Friday, November 1, 2013

শিক্ষার মানোন্নয়ন বনাম শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া

ড. আবদুল্লাহ ইকবাল

আমরা যারা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা খোঁজখবর রাখি সবাই কথায় কথায় বলে থাকি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই। প্রতিটি সরকারও তার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ক্ষমতা ছাড়ার সময় পর্যন্ত (আর বিরোধী দলে থাকাকালীন ক্ষমতায় আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত) প্রতিনিয়তই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথাও বলে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন পর্যায়ে পাসের হার বাড়ছে (বিশেষত শহর এলাকায়)। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটছে এর উল্টোটা। এর কারণ হিসেবে কি বলা যাবে যে, প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রীরা মেধাবী না বা কম মেধাবী? মোটেও সেটি বলা যাবে না। প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক মেধাবী, যাদের নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা (শহর এলাকার ১০ ভাগের ১ ভাগ দিতে পারলেও) দিতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বা তাক লাগানোর মতো কিছু ঘটতে পারত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে কোনোমতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে পরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীর (এমনকি প্রথম/দ্বিতীয়/... স্থান অধিকার করে ফেলে) তালিকায় ঢুকে যায়। আবার পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফল করে এসেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে খুব খারাপ ফল করাটা অতি স্বাভাবিক। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে যে, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে মুখস্থ করার প্রবণতা এবং প্রাইভেট কোচিংয়ের একটা প্রভাব থাকে, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও প্রকটভাবে দেখা যায় না। তবে সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষার মান নিয়ে কেউই সন্তুষ্ট না_ না সরকারের মন্ত্রীরা, না শিক্ষাবিদরা, না অভিভাবকরা। এরই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে গত ২৪ জুলাই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রীর শিক্ষার মান নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে (শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে)। তার মতে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে অবহেলিত ও দুর্বল মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আসবে। দল-মত সবাই এ ব্যাপারটিতে একমত হবেন! বর্তমানে আমরা ছাত্রছাত্রীদের যে শিক্ষা দিচ্ছি তাহলো চাকরিমুখী শিক্ষা_ লেখাপড়া শেষে যেভাবেই হোক তাকে একটা চাকরি পেতেই হবে!

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন কারা? বেশিরভাগই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রী, যাদের অধিকাংশই অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বা ভর্তির সুযোগ পায়নি। তাদের বেশিরভাগকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পেতে হয়। এবার শুরু হলো তার শিক্ষকতা। আমরা বলি ভালো বীজে ভালো ফসল, আর এ ক্ষেত্রে ভালো ফসল হলো ভালো ছাত্র। তাহলে কতটুকু ভালো ছাত্র আশা করা যায়? এরই ঠিক কয়েক বছর পর আবার বর্তমানের ভালো ছাত্রটিই (!) আবার পূর্বের প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবে ওই স্কুল-মাদ্রাসাটিতে। তাহলে শিক্ষার মান প্রতিনিয়তই বাড়বে না কমবে? এই সমস্যাটি থেকে উত্তরণের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে আলাদা একটি কমিশন বা অনুরূপ কিছু করা যেতে পারে, যারা কেন্দ্রীয়ভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করবেন।

এবার আসা যাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মানের ব্যাপারে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি বলেই (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ৬০-৬৫ নম্বর পেয়ে চাকরি না পেলেও বিভিন্ন কোটায় ৫০ নম্বর পেয়ে চাকরি পেয়ে গেল। সেখানেও যে নিয়োগে অনিয়ম হয় না সেটাও বলা যাবে না। তবে তার তীব্রতা-মাত্রা কিছুটা কম। কারণ সেখানে একটি লিখিত পরীক্ষায় একেবারেই অযোগ্যদের ছেঁকে নেওয়া হয়। আবার মৌখিক পরীক্ষায়, এখানেও থাকেন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা (সাধারণত সরকারি দলের)। সব মিলিয়ে এখানেও যে আমরা খুব ভালো ছাত্রছাত্রীটিকে শিক্ষক হিসেবে পাচ্ছি তা বলা যাবে না। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকেই শুরু হয় শিক্ষার মানের ব্যাপারটি।

এরপর হলো শিক্ষার মানটি ধরে রাখা বা উন্নীত করা। এটি করতে হলে প্রতিনিয়তই আমাদের সচেষ্ট হতে হবে, কেমন করে ভালো ছাত্রছাত্রীটিকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। যেন একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার পর অন্য চাকরি না খোঁজেন, তিনি যেন এখানে তার অবস্থায় তৃপ্ত হন তার ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টাটুকু অব্যাহত রাখতে। সেখানেই আসে শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রসঙ্গ। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একটা বড় ক্ষোভ হলো এই পদোন্নতি নিয়ে। দেখা যায়, একই পদে সারাজীবন চাকরি করে অবসর নিতে হয়। অথচ একই পদমর্যাদার অন্য চাকরির বেলায় পদোন্নতিসহ অধিকতর আর্থিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই চাকরি প্রার্থীরা শিক্ষকতার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা তো আরও করুণ। তাদের দীর্ঘ সময়ের দাবি প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা দান করা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকের অনুরূপ দাবি মেনে নিলেও প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যাপারে কোনো আন্তরিকতা দেখা যায়নি। আবার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি করার ঘোষণা (প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক) দিলেও এখনও সেগুলোর কোনোই সুরাহা হয়নি_ এখন সেগুলো না রেজিস্টার্ড, না সরকারি! তারা আরও হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। ফলে অনেক হতাশা আর বঞ্চনা নিয়ে তারা এখন আবার আন্দোলন শুরু করেছেন (যা বর্তমানে চলমান)। বিভিন্ন খাতে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও এই খাতে সরকার একটু সহানুভূতিশীল হলে ভবিষ্যতে অধিকতর মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেতে পারত অধিকতর উন্নত শিক্ষা।

সবগুলো সরকার এসেই বলে যে, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিতে হবে, নইলে ভালো ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতায় আসবে না, শিক্ষার মান বাড়বে না ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে কি কিছু হচ্ছে? কারও কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তাকে তো অন্তত কিছু দিতে হবে। শিক্ষকরা যখন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ শুধু আশ্বাস আর দাবি নিয়েই চলছেন, তখন অন্য অনেকেই স্বতন্ত্র বেতন স্কেল-ভাতা পেয়ে গেলেন। সুতরাং সরকারের এখন বুঝতে হবে যে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি না করে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্বমানের কর্মমুখী শিক্ষা লাভ করতে পারে। আর এই দায়িত্বটুকু শিক্ষকদের ওপর না দিয়ে সরকারকেই আরও আন্তরিক হতে হবে। বর্তমান অবস্থায় এটি কখনও সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে রাজনীতি না করে বাস্তবতার নিরিখে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে দেশের সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে।

সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
iqbal21155@bau.edu.bd

Published in: http://archive.samakal.net/2013/11/02/17378

Saturday, September 21, 2013

‘শিক্ষকদের জন্য আলাদা স্কেল হচ্ছে’

