কথায় কথায় বলে থাকি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই। প্রতিটি সরকারও তার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ক্ষমতা ছাড়ার সময় পর্যন্ত (আর বিরোধী দলে থাকাকালীন ক্ষমতায় আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত) প্রতিনিয়তই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথাও বলে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন পর্যায়ে পাসের হার বাড়ছে (বিশেষত শহর এলাকায়)। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটছে এর উল্টোটা। এর কারণ হিসেবে কি বলা যাবে যে, প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রীরা মেধাবী না বা কম মেধাবী? মোটেও সেটি বলা যাবে না। প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক মেধাবী, যাদের নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা (শহর এলাকার ১০ ভাগের ১ ভাগ দিতে পারলেও) দিতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বা তাক লাগানোর মতো কিছু ঘটতে পারত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে কোনোমতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে পরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীর (এমনকি প্রথম/দ্বিতীয়/... স্থান অধিকার করে ফেলে) তালিকায় ঢুকে যায়। আবার পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফল করে এসেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে খুব খারাপ ফল করাটা অতি স্বাভাবিক। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে যে, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে মুখস্থ করার প্রবণতা এবং প্রাইভেট কোচিংয়ের একটা প্রভাব থাকে, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও প্রকটভাবে দেখা যায় না। তবে সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষার মান নিয়ে কেউই সন্তুষ্ট না_ না সরকারের মন্ত্রীরা, না শিক্ষাবিদরা, না অভিভাবকরা। এরই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে গত ২৪ জুলাই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রীর শিক্ষার মান নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে (শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে)। তার মতে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে অবহেলিত ও দুর্বল মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আসবে। দল-মত সবাই এ ব্যাপারটিতে একমত হবেন! বর্তমানে আমরা ছাত্রছাত্রীদের যে শিক্ষা দিচ্ছি তাহলো চাকরিমুখী শিক্ষা_ লেখাপড়া শেষে যেভাবেই হোক তাকে একটা চাকরি পেতেই হবে!

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন কারা? বেশিরভাগই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রী, যাদের অধিকাংশই অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বা ভর্তির সুযোগ পায়নি। তাদের বেশিরভাগকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পেতে হয়। এবার শুরু হলো তার শিক্ষকতা। আমরা বলি ভালো বীজে ভালো ফসল, আর এ ক্ষেত্রে ভালো ফসল হলো ভালো ছাত্র। তাহলে কতটুকু ভালো ছাত্র আশা করা যায়? এরই ঠিক কয়েক বছর পর আবার বর্তমানের ভালো ছাত্রটিই (!) আবার পূর্বের প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবে ওই স্কুল-মাদ্রাসাটিতে। তাহলে শিক্ষার মান প্রতিনিয়তই বাড়বে না কমবে? এই সমস্যাটি থেকে উত্তরণের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে আলাদা একটি কমিশন বা অনুরূপ কিছু করা যেতে পারে, যারা কেন্দ্রীয়ভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করবেন।

এবার আসা যাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মানের ব্যাপারে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি বলেই (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ৬০-৬৫ নম্বর পেয়ে চাকরি না পেলেও বিভিন্ন কোটায় ৫০ নম্বর পেয়ে চাকরি পেয়ে গেল। সেখানেও যে নিয়োগে অনিয়ম হয় না সেটাও বলা যাবে না। তবে তার তীব্রতা-মাত্রা কিছুটা কম। কারণ সেখানে একটি লিখিত পরীক্ষায় একেবারেই অযোগ্যদের ছেঁকে নেওয়া হয়। আবার মৌখিক পরীক্ষায়, এখানেও থাকেন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা (সাধারণত সরকারি দলের)। সব মিলিয়ে এখানেও যে আমরা খুব ভালো ছাত্রছাত্রীটিকে শিক্ষক হিসেবে পাচ্ছি তা বলা যাবে না। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকেই শুরু হয় শিক্ষার মানের ব্যাপারটি।

