Tuesday, September 11, 2012

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

মো. আক্তারুজ্জামান

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুগবাণীর ‘‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, ‘‘ আমরা চাই আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিতে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে-শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসেবে ‘ডাংপিটে’ ছেলে বরং অনেক ভাল। কারণ পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না; আর যাহার ‘জান’ নাই, সে মোর্দা দিয়ে কোন কাজই হয় নাই আর হইবেও না। এই দুই শক্তিকে – প্রাণশক্তি আর কর্মশক্তিকে একত্রীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।’’ (নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, সম্পা. আবদুল কাদির, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬, পৃ. ৮৪৪)। নি:সন্দেহে, যে-শিক্ষার জীবনীশক্তি নেই তা মানবিকও নয়। আশাব্যঞ্জক এই যে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ -এ মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত বক্তব্য, মন্তব্য ও সুপারিশ বহুলমাত্রায় পরিলক্ষিত।

প্রাক্-ব্রিটিশ সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠান ও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ঘোষিত শিক্ষানীতি হলো বাংলা তথা ভারতের প্রথম সরকারি শিক্ষানীতি। এর মাধ্যমে নীতিগতভাবে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর বহুল আলোচিত অ্যাডাম রিপোর্ট (১৮৩৫-১৮৩৮) -এর উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি (১৯৪৭) পর্যন্ত অন্তত আটটি কমিশন, কমিটি ও সংস্কার প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে হান্টার কমিশন রিপোর্ট (১৮৮২) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত নাথান কমিটি (১৯১১) রিপোর্ট খুবই পরিচিত। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৮-১৯৭১) বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি রিপোর্ট প্রণীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার (আতাউর রহমান খান) কমিশন ১৯৫৭, জাতীয় শিক্ষা কমিশন (এস এম শরিফ কমিশন) রিপোর্ট ১৯৫৯, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট ১৯৬৬ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘শিক্ষা নীতি’ নামেও দু’টো প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছিল- এয়ার মার্শাল এম. নূর খান নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন শিক্ষানীতি ১৯৬৯ ও শামসুল হক কমিটি প্রণীত শিক্ষানীতি ১৯৭০। উল্লেখ্য, ঘোষিত সব কয়টি প্রতিবেদন/নীতি প্রবল আন্দোলনের মুখ থুবড়ে পড়ে, নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুড়ে। বর্তমান মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ (এমপি)সহ বরণ্য শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতক নেতৃবৃন্দের অনেকে এসব আন্দোলন সংগ্রামে শরিক ছিলেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন বিশেষ করে ১৭ সেপ্টেম্বরের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এক্ষেত্রে বড় দৃষ্টান্ত।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ -এর পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশে আরো ছয়টি কমিশন/কমিটি রিপোর্ট ঘোষিত হয়েছিল। এগুলো হলো : বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন (ড. কুদরত-ই-খুদা) রিপোর্ট ১৯৭৪, অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি (কাজী জাফর-আবদুল বাতেন প্রণীত) ১৯৭৯, মজিদখান কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৩, মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ ও জাতীয় শিক্ষা কমিশন (মনিরুজ্জামান মিয়া) প্রতিবেদন ২০০৩। জাতির দীর্ঘদিনের আন্দোলন, সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেমনি সাংবিধানের চার মূলনীতির উদ্ভব ঘটেছিল তেমনি স্বধীনতাউত্তর বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও জাতীয় উন্নয়নের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রণীত সুপারিশেও জাতির প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক স্বৈরাচারী সরকারসমূহ তা বাস্তবায়ন না করে, সকলেই বিতর্কিত, খন্ডিত কিছু প্রতিবেদন, সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে শিক্ষাঙ্গন ও সুশীল সমাজের বৈধতা পাওয়ার এক ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে। স্পষ্টত: বাংলাদেশে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ হয়েছে দু’টো । দু’টোই হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ তথা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে – ২০০০ ও ২০১০ -এ।

জাতীয় শিক্ষানীতির কয়েকটি মৌলিক বেশিষ্ট্য থাকে : এর শিক্ষা-দর্শন থাকবে, এতে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে; জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা প্রণীত ও গৃহীত হবে। জাতির পূর্ব অভিজ্ঞতাসমূহ এখানে ব্যবহৃত হবে, উপেক্ষিত হবে না। এসকল মানদন্ডে ৬ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে গঠিত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী (চেয়ারম্যান) ও ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ (কো-চেয়ারম্যান) নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রণীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ যথার্থ অর্থেই জাতীয় শিক্ষানীতির মর্যাদা লাভ করেছে। এটি প্রণয়নে আমাদের মহান সংবিধানের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাবলি, জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের সুপারিশ এবং পূর্বে প্রণীত বিভিন্ন কমিটি/কমিশন প্রতিবেদন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। সর্বোপরি, শিক্ষাবিদসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মন্তব্য ও পরামর্শ সংগ্রহ করে তার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেও অন্তর্ভুক্তিকরণ (inclusiveness) দর্শনের বহি:প্রকাশ লক্ষ্যনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এম পি শিক্ষানীতির ‘প্রাক্-কথন’-এ বলেন, ‘‘২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে আমরা সরকারের দায়িত্ব নেবার পর নির্ধারিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে পূর্বে প্রণীত শিক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করার জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়। সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে এই শিক্ষানীতি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়।’’ একইভাবে, শিক্ষানীতির ‘মুখবন্ধ’ -এ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নূরুল ইসলাম নাহিদ, এমপি -র বক্তব্যও শিক্ষানীতির গণমুখীতা ও যুগের সাথে এর বহমান ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন- ‘‘(১) এটা কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয় – জনগণ তথা জাতির আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। (২) শিক্ষানীতি কোন অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সব সময় উন্মুক্ত থাকবে। কোন ভুল-ত্র“টি হলে তা সংশোধন করা যাবে।’’ বর্তমান শিক্ষানীতির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, যথার্থতা ও জাতীয় মর্যাদা লাভের আরেকটি পরিমাপক হলো এর বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম পরিলক্ষিত না-হওয়া।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ন্যায় শিক্ষাও একটি প্রধান মৌলিক অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্র ও সরকার এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশের সংবিধানে এ-নিরিখে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘‘(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’’ এ-ছাড়াও ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে শিক্ষালাভে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য না করার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মহান সংবিধানের ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদে। প্রাক্ কথন মুখবন্ধ, আঠাশটি অধ্যায় ও দু’টো সংযোজনী নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর কলেবর।