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হচ্ছে। এবিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই আপনারা এ বিষয়ে জানবেন।’
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষকের সম্পাদনায় ‘রিসার্স অ্যান্ড এডুকেশন চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়- নিউজিল্যান্ডের যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কর্যক্রমের অংশ হিসেবে এনিমকা গ্রিনউড, জন আরবাট, আরিফুল হক কবির এবং সাফায়াত আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে এ বইটি। গ্রন্থের সম্পাদকগণ হলেন নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনিনকা গ্রিনউড, অধ্যাপক জন এভারেট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. আরিফুল হক কবির ও সাফায়েত আলম।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য আধুনিক জ্ঞান ও শিক্ষা প্রয়োজন। এ আধুনিক শিক্ষা ছাড়া আমাদের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যেতে পারবে না। আর নতুর প্রজন্ম এগিয়ে না গেলে জাতিও থেমে যাবে। এ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দিবেন শিক্ষকরা। আর এ শিক্ষকরাই যদি কম বেতন পান তাহলে তারা তাদের কাজে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারবেন না, আবার অনেকে অসত্ হয়ে যেতে পারেন। এজন্যই আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে।’

তিনি আরও বলেন, আমাদের আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। আর এ গবেষণা বাড়ালেই আমাদের শিক্ষার মান অনেক উন্নত হবে। তবে শিক্ষকরা বিদেশে যেয়ে অনেক গবেষণা করেন। তারা ওইসব দেশের বিষয় ও সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেন। আমরা ওই গবেষণা চাই। আমাদের দেশে ওই রকম হাজারো সমস্যা রযেছে। তাই ওই গবেষণা আমাদের দেশে হতে হবে। তবেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘গবেষণা বৃদ্ধির জন্য আমরা এপর্যন্ত ১০৬টি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি আশা করি এ প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণার অনেক দিক উন্মোচিত হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক অর্জন আছে। এ থেকে বিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে। নারী শিক্ষার প্রতি বিরূপ মন্তব্য শুনলে আমি হতবাক হই। এ মনমানসিকতার মানুষকে দেখে আমি অবাক হই। এসব মানুষ দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক নূরুর রহমান খান। গ্রন্থের উপজীব্য তুলে ধরেন নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এনিনকা গ্রিনউড। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ নাজমুল হক। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন।

Published in: http://fenirshomoy.com/index.php?option=com_content&view=article&id=2877

Sunday, September 15, 2013

শিক্ষকদের শুধু সম্মান নয় উপযুক্ত সম্মানীও চাই

মো. আবু সালেহ সেকেন্দার

শিক্ষকতা পেশায় যারা নিয়োজিত, সম্মানের দিক দিয়ে তারা সমাজের সবচেয়ে উঁচু স্তরের মানুষ। কিন্তু সম্মানজনক সম্মানী প্রাপ্তির দিক দিয়ে তারা আজও রয়ে গেছেন পাতালেই। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি, নেতাদের স্লোগানে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর বিষয়টি যুগ-যুগান্তরে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই শিক্ষকদের সম্মানের বিষয়টি বিবেচনা করে সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করেনি। প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিতরা তাই জীবনের অধিকাংশ সময় মানবেতর জীবনযাপন করেন। শিক্ষকরা ক্লাসে ছাত্রদের যে প্রবাদ প্রবচন পড়ান, সেই ‘হ্যান্ড টু মাউথ’ অথবা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’Ñ প্রবাদটিই তাদের নিত্যসঙ্গী। অথচ শিক্ষকের ছাত্ররাই ওই প্রবাদবাক্য শিখে সিএসপি অফিসার হন। বিসিএস, জেসিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট, ডিসি, এসপি, জজ, ব্যারিস্টার, অফিসের বড় কর্তার পদ অলঙ্কৃত করেন।

শিক্ষকের স্নেহের শিক্ষার্থীরাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ডিজি, মহাপরিচালক পদে আসীন হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের পিছু ছাড়ে না। ওই সম্মানটুকু নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, বিচারকরা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে অথবা শিক্ষককে কাছে পেলে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দে বিগলিত হন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে মুখে রা’টি পর্যন্ত করেন না। পাছে যদি গাঁটের পয়সা খরচ হয়! মহামান্য বিচারকরা কত শত বিষয়ে স্বপ্রণোদিত রায় প্রদান করেন অথবা আইনজীবীরা প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে রিট করেন অথবা আদালতের নজরে আনেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের, তারা এখনও পর্যন্ত এমন কোনো ছাত্র তৈরি করতে পারেননি; যিনি শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন। কেন শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্মানজনক সম্মানী দেয়া হয় না? সেই বিষয়ে আদালত সরকারের কাছে জানতে চাইবে। সরকারি ও বিরোধী দলের সব নেতাই তো শিক্ষকদের ছাত্র। তারাও কেন সংসদে বিল উত্থাপন করেন না এ বিষয়ে? এরকম হাজারও প্রশ্ন আমার মাথার ভেতর প্রায়ই ঘুরপাক খায়। এমন ভাবনা ভুল না শুদ্ধ জানি না; তবে এমন ভাবি, হয়তো নিজেই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছি তাই।

দুই.

‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মে না’। বাংলাদেশের জন্য এ উক্তিটি বেমানান। কারণ এদেশে গুণীর কদর করা না হলেও, আল্লাহর রহমতে গোবরে পদ্ম ফুল প্রতি যুগে কয়েক ডজন ফোটে। তারা সারা বিশ্বে এদেশের মাথা উঁচু করেন। এরকমই একজন খ্যাতিমান অধ্যাপককে একজন সংসদ সদস্য সংসদে ওই বছরের সেরা ধোলাই দিয়েছিলেন। ওই সংসদ সদস্য যা বলেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ অনেকটা এরকম তিনি একজন শিক্ষক। তার এত টাকা কোথা থেকে আসে? গাড়ি বাড়ি কোথায় পান?... ইত্যাদি। এ ধারণাটি শুধু ওই সম্মানিত সংসদ সদস্যের নয়; প্রায় পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রযন্ত্রই এমনটি বিশ্বাস করে বলে মনে হয়। আর এমন ধারণা হওয়ার কারণ, আবহমান কালের চিরাচরিত ঐতিহ্য ‘প্রকৃত পন্ডিত মশায় মানে ধবধবে সাদা পুরাতন পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনও হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তির ছবিই আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে। আমরা ধরেই নেই যে, যিনি অধিক বিদ্বান, তিনি হবেন অতি ভদ্র, বিদ্যার ভারে তার মাথা সব সময় নুয়ে থাকবে।

আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানী, পাঠান, মোগল, ইংরেজ কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ সর্বদাই ওই একই চিত্র। বাংলার বাইরে উমাইয়া-আব্বাসীয় খিলাফত, অটোমান সালতানাতও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে আলোচনা থাকলেও, ওইসব যুগে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কেমন ছিল, সে সম্পর্কে আলোকপাত একেবারেই নেই বলেলেই চলে। দয়া করে দু-একজন ঐতিহাসিক এ বিষয়ে যা আলোকপাত করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, বৈদিক যুগে শিক্ষকরা কোন গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করতেন না। ভিক্ষা দ্বারা জীবন নির্বাহ করতেন। পাল যুগে বিহারগুলোতেই পন্ডিতদের থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছিল। রাজা বিহারের জন্য যে করমুক্ত জমি দান করতেন, সেখান থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের ব্যয় নির্বাহ হতো। মোগল দরবার থেকে ঢাকার শিক্ষা বিস্তারে নিযুক্ত শেষ শিক্ষক মৌলভী আসাদ উল্লাহর বেতন ছিল মাসিক ৬০ টাকা। বঙ্গদেশে আধুনিক ধাঁচের সর্বপ্রথম উচ্চ আরবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (১৭৬৫ সালে বর্ধমানের বিহারে জমিদার মুনশী সদরুদ্দীন প্রতিষ্ঠা করেন) শিক্ষক মোল্লা নিজামুদ্দীনের ছেলে আবদুল আলীম বাহারুল মাসিক ৪০০ টাকা বেতন পেতেন। ব্রিটিশ ভারতে সরকার ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য যে দু’জন সহকারী পরিদর্শক নিয়োগ করতেন; তাদের মাসিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা প্রদান করা হতো। এরকম কম-বেশি দু-চারটি উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একথা সত্য, সব যুগেই শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে।