এরপর হলো শিক্ষার মানটি ধরে রাখা বা উন্নীত করা। এটি করতে হলে প্রতিনিয়তই আমাদের সচেষ্ট হতে হবে, কেমন করে ভালো ছাত্রছাত্রীটিকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। যেন একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার পর অন্য চাকরি না খোঁজেন, তিনি যেন এখানে তার অবস্থায় তৃপ্ত হন তার ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টাটুকু অব্যাহত রাখতে। সেখানেই আসে শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রসঙ্গ। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একটা বড় ক্ষোভ হলো এই পদোন্নতি নিয়ে। দেখা যায়, একই পদে সারাজীবন চাকরি করে অবসর নিতে হয়। অথচ একই পদমর্যাদার অন্য চাকরির বেলায় পদোন্নতিসহ অধিকতর আর্থিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই চাকরি প্রার্থীরা শিক্ষকতার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা তো আরও করুণ। তাদের দীর্ঘ সময়ের দাবি প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা দান করা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকের অনুরূপ দাবি মেনে নিলেও প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যাপারে কোনো আন্তরিকতা দেখা যায়নি। আবার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি করার ঘোষণা (প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক) দিলেও এখনও সেগুলোর কোনোই সুরাহা হয়নি_ এখন সেগুলো না রেজিস্টার্ড, না সরকারি! তারা আরও হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। ফলে অনেক হতাশা আর বঞ্চনা নিয়ে তারা এখন আবার আন্দোলন শুরু করেছেন (যা বর্তমানে চলমান)। বিভিন্ন খাতে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও এই খাতে সরকার একটু সহানুভূতিশীল হলে ভবিষ্যতে অধিকতর মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেতে পারত অধিকতর উন্নত শিক্ষা।

সবগুলো সরকার এসেই বলে যে, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিতে হবে, নইলে ভালো ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতায় আসবে না, শিক্ষার মান বাড়বে না ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে কি কিছু হচ্ছে? কারও কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তাকে তো অন্তত কিছু দিতে হবে। শিক্ষকরা যখন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ শুধু আশ্বাস আর দাবি নিয়েই চলছেন, তখন অন্য অনেকেই স্বতন্ত্র বেতন স্কেল-ভাতা পেয়ে গেলেন। সুতরাং সরকারের এখন বুঝতে হবে যে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি না করে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্বমানের কর্মমুখী শিক্ষা লাভ করতে পারে। আর এই দায়িত্বটুকু শিক্ষকদের ওপর না দিয়ে সরকারকেই আরও আন্তরিক হতে হবে। বর্তমান অবস্থায় এটি কখনও সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে রাজনীতি না করে বাস্তবতার নিরিখে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে দেশের সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে।

সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
iqbal21155@bau.edu.bd

Published in: http://archive.samakal.net/2013/11/02/17378

Saturday, September 21, 2013

‘শিক্ষকদের জন্য আলাদা স্কেল হচ্ছে’

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হচ্ছে। এবিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই আপনারা এ বিষয়ে জানবেন।’
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষকের সম্পাদনায় ‘রিসার্স অ্যান্ড এডুকেশন চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়- নিউজিল্যান্ডের যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কর্যক্রমের অংশ হিসেবে এনিমকা গ্রিনউড, জন আরবাট, আরিফুল হক কবির এবং সাফায়াত আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে এ বইটি। গ্রন্থের সম্পাদকগণ হলেন নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনিনকা গ্রিনউড, অধ্যাপক জন এভারেট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. আরিফুল হক কবির ও সাফায়েত আলম।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য আধুনিক জ্ঞান ও শিক্ষা প্রয়োজন। এ আধুনিক শিক্ষা ছাড়া আমাদের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যেতে পারবে না। আর নতুর প্রজন্ম এগিয়ে না গেলে জাতিও থেমে যাবে। এ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দিবেন শিক্ষকরা। আর এ শিক্ষকরাই যদি কম বেতন পান তাহলে তারা তাদের কাজে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারবেন না, আবার অনেকে অসত্ হয়ে যেতে পারেন। এজন্যই আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে।’

তিনি আরও বলেন, আমাদের আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। আর এ গবেষণা বাড়ালেই আমাদের শিক্ষার মান অনেক উন্নত হবে। তবে শিক্ষকরা বিদেশে যেয়ে অনেক গবেষণা করেন। তারা ওইসব দেশের বিষয় ও সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেন। আমরা ওই গবেষণা চাই। আমাদের দেশে ওই রকম হাজারো সমস্যা রযেছে। তাই ওই গবেষণা আমাদের দেশে হতে হবে। তবেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘গবেষণা বৃদ্ধির জন্য আমরা এপর্যন্ত ১০৬টি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি আশা করি এ প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণার অনেক দিক উন্মোচিত হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক অর্জন আছে। এ থেকে বিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে। নারী শিক্ষার প্রতি বিরূপ মন্তব্য শুনলে আমি হতবাক হই। এ মনমানসিকতার মানুষকে দেখে আমি অবাক হই। এসব মানুষ দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক নূরুর রহমান খান। গ্রন্থের উপজীব্য তুলে ধরেন নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এনিনকা গ্রিনউড। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ নাজমুল হক। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন।