আঠাইশটি (২৮টি) অধ্যায়ে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর, ধারা, ক্ষেত্র, পাঠক্রম, নারী শিক্ষা, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষার্থীকল্যান, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার, স্তর-নির্বিশেষে গৃহীতব্য পদক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ের সাবলীল বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনায় সংবিধানের উপরিউক্ত নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। আলোচ্য শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘‘শিক্ষানীতি —– দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।‘‘ বস্তুত ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়টি জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০-এর মূল ভিত্তি। এখানে ৩০ (ত্রিশ) টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করে সেসবের বাস্তবায়ন ও অর্জনের লক্ষ্যে পরবর্তী সাতাশটি অধ্যায়ে বিভিন্ন নীতি দর্শন, সুপারিশ ও করণীয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসবের মৌলিক কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে নিম্নে উপস্থাপিত হলো।
(১) প্রাথমিক শিক্ষার স্তর হবে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আট বছরব্যাপী। এখানে প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণিও সংযুক্ত থাকবে;
(২) পঞ্চম শ্রেণি শেষে জাতীয়ভাবে অভিন্ন প্রশ্নে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এটি বর্তমানে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (PSC) নামে পরিচিত। অনুরূপ অষ্টম শ্রেণি শেষে জাতীয় ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় অভিন্ন প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার নাম জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (JSC);
(৩) সন্ত্রন্ত্রভাবে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রয়োজন নেই, PSC ও JSC মেধা তালিকা থেকে বৃত্তি প্রদান করা হবে;
(৪) মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত;
(৫) বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সমগ্রদেশে প্রাথমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়সমূহে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করা হবে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধারার যথা: সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিল্ডারগার্টেন (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম), ইবতেদায়িসহ সব ধরণের মাদ্রাসার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা হবে;
(৬) প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত বিষয়ে অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে;
(৭) মাদ্রাসাসহ অন্যান্য বিশেষ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রাখার জন্য নিজস্ব বিষয়াদি বাধ্যতামূলক বিষয়ের সাথে সন্নিবেশ করা যাবে;
(৮) চার বছরব্যাপী মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে – (ক) তিনটি ধারা থাকবে – সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাধারা এবং প্রত্যেক ধারা কয়েকটি শাখায় বিভক্ত থাকবে। সব ধারাতেই কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে যথা-বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক থাকবে। (খ) প্রত্যেক ধারায় এসকল বিষয়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে স্ব স্ব বোর্ডের নেতৃত্বে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। (গ) নিজ নিজ ধারার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক ধারায় সেই ধারা সংশ্লিষ্ট আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক বিভিন্ন বিষয় থাকবে;
(৯) শিক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি ও সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া ও শিক্ষার মান অর্জনের জন্য গাইড বই, নোট বই, প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এসবের অপকারিতা বিষয়ে সচেতন করা হবে;
(১০) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সকল ধারার শিক্ষার্থীদের যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে সে প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে;
(১১) ঝরে পড়া রোধ ও অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দুপুরে পুষ্টিকর খাবার প্রদান করতে হবে এবং প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে;
(১২) নীতিগতভাবে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যাবে না, এ প্রবণতা নিরুৎসাহিত করতে হবে। ব্যতিক্রমক্ষেত্রে কোড (code) পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি বিষয়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত;
(১৩) শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নিশ্চিত করতে স্তর নির্বিশেষে সকল শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে এবং নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা বাঞ্চনীয়;
(১৪) শিক্ষা প্রশাসন জবাবদিহি, স্বচ্ছ, গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে – (ক) সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে; (খ) সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষানীতির পরিমার্জন ও পরিবর্তনের জন্য স্থায়ী ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করতে হবে; (গ) মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতির আওতাধীন ও এমপিওভুক্ত সকল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি ও পদোন্নতির জন্য সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারী শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে; (ঘ) দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয়ের জন্য এবং সেই ভিত্তিতে প্রতিবছর এগুলোর র‌্যাংকিং নির্ধারণ করা ও উন্নয়নের পরামর্শ দেয়ার জন্য যথাযথ ক্ষমতা ও দক্ষতা সম্পন্ন একটি ‘এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠা করা হবে; (ঙ) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হবে; (চ) মাদ্রাসাকেন্দ্রিক উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ফাযিল ও কামিল পর্যায়ের মাদ্রাসার অনুমোদন, পাঠক্রম প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, সনদ প্রদান ও অন্যান্য একাডেমিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় একটি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে;

(১৫) বর্তমানে সকল স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকহারে বেতন আদায়ের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। চাঁদা আদায়ের বিষয়টিও নীতিমালার আওতায় আনতে হবে;
(১৬) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষার কোন স্তরেই শিক্ষার্থী যাতে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;
(১৭) নির্দিষ্ট অনুপাতে (১:৩০) প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যাবশ্যক অবকাঠামো সংযোজন করে ২০১৮ -এর মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষানীতির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ধারাসমূহ বাস্তবায়ন করা হবে;
(১৮) শিক্ষার্থীকে মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন পাঠ্যসূচি মোতাবেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পুস্তক রচনা করতে হবে। ২০১৩-র মধ্যে এই নতুন পাঠ্য পুস্তক প্রবর্তন করতে হবে;

উল্লিখিত সুপারিশ, প্রস্তাবনা ও প্রতিবেদনসহ চূড়ান্ত খসড়া শিক্ষানীতি ৭ ডিসেম্বর ২০১০ মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। নীতিগতভাবে এসব এখন সরকারের সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, এরূপ ভালো ভালো সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য বিগত সময়ের বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদ/সুপারিশেও ছিল। কিন্তু ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর সাথে সেসবের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে- আর তা হলো বাস্তবায়ন বা কার্যকর করার প্রশ্নে। এই একমাত্র শিক্ষানীতি যা কোন সরকার বাস্তবায়ন করছে, ধাপে ধাপে। উল্লেখ্য, এই প্রথমবারের মত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৮ জুন ২০১১ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে আহবায়ক করে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কেন্দ্রীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। উপবৃত্তি সম্প্রসারণ, শিক্ষা সহায়ক ভাতা প্রদান, কতিপয় এলাকায় দুপুরের খাবার সরবরাহ কার্যক্রম গ্রহণ প্রভৃতি পদক্ষেপের ফলে ২০১২-এ প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ভর্তির হার ৯৫%-এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৫-এর পূর্বেই শতভাগ ভর্তির সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDG) অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাদ্রাসাসহ সকল ধারার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এত বিপুল সংখ্যক (প্রায় ২৫ কোটি) পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে সরবরাহ বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১লা জানুয়ারি এ-পুস্তক প্রদান কার্যক্রম সরকার প্রধান উদ্বোধন করেন। ১লা জানুয়ারি এখন পাঠ্য পুস্তক দিবস। নতুন শিক্ষাক্রম পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পুস্তক রচনা ও ছাপানোর কাজ এগিয়ে চলছে। ২০১৩ সন থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক পাঠদান শুরু করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ২০১২-এ চল্লিশ হাজারেরও বেশি বিদ্যালয়ে প্রাক্ প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা হয়েছে বলে জানা যায়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষে যথাক্রমে সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুযোগের বৈষম্য দূর হয়ে, গুটিকতকের বৃত্তি পরীক্ষার সুযোগ ও কোচিং বন্ধ হয়ে এখন সকল শিক্ষার্থী সমাপনী পরক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং সে ফলাফলের ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। দেশের সকল প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শ্রেণি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে ‘শিক্ষার্থী সংসদ’ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যমে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনার মধ্যে খুদে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রচর্চার পাঠ শুরু হয়েছে। নির্ধারিত শিক্ষাপঞ্জির ভিত্তিতে এখন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি এবং এইচ এস সি ও সমমানের পরীক্ষা ১ এপ্রিল শুরু হয় এবং ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলে অনেক অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রচলন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া সরবরাহসহ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসার কারিক্যুলাম উন্নয়ন করা হয়েছে। এবতেদায়ি ও জুনিয়র দাখিল পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করা হচ্ছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম চালু করে ভর্তি-বাণিজ্য রোধ করার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে এককালীন দেয় ফি ও অনুদান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। যারা নির্ধারিত অর্থের অতিরিক্ত আদায় করেছে, তাদেরকে তা ফেরৎ দিতে বা সমন্বয় করতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বিশেষায়িত ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে টেক্সটাইল বিশ্ববিদাালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং লেদার টেকনোলজি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট হিসেবে ন্যস্ত করা হয়েছে। তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদাালয় স্থাপন করা হয়েছে- ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদাালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। মাদ্রাসার ফাযিল ও কামিলস্তরের শিক্ষা প্রসারের জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খসড়া আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনয়ন ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য “The Private University Act 2010″ কার্যকর হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায়, প্রতীয়মান হয় যে, দু’বছরে শিক্ষানীতির প্রায় ২০% – ২৫% বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন, ১৫-৪৫ বছর বয়সীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানক্রম নির্ধারণের জন্য ‘এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংযোজন, স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন প্রভৃতি কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদিও প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে খবর বেরিয়েছে, কিন্ত ফলপ্রসূ কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়।এতদসত্ত্বেও সম্ভাবনা অনেক। শিক্ষা গবেষক, শিক্ষা আন্দোলনের নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদ যথার্থই বলেন, ‘‘সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব না থাকলে এবং সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে সরকারের এ-মেয়াদে শিক্ষানীতির অন্তত: ৩০% অর্জন সম্ভব হবে।’’ কেউ যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করেন তবে একবাক্যে বলবেন যে, শিক্ষা নীতির বাস্তবায়নের দিকটি সময় ও জাতির সীমিত স¤পদের মানদন্ডে, নি:সন্দেহে, সন্তোষজনক।