তবে প্রায় সব শাসকই শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। খলিফা হারুন আল রশীদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) তার ছেলে আল আমিনের শিক্ষককে রাজপুত্রকে প্রহারের অনুমতিও দিয়েছিলেন। তিনি তার ছেলের শিক্ষককে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা থেকেই জানা যায় ‘এত কড়া হবেন না যাতে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ রুদ্ধ হয়; অথবা এমন নরম হবেন না যাতে সে আলস্য উপভোগ করতে পারে এবং কুড়েমিটাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়। স্নেহ ও দয়ার স্পর্শে তাকে সহজ-সরল করে গড়ে তুলুন; কিন্তু তাতে যদি সে সাড়া না দেয়, তাহলে কঠোর হাতে ও প্রয়োজনে মারধর করতেও দ্বিধা করবেন না।’

মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি ইতিহাস খ্যাত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তার জীবনী পাঠ থেকে জানা যায়, ‘একবার তার গৃহশিক্ষকের গুটিবসন্ত হয়েছিল। ফলে ওই শিক্ষকের ঘরে কেউ যেতে চাইতো না। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি গরম পানি করে শিক্ষককে স্নান করান, বিছানার চাদর বদলে দেন।’

তিন.

অনেকে হয়তো রাজা-বাদশাহদের শিক্ষকের প্রতি আহ্লাদে গদ গদ হতে দেখে আবেগময় হয়ে পড়ছেন! আর সেদিন কত না ভালো ছিল বলে ভাবছেন! উচ্চ বেতন না থাকলেও রাজকীয় সম্মান তো ছিল, এমন কল্পনায় উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন! আর মনে মনে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে অভিসম্পাত করতে করতে বলছেন অন্তত আজকের মতো সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার বাহিনীর হাতে পিটুনি খাওয়া অথবা ন্যায্য দাবি আদায়ে শহীদ মিনারে অনশনরত শিক্ষকদের ওপর সরকারি পেটোয়া বাহিনী পুলিশ কর্তৃক লাঠিপেটা বা পিপার স্প্রে থেকে তো রক্ষা পাওয়া যেত, তাদের বলছি। দাঁড়াও বাছা! এ তো কেবল মুদ্রার একপিঠ দেখেছ, অন্য পিঠের বর্ণনা পর্যন্ত অপেক্ষা কর! এ যুগের মতো সেই যুগেও শিক্ষকের মানমযার্দা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার লোকের অভাব ছিল না। আব্বাসীয় আমলের একটা প্রবাদ শুনলেই আশা করি রণভঙ্গ দিয়ে পালাবেন ‘শিক্ষক, মেষপালক বা মেয়েদের সঙ্গে বেশি থাকে এমন পুরুষের কাছ থেকে কোনো উপদেশ চেয়ো না।’ বুঝলেন হে! আরও আছে আরবীয় সাহিত্যে বেশ কিছু ছোট ছোট কাহিনী আছে, যেখানে শিক্ষকদের ‘মোটা মাথার লোক’ বলে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ‘প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চেয়েও মূর্খ...’। এমনকি আব্বাসীয় খলিফা মামুনের রাজত্বকালে একজন বিচারক আদালতে একজন শিক্ষকের সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতে পর্যন্ত রাজি হননি। আর একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের তিন পাওয়ালা কুকুরের জন্য মাসে ২৫ টাকা ব্যয় এবং পান্ডিত মশায়ের মাসিক ১৭ টাকা বেতনে ৮ সদস্যের পরিবারের জীবন ধারণের পুরনো গল্প নাই বা বললাম...

চার.

শিক্ষক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান ও সম্মানী দুটিই চাই। প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকদের বেতন অন্য যে কোনো চাকরির বেতনের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করি। যদি শিক্ষকদের বেতন তাদের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রদান করা হয়; তবেই কেবল মেধাবীরা এ পেশাকে গ্রহণ করবে। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক যে তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদা পান, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সম্প্রতি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীতকরণের তোড়জোড় থেকে জেনেছি। ওই বিষয়টি আমাকে পীড়িত করেছে। কারণ প্রাথমিকেই একজন শিক্ষার্থীর ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি তৈরি হয়। আর ওই দুর্বল ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির ওপর অনেক তলা নির্মিত হলে, ভবিষ্যতে যে তা রানা প্লাজার মতো ধসে পড়বে, এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের অফিস-আদালতে তৃতীয় শ্রেণীর কমকর্তা-কর্মচারী কারা, আমরা কী একবারও ভেবেছি? ওই তৃতীয় শ্রেণীদের হাতে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারিরা বেড়ে উঠছে, ভাবা যায়! আমি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ছোট করতে চাইছি না। আমি বাস্তব অবস্থা বোঝাতে চাইছি। তৃতীয় শ্রেণীর হাতে বেড়ে ওঠা একটা শিশু চিন্তা-চেতনায় তৃতীয় শ্রেণীর হবে, এটাই কী স্বাভাবিক নয়? আর কোনো শিক্ষকের অর্থনৈতিক অবস্থা যদি দুর্বল হয় এবং সারা দিন যদি তাকে চিন্তা করতে হয় যে, মাসের বাকি ১৫ দিন আমি কীভাবে সংসার চালাব? সেই বিষয়ে; তবে তাকে দিয়ে অন্তত সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতি এরকম গন্ডায় গন্ডায় হাজারে হাজারে নিয়মকানুন তৈরি করলেও, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন প্রদান ছাড়া শিক্ষার মানের উন্নয়ন অসম্ভব। সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্মানী প্রদান করতে হবে।

আর যদি শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা যায়; তবে শিক্ষকরা নিজ থেকেই টিউশনি পরিহার করবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে বিরত হবে, ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণে নিয়মিত সময় দেবে। অন্যথায় যত আইনই করা হোক না কেন, সামগ্রিক অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। শিক্ষকরা আইনের ফাঁকফোকর বের করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আগের নিয়মেই চলবে। কিন্তু আমরা সব সরকারকেই দেখেছি, শিক্ষকদের উচ্চতর বেতনের বিষয়টির প্রতি নজর না দিয়ে অন্যসব কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা হারাচ্ছে ভারসাম্য হচ্ছে ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’। তবে একথা সত্য যে, সব সরকারই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, বেতন কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। বছরের পর বছর ওইগুলো বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশ্বাসও প্রদান করছেন। অনেকটা নাকের ডগায় মুলা ঝুলিয়ে রাখা আর কী? পূর্বতন সরকারের মতো বর্তমান মহাজোট সরকারও তার বহু অঙ্গীকারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শিক্ষানীতি থেকে শিক্ষা আইন, নির্বাচনী ইশতেহার থেকে ভিশন-২০২১ সব জায়গায়ই বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।