Published in: http://fenirshomoy.com/index.php?option=com_content&view=article&id=2877

Sunday, September 15, 2013

শিক্ষকদের শুধু সম্মান নয় উপযুক্ত সম্মানীও চাই

মো. আবু সালেহ সেকেন্দার

শিক্ষকতা পেশায় যারা নিয়োজিত, সম্মানের দিক দিয়ে তারা সমাজের সবচেয়ে উঁচু স্তরের মানুষ। কিন্তু সম্মানজনক সম্মানী প্রাপ্তির দিক দিয়ে তারা আজও রয়ে গেছেন পাতালেই। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি, নেতাদের স্লোগানে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর বিষয়টি যুগ-যুগান্তরে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই শিক্ষকদের সম্মানের বিষয়টি বিবেচনা করে সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করেনি। প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিতরা তাই জীবনের অধিকাংশ সময় মানবেতর জীবনযাপন করেন। শিক্ষকরা ক্লাসে ছাত্রদের যে প্রবাদ প্রবচন পড়ান, সেই ‘হ্যান্ড টু মাউথ’ অথবা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’Ñ প্রবাদটিই তাদের নিত্যসঙ্গী। অথচ শিক্ষকের ছাত্ররাই ওই প্রবাদবাক্য শিখে সিএসপি অফিসার হন। বিসিএস, জেসিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট, ডিসি, এসপি, জজ, ব্যারিস্টার, অফিসের বড় কর্তার পদ অলঙ্কৃত করেন।

শিক্ষকের স্নেহের শিক্ষার্থীরাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ডিজি, মহাপরিচালক পদে আসীন হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের পিছু ছাড়ে না। ওই সম্মানটুকু নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, বিচারকরা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে অথবা শিক্ষককে কাছে পেলে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দে বিগলিত হন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে মুখে রা’টি পর্যন্ত করেন না। পাছে যদি গাঁটের পয়সা খরচ হয়! মহামান্য বিচারকরা কত শত বিষয়ে স্বপ্রণোদিত রায় প্রদান করেন অথবা আইনজীবীরা প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে রিট করেন অথবা আদালতের নজরে আনেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের, তারা এখনও পর্যন্ত এমন কোনো ছাত্র তৈরি করতে পারেননি; যিনি শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন। কেন শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্মানজনক সম্মানী দেয়া হয় না? সেই বিষয়ে আদালত সরকারের কাছে জানতে চাইবে। সরকারি ও বিরোধী দলের সব নেতাই তো শিক্ষকদের ছাত্র। তারাও কেন সংসদে বিল উত্থাপন করেন না এ বিষয়ে? এরকম হাজারও প্রশ্ন আমার মাথার ভেতর প্রায়ই ঘুরপাক খায়। এমন ভাবনা ভুল না শুদ্ধ জানি না; তবে এমন ভাবি, হয়তো নিজেই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছি তাই।

দুই.

‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মে না’। বাংলাদেশের জন্য এ উক্তিটি বেমানান। কারণ এদেশে গুণীর কদর করা না হলেও, আল্লাহর রহমতে গোবরে পদ্ম ফুল প্রতি যুগে কয়েক ডজন ফোটে। তারা সারা বিশ্বে এদেশের মাথা উঁচু করেন। এরকমই একজন খ্যাতিমান অধ্যাপককে একজন সংসদ সদস্য সংসদে ওই বছরের সেরা ধোলাই দিয়েছিলেন। ওই সংসদ সদস্য যা বলেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ অনেকটা এরকম তিনি একজন শিক্ষক। তার এত টাকা কোথা থেকে আসে? গাড়ি বাড়ি কোথায় পান?... ইত্যাদি। এ ধারণাটি শুধু ওই সম্মানিত সংসদ সদস্যের নয়; প্রায় পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রযন্ত্রই এমনটি বিশ্বাস করে বলে মনে হয়। আর এমন ধারণা হওয়ার কারণ, আবহমান কালের চিরাচরিত ঐতিহ্য ‘প্রকৃত পন্ডিত মশায় মানে ধবধবে সাদা পুরাতন পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনও হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তির ছবিই আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে। আমরা ধরেই নেই যে, যিনি অধিক বিদ্বান, তিনি হবেন অতি ভদ্র, বিদ্যার ভারে তার মাথা সব সময় নুয়ে থাকবে।

আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানী, পাঠান, মোগল, ইংরেজ কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ সর্বদাই ওই একই চিত্র। বাংলার বাইরে উমাইয়া-আব্বাসীয় খিলাফত, অটোমান সালতানাতও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে আলোচনা থাকলেও, ওইসব যুগে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কেমন ছিল, সে সম্পর্কে আলোকপাত একেবারেই নেই বলেলেই চলে। দয়া করে দু-একজন ঐতিহাসিক এ বিষয়ে যা আলোকপাত করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, বৈদিক যুগে শিক্ষকরা কোন গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করতেন না। ভিক্ষা দ্বারা জীবন নির্বাহ করতেন। পাল যুগে বিহারগুলোতেই পন্ডিতদের থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছিল। রাজা বিহারের জন্য যে করমুক্ত জমি দান করতেন, সেখান থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের ব্যয় নির্বাহ হতো। মোগল দরবার থেকে ঢাকার শিক্ষা বিস্তারে নিযুক্ত শেষ শিক্ষক মৌলভী আসাদ উল্লাহর বেতন ছিল মাসিক ৬০ টাকা। বঙ্গদেশে আধুনিক ধাঁচের সর্বপ্রথম উচ্চ আরবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (১৭৬৫ সালে বর্ধমানের বিহারে জমিদার মুনশী সদরুদ্দীন প্রতিষ্ঠা করেন) শিক্ষক মোল্লা নিজামুদ্দীনের ছেলে আবদুল আলীম বাহারুল মাসিক ৪০০ টাকা বেতন পেতেন। ব্রিটিশ ভারতে সরকার ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য যে দু’জন সহকারী পরিদর্শক নিয়োগ করতেন; তাদের মাসিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা প্রদান করা হতো। এরকম কম-বেশি দু-চারটি উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একথা সত্য, সব যুগেই শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে।

তবে প্রায় সব শাসকই শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। খলিফা হারুন আল রশীদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) তার ছেলে আল আমিনের শিক্ষককে রাজপুত্রকে প্রহারের অনুমতিও দিয়েছিলেন। তিনি তার ছেলের শিক্ষককে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা থেকেই জানা যায় ‘এত কড়া হবেন না যাতে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ রুদ্ধ হয়; অথবা এমন নরম হবেন না যাতে সে আলস্য উপভোগ করতে পারে এবং কুড়েমিটাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়। স্নেহ ও দয়ার স্পর্শে তাকে সহজ-সরল করে গড়ে তুলুন; কিন্তু তাতে যদি সে সাড়া না দেয়, তাহলে কঠোর হাতে ও প্রয়োজনে মারধর করতেও দ্বিধা করবেন না।’

মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি ইতিহাস খ্যাত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তার জীবনী পাঠ থেকে জানা যায়, ‘একবার তার গৃহশিক্ষকের গুটিবসন্ত হয়েছিল। ফলে ওই শিক্ষকের ঘরে কেউ যেতে চাইতো না। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি গরম পানি করে শিক্ষককে স্নান করান, বিছানার চাদর বদলে দেন।’

তিন.