শিক্ষানীতির সমালোচনা করে কিছু পেশাজীবী সংগঠন স্ববিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তারা বলেন, ‘‘ইতোপূর্বেকার কুদরাত-ই-খুদা ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত্ব না পাওয়ার বরাবরই এ-জাতি সে বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০-কেও খুদা এবং হক কমিশনেরই প্রতিরূপ (replica) বলে মনে হয়েছে। এজন্যই এ শিক্ষানীতিতে অনেক ভাল প্রস্তাব থাকার পরও জাতি তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না।’’ তারা আরো বলেন, ‘‘—– এ শিক্ষানীতি বাস্তাবায়িত হলে একজন সাধারণ ধারার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের সূচনা হতে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে এ-শিক্ষানীতি কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না।’’ (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ.৪, ১৬) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একমাত্র শিক্ষানীতি যেখানে শিক্ষাধারা নির্বিশেষে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাধ্যতামূলক। সুতরাং উল্লিখিত মন্তব্য যে ভিত্তিহীন, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উস্কানিমূলক তাতে কোন সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিয়া ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম. ওসমান ফারুক শিক্ষানীতির যে পর্যালোচনা ও সমালোচনা করেছেন তা উল্লেখের দাবিদার। তাদের বক্তব্যে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন বিষয়ে সংশয় প্রকাশ পেলেও তা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। প্রফেসর মিয়া বলেন যে, ‘প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০ -এর অনেক কিছু পূর্বেও ছিল। প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার বিষয়টি নতুন নয়, আগেও এ – সুপারিশ ছিল, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কেউ তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি; এসরকারও পারবে না।’ ড. ওসমান ফারুক বলেন যে, ‘শিক্ষানীতিতে বেশ সহজ সাবলীল ভাষায় রচিত, সকলে এটি বুঝতে পারবে।’ তিনি শিক্ষানীতিকে সমর্থন করে ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে ‘প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে পারলে ভালো; কিন্তু এটা অনিবার্য নয়, বাস্তবে এটা অসম্ভবও বটে।’ তিনি মূলত শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নের প্রতিই গুরুত্বরোপ করেছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ জুন ২০১০)। তাদের উভয়ের মতে, শিক্ষানীতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনায় অনেক উৎকৃষ্ট উপাদান রয়েছে; তবে সেসব বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কেননা, প্রয়োজনীয় বাজেট লাগবে, ভৌত অবকাঠামো লাগবে, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ লাগবে। এ বক্তব্যের সাথে খুব বেশি দ্বিমত না করেই শুধু একথা সংযোজন করা যায় যে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ – এসব কিছুই শিক্ষা নীতির অংশ বিশেষ। আর একথা সত্য যে কোন কিছুর বাস্তবায়নই হলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নি:সন্দেহে, সীমিত সম্পদের দেশে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও হতে হবে ধারাবাহিক, পর্যায়ক্রমিক।

তবে এটি ঠিক যে, শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত বাজেট আশাব্যঞ্জক নয়। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ ও মোট বাজেটের ২০ ভাগ বরাদ্দের কথা থাকলেও ২০১১-২০১২ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ১২ শতাংশ। এ চিত্র আরো হতাশাগ্রস্থ করে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের সংশ্লিষ্ট খাতের বাজেট। বাজেটের আয়তন বড় হওয়ায় ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে ১৫৭১ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, তবে জিডিপির এবং মোট বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট, তিলে তিলে হলেও, বৃদ্ধি পাবে, সেখানে উল্টো ২০১১-২০১২ -এ শিক্ষাখাতে (প্রাথমিক, গণশিক্ষা, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা প্রযুক্তি, মাদ্রাসাসহ) জিডিপির ২.৩% ও মোট বাজেটের ১২% -এর স্থলে ২০১২-২০১৩ -এ যথাক্রমে ২.২% ও ১১.৫% বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র তিন বছরে সরকারের যে অভূতপূর্ব সাফল্য তাই হয়তো বাজেট প্রণেতাদের এ-ক্ষেত্রে দৃষ্টি কাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত: ‘বেশি ভালো ভালো না’ – প্রাচীন সেই বাংলা প্রাবাদটি শিক্ষা-বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয়েছে। প্রসঙ্গত, দক্ষিন এশিয়ার আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুগ্মভাবে বাংলাদেশ ও নেপালের শিক্ষা-বাজেট নিম্নতম, সর্বোচ্চ হলো শ্রীলঙ্কার। উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর নীতিমালায় শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬% এবং মোট বাজেটের ২৫% বরাদ্দের পরামর্শ রয়েছে।

সদ্দিচ্ছা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে সীমিত স¤পদের মধ্যেও যে মহৎ কিছু করা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’। ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মত ও পরামর্শ ধারণ করেই প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে এ শিক্ষানীতি। অন্যসবের বিপরীতে বাস্তবায়নের মধ্যেই রয়েছে এর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা শিক্ষানীতির একটি মৌলিক দর্শন। মানবিক ও নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কর্মমুখী মানবস¤পদ বিনির্মানে সহায়ক গুনগত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা ও নীতিমালা রয়েছে এ-শিক্ষানীতিতে। মৌলিক অধিকার হিসেবে সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যে রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব তার প্রতিফলন ঘটেছে এর পাতায় পাতায়। তবে দায়িত্বের সঙ্গে দায় আছে। এই দায় আর্থিক দায়। আর্থিক দায় বহন ছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে কী? কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘‘শিক্ষার বাহন’’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘‘শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই।’’ রবীন্দ্রনাথ( সঙ্কলন, বিশ্বভারতী, ১৪০১, পৃ. ২৩)। মূলত: আমাদের কথা, কাজ ও চাহিদা -এসবের মধ্যে প্রয়োজন অধিকতর সামঞ্জস্য, সমন্বয়; গড়মিল বা হেরফের নয়। আর হেরফের থাকলে কাঙ্খিত সাফল্য আবদার হিসেবেই থাকবে। কবি গুরুর ‘‘শিক্ষার হেরফের’’ শীর্ষক প্রবন্ধ এক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে: ‘‘আমাদের হেরফের ঘুচিলেই আমরা চরিতার্থ হই। শীতের সহিত শীতবস্ত্র, গ্রীষ্মের সহিত গ্রীষ্মবস্ত্র কেবল একত্র করিতে পারিতেছিনা বলিয়াই আমাদের এত দৈন্য, নহিলে আছে সকলই। এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাই আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও।’’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঙ্কলন, বিশ্বভারতী, ১৪০১, পৃ. ১৫)

ডক্টর মো. আখতারুজ্জামান: জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য। অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Published in: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/6225

Sunday, August 12, 2012

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমিতি ফেডারেশনের নয়া কমিটি

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সমিতির সদ্য বিদায়ী সভাপতি অধ্যাপক মো. নুরুল আলম।কমিটিতে রয়েছেন, সহ-সভাপতি পদে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কে এম রেজানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথি্বলা নাজনীন নীলিমা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সরিফা সালোয়া ডিনা, কোষাধ্যক্ষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ সেলিম, যুগ্ম মহাসচিব বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ শামছুদ্দিন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।

Wednesday, August 8, 2012

শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো – ১

ড. রমিত আজাদ 

“মানুষ কি আর এমনি বটে,
যার চরণে জগৎ লুটে…..।”
মানুষের মর্যাদা ও মহত্ব বোঝার জন্য গানের এই দুটি চরণই যথেষ্ট। মানুষের সবচাইতে দুঃসাহসিক অভিযান হলো জ্ঞানের জগতে। জ্ঞানের সংগ্রহ, সন্চালন, সংযোজন এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টির যে আয়োজন তাকে আমরা শিক্ষা বলি। এই শিক্ষাই মানব সভ্যতার সবচাইতে বড় উদ্ভাবন। জ্ঞানের সাধনা মানুষকে দি্যেছে গভীর অন্তদৃষ্টি।

শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা করতে গেলেই শিক্ষক বিষয়ক আলোচনাটিও সেখানে সরাসরি এসে উপস্থিত হয়। ২০০৬/২০০৭ -এর দিকের কথা, বাংলাদেশের একজন সেলিব্রেটির সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজেও একজন শিক্ষক । একটি আড্ডার আসরে তিনি সৃজনশীল পদ্ধতির গুরুত্ব বোঝাচ্ছিলেন। একজন শিক্ষক হিসাবে আমি সেই আলোচনায় অংশ নিয়ে বললাম, ” স্যার শিক্ষার উন্নয়নের জন্যে ভালো শিক্ষা পদ্ধতি আরোপ করা অবশ্যই জরুরী। তবে ভালো শিক্ষার প্রথম শর্তই হলো ভালো শিক্ষক, এটাই প্রথমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা বহুকাল ধরে চলছে। এ সম্পর্কে অনেক বিতর্ক হয়েছে রাজনৈতিক কর্মসূচীও গৃহিত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো যথেষ্ট ভালো । আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সরকার প্রায়শঃই সম্পদের অভাবের ধুয়ো তুলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সরকার মনযোগ দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যথা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইত্যাদি এমনকি তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের বেতন কাঠামো পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারবে যে, আমাদের শিক্ষক গোষ্ঠি কিভাবে বন্চিত।
দেশের অথনৈতিক বাস্তবতা-র ধুয়োটাই সব সময় তোলা হয়। ৬০-এর দশকে আমাদের দেশের অথনৈতিক অবস্থা এখনকার তুলনায় অনেক খারাপ ছিল, অথচ তখনই শিক্ষকদের অথনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশী ছিল। যেই রাজনীতিবিদ ও আমলারা পলিসি মেকার তাদের বাড়ী-গাড়ী-র দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন তো, দেশের অথনৈতিক অবস্থার ছাপ সেখানে দেখতে পান কিনা। শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো হলে অন্যান্য পেশাজীবিদের হিংসা করা কি ঠিক হবে? প্রথমতঃ শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যে, যেকোন শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই এখানে আসা যায় । ডাক্তার, ইন্জিনীয়ার, পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিজ্ঞানী, সমাজবিদ, ইতিহাসবিদ, ইত্যাদি, এমনকি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারাও এই পেশায় আসতে পারেন, শর্ত কেবল একটাই – ভালো ছাত্র হতে হবে, মেধাবী হতে হবে। দ্বিতীয়তঃ অন্যান্য পেশাজীবিদের ছেলেমেয়েদের তো শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঐ শিক্ষকদের হাতেই তুলে দিতে হচ্ছে। নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই, তাদেরও উচিত এই আন্দোলনে শরীক হওয়া।
 
২০০৯ সালে একটি জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০০৯ (চুড়ান্ত- খসড়া) প্রণয়ন করা হয়। সেখানে জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক পয়েন্টই ছিল, কিন্তু নীতি বাস্তবায়নে মূল ভুমিকা রাখবেন যে শিক্ষকেরা তাদের বিষয়টি প্রায় উহ্যই থেকে যায়। এই নীতি নিয়ে অনেক প্রকার আলোচনা-সমালোচনাই হয়েছে কিন্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তেমন কোন প্রাধান্যই পায়নি।
৭ই ডিসেম্বর ২০১০-এ জাতীয় সংসদে জাতীয় শিক্ষা নীতি পাশ হয়। এখানে শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব নিরূপন করেছেন। শিক্ষামন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৪টি উপ-কমিটি গঠন করে দ্রুত রিপোর্ট দেয়ার জন্য বলেছেন । শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্বগুলো নিম্নরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে ঃ- * শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা: শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা শুধুমাত্র সুবিন্যস্ত বাক্য গাথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে প্রকৃত অর্থে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা দেয়া না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সম্ভব নয়। সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের আত্মপ্রত্যয়ী, কর্মদক্ষ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এক একজন সফল অবদানকারী হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। এজন্য শিক্ষকদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, শিক্ষাখাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রাপ্ত বৈদেশিক বৃত্তি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ শিক্ষকদের দেয়া হবে। আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। * শিক্ষকদের দায়-দায়িত্ব ঃ প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দক্ষতা, মর্যাদা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ জরুরি। তাদের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা মূল্যায়নের অব্যাহত ব্যবস্থা থাকবে। * শিক্ষার সকল স্তরের জন্য উপযুক্ত দু’টি বিষয়ে অর্থাৎ মর্যাদা ও বেতনভাতাদিসহ সুযোগ-সুবিধার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা সুপারিশ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতিনিধিত্ব সংবলিত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হবে। * মহিলা শিক্ষকদের চাকুরিতে নিয়োগসহ কোন ক্ষেত্রেই বৈষম্য রাখা হবে না। সমযোগ্যতাসম্পন্ন মহিলাদের বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। * শিক্ষার সকল পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জেষ্ঠ্যতা এবং শিক্ষার সকল পর্যায়ে তাদের শিক্ষকতার মান বিবেচনায় আনা হবে। সেজন্য শিক্ষকতার মান নির্ণয় করার পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে। গৃহীত প্রশিক্ষণও শিক্ষার সর্বস্তরে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে উন্নতমানের প্রকাশনা ও গবেষণা এবং গৃহীত প্রশিক্ষণ বিবেচনায় নেয়া অব্যাহত থাকবে। * শিক্ষাক্ষেত্রে ও সমাজে বিশেষ অবদান, মৌলিক রচনা ও প্রকাশনার জন্য শিক্ষকদের সম্মানিত ও উৎসাহিত করা হবে। * মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচিত শিক্ষকদের শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদায়ন করা হবে এবং তাদের পদোন্নতির সুযোগ থাকবে। * শিক্ষক সংগঠনগুলোর উচিত শিক্ষকদের নৈতিক আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা এবং এ নীতিমালা অনুসৃত হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা । এ ব্যাপারে সরকারও একটি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। * দায়িত্ব পালনকালে পরীক্ষায় নকল ও অসাদুপায় অবলম্বন বন্ধ করতে গিয়ে শিক্ষকগণকে যাতে সন্ত্রাসী ও দৃষকৃতকারীদের হামলার মুখোমুখি হতে না হয় সে লক্ষ্যে তাদের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। * পেশাগত আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপসমূহ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হবে এবং বিধিসম্মতভাবে প্রয়োগ করা হবে। * প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে ছুটির সময় ব্যতীত শিক্ষা সংক্রান্ত কাজের বাইরে অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ত করা হবে না। * সরকারি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অন্যান্যদের মতো অর্জিত ছুটির ব্যবস্থা থাকবে। * শিক্ষার্থীদের মনে সুকুমার বৃত্তির অনুশীলনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি, তাদের মধ্যে শ্রমশীলতা, সহনশীলতা, ধৈর্য্য, নিজ ও অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং অধ্যাবসায়ের অভ্যাস গঠন; কুসংস্কারমুক্ত, দেশপ্রেমিক ও কর্মকুশল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকদের প্রধান কর্তব্য। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ব্রত নিয়ে শিক্ষকবৃন্দ মনোযোগ সহকারে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করবেন। এজন্য শিক্ষকবৃন্দের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করা বাঞ্চনীয় । * শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব বাস্তবায়ন করাই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এত কিছুর পরেও দেখা গিয়েছে । সরকার শিক্ষকদের জন্য প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস ব্যতীত বেশি কিছু করেছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসে কি পেট ভরবে ?
৩রা আগস্ট ২০১১ সালের সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে।ইউজিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইউজিসি চেয়ারম্যান বৈঠকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এতে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অবস্থান সংসদ সদস্যদের পরের ধাপে নির্ধারণ করা, উপাচার্যদের সম্মানিত ভাতা তাদের পদ, দায়িত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, ইউজিসিকে সম্প্রসারিত করে কার্যপরিধি বিস্তৃত ও ক্ষমতায়ন করে উচ্চশিক্ষা কমিশন হিসেবে রূপান্তরিত করা, মঞ্জুরি কমিশনের বাজেটের ঘাটতি পূরণ করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদে গ্রহণ করা উচ্চশিক্ষা কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়। ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রস্তাব করেন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় বা উচ্চশিক্ষা কমিশনের প্রধান হবেন একজন পূর্ণমন্ত্রী অথবা পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদার দক্ষ, যোগ্য, প্রবীণ, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। একই সঙ্গে কমিশনের পূর্ণকালীন সদস্য বাড়িয়ে তাদের কেবিনেট সচিবের পদমর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
Click This Link
শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১১
শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা
বহুল আলোচিত জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এর জন্য এখনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে শিক্ষানীতির আলোকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক এবং দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর নির্ধারণ করায় শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন স্কেল নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় ২৬ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক কোনোভাবেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে রাজি নন। আবার কলেজের শিক্ষকরা চান না স্কুলশিক্ষকে পরিণত হতে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠদানকারী কলেজশিক্ষকরাও প্রভাষক পদ হারাতে রাজি নন। সূত্রমতে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে অনেক কলেজের অস্তিত্বও এখন হুমকির মুখে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানকারী কলেজ প্রধানদের পদবি অধ্যক্ষ। নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে তারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে অভিহিত হবেন। এটা তারা মেনে নিতে পারছেন না। কেননা অধ্যক্ষ আর প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা ও বেতন স্কেল এক নয়। একইভাবে প্রভাষক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকের বেতন স্কেলও এক নয়। জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে আট হাজার ‘ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ রয়েছে। এর অধ্যক্ষদের বেতন স্কেল ২২ হাজার ৫০০ টাকা। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর হয়ে গেলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৫ হাজার টাকার স্কেলে বেতন নিতে হবে। একইভাবে প্রভাষকরা ১১ হাজার টাকার স্কেল থেকে স্কুলশিক্ষকের ছয় হাজার ৮০০ টাকার স্কেলে নেমে আসবেন।
এ অবস্থায় শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতনভাতা কীভাবে নিরূপিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট তিনটি অধিদফতরে এখন ঘনঘন সভা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষানীতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভা থেকে তিন অধিদফতরকেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষার ওপর আলাদা প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শিক্ষক সংগঠনের নেতারা বলেছেন, পদমর্যাদা ও বেতন স্কেল ঢেলে সাজালেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এতে শিক্ষকরাও খুশি হবেন। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, হঠাৎ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন কাঠামো পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে সরকার শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সবাইকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কোনোভাবেই শিক্ষকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হবে না। তাদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকার আন্তরিক।’ প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল শিক্ষানীতি প্রণয়নে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ওই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে তাদের সুপারিশ জমা দেয়। গত বছর মে মাসে মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুমোদন পায়। পরে সেটি জাতীয় সংসদেও গৃহীত হয়। তবে বিরোধী দল ও সমমনা ধর্মভিত্তিক দলগুলো তখন এর বিরোধিতা করে। অবশ্য দেশের অনেক শিক্ষাবিদই শিক্ষানীতিকে স্বাগত জানিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন।
Click This Link
(চলবে)
(এই লেখাটিকে আমি পূর্ণাঙ্গ বলতে চাইনা। উপরন্তু আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকার কারনে, লেখাটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়াও স্বাভাবিক। এই বিষয়ে আমি পাঠকদের সাহায্য চাইব। আমি আশা করি, পাঠকদের মন্তব্য ও প্রতিমন্তব্যে লেখাটির ত্রুটি ধরা পরবে এবং আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লেখাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।)
Published in: http://www.cadetcollegeblog.com/ramit/37154