সঙ্কটমোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প-২০২১ সালে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় ‘শিক্ষা’ উপশিরোনামে বলা হয়েছে, ‘২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে’ (ভিশন ২০২১, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা : ২০০৯, পৃ. ৫১)। শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামো নিয়ে প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দেখে আমার শৈশবে শিক্ষাগুরুর কাছে শেখা গাধা সম্পর্কিত দুটি উক্তি বেশ মনে পড়ছে। এক. ‘গাধা পানি খায় ঘোলায়ে’, দুই. ‘গাধার সামনে মুলা ঝুলিয়ে সাধ্য সিদ্ধি করা’। বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ এর মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, অনেকটা শিক্ষকদের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রাখার মতোই। কারণ বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২০১৪ সালের প্রথমেই শেষ হয়ে যাবে। তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া অযৌক্তিক নয় যে, কেন তারা ২০১৪ সালের মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামোর বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে এমনটি বললেন। তারা বলতে পারতেন ২০১৩ সালে মধ্যে...। তাহলে আমরা বুঝতাম যে, সরকারের এ বিষয়ে সদিচ্ছা আছে। কিন্তু বিষয়টি অনেকটা ওই গাধার সামনে মুলা ঝোলানোর মতোই। আমার বিশ্বাস, শিক্ষক সমাজও এ বিষয়টি ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কারণ তারা তো আর গাধা নয় যে, মুলা ঝোলালেই খুশি হবে। বরং শিক্ষকরা হচ্ছে সেই প্রজাতির মানুষ যারা ‘গাধা পিটিয়ে মানুষ করার মহান দায়িত্ব পালন করেন’।

আর প্রথম উক্তিটির বিষয়ে আলোকপাত হচ্ছে সরকার শিক্ষা আইন, শিক্ষক নীতি, টিউশনি বন্ধে প্রজ্ঞাপন, পাস না করলে এমপিও বন্ধ এরকম হাজারটি পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রদান ব্যতিরেকে যা কখনও সম্ভব নয়। তাই মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রথমেই শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। আমার বিশ্বাস, সরকার সেই উদ্যোগ হয়তো নিবে, যখন সরকারের সব উদ্যোগের ফলেও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না, তখনই। অনেকটা প্রথম উক্তিটির মতোই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ততদিনে মানসম্মত শিক্ষাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক অংশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট

salah.sakender@gmail.com

Published in: http://www.alokitobangladesh.com/editorial/2013/09/16/22770

Thursday, April 11, 2013

শিক্ষকদের প্রস্তাব গৃহীত হবে কি?

সাইফুদ্দীন চৌধুরী

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলাদা বেতনকাঠামো তৈরি এবং চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের ওই প্রস্তাব আন্তবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মাধ্যমে দাবি আকারে সরকারের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে। 
সার্কভুক্ত দেশগুলোর, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন হার বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি। সে আলোকে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও বেতনকাঠামো প্রবর্তনের জন্য প্রস্তাব করেছেন। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বছর তিনেক আগে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন, শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি বেতনকাঠামো প্রদানের বিষয় বিবেচনা করা হবে। তিনি এমনও বলেছিলেন, সার্কভুক্ত অন্য সব দেশে বিদ্যমান বেতন স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনক্রম প্রণীত হবে। কার্যত তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অনেকেই ভাবছেন, তা আমলাতন্ত্রের কুদৃষ্টিতে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আরও প্রস্তাব করেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতগুলোতে দায়িত্ব পালনরত বিচারপতিদের মতো তাঁদেরও বয়সসীমা দায়িত্ব পালনরত বিচারপতিদের মতো বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ করতে হবে। 

শিক্ষকদের পক্ষ থেকে যুক্তি হলো, বিশ্বের বহু খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান কৃৎকৌশল সুসংবদ্ধ অবস্থায় পেতে প্রবীণদের মর্যাদা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট রাখা হয়। সাম্প্রতিক কালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশেও মানুষের গড়পড়তা আয়ুষ্কাল অনেকটা বেড়েছে। ৬৭ কেন? এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ৭০ বছরেও প্রায় এঁরা সবাই কর্মক্ষম থাকেন। অবসর নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এমন অনেক তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে। কাজেই ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওই সব একাডেমিশিয়ানের বড় রকমের সহযোগিতা যে পেতে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ই অধিক লাভবান হবে। 

এখানে একটি কথা অবশ্য উল্লেখ করতে হবে, ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকো ও আইএলওর উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে শিক্ষকদের জন্য একটি সনদ ঘোষণা করা হয়। ১৪৬টি ধারা ও উপধারাসংবলিত ওই সনদে বলা হয়েছে, শিক্ষকেরাই সব কর্মকাণ্ডের কারিগর, জাতি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তাঁদেরই। আগামী দিনের মর্যাদা ও উপযুক্ত নাগরিক তাঁরাই তৈরি করেন। এই শিক্ষকদের মর্যাদার ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের ত্রুটি না ঘটে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে। ওই প্যারিস ঘোষণার ৭-এর (চ) উপধারায় বলা হয়েছে—

‘জীবনধারণের ব্যয় বৃদ্ধি ও বর্ধিত উৎপাদনশীলতার কারণে জীবনযাত্রার উচ্চতর মান অথবা বেতন ঊর্ধ্বমুখী গতি বিবেচনায় মাঝে মাঝে বেতন স্কেল পুনর্বিবেচনা করা।’ আদতে সেখানে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল প্রদানের কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে। প্যারিস কনভেনশন সূত্রে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতটা অধিকার ভোগ করেন, তার জবাব অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। কতটা লজিস্টিক সুবিধা পান রাষ্ট্রের কাছ থেকে শিক্ষকেরা। এই শিক্ষকদের যথার্থ একাডেমিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে প্রধান অন্তরায় হলো অর্থসংকট। শিক্ষকেরা যাতে সেসব দায় মেটাতে বহির্মুখী না হন, অর্থাৎ কর্মসংস্থানের জন্য অন্য কোথাও নিয়োজিত না হন এবং প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য দেশত্যাগ না করেন, রাষ্ট্রের উচিত সে প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করা।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থার জন্য দরকার দক্ষ শিক্ষক এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা। লক্ষ রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কাজের যেন ব্যত্যয় না ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পরিবেশ না থাকার কারণে অনেক কৃতী, জ্ঞানবৃদ্ধ ও খ্যাতিমান শিক্ষক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, এমন নজির অনেকই আছে আমাদের দেশে। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বলেছিলেন, ‘ইয়োর ইমাজিনেশান ইজ মোর ইম্পর্টেন্ট দ্যান নলেজ।’ আমার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকেরাই ওই ইমাজিনেশান তৈরি করতে সমর্থ, তখন তাঁরা নিজেরাই কেউ কেউ ইনস্টিটিউশন হয়ে ওঠেন। জ্ঞানের নতুন নতুন উৎসের জন্য, বিজ্ঞানের অভিনব উদ্ভাবনের জন্য, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, প্রবীণ শিক্ষকদের কর্মকাল প্রলম্বিত করার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে এসব বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।

ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

Published in: http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-11/news/343994

Wednesday, April 10, 2013

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ

অনুমতি ছাড়া ছুটিতে থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী কমিটি। আজ বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
শিক্ষকেরা হলেন আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহমুদ বিন সাঈদ এবং একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনুপ চৌধুরী। গত সোমবার স্থায়ী কমিটির সভায় তাঁদের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সিন্ডিকেটের কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করতে অনুপ চৌধুরী ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই দফায় ছয় বছর শিক্ষা ছুটি নেন। এর মধ্যে চার বছর তিনি সবেতনে ছুটি ভোগ করেন। এরপর অনুমতি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকায় ২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে আট সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তাঁর চাকরির পরিসমাপ্তি হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে আবারও এক বছরের ছুটির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সিন্ডিকেট সেই আবেদন অনুমোদন না করে পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাকরির পরিসমাপ্তির বিষয়ে মতামত দিতে স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়।