অনেকে হয়তো রাজা-বাদশাহদের শিক্ষকের প্রতি আহ্লাদে গদ গদ হতে দেখে আবেগময় হয়ে পড়ছেন! আর সেদিন কত না ভালো ছিল বলে ভাবছেন! উচ্চ বেতন না থাকলেও রাজকীয় সম্মান তো ছিল, এমন কল্পনায় উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন! আর মনে মনে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে অভিসম্পাত করতে করতে বলছেন অন্তত আজকের মতো সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার বাহিনীর হাতে পিটুনি খাওয়া অথবা ন্যায্য দাবি আদায়ে শহীদ মিনারে অনশনরত শিক্ষকদের ওপর সরকারি পেটোয়া বাহিনী পুলিশ কর্তৃক লাঠিপেটা বা পিপার স্প্রে থেকে তো রক্ষা পাওয়া যেত, তাদের বলছি। দাঁড়াও বাছা! এ তো কেবল মুদ্রার একপিঠ দেখেছ, অন্য পিঠের বর্ণনা পর্যন্ত অপেক্ষা কর! এ যুগের মতো সেই যুগেও শিক্ষকের মানমযার্দা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার লোকের অভাব ছিল না। আব্বাসীয় আমলের একটা প্রবাদ শুনলেই আশা করি রণভঙ্গ দিয়ে পালাবেন ‘শিক্ষক, মেষপালক বা মেয়েদের সঙ্গে বেশি থাকে এমন পুরুষের কাছ থেকে কোনো উপদেশ চেয়ো না।’ বুঝলেন হে! আরও আছে আরবীয় সাহিত্যে বেশ কিছু ছোট ছোট কাহিনী আছে, যেখানে শিক্ষকদের ‘মোটা মাথার লোক’ বলে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ‘প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চেয়েও মূর্খ...’। এমনকি আব্বাসীয় খলিফা মামুনের রাজত্বকালে একজন বিচারক আদালতে একজন শিক্ষকের সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতে পর্যন্ত রাজি হননি। আর একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের তিন পাওয়ালা কুকুরের জন্য মাসে ২৫ টাকা ব্যয় এবং পান্ডিত মশায়ের মাসিক ১৭ টাকা বেতনে ৮ সদস্যের পরিবারের জীবন ধারণের পুরনো গল্প নাই বা বললাম...

চার.

শিক্ষক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান ও সম্মানী দুটিই চাই। প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকদের বেতন অন্য যে কোনো চাকরির বেতনের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করি। যদি শিক্ষকদের বেতন তাদের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রদান করা হয়; তবেই কেবল মেধাবীরা এ পেশাকে গ্রহণ করবে। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক যে তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদা পান, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সম্প্রতি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীতকরণের তোড়জোড় থেকে জেনেছি। ওই বিষয়টি আমাকে পীড়িত করেছে। কারণ প্রাথমিকেই একজন শিক্ষার্থীর ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি তৈরি হয়। আর ওই দুর্বল ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির ওপর অনেক তলা নির্মিত হলে, ভবিষ্যতে যে তা রানা প্লাজার মতো ধসে পড়বে, এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের অফিস-আদালতে তৃতীয় শ্রেণীর কমকর্তা-কর্মচারী কারা, আমরা কী একবারও ভেবেছি? ওই তৃতীয় শ্রেণীদের হাতে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারিরা বেড়ে উঠছে, ভাবা যায়! আমি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ছোট করতে চাইছি না। আমি বাস্তব অবস্থা বোঝাতে চাইছি। তৃতীয় শ্রেণীর হাতে বেড়ে ওঠা একটা শিশু চিন্তা-চেতনায় তৃতীয় শ্রেণীর হবে, এটাই কী স্বাভাবিক নয়? আর কোনো শিক্ষকের অর্থনৈতিক অবস্থা যদি দুর্বল হয় এবং সারা দিন যদি তাকে চিন্তা করতে হয় যে, মাসের বাকি ১৫ দিন আমি কীভাবে সংসার চালাব? সেই বিষয়ে; তবে তাকে দিয়ে অন্তত সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতি এরকম গন্ডায় গন্ডায় হাজারে হাজারে নিয়মকানুন তৈরি করলেও, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন প্রদান ছাড়া শিক্ষার মানের উন্নয়ন অসম্ভব। সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্মানী প্রদান করতে হবে।

আর যদি শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা যায়; তবে শিক্ষকরা নিজ থেকেই টিউশনি পরিহার করবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে বিরত হবে, ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণে নিয়মিত সময় দেবে। অন্যথায় যত আইনই করা হোক না কেন, সামগ্রিক অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। শিক্ষকরা আইনের ফাঁকফোকর বের করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আগের নিয়মেই চলবে। কিন্তু আমরা সব সরকারকেই দেখেছি, শিক্ষকদের উচ্চতর বেতনের বিষয়টির প্রতি নজর না দিয়ে অন্যসব কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা হারাচ্ছে ভারসাম্য হচ্ছে ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’। তবে একথা সত্য যে, সব সরকারই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, বেতন কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। বছরের পর বছর ওইগুলো বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশ্বাসও প্রদান করছেন। অনেকটা নাকের ডগায় মুলা ঝুলিয়ে রাখা আর কী? পূর্বতন সরকারের মতো বর্তমান মহাজোট সরকারও তার বহু অঙ্গীকারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শিক্ষানীতি থেকে শিক্ষা আইন, নির্বাচনী ইশতেহার থেকে ভিশন-২০২১ সব জায়গায়ই বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।