Saturday, April 7, 2012

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্কট রাজনৈতিকবোধে না কাঠামোতে?


মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান



আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে সমালোচনার শেষ নাই। সবচাইতে বড় সমালোচনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান রাজনৈতিক বিভেদ এবং দলাদলি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব-শিক্ষায় অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে সামগ্রিক অর্থে। এই পিছিয়ে পড়ার মানে কি এই যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পুরোপুরি ব্যর্থ ও সম্ভাবনাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে? রাজনীতির কবলে পড়ে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো “ওয়াসা” অথবা “আদমজী” হয়ে পড়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজ়ার জন্য, আমি মনে করি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই সঙ্কটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা খুব জরুরী।

আসলে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐতিহ্যগত ভুমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অন্যতম বিপদ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রে যারাই ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হন, তারাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করার ব্যপারটিকে অন্য যে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের চাইতে কম গুরুত্ব দেন না। ফলে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তাই রাষ্ট্রের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্কের ভিত্তি হয়ে ওঠে। আর সেটা কাটাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা একদিকে যেমনি তাদের নিজস্ব ছাত্র সংগঠনের দ্বারা বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেন, অন্যদিকে একরকমের পোষক-পোষিতের (পেট্রন-কায়েন্ট) কাঠামোর বিকাশ ও লালনকে মূল কাজ বলে মনে করেন। মূলত এই কাঠামোটি সামরিক সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক দলগুলোও এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছে। আর এই সুযোগে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের একটি অংশ সাদা-নীল-আকাশী-হলুদ বর্ণে বিভক্ত হয়ে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে তোষনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এটার একটা বড় কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর শিক্ষকদের জীবনযাপনে স্বাভাবিক মানের অনিশ্চয়তা আর অভাববোধ। শিক্ষার্থীরাও একই অবস্থার শিকার। তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির প্রাথমিক সূচনা ঘটে হলে আসন পাওয়াকে কেন্দ্র করে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বিস্তারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে এবং এর বিকাশের ধারাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছে প্রতিনিয়ত। তাই ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যারা অধিষ্ঠিত হন, তাদেরকে টিকে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার উপর নির্ভর করতে হয় না। বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সুসম্পর্কটাই মূল নিয়ামক। তারপরও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার জন্য বাজারকেন্দ্রিক চটকদারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করতে হয়না। কেননা অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যহীন অথবা কম সামর্থ্যের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো অন্যতম ভরসা কিংবা আস্থার জায়গা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একপেশে সমালোচনা দাতাগোষ্ঠীর বেসরকারীকরণের দর্শণ আর প্রক্রিয়াকে আরো অনেক বেশী শক্তিশালী করে। এতে বঞ্ছিত মানুষগুলোর শিক্ষা-বঞ্চনার ক্ষেত্র আরো বেশী প্রসারিত আর শক্তিশালী হয়, অন্য কিছু নয় । স্কুল আর কলেজ পর্যায়ে এটা এখন রূঢ় বাস্তবতা। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের জন্য সরকারী স্কুল-কলেজে পড়াটা যেন এখন একটা মহাপাপের ভাগীদার হওয়া! যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, স্ংগতি আছে, তারা আর এই মহাপাপের ভাগীদার হতে চায়না। সব কিছু দেখে শুনে মনে হছে এখন মনে হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পালা শুরু হয়েছে! 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা রাজনৈতিক বোধের লালনে বা রাজনৈতিক ঐতিহ্যে নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতে যে অপরাজনীতি ও দুষ্ট রাজনীতি বাসা বেঁধেছে সেটাই মূল সমস্যা। এই সংকটপূর্ণ কাঠামোর সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে আরো দু‘টি নতুন বিষয়। তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষকদের এনজিও কার্যক্রমে অংশগ্রহন এবং অপরটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যখন সমালোচনা হয় তখন অনেকের মাঝে একটা বড় প্রবণতা দেখা যায় যে, ‘নন্দঘোষ রাজনীতিকে’ সবসময় দোষারোপ করা। অথচ অপরাজনীতি উৎপাদনকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ কিংবা আলোচনা হয়না! বর্তমান সময়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। 


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং চীনসহ আজকে যদি এ রকম আরও কয়েকটি দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে ঐ সব দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে। এটা শুধু ‘তথ্য ও জ্ঞাননির্ভর’ রাজনৈতিক বোধ বিবর্জিত মেধাকে কেন্দ্র করে ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। এক্ষেত্রে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণই যথেষ্ট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেবার পার্টি কর্তৃক পরিচালিত লেবার-স্টুডেন্ট ক্লাব বৃটেনের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। লেবার পার্টির এমপি এবং মন্ত্রীসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই রাজনৈতিক ক্লাবের সাথে ছাত্রাবস্থায় যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট রয় জেনকিনস, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র, ডেভিড মিলিব্যান্ডসহ মিডিয়া টাইকুন রুপার্ড মারডকের নাম উল্লেখযোগ্য। বৃটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সফরের সময়, দেশটির প্রগতিশীল রাজনীতিতে এই ক্লাবের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। 

শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে বৃটেনের বিজনেস সেক্রেটারি ভিনস কেবলের সফরকে বাতিল করতে বাধ্য করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৬০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা কে না জানে। সাম্প্রতিক সময়ে অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রিট আন্দোলনে নিউ ইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাকে খাটো ক’রে দেখার কিছু নাই। রাষ্ট্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাদের অর্জিত জ্ঞান, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বোধশক্তি বাড়াবে, এটাই তো উচ্চ শিক্ষার অনেকগুলো লক্ষের একটা । ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা কিন্তু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের নেতৃত্বেই ঘটেছিল। 

তবে বাংলাদেশের সাথে অন্য দেশগুলোর পার্থক্য হলো এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঐ রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন অনেক সুস্থির এবং দলীয়-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রনের নয়। চীন অবশ্য রাজনৈতিক আদর্শিক কারণে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বরং রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা কার্যকক্রমের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা আমরা এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান উন্নয়ন ও তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হলো- রাষ্ট্রের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের পুনর্নির্ধারণ এবং পুনর্মূল্যায়ন। আর সেটা করার জন্য আজকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে দূর্বৃত্তের আর দখলের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। আর তার সাথে সাথে রাষ্ট্রের একটা উন্নয়ন দর্শন নির্ধারণ করা। সেটা করতে ব্যর্থ হলে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন অন্য যে কোন ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বমানে পৌছাতে পারবে না। আর পিছিয়ে পড়ার যে সামগ্রিক আর ঐতিহ্যগত ধারা সেটা থেকেও বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে মুক্তি পাবে না। 



মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটিতে), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত।

Source: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/5219













Tuesday, December 27, 2011

ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"

আহ্‌মদ ইকরাম আনাম

ক্লাসে স্যার একটা ঘটনা বলেছিলেন। একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা গিয়েছেন বিসিএস প্রশাসন অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে। প্রথম দিন প্রশিক্ষণে রিসোর্স পারসন হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তিনি বক্তব্য শুরু করলেন এভাবে, "শুনেন, প্রশাসন ক্যাডার হচ্ছে ক্যাডারের রাজা। সুতরাং, আপনারা অন্য কোন ক্যাডারকে পুছবেন না।"

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দোষারোপ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং আমাদের দেশের সিভিল সার্ভিসের কিছু অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলাই আমার লক্ষ্য। মুনতাসীর মামুন এবং জয়ন্তকুমার রায় রচিত "প্রশাসনের অন্দরমহল" শীর্ষক গ্রন্থে সরকারি চাকরিতে স্পেশালিস্ট এবং জেনারালিস্ট নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। প্রশাসনের গতিশীলতার জন্য রাষ্ট্রে জেনারালিস্টদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু কীভাবে একটি দেশে জেনারালিস্টরা মোটামুটি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে সে বর্ণনাও বইটিতে বিদ্যমান। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদচারনা। তারা যে অবৈধভাবে সে পদগুলোতে নিযুক্ত আছেন তা কিন্তু নয়, বরং আইনই তাদেরকে সব জায়গায় শীর্ষ পদের অধিকার দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা পুলিশ বাহিনীর কথা বলতে পারি। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন একটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, এটি তার কাজের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ। তাদের বেতন-ভাতা সব হয় এই মন্ত্রণালয় থেকেই। এই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন স্বরাষ্ট্র সচিব যিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। ফায়ার সার্ভিস, বর্ডার গার্ড, আনসার ও ভিডিপি, বহির্গমন পাসপোর্ট বিভাগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর- এসব ক'টি প্রতিষ্ঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর প্রধান হতে পারেন, একজন কারা কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদ হিসেবে কারা অধিদপ্তরের প্রধান (এটি আবার সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য হয়ে গিয়েছে) হতে পারেন কিন্তু একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা তাদের সবার চেয়ে উপরে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থাৎ সচিব হতে পারেন। এক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে একই দৃশ্য সব মন্ত্রণালয়ে। 

একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হতে পারেন কিন্তু স্বাস্থ্য সচিব হবেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বা জেনারালিস্ট। শিক্ষা হোক আর অর্থই হোক- সব মন্ত্রণালয়ের প্রধান একজন সচিব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন জেনারালিস্ট বা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা কি সব বিষয়ে পারদর্শী? তিনি কি সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ? ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা যেমন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধানও হন, জাতীয় জাদুঘরেরও প্রধান হন আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধানও হন। তিনি কি আইন থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মত পুলিশি কাজ, স্বাস্থ্যসেবার মত চিকিৎসকের কাজ বা জাদুঘর পরিচালনার জন্য ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার কাজ সবই পারেন? একজন মানুষ এতকিছু কিভাবে পারেন? অনেকেই বলতে পারেন তিনি তো প্রশাসনিক কাজ করেন, আর প্রশাসনিক কাজ তো সব জায়গায় একই। তাহলে আমার প্রশ্ন, তিনি সব জায়গায় প্রশাসনিক কাজ করতে চান ভাল কথা কিন্তু সব জায়গায় তিনিই কেন সর্বোচ্চ পদের মালিক হবেন? সরকারি সব প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীন। মন্ত্রীর পরে সেই মন্ত্রণালয়ের বস হচ্ছেন একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। খুব অল্প ক্ষেত্রে আমরা বিশেষজ্ঞদের মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দেখেছি। পুলিশের সাবেক একজন মহাপরিদর্শক স্বরাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম ঘটনা। 

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একবার উন্নত চিকিৎসার জন্য কোন এক যন্ত্র ক্রয় করা হয়। কোন এক উপলক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় হাসপাতালে আসেন। সেখানে বক্তব্য দেয়ার সময় সদ্য ক্রয়কৃত যন্ত্রটি সম্পর্কেও বলতে হবে। বক্তৃতা দেয়ার আগে তিনি চিকিৎসকদের কাছে কোন রোগে উক্ত যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয় তা জানতে চান। যেকোনো চিকিৎসকই ঐ যন্ত্র কোন রোগে ব্যবহৃত হয়, কীভাবে কেন ব্যবহৃত হয় বলতে পারেন। কিন্তু সচিব মহোদয় চিকিৎসাবিজ্ঞান তো দূরে থাক, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীও নন। তাকে সেই যন্ত্রের কার্যকারিতা বোঝাতে গিয়ে চিকিৎসকদের খবর হয়ে গেল। এখানে সচিব মহোদয়ের দোষ দেখি না। এটা হল আমাদের সিস্টেমের দোষ। ডাক্তারদের বস যদি প্রশাসন ক্যাডারকে বানানো হয় তাহলে ফলাফল এমনই ঘটবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়গণ কীভাবে প্রকৌশল বিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আমার জানা নাই। চিকিৎসকদের অনুষ্ঠানের মত কিছুই ঘটবার কথা সেখানেও। 

আগেই বলেছিলাম, প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য জেনারালিস্টদের দরকার আছে। একেক মন্ত্রণালয়ের একেক কাজ। মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব, উপ-সচিব বা যুগ্ম- সচিবদের কাজ মূলত ঐ মন্ত্রণালয়াধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, পদন্নোতি, বদলি, পেনশন কিংবা অধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ বরাদ্দ, ফাইল তৈরি ও মেইনটেইন করা, অন্যান্য দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা ইত্যাদি। কিন্তু প্রশাসনিক পদের কর্মকর্তাদের জন্য কেন সকল মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদগুলো সংরক্ষিত থাকবে? একই যোগ্যতা এবং একই পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে সাধারণ বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত আরও অনেক ক্যাডারে কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। এক পররাষ্ট্র ক্যাডার ব্যতীত আর সব ক্যাডারদের বস কেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই হন? কেন তাদের হাতেই সব ক্যাডারদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার সংরক্ষিত থাকে? কর বা শুল্ক আদায়ে কর ও শুল্ক ক্যাডার রয়েছে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। এটি কি কর ও শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রতি বৈষম্য নয়? পরিবার পরিকল্পনার জন্য পৃথক ক্যাডার থাকলেও পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ভাগ্য ভালো যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একজন চিকিৎসক এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক একজন পুলিশ কর্মকর্তাই হন। সেখানে এখনও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসে পড়েন নি। 

প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা খুব বেশি হলে তাদের অধিদপ্তরের প্রধান হতে পারেন। কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ে প্রধান থাকেন সেই অ্যাডমিন ক্যাডারই। সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদ যদি নিজ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে সাধারণ বিসিএসে এতগুলো ক্যাডারের দরকার কী? শুধু প্রশাসন ক্যাডার থাকলেই হয়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যদি সব মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে পারেন তাহলে তারা সব অধিদপ্তরেও কাজ করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারলে করও আদায় করতে পারবেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে পারলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপপরিচালকও হতে পারবেন। খামোখা আর তথ্য ক্যাডারের দরকার কী? 

এক স্বশস্ত্র বাহিনী আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে সব জায়গায়তে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই টপ লেভেল বস। সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব তো প্রশাসনিক। তিনি তো আর যুদ্ধ করেন না। সেনাবাহিনী প্রধানের পদটাও প্রশাসনে ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় না কেন? দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা সাধারণত পেশাজীবী (স্পেশালিস্ট) হয়। সরকারি চাকরিতে তাদের বদলি, নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতনের হিসাব-নিকাশ রাখেন যারা, তারা কী করে তাদের বস হন? একই লোক যদি স্বাস্থ্য সচিব, যোগাযোগ সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব কিংবা তথ্য ও যোগাযোগ সচিব- সবই হতে পারেন তাহলে তিনিই কেন চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ অন্যান্য সব সেবা দিতে পারেন না? 