অন্যদিকে আরবি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ইংল্যান্ডে পিএইচডি করতে মাহমুদ বিন সাঈদ ২০০৬ সালের ২২ এপ্রিল থেকে দুই দফায় ছয় বছর শিক্ষা ছুটি নেন। ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে আট সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে চাকরিতে যোগ না দিলে চাকরির পরিসমাপ্তি হবে বলেও জানানো হয়। 

স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অননুমোদিত ছুটিতে থাকায় তাঁদের চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করা হয়েছে।

Source: http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-10/news/343741

Monday, October 1, 2012

Sri Lanka increase Salaries of University Lecturers


Secretary to the ministry of Higher Education Dr. Sunil Jayantha NawaratneDespite Sri Lanka's striking university teachers, Federation of University Teachers' Associations stepping back from their ongoing strike that dragged for nearly four months; Sri Lanka had increased the salaries of University Lectures with effective from 1st October 2012.

Speaking to the Asian Tribune Secretary to the ministry of Higher Education Dr. Sunil Jayantha Nawaratne said that accordingly the Salary of a Senior Professor has been increased to Rs. 140,721.

As at 30th June the salary of Senior Professor was nearly Rs. 119,000 and by 01st July 2012 it was increased to Rs.131,329 and with yesterday’s increase now it has increased by over Rs.21,000” Dr. Nawaratne said adding during the last four months a salary of a Senior Professor had increased by over 18.25%.

Subsequently the salary of a Senior Lecturer had been increased to Rs. 98,761 and the salary of an Assistant Lecturer has been increased to Rs. 55,775.

“The lowest grade Assistant Lecturer or Lecturer on probations salary alone had been increased by Rs.21, 32 on 1st July 2012 from Rs.52,857 and further to current level of Rs.55,775 as at 1st October 2012 and it is nearly a 5.52% increase.

Dr. Nawaratne added that the latest salary increase is a part of the series increments that came into effect for university lecturers salaries.

He noted that it’s only the Finance Ministry that has its powers to increase the salaries of the lecturers.

On the contrary as per data the salary of the Chief Justice of Sri Lanka amounts to only Rs. 70,000, the salary of a Secretary to the Ministry range to Rs. 44,000, the salary of an Administrative Service staff is only Rs. 29,810 and the salaries of the graduate service amounts to Rs. 15,635.

The Ministry of Higher Education further noted that no government in the past has increased the salaries of lecturers by this proportion.

Sri Lankan university lecturers are also entitled to some of the other perks and privileges including to retire late at 65 years of age, and upon completion of 8 years service, becomes entitled to a duty free vehicle permit renewable every 5 years, 3 years and 9 months fully paid study leave to study for Darshanapathy and Doctorates, 7 years leave and one year’s salary to further their educational activities and 42 days fully paid leave when they go for foreign countries for lectures, seminars and workshops and with free air tickets provided for them and their spouses for overseas studies and they can join any local and foreign institution and earn another salary and earn any consultation fee on consultation they provide for private companies on a project basis. University lecturers are also entitled for housing loans under concessionary interest rates and can provide advisory service to any institution and can get 90% of the remuneration received from such service. They are also entitled for post graduate scholarships and for 3 months vacation leave and 42 days full paid leave annually.

In Sri Lanka generally an external lecturer will get paid at the rate of Rs.1, 500 per hour, whilst university lecturers are entitled from Rs. 3,000 to Rs.5,000 for post graduate lectures and for additional payment for conducting university examinations, for preparing question papers, for marking answer scripts, for acting as invigilators, for scrutiny of thesis, and for invitee lectures.

On the contrary, several parent and university undergraduates learning at private universities in Sri Lanka outline that several private education houses that has affiliations with American, British and Australian Universities are paying commissions to the same university lecturers on a per student basis to fail in their exams such that those students are continuously contributing cash as fees for those private companies.

“In our private university that offers us American Degree programs, British Degree Programs and Australian university programs we have nearly 10 to 20 lecturers who are also lecturing at government universities and each class room is only accommodating a maximum of 30 students.

But our private university owning company pays commissions to university lecturers for each student they fail so that the private university can retain those students as income generating instruments for the owning company,” Shehan Lenadora a student at a Sri Lankan private university said.

Whilst Shehan Lenadora learns at private university owned by a leading private insurance company in Sri Lanka –the only remaining subsidiary of a failed business conglomerate and a tycoon - he said that similar practices are being done by some private universities that are also owned by an automobile company and another university owned by a conglomerate that is into many freight forwarding ventures in the island nation.

“I have many friends who are learning at different private universities in Sri Lanka and they also tell me these type of unethical practices are being conducted,” Lenadora said.

While Shehan Lenadora pays nearly US $ 2,000 per semester for his private university, he said government will also need to safeguard the future education of Sri Lankan students who are falling prey to private companies that try to make exorbitant profits from private education ventures with foreign universities.

Dinesh Lokuhetty another student from a private university said, “It is sad Sri Lanka has only 14 public universities that only accommodate nearly 20,000 students, so most of us among over 300,000 students who pass out from Ordinary Levels and Advanced levels, go to private universities but we learn from same lecturers - but those lecturers are happily serving at private universities since they are paid commissions to fail the future generation of our country.”

“A lecturer at our university is nearly paid at the range from Rs.150,000 to Rs.300,000 per month,” Shehan Lenadora said.

Meanwhile, yesterday the union of Sri Lanka's striking university teachers, Federation of University Teachers' Associations (FUTA) expressed willingness to step back from their unyielding demands that asked for 20% increase of their salaries.

As the union faced criticism from many segments of the public including the parents and students affected by the strike for failing to reach a resolution with authorities due to their unwavering stance, FUTA secretary Terrence Madujith speaking behalf of the union admitted it was difficult to allocate that amount of money for education instantly, and the FUTA secretary called on the government to promise to grant their demand within a certain period by gradually increasing expenses for education.

Sri Lankan government's 2013 appropriation bill, which last week received cabinet approval, has increased the funds allocated for the education and higher education sectors in the next year's budget. Allocations to the Education Ministry has been increased by Rs. 3.43 billion from last year to Rs. 37.9 billion while the Higher Education Ministry has been allocated Rs. 27.9 billion, which is an increase of Rs 4.1 billion from 2012.