সঙ্কটমোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প-২০২১ সালে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় ‘শিক্ষা’ উপশিরোনামে বলা হয়েছে, ‘২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে’ (ভিশন ২০২১, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা : ২০০৯, পৃ. ৫১)। শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামো নিয়ে প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দেখে আমার শৈশবে শিক্ষাগুরুর কাছে শেখা গাধা সম্পর্কিত দুটি উক্তি বেশ মনে পড়ছে। এক. ‘গাধা পানি খায় ঘোলায়ে’, দুই. ‘গাধার সামনে মুলা ঝুলিয়ে সাধ্য সিদ্ধি করা’। বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ এর মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, অনেকটা শিক্ষকদের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রাখার মতোই। কারণ বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২০১৪ সালের প্রথমেই শেষ হয়ে যাবে। তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া অযৌক্তিক নয় যে, কেন তারা ২০১৪ সালের মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামোর বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে এমনটি বললেন। তারা বলতে পারতেন ২০১৩ সালে মধ্যে...। তাহলে আমরা বুঝতাম যে, সরকারের এ বিষয়ে সদিচ্ছা আছে। কিন্তু বিষয়টি অনেকটা ওই গাধার সামনে মুলা ঝোলানোর মতোই। আমার বিশ্বাস, শিক্ষক সমাজও এ বিষয়টি ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কারণ তারা তো আর গাধা নয় যে, মুলা ঝোলালেই খুশি হবে। বরং শিক্ষকরা হচ্ছে সেই প্রজাতির মানুষ যারা ‘গাধা পিটিয়ে মানুষ করার মহান দায়িত্ব পালন করেন’।

আর প্রথম উক্তিটির বিষয়ে আলোকপাত হচ্ছে সরকার শিক্ষা আইন, শিক্ষক নীতি, টিউশনি বন্ধে প্রজ্ঞাপন, পাস না করলে এমপিও বন্ধ এরকম হাজারটি পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রদান ব্যতিরেকে যা কখনও সম্ভব নয়। তাই মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রথমেই শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। আমার বিশ্বাস, সরকার সেই উদ্যোগ হয়তো নিবে, যখন সরকারের সব উদ্যোগের ফলেও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না, তখনই। অনেকটা প্রথম উক্তিটির মতোই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ততদিনে মানসম্মত শিক্ষাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক অংশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট

salah.sakender@gmail.com

Published in: http://www.alokitobangladesh.com/editorial/2013/09/16/22770

Thursday, April 11, 2013

শিক্ষকদের প্রস্তাব গৃহীত হবে কি?

সাইফুদ্দীন চৌধুরী

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলাদা বেতনকাঠামো তৈরি এবং চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের ওই প্রস্তাব আন্তবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মাধ্যমে দাবি আকারে সরকারের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে। 
সার্কভুক্ত দেশগুলোর, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন হার বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি। সে আলোকে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও বেতনকাঠামো প্রবর্তনের জন্য প্রস্তাব করেছেন। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বছর তিনেক আগে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন, শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি বেতনকাঠামো প্রদানের বিষয় বিবেচনা করা হবে। তিনি এমনও বলেছিলেন, সার্কভুক্ত অন্য সব দেশে বিদ্যমান বেতন স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনক্রম প্রণীত হবে। কার্যত তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অনেকেই ভাবছেন, তা আমলাতন্ত্রের কুদৃষ্টিতে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আরও প্রস্তাব করেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতগুলোতে দায়িত্ব পালনরত বিচারপতিদের মতো তাঁদেরও বয়সসীমা দায়িত্ব পালনরত বিচারপতিদের মতো বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ করতে হবে। 

শিক্ষকদের পক্ষ থেকে যুক্তি হলো, বিশ্বের বহু খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান কৃৎকৌশল সুসংবদ্ধ অবস্থায় পেতে প্রবীণদের মর্যাদা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট রাখা হয়। সাম্প্রতিক কালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশেও মানুষের গড়পড়তা আয়ুষ্কাল অনেকটা বেড়েছে। ৬৭ কেন? এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ৭০ বছরেও প্রায় এঁরা সবাই কর্মক্ষম থাকেন। অবসর নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এমন অনেক তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে। কাজেই ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওই সব একাডেমিশিয়ানের বড় রকমের সহযোগিতা যে পেতে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ই অধিক লাভবান হবে। 