আমাদের দেশ আজ আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দী। এই আমলাতন্ত্র উপমহদেশে চালু করে দিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশরা। তারা নিজেদের দেশে এই ব্যবস্থার অনেক সংস্কার সাধন করেছে। আমরা এখনও বের হয়ে আসতে পারি নি এই শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে। ভারতেও আমলাতন্ত্র রয়েছে তবে আমাদের মত হুবহু ব্রিটিশ সিস্টেম তারা ধরে রাখে নি। তারা প্রশাসন, পুলিশ এবং বনের ক্ষেত্রে আলাদা সার্ভিস গঠন করেছে। এক পরীক্ষা দিয়ে সবাইকে নিয়োগ দেয়ার সংস্কৃতি থেকেও তারা বের হয়েছে। সব পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বা আমলাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করেছে অনেকাংশে। কেননা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সুবিধা-অসুবিধা কীভাবে বুঝবেন? তাদের হাতে সব জায়গার ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ কি বৃদ্ধি পায় না? জেনারালিস্টরা কেন অল সাবজেক্ট স্পেশালিস্ট হয়ে উঠবেন? 

বিচার বিভাগকে আমলাতন্ত্র থেকে আলাদা করে বাংলাদেশ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেসি বা আইনি আদেশ জারির দায়িত্ব বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই থাকা উচিৎ, আমলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নয়। যার যেটা কাজ তাকে দিয়েই সেটা করানো উচিৎ। সব জায়গায় এক লোক- এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নইলে ফাইল টেবিল থেকে টেবিলেই ঘুরবে, ফাইল ঘুরতে ঘুরতে পদোন্নতি আটকে থাকবে আর পুলিশ সচিব রাতারাতি হয়ে যাবেন ইঞ্জিনিয়ার সচিব বা ডাক্তার সচিব 

Wednesday, August 3, 2011

শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো বিবেচনাধীন , প্রধানমন্ত্রী

সমকাল ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিলের জন্য শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজ উদ্যোগে তহবিল সংগ্রহের জন্য উপাচার্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ আহ্বান জানান।
ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ইউজিসির সব সদস্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা ছিলেন।বাসস জানায়, সাক্ষাৎকালে উপাচার্যরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ও নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার কথা তুলে ধরে তা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের আশ্বাস দেন। তিনি শিক্ষা খাতের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, সরকার ইতিমধ্যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে এবং তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষার কাঙ্ক্ষিত প্রসার ঘটেনি। কারণ তাদের আমলে দলীয়করণ করে শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার অত্যন্ত পরিশ্রম করে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য তিনি শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অবদানের কথা তুলে ধরে তাদের ধন্যবাদ জানান।শেখ হাসিনা বলেন, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১) দেশে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এবার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সরকার বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া আরও নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে বক্তব্য রাখেন মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এমএ করিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান ও প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ইউজিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইউজিসি চেয়ারম্যান বৈঠকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এতে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অবস্থান সংসদ সদস্যদের পরের ধাপে নির্ধারণ করা, উপাচার্যদের সম্মানিত ভাতা তাদের পদ, দায়িত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, ইউজিসিকে সম্প্রসারিত করে কার্যপরিধি বিস্তৃত ও ক্ষমতায়ন করে উচ্চশিক্ষা কমিশন হিসেবে রূপান্তরিত করা, মঞ্জুরি কমিশনের বাজেটের ঘাটতি পূরণ করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদে গ্রহণ করা উচ্চশিক্ষা কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়। ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রস্তাব করেন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় বা উচ্চশিক্ষা কমিশনের প্রধান হবেন একজন পূর্ণমন্ত্রী অথবা পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদার দক্ষ, যোগ্য, প্রবীণ, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। একই সঙ্গে কমিশনের পূর্ণকালীন সদস্য বাড়িয়ে তাদের কেবিনেট সচিবের পদমর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশন হিসেবে রূপান্তরের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। উচ্চশিক্ষার গতিশীলতার স্বার্থে উচ্চশিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা জরুরি উল্লেখ করে এ বিষয়ে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। এ ছাড়া তিনি উল্লেখ করেন শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারণের বিষয়টি সরকারের চিন্তাভাবনায় আছে ।বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে তহবিল বাড়াতে পারে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু সরকারি তহবিলের দিকে তাকিয়ে না থেকে এ ধরনের বিশেষ তহবিল গঠনের সংস্কৃতি চালু করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের গুণগত মান বাড়ানোর প্রতি উপাচার্যদের দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।

Sunday, September 5, 2010

চিলের হাতে বিপন্ন কান, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নিয়ে বিভ্রান্তি


Ragib Hasan



চিলে কান নিয়েছে, এই শুনে চিলের পেছনে দৌড়ানোটা আমাদের অনেকের প্রিয় স্বভাব। আর সেই চিল যদি বিদেশী চিল হয়, তবে তো কথাই নেই। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিদেশী চিল হলে তো সোনায় সোহাগা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে, এমনকি খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছেও কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঐ তালিকায় অন্য কাউকে কাউকে পেছনে ফেলতে পেরে রয়েছে আত্মহারা হবার পথে। জ্ঞানগর্ভ নানা লেখা আসতে শুরু করেছে, বিশেষজ্ঞরা গবেষণা শুরু করেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা সম্পর্কে "চিন্তাশীলদের" চিন্তার আর কমতি নেই আজ।

(১)

ঘটনার শুরুতে যাওয়া যাক। স্পেনের একটি সংস্থা Consejo Superior de Investigaciones Científicas (CSIC), যা দেশটির বৃহত্তম সরকারী গবেষণা সংস্থা। এর একটি গবেষণাগার এর নাম সাইবারনেটিক্স ল্যাব। এখান থেকেই প্রতি বছর প্রকাশ করা হয় ওয়েবোমেট্রিক্স র‌্যাংকিং অফ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস। সম্প্রতি ২০১০ এর র‌্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে, আর তাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান এরকম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (২৯১৬), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (৪৫৭৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৫৫৩১),আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ (৫৮৮২তম স্থান), ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (৬২১০), ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (৬৩৫৯), ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (৬৮৬০), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (৭০৭৮), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (৭১৯৬), ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (৮৭৫৯), জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় (৮৭৮৯), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (৯৪০৯), আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১০২০৩), ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (১০৪৭৪), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১০৫০৩), ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক বাংলাদেশ (১০৫১৮), চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১০৬৪৭), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (১০৬৬৭), ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (১১০৪৩), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (১১১৪২), ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১১২৩৫), খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১১৪২২) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (১১৬৪৩)। বিস্তারিত র‌্যাংকিং পাবেন এখানে

বলাই বাহুল্য, এই র‌্যাংকিং দেখে পত্রপত্রিকায় তুলকালাম কাণ্ড হয়ে চলেছে। ঢাবির এমন অবস্থা হবারই কথা, এরকম ইঙ্গিত গিয়ে ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক রঙ দেয়ার চেষ্টা চলছে। আবার শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়ানো নিয়েও অনেকে কথা বলছেন। মানবজমিনের একটি রিপোর্টে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছে,



র‌্যাংকিংয়ের দিক দিয়ে পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এমনকি বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান।


(২)

এই র‌্যাংকিং দেখে শুরুতেই খটকা লাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং করাটা বেশ কঠিন একটা কাজ। মার্কিন ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল গত চার বছর ধরে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং করার চেষ্টা করে এখনো তাদের রিপোর্ট বের করতে পারেনি, সেখানে CSIC কি না প্রতি বছর ১২০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বের করে চলেছে! কৌতুহলবশত CSIC এর সাইটে গিয়ে তাদের র‌্যাংকিং এর কৌশল ঘাটতেই থলের বেড়াল বেরিয়ে এলো। এই র‌্যাংকিং আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের বিচার নয়, বরং তাদের ওয়েবসাইটের মানের বিচার!!

কীভাবে? দেখা যাক, CSIC এর র‌্যাংকিং এর ফরমুলা

প্যারামিটার

Size (S). Number of pages recovered from four engines: Google, Yahoo, Live Search and Exalead. For each engine, results are log-normalised to 1 for the highest value. Then for each domain, maximum and minimum results are excluded and every institution is assigned a rank according to the combined sum.

Visibility (V). The total number of unique external links received (inlinks) by a site can be only confidently obtained from Yahoo Search. Results are log-normalised to 1 for the highest value and then combined to generate the rank.