- Asian Tribune -
Source: http://www.asiantribune.com/news/2012/10/02/sri-lanka-increase-salaries-university-lecturers

Tuesday, September 11, 2012

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

মো. আক্তারুজ্জামান

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুগবাণীর ‘‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, ‘‘ আমরা চাই আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিতে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে-শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসেবে ‘ডাংপিটে’ ছেলে বরং অনেক ভাল। কারণ পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না; আর যাহার ‘জান’ নাই, সে মোর্দা দিয়ে কোন কাজই হয় নাই আর হইবেও না। এই দুই শক্তিকে – প্রাণশক্তি আর কর্মশক্তিকে একত্রীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।’’ (নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, সম্পা. আবদুল কাদির, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬, পৃ. ৮৪৪)। নি:সন্দেহে, যে-শিক্ষার জীবনীশক্তি নেই তা মানবিকও নয়। আশাব্যঞ্জক এই যে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ -এ মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত বক্তব্য, মন্তব্য ও সুপারিশ বহুলমাত্রায় পরিলক্ষিত।

প্রাক্-ব্রিটিশ সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠান ও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ঘোষিত শিক্ষানীতি হলো বাংলা তথা ভারতের প্রথম সরকারি শিক্ষানীতি। এর মাধ্যমে নীতিগতভাবে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর বহুল আলোচিত অ্যাডাম রিপোর্ট (১৮৩৫-১৮৩৮) -এর উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি (১৯৪৭) পর্যন্ত অন্তত আটটি কমিশন, কমিটি ও সংস্কার প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে হান্টার কমিশন রিপোর্ট (১৮৮২) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত নাথান কমিটি (১৯১১) রিপোর্ট খুবই পরিচিত। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৮-১৯৭১) বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি রিপোর্ট প্রণীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার (আতাউর রহমান খান) কমিশন ১৯৫৭, জাতীয় শিক্ষা কমিশন (এস এম শরিফ কমিশন) রিপোর্ট ১৯৫৯, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট ১৯৬৬ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘শিক্ষা নীতি’ নামেও দু’টো প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছিল- এয়ার মার্শাল এম. নূর খান নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন শিক্ষানীতি ১৯৬৯ ও শামসুল হক কমিটি প্রণীত শিক্ষানীতি ১৯৭০। উল্লেখ্য, ঘোষিত সব কয়টি প্রতিবেদন/নীতি প্রবল আন্দোলনের মুখ থুবড়ে পড়ে, নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুড়ে। বর্তমান মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ (এমপি)সহ বরণ্য শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতক নেতৃবৃন্দের অনেকে এসব আন্দোলন সংগ্রামে শরিক ছিলেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন বিশেষ করে ১৭ সেপ্টেম্বরের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এক্ষেত্রে বড় দৃষ্টান্ত।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ -এর পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশে আরো ছয়টি কমিশন/কমিটি রিপোর্ট ঘোষিত হয়েছিল। এগুলো হলো : বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন (ড. কুদরত-ই-খুদা) রিপোর্ট ১৯৭৪, অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি (কাজী জাফর-আবদুল বাতেন প্রণীত) ১৯৭৯, মজিদখান কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৩, মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৮৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ ও জাতীয় শিক্ষা কমিশন (মনিরুজ্জামান মিয়া) প্রতিবেদন ২০০৩। জাতির দীর্ঘদিনের আন্দোলন, সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেমনি সাংবিধানের চার মূলনীতির উদ্ভব ঘটেছিল তেমনি স্বধীনতাউত্তর বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও জাতীয় উন্নয়নের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রণীত সুপারিশেও জাতির প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক স্বৈরাচারী সরকারসমূহ তা বাস্তবায়ন না করে, সকলেই বিতর্কিত, খন্ডিত কিছু প্রতিবেদন, সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে শিক্ষাঙ্গন ও সুশীল সমাজের বৈধতা পাওয়ার এক ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে। স্পষ্টত: বাংলাদেশে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ হয়েছে দু’টো । দু’টোই হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ তথা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে – ২০০০ ও ২০১০ -এ।

জাতীয় শিক্ষানীতির কয়েকটি মৌলিক বেশিষ্ট্য থাকে : এর শিক্ষা-দর্শন থাকবে, এতে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে; জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা প্রণীত ও গৃহীত হবে। জাতির পূর্ব অভিজ্ঞতাসমূহ এখানে ব্যবহৃত হবে, উপেক্ষিত হবে না। এসকল মানদন্ডে ৬ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে গঠিত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী (চেয়ারম্যান) ও ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ (কো-চেয়ারম্যান) নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রণীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ যথার্থ অর্থেই জাতীয় শিক্ষানীতির মর্যাদা লাভ করেছে। এটি প্রণয়নে আমাদের মহান সংবিধানের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাবলি, জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের সুপারিশ এবং পূর্বে প্রণীত বিভিন্ন কমিটি/কমিশন প্রতিবেদন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। সর্বোপরি, শিক্ষাবিদসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মন্তব্য ও পরামর্শ সংগ্রহ করে তার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেও অন্তর্ভুক্তিকরণ (inclusiveness) দর্শনের বহি:প্রকাশ লক্ষ্যনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এম পি শিক্ষানীতির ‘প্রাক্-কথন’-এ বলেন, ‘‘২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে আমরা সরকারের দায়িত্ব নেবার পর নির্ধারিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে পূর্বে প্রণীত শিক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করার জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়। সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে এই শিক্ষানীতি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়।’’ একইভাবে, শিক্ষানীতির ‘মুখবন্ধ’ -এ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নূরুল ইসলাম নাহিদ, এমপি -র বক্তব্যও শিক্ষানীতির গণমুখীতা ও যুগের সাথে এর বহমান ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন- ‘‘(১) এটা কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয় – জনগণ তথা জাতির আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। (২) শিক্ষানীতি কোন অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সব সময় উন্মুক্ত থাকবে। কোন ভুল-ত্র“টি হলে তা সংশোধন করা যাবে।’’ বর্তমান শিক্ষানীতির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, যথার্থতা ও জাতীয় মর্যাদা লাভের আরেকটি পরিমাপক হলো এর বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম পরিলক্ষিত না-হওয়া।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ন্যায় শিক্ষাও একটি প্রধান মৌলিক অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্র ও সরকার এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশের সংবিধানে এ-নিরিখে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘‘(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’’ এ-ছাড়াও ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে শিক্ষালাভে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য না করার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মহান সংবিধানের ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদে। প্রাক্ কথন মুখবন্ধ, আঠাশটি অধ্যায় ও দু’টো সংযোজনী নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর কলেবর।