এখানে একটি কথা অবশ্য উল্লেখ করতে হবে, ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকো ও আইএলওর উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে শিক্ষকদের জন্য একটি সনদ ঘোষণা করা হয়। ১৪৬টি ধারা ও উপধারাসংবলিত ওই সনদে বলা হয়েছে, শিক্ষকেরাই সব কর্মকাণ্ডের কারিগর, জাতি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তাঁদেরই। আগামী দিনের মর্যাদা ও উপযুক্ত নাগরিক তাঁরাই তৈরি করেন। এই শিক্ষকদের মর্যাদার ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের ত্রুটি না ঘটে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে। ওই প্যারিস ঘোষণার ৭-এর (চ) উপধারায় বলা হয়েছে—

‘জীবনধারণের ব্যয় বৃদ্ধি ও বর্ধিত উৎপাদনশীলতার কারণে জীবনযাত্রার উচ্চতর মান অথবা বেতন ঊর্ধ্বমুখী গতি বিবেচনায় মাঝে মাঝে বেতন স্কেল পুনর্বিবেচনা করা।’ আদতে সেখানে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল প্রদানের কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে। প্যারিস কনভেনশন সূত্রে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতটা অধিকার ভোগ করেন, তার জবাব অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। কতটা লজিস্টিক সুবিধা পান রাষ্ট্রের কাছ থেকে শিক্ষকেরা। এই শিক্ষকদের যথার্থ একাডেমিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে প্রধান অন্তরায় হলো অর্থসংকট। শিক্ষকেরা যাতে সেসব দায় মেটাতে বহির্মুখী না হন, অর্থাৎ কর্মসংস্থানের জন্য অন্য কোথাও নিয়োজিত না হন এবং প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য দেশত্যাগ না করেন, রাষ্ট্রের উচিত সে প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করা।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থার জন্য দরকার দক্ষ শিক্ষক এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা। লক্ষ রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কাজের যেন ব্যত্যয় না ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পরিবেশ না থাকার কারণে অনেক কৃতী, জ্ঞানবৃদ্ধ ও খ্যাতিমান শিক্ষক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, এমন নজির অনেকই আছে আমাদের দেশে। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বলেছিলেন, ‘ইয়োর ইমাজিনেশান ইজ মোর ইম্পর্টেন্ট দ্যান নলেজ।’ আমার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকেরাই ওই ইমাজিনেশান তৈরি করতে সমর্থ, তখন তাঁরা নিজেরাই কেউ কেউ ইনস্টিটিউশন হয়ে ওঠেন। জ্ঞানের নতুন নতুন উৎসের জন্য, বিজ্ঞানের অভিনব উদ্ভাবনের জন্য, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, প্রবীণ শিক্ষকদের কর্মকাল প্রলম্বিত করার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে এসব বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।

ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

Published in: http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-11/news/343994

Wednesday, April 10, 2013

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ

অনুমতি ছাড়া ছুটিতে থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী কমিটি। আজ বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
শিক্ষকেরা হলেন আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহমুদ বিন সাঈদ এবং একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনুপ চৌধুরী। গত সোমবার স্থায়ী কমিটির সভায় তাঁদের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সিন্ডিকেটের কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করতে অনুপ চৌধুরী ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই দফায় ছয় বছর শিক্ষা ছুটি নেন। এর মধ্যে চার বছর তিনি সবেতনে ছুটি ভোগ করেন। এরপর অনুমতি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকায় ২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে আট সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তাঁর চাকরির পরিসমাপ্তি হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে আবারও এক বছরের ছুটির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সিন্ডিকেট সেই আবেদন অনুমোদন না করে পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাকরির পরিসমাপ্তির বিষয়ে মতামত দিতে স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়।

অন্যদিকে আরবি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ইংল্যান্ডে পিএইচডি করতে মাহমুদ বিন সাঈদ ২০০৬ সালের ২২ এপ্রিল থেকে দুই দফায় ছয় বছর শিক্ষা ছুটি নেন। ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে আট সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে চাকরিতে যোগ না দিলে চাকরির পরিসমাপ্তি হবে বলেও জানানো হয়। 

স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অননুমোদিত ছুটিতে থাকায় তাঁদের চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করা হয়েছে।

Source: http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-10/news/343741