Rich Files (R). After evaluation of their relevance to academic and publication activities and considering the volume of the different file formats, the following were selected: Adobe Acrobat (.pdf), Adobe PostScript (.ps), Microsoft Word (.doc) and Microsoft Powerpoint (.ppt). These data were extracted using Google and merging the results for each filetype after log-normalising in the same way as described before.

Scholar (Sc). Google Scholar provides the number of papers and citations for each academic domain. These results from the Scholar database represent papers, reports and other academic items.

অর্থাৎ, চারটি প্যারামিটার হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে কতোটি ওয়েবপেইজ আছে, বাইরের অন্যান্য সাইট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে কতোটি লিংক এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে কতোটি পিডিএফ ফাইল রাখা আছে, আর গুগল স্কলারে বিভিন্ন একাডেমিক ডোমেইনের প্রতি কতোটি গবেষণাপত্র ও সাইটেশন পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে প্রথম তিনটিই হলো পুরোই ওয়েবসাইটের গুণাগুণ। এবার দেখা যাক, এই চারটি প্যারামিটারকে কীভাবে ফরমুলায় ব্যবহার করা হয়েছে,
Visibility (50%), size (20%), rich files (15%), scholar (15%).

অর্থাৎ, ফরমুলাতে মূল বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে বাইরে থেকে কতোটি লিংক এসেছে। গবেষণার সাথে জড়িত একমাত্র প্যারামিটারটির গুরুত্ব মাত্র ১৫%।

এই ফরমুলাতে কী প্রকাশ পাচ্ছে তাহলে? এখানে প্রকাশ পাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অনলাইন প্রেজেন্স, তথা ইন্টারনেটে উপস্থিতি কতটুকু। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলে, আর গাদায় গাদায় পিডিএফ বা ওয়ার্ড ফাইল দেয়া থাকলে, তাদের র‌্যাংকিং সামনের দিকে চলে আসবে এমনি এমনিই।

ওয়েবে উপস্থিতি কিংবা ওয়েবসাইটের অবস্থা মাপার এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ওয়েবোমেট্রিক্স বা ওয়েব পরিমাপ। ফরমুলা থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মাপ আদৌ এই হিসাবে নেই, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিমাণ অল্পই গুরুত্ব পেয়েছে। CSIC নিজেই বলছে, এই র্যাংকিং এর উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন উপস্থিতি বাড়ানো, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংক কম হলে যেনো তারা তাদের ওয়েবসাইটের মান বাড়ানোতে মনোযোগী হয়, সেটাতে উদ্বুদ্ধ করা, ইত্যাদি। কোনোভাবেই এটা দাবী করেনি CSIC নিজেও যে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদীক্ষার মানের পরিমাপ, অথবা গবেষণামূলক তৎপরতার হিসাব।

(৪)

CSIC এর র‌্যাংকিং এ আগে যাওয়ার উপায় কী? খুব সহজ। অল্প পয়সা খরচ করে ভালো একজন ওয়েব ডিজাইনার লাগবে, যার কাজ হবে ওয়েবসাইটে পাতার সংখ্যা বাড়ানো, আর বিভিন্ন জায়গা থেকে ওয়েবসাইটে ইন-লিংক বাড়ানো। ধরাযাক, বাদুরতলা ইউনিভার্সিটি চাইছে, চৌকিরতলা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে র‌্যাংকে আগাতে। যেহেতু ফরমুলাতে মূল গুরুত্ব (৫০+২০=৭০%) এসেছে ওয়েবসাইটের লিংক এবং পাতার সংখ্যা থেকে, বাদুরতলার ওয়েবসাইট ডিজাইনারের কাজ হবে ওয়েবসাইটে পেইজের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া, আর সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের মাধ্যমে অন্য বিভিন্ন সাইটে বাদুরতলার সাইটের লিংক যোগ করা। (উল্লেখ্য, CSIC এর ফরমুলাতে কিন্তু কোথা থেকে লিংক এসেছে, তার বিচার করা হয়না, বরং কয়টা লিংক আছে, তাই বিবেচ্য, সুতরাং ব্লগে ব্লগে বাদুরতলার সাইটের অজস্র লিংক যোগ করলে তাদের র‌্যাংক বাড়বে)। বাদুরতলার ওয়েব ডিজাইনারের পরের কাজটা হবে তাদের সাইটে হাবিজাবি পিডিএফ, ওয়ার্ড এসব ফাইল রাখা, বিভিন্ন পাতায় ওয়েবপেইজের মধ্যে সেগুলোর লিংক রেখে দেয়া। সেটার গুরুত্ব আবার ১৫%। সব মিলে ওয়েব ডিজাইনারের হাতে আছে ৮৫%। বাকি মাত্র ১৫% হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণাপত্র গুগল স্কলারে কতটুকু এসেছে সেটা। কাজেই অল্প একটু খেটেই বাদুরতলা ইউনি টেক্কা দিতে পারবে চৌকিরতলা ইউনিকে।

অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে এটাকে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানের তুলনা হিসাবে। র‌্যাংকিং কেনো কম, এই নিয়ে ঢাবির শিক্ষকদের তলব করে কৈফিয়ত নেয়া হয়েছে, বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বিশাল গর্ব করেছে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে আছে এই নিয়ে। কলামের পর কলাম লেখা হয়ে চলেছে এই নিয়ে। কিন্তু এতো সব লেখালেখি, এতো সব বিজ্ঞ ব্যক্তিরা, কেউই এটা কীসের র‌্যাংকিং, একবারও পড়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। কেউ খেয়ালও করেননি, এটা ওয়েবসাইটের র‌্যাংকিং, তা না করে সবাই বলে চলেছেন গেলো গেলো, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রসাতলে গেলো!

(৫)

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংক CSIC এর ওয়েবোমেট্রিক্স র‌্যাংকিং এ কম কেনো, তা কিন্তু সহজেই বোঝা চলে। অধিকাংশ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের বেশ দুরবস্থা। প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় না, বিভাগওয়ারী ওয়েবপাতা থাকলেও তাতে অল্প কিছু তথ্য/পাতা তৈরী করেই শেষ। অবশ্য অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটের বয়স খুব বেশি নয়, তাই অন্য সাইট থেকে তাদের প্রতি লিংকের সংখ্যাও কম। কাজেই ওয়েবোমেট্রিক্সের ফরমুলার মোটামুটি ৮৫% এ পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী হলো ওয়েবসাইট নির্মাণে অদক্ষতা – মোটেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বা গবেষণার মান এখানে দায়ী নয়।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং খুব দরকার। কিন্তু সেটা হতে হবে একাডেমিক র‌্যাংকিং। ওয়েবসাইটের র‌্যাংকিং এর মতো ফালতু ব্যাপারকে নিয়ে মাতামাতি করার মাঝে এই একাডেমিক র‌্যাংকিং এর ব্যাপারটা সবার নজর এড়িয়ে যায়। আর এই একাডেমিক র‌্যাংকিং এর কাজটা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা এদের মতো নিরপেক্ষ সরকারী কোনো সংস্থাকেই। একাডেমিক প্রকাশনার সংখ্যা, গবেষণাকর্মের ইম্প্যাক্ট, ছাত্রশিক্ষক অনুপাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামো -- এসব কিছু বিবেচনা করে র‌্যাংক করতে হবে। US News and World Report নামের সংস্থাটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংক প্রকাশ করে পড়াশোনার মান ও গবেষণার উৎকর্ষের ভিত্তিতেই। । সেটা না করে ওয়েবসাইটের পেইজের সংখ্যার ভিত্তিতে বানানো র‌্যাংককে নিয়ে মাথা ঘামানোটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

উপসংহার

চিলে কান নিয়েছে শুনে ছুটেই চলেছি আমরা, আর স্পেনীয় চিল, ইন্টারনেট থেকে জানা গেছে শুনেই মাতম শুরু করেদিয়েছি, দেশের উচ্চ শিক্ষা রসাতলে গেছে বলে রায় দিয়ে চলেছি … অথচ আসলে কীসের র‌্যাংকিং, তা পড়ে দেখার ইচ্ছে কারো নেই। পরের মুখে ঝোল খেতেই সবাই ব্যস্ত। আসুন, স্পেনীয় ওয়েব চিলকে তার যথার্থ স্থানে রাখি, আর দৌড়ানো থামিয়ে একটু হাত দিয়ে দেখি কানটা আছে কি না, যথার্থ মাপকাঠিতেই মেপে দেখি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সোনালী ডানার চিল চলে যাক ওয়েবের নির্বাসনে …।

Published in: http://www.sachalayatan.com/ragib/34878