আঠাইশটি (২৮টি) অধ্যায়ে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর, ধারা, ক্ষেত্র, পাঠক্রম, নারী শিক্ষা, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষার্থীকল্যান, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার, স্তর-নির্বিশেষে গৃহীতব্য পদক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ের সাবলীল বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনায় সংবিধানের উপরিউক্ত নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। আলোচ্য শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘‘শিক্ষানীতি —– দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।‘‘ বস্তুত ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়টি জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০-এর মূল ভিত্তি। এখানে ৩০ (ত্রিশ) টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করে সেসবের বাস্তবায়ন ও অর্জনের লক্ষ্যে পরবর্তী সাতাশটি অধ্যায়ে বিভিন্ন নীতি দর্শন, সুপারিশ ও করণীয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসবের মৌলিক কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে নিম্নে উপস্থাপিত হলো।
(১) প্রাথমিক শিক্ষার স্তর হবে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আট বছরব্যাপী। এখানে প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণিও সংযুক্ত থাকবে;
(২) পঞ্চম শ্রেণি শেষে জাতীয়ভাবে অভিন্ন প্রশ্নে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এটি বর্তমানে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (PSC) নামে পরিচিত। অনুরূপ অষ্টম শ্রেণি শেষে জাতীয় ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় অভিন্ন প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার নাম জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (JSC);
(৩) সন্ত্রন্ত্রভাবে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রয়োজন নেই, PSC ও JSC মেধা তালিকা থেকে বৃত্তি প্রদান করা হবে;
(৪) মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত;
(৫) বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সমগ্রদেশে প্রাথমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়সমূহে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করা হবে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধারার যথা: সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিল্ডারগার্টেন (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম), ইবতেদায়িসহ সব ধরণের মাদ্রাসার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা হবে;
(৬) প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত বিষয়ে অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে;
(৭) মাদ্রাসাসহ অন্যান্য বিশেষ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রাখার জন্য নিজস্ব বিষয়াদি বাধ্যতামূলক বিষয়ের সাথে সন্নিবেশ করা যাবে;
(৮) চার বছরব্যাপী মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে – (ক) তিনটি ধারা থাকবে – সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাধারা এবং প্রত্যেক ধারা কয়েকটি শাখায় বিভক্ত থাকবে। সব ধারাতেই কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে যথা-বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক থাকবে। (খ) প্রত্যেক ধারায় এসকল বিষয়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে স্ব স্ব বোর্ডের নেতৃত্বে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। (গ) নিজ নিজ ধারার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক ধারায় সেই ধারা সংশ্লিষ্ট আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক বিভিন্ন বিষয় থাকবে;
(৯) শিক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি ও সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া ও শিক্ষার মান অর্জনের জন্য গাইড বই, নোট বই, প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এসবের অপকারিতা বিষয়ে সচেতন করা হবে;
(১০) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সকল ধারার শিক্ষার্থীদের যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে সে প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে;
(১১) ঝরে পড়া রোধ ও অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দুপুরে পুষ্টিকর খাবার প্রদান করতে হবে এবং প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে;
(১২) নীতিগতভাবে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যাবে না, এ প্রবণতা নিরুৎসাহিত করতে হবে। ব্যতিক্রমক্ষেত্রে কোড (code) পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি বিষয়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত;
(১৩) শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নিশ্চিত করতে স্তর নির্বিশেষে সকল শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে এবং নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা বাঞ্চনীয়;
(১৪) শিক্ষা প্রশাসন জবাবদিহি, স্বচ্ছ, গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে – (ক) সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে; (খ) সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষানীতির পরিমার্জন ও পরিবর্তনের জন্য স্থায়ী ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করতে হবে; (গ) মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতির আওতাধীন ও এমপিওভুক্ত সকল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি ও পদোন্নতির জন্য সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারী শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে; (ঘ) দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয়ের জন্য এবং সেই ভিত্তিতে প্রতিবছর এগুলোর র‌্যাংকিং নির্ধারণ করা ও উন্নয়নের পরামর্শ দেয়ার জন্য যথাযথ ক্ষমতা ও দক্ষতা সম্পন্ন একটি ‘এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠা করা হবে; (ঙ) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হবে; (চ) মাদ্রাসাকেন্দ্রিক উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ফাযিল ও কামিল পর্যায়ের মাদ্রাসার অনুমোদন, পাঠক্রম প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, সনদ প্রদান ও অন্যান্য একাডেমিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় একটি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে;

(১৫) বর্তমানে সকল স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকহারে বেতন আদায়ের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। চাঁদা আদায়ের বিষয়টিও নীতিমালার আওতায় আনতে হবে;
(১৬) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষার কোন স্তরেই শিক্ষার্থী যাতে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;
(১৭) নির্দিষ্ট অনুপাতে (১:৩০) প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যাবশ্যক অবকাঠামো সংযোজন করে ২০১৮ -এর মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষানীতির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ধারাসমূহ বাস্তবায়ন করা হবে;
(১৮) শিক্ষার্থীকে মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন পাঠ্যসূচি মোতাবেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পুস্তক রচনা করতে হবে। ২০১৩-র মধ্যে এই নতুন পাঠ্য পুস্তক প্রবর্তন করতে হবে;

উল্লিখিত সুপারিশ, প্রস্তাবনা ও প্রতিবেদনসহ চূড়ান্ত খসড়া শিক্ষানীতি ৭ ডিসেম্বর ২০১০ মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। নীতিগতভাবে এসব এখন সরকারের সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, এরূপ ভালো ভালো সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য বিগত সময়ের বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদ/সুপারিশেও ছিল। কিন্তু ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর সাথে সেসবের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে- আর তা হলো বাস্তবায়ন বা কার্যকর করার প্রশ্নে। এই একমাত্র শিক্ষানীতি যা কোন সরকার বাস্তবায়ন করছে, ধাপে ধাপে। উল্লেখ্য, এই প্রথমবারের মত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৮ জুন ২০১১ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে আহবায়ক করে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কেন্দ্রীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। উপবৃত্তি সম্প্রসারণ, শিক্ষা সহায়ক ভাতা প্রদান, কতিপয় এলাকায় দুপুরের খাবার সরবরাহ কার্যক্রম গ্রহণ প্রভৃতি পদক্ষেপের ফলে ২০১২-এ প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ভর্তির হার ৯৫%-এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৫-এর পূর্বেই শতভাগ ভর্তির সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDG) অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাদ্রাসাসহ সকল ধারার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এত বিপুল সংখ্যক (প্রায় ২৫ কোটি) পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে সরবরাহ বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১লা জানুয়ারি এ-পুস্তক প্রদান কার্যক্রম সরকার প্রধান উদ্বোধন করেন। ১লা জানুয়ারি এখন পাঠ্য পুস্তক দিবস। নতুন শিক্ষাক্রম পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পুস্তক রচনা ও ছাপানোর কাজ এগিয়ে চলছে। ২০১৩ সন থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক পাঠদান শুরু করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ২০১২-এ চল্লিশ হাজারেরও বেশি বিদ্যালয়ে প্রাক্ প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা হয়েছে বলে জানা যায়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষে যথাক্রমে সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুযোগের বৈষম্য দূর হয়ে, গুটিকতকের বৃত্তি পরীক্ষার সুযোগ ও কোচিং বন্ধ হয়ে এখন সকল শিক্ষার্থী সমাপনী পরক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং সে ফলাফলের ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। দেশের সকল প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শ্রেণি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে ‘শিক্ষার্থী সংসদ’ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যমে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনার মধ্যে খুদে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রচর্চার পাঠ শুরু হয়েছে। নির্ধারিত শিক্ষাপঞ্জির ভিত্তিতে এখন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি এবং এইচ এস সি ও সমমানের পরীক্ষা ১ এপ্রিল শুরু হয় এবং ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলে অনেক অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রচলন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া সরবরাহসহ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসার কারিক্যুলাম উন্নয়ন করা হয়েছে। এবতেদায়ি ও জুনিয়র দাখিল পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করা হচ্ছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম চালু করে ভর্তি-বাণিজ্য রোধ করার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে এককালীন দেয় ফি ও অনুদান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। যারা নির্ধারিত অর্থের অতিরিক্ত আদায় করেছে, তাদেরকে তা ফেরৎ দিতে বা সমন্বয় করতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বিশেষায়িত ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে টেক্সটাইল বিশ্ববিদাালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং লেদার টেকনোলজি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট হিসেবে ন্যস্ত করা হয়েছে। তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদাালয় স্থাপন করা হয়েছে- ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদাালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। মাদ্রাসার ফাযিল ও কামিলস্তরের শিক্ষা প্রসারের জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খসড়া আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনয়ন ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য “The Private University Act 2010″ কার্যকর হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায়, প্রতীয়মান হয় যে, দু’বছরে শিক্ষানীতির প্রায় ২০% – ২৫% বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন, ১৫-৪৫ বছর বয়সীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানক্রম নির্ধারণের জন্য ‘এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংযোজন, স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন প্রভৃতি কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদিও প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে খবর বেরিয়েছে, কিন্ত ফলপ্রসূ কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়।এতদসত্ত্বেও সম্ভাবনা অনেক। শিক্ষা গবেষক, শিক্ষা আন্দোলনের নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদ যথার্থই বলেন, ‘‘সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব না থাকলে এবং সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে সরকারের এ-মেয়াদে শিক্ষানীতির অন্তত: ৩০% অর্জন সম্ভব হবে।’’ কেউ যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করেন তবে একবাক্যে বলবেন যে, শিক্ষা নীতির বাস্তবায়নের দিকটি সময় ও জাতির সীমিত স¤পদের মানদন্ডে, নি:সন্দেহে, সন্তোষজনক।

শিক্ষানীতির সমালোচনা করে কিছু পেশাজীবী সংগঠন স্ববিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তারা বলেন, ‘‘ইতোপূর্বেকার কুদরাত-ই-খুদা ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত্ব না পাওয়ার বরাবরই এ-জাতি সে বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০-কেও খুদা এবং হক কমিশনেরই প্রতিরূপ (replica) বলে মনে হয়েছে। এজন্যই এ শিক্ষানীতিতে অনেক ভাল প্রস্তাব থাকার পরও জাতি তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না।’’ তারা আরো বলেন, ‘‘—– এ শিক্ষানীতি বাস্তাবায়িত হলে একজন সাধারণ ধারার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের সূচনা হতে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে এ-শিক্ষানীতি কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না।’’ (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ.৪, ১৬) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একমাত্র শিক্ষানীতি যেখানে শিক্ষাধারা নির্বিশেষে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাধ্যতামূলক। সুতরাং উল্লিখিত মন্তব্য যে ভিত্তিহীন, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উস্কানিমূলক তাতে কোন সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিয়া ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম. ওসমান ফারুক শিক্ষানীতির যে পর্যালোচনা ও সমালোচনা করেছেন তা উল্লেখের দাবিদার। তাদের বক্তব্যে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন বিষয়ে সংশয় প্রকাশ পেলেও তা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। প্রফেসর মিয়া বলেন যে, ‘প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০ -এর অনেক কিছু পূর্বেও ছিল। প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার বিষয়টি নতুন নয়, আগেও এ – সুপারিশ ছিল, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কেউ তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি; এসরকারও পারবে না।’ ড. ওসমান ফারুক বলেন যে, ‘শিক্ষানীতিতে বেশ সহজ সাবলীল ভাষায় রচিত, সকলে এটি বুঝতে পারবে।’ তিনি শিক্ষানীতিকে সমর্থন করে ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে ‘প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে পারলে ভালো; কিন্তু এটা অনিবার্য নয়, বাস্তবে এটা অসম্ভবও বটে।’ তিনি মূলত শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নের প্রতিই গুরুত্বরোপ করেছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ জুন ২০১০)। তাদের উভয়ের মতে, শিক্ষানীতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনায় অনেক উৎকৃষ্ট উপাদান রয়েছে; তবে সেসব বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কেননা, প্রয়োজনীয় বাজেট লাগবে, ভৌত অবকাঠামো লাগবে, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ লাগবে। এ বক্তব্যের সাথে খুব বেশি দ্বিমত না করেই শুধু একথা সংযোজন করা যায় যে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ – এসব কিছুই শিক্ষা নীতির অংশ বিশেষ। আর একথা সত্য যে কোন কিছুর বাস্তবায়নই হলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নি:সন্দেহে, সীমিত সম্পদের দেশে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও হতে হবে ধারাবাহিক, পর্যায়ক্রমিক।

তবে এটি ঠিক যে, শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত বাজেট আশাব্যঞ্জক নয়। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ ও মোট বাজেটের ২০ ভাগ বরাদ্দের কথা থাকলেও ২০১১-২০১২ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ১২ শতাংশ। এ চিত্র আরো হতাশাগ্রস্থ করে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের সংশ্লিষ্ট খাতের বাজেট। বাজেটের আয়তন বড় হওয়ায় ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে ১৫৭১ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, তবে জিডিপির এবং মোট বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট, তিলে তিলে হলেও, বৃদ্ধি পাবে, সেখানে উল্টো ২০১১-২০১২ -এ শিক্ষাখাতে (প্রাথমিক, গণশিক্ষা, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা প্রযুক্তি, মাদ্রাসাসহ) জিডিপির ২.৩% ও মোট বাজেটের ১২% -এর স্থলে ২০১২-২০১৩ -এ যথাক্রমে ২.২% ও ১১.৫% বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র তিন বছরে সরকারের যে অভূতপূর্ব সাফল্য তাই হয়তো বাজেট প্রণেতাদের এ-ক্ষেত্রে দৃষ্টি কাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত: ‘বেশি ভালো ভালো না’ – প্রাচীন সেই বাংলা প্রাবাদটি শিক্ষা-বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয়েছে। প্রসঙ্গত, দক্ষিন এশিয়ার আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুগ্মভাবে বাংলাদেশ ও নেপালের শিক্ষা-বাজেট নিম্নতম, সর্বোচ্চ হলো শ্রীলঙ্কার। উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর নীতিমালায় শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬% এবং মোট বাজেটের ২৫% বরাদ্দের পরামর্শ রয়েছে।

সদ্দিচ্ছা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে সীমিত স¤পদের মধ্যেও যে মহৎ কিছু করা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’। ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মত ও পরামর্শ ধারণ করেই প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে এ শিক্ষানীতি। অন্যসবের বিপরীতে বাস্তবায়নের মধ্যেই রয়েছে এর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা শিক্ষানীতির একটি মৌলিক দর্শন। মানবিক ও নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কর্মমুখী মানবস¤পদ বিনির্মানে সহায়ক গুনগত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা ও নীতিমালা রয়েছে এ-শিক্ষানীতিতে। মৌলিক অধিকার হিসেবে সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যে রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব তার প্রতিফলন ঘটেছে এর পাতায় পাতায়। তবে দায়িত্বের সঙ্গে দায় আছে। এই দায় আর্থিক দায়। আর্থিক দায় বহন ছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে কী? কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘‘শিক্ষার বাহন’’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘‘শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই।’’ রবীন্দ্রনাথ( সঙ্কলন, বিশ্বভারতী, ১৪০১, পৃ. ২৩)। মূলত: আমাদের কথা, কাজ ও চাহিদা -এসবের মধ্যে প্রয়োজন অধিকতর সামঞ্জস্য, সমন্বয়; গড়মিল বা হেরফের নয়। আর হেরফের থাকলে কাঙ্খিত সাফল্য আবদার হিসেবেই থাকবে। কবি গুরুর ‘‘শিক্ষার হেরফের’’ শীর্ষক প্রবন্ধ এক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে: ‘‘আমাদের হেরফের ঘুচিলেই আমরা চরিতার্থ হই। শীতের সহিত শীতবস্ত্র, গ্রীষ্মের সহিত গ্রীষ্মবস্ত্র কেবল একত্র করিতে পারিতেছিনা বলিয়াই আমাদের এত দৈন্য, নহিলে আছে সকলই। এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাই আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও।’’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঙ্কলন, বিশ্বভারতী, ১৪০১, পৃ. ১৫)

ডক্টর মো. আখতারুজ্জামান: জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য। অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Published in: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/